খোলা চোখে-বাঘের ওপরে ঘোগ by হাসান ফেরদৌস
শিশুতোষ গ্রন্থে পড়েছি, বাঘের ওপরেও নাকি আছে ঘোগ। বাঘ বনের রাজা হলে কী হবে, ঘোগের নামে সেও সেলাম ঠোকে। শুধু বনে নয়, রাজনীতিতেও ঘোগ রয়েছে। প্রমাণ হিসেবে দুটি সাম্প্রতিক ঘটনার কথা বলছি। প্রথমটি বাংলাদেশের। শেয়ার কেলেঙ্কারি নিয়ে গত কয়েক সপ্তাহ লঙ্কাকাণ্ড চলছে।
অদৃশ্য হাতের কারসাজিতে কোটি কোটি টাকা বেহাত হয়ে গেছে। কীভাবে এমন ঘটনা ঘটল, তা জানার জন্য সরকার বাহাদুর নিজ উদ্যোগে তদন্ত কমিটি দিয়ে খোঁজখবর করেছে। কিন্তু তদন্ত কমিটি যখন তার প্রতিবেদন মাননীয় অর্থমন্ত্রীর কাছে পেশ করল, মন্ত্রী বাহাদুরের তো চক্ষু চড়কগাছ। এ যে সব চেনা মানুষ! সকালে মিটিং, সন্ধ্যায় নৈশভোজ তো এদের সঙ্গেই হয়। মন্ত্রী জানালেন, প্রতিবেদন প্রকাশিত হবে, তবে কিছু মানুষের নাম কেটে বাদ দেওয়ার পর। এরা এত ক্ষমতাধর যে তাদের নামধামসহ সে প্রতিবেদন প্রকাশের ক্ষমতা মন্ত্রীর নেই। দেশের দুঁদে মন্ত্রী তিনি, সবাই তাঁর নাম শুনে সালাম ঠোকে। তিনিই কিনা অদৃশ্য কিছু মানুষের ভয়ে অস্থির। বুঝলাম, এঁরাই হচ্ছেন ঠাকুরমার ঝুলির সেই ঘোগ, রাজনীতির বাঘ মামাও যাকে দেখে ভয়ে কাঁপে।
দ্বিতীয় ঘটনা রাশিয়ার। একসময়ের ধনকুবের মিখাইল খদরকভস্কিকে দ্বিতীয়বারের মতো জেলে পাঠানো হয়েছে। অর্থ পাচার ও কর ফাঁকির অভিযোগে ২০০৩ সাল থেকে তিনি জেলে। ছাড়া পাওয়ার সময় হয়ে এসেছিল। তার আগেই দ্বিতীয় দফা শাস্তি হলো ওই একই অভিযোগে। এই খদরকভস্কি ইয়েলৎসিনের আমলে কম দামে সরকারি তেল-গ্যাস কোম্পানি কিনে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যান। ভালোই ছিলেন, হঠাৎ তাঁর মাথায় কী দুর্বুদ্ধি এল, ঠিক করলেন রাজনীতি করবেন। তত দিনে ইয়েলৎসিনের দিন শেষ, ক্রেমলিনে নতুন জার হয়ে এসেছেন পুতিন। সে ভদ্রলোক ব্যাপারটাকে ব্যক্তিগত অপমান ধরে নিয়ে খদরকভস্কিকে জেলে পুরলেন আর তাঁর কোম্পানি কয়েক টুকরো করে সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলেন। জেলের মেয়াদ যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, তখন নতুন করে মামলা ঠোকা হলো। গত বছরের ডিসেম্বরে সেই মামলার রায়ে খদরকভস্কিকে যে দ্বিতীয় দফা দণ্ড দেওয়া হয়, তাতে ২০১৭ সালের আগে জেল থেকে তাঁর বেরোনোর সম্ভাবনা নেই। কিন্তু খবর এটা নয়। জানা গেছে, মামলার কী রায় হবে, তা মান্যবর বিচারক মহোদয়কে অক্ষরে অক্ষরে বলে দেওয়া হয়েছিল। ভিক্তর দানিলকিন নামের এই বিচারকের সহকারী নাতালিয়া ভাসিলিয়েভার কাছ থেকে এ কথা জানা গেছে। একটি রুশ পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে নাতালিয়া জানিয়েছেন, রাশিয়ার বিচারব্যবস্থায় এটা কোনো নতুন ঘটনা নয়। বিচারকেরা সবাই খুব ভালো করেই জানেন, এ ধরনের মামলায় কী রায় দিতে হবে, কারণ সে রায় তাদের আগেভাগেই জানিয়ে দেওয়া হয়। এখানে বিচারক বাহাদুর যদি হন বাঘ, তো পেছন থেকে যাঁরা তাঁকে সে রায় লিখে দেন, তাঁরা হলেন বাঘের বাবা ঘোগ।
এই দুটি ঘটনা থেকে দেখা যাচ্ছে, ঘোগ রয়েছে দুই ধরনের—প্রথম ধরনের ঘোগ হলো তারা, যারা সরকারের বাইরে থেকে ছায়া সরকারের মতো কাজ করে। অর্থমন্ত্রী আছেন, কিন্তু অর্থবিষয়ক সিদ্ধান্ত সেই ছায়া সরকারের সম্মতি ছাড়া নেওয়া যাবে না। পূর্তমন্ত্রী আছেন, কিন্তু বেআইনি জেনেও তিনি গৃহনির্মাণের অনুমতি দেবেন, কারণ লাল টেলিফোনে নির্দেশ এসে গেছে ওই ঘোগদের একজনের কাছ থেকে। তাদের নামধাম আমরা জানি, কিন্তু কোথাও তাদের নাম নেওয়া যাবে না। মুখ ফুটে বলা যাবে না—এই আপা বা ওই ভাইয়ের নির্দেশে পুলিশ প্রধান চোরকে ছেড়ে দিয়েছে বা মাননীয় বিচারক খুনের আসামিকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত, সরকার নিজেই যখন নিজের বানানো আইন ভাঙার প্রয়োজন দেখে, তখন বাঘের ছাল খুলে ঘোগের জামা পরে নেয়। এই জামা পরার একটা সুবিধা হলো, সে জামার বুকে কারও নাম-ঠিকানা লেখা থাকে না। গুম খুন হচ্ছে, মিছিলে গুলি ছুটছে, চলন্ত ট্রাক তুলে দেওয়া হচ্ছে মানুষের ওপর। কে করছে জিজ্ঞেস করুন, কোনো উত্তর নেই। এই ঘোগের খবর মেলে সরকার পতনের পর। পুতিন না যাওয়া পর্যন্ত জানা যাবে না খদরকভস্কির রায় কার নির্দেশে লেখা হয়েছিল। বাংলাদেশে বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ১৮ ট্রাক বেআইনি অস্ত্রের চোরাচালান ধরা পড়েছিল। তখন জানা যায়নি সে অস্ত্র কে এনেছিল, তা খালাসের নির্দেশ কে দিয়েছিল এবং কোথায় যাচ্ছিল সে অস্ত্র। আমরা ধরে নিয়েছি, এ হলো ঘোগের কাণ্ড। সে সরকার আর ক্ষমতায় নেই, এখন সেসব ঘোগের নাম এক এক করে বেরোচ্ছে। এদের কেউ মন্ত্রী, কেউ বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা, এমনকি তিন তারা জেনারেলও আছেন। কথা ছিল, তাঁরা সব আইন মাথায় তুলে রাখবেন, কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, উলটো তারাই সব আইন কিমা বানিয়ে গুলে খেয়েছেন।
কিন্তু অবস্থাটা পালটে যায়, যদি বাঘের ওপর একটা সত্যিকারের ঘোগ বসানো যায়। সরকারের ওপর নজর রাখা হবে এই ঘোগের কাজ। এ হবে এমন এক ঘোগ, যাকে সবাই চিনবে, জানবে। এমনিতে ভয়ে সরকারি কর্তাদের ধারে-কাছে আসা যায় না, সাধারণ মানুষের তো তার নাম শুনেই হূৎকম্প শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু এই ঘোগ হবে সেই রকম একজন, যার কাছে যে কেউ যোগাযোগ করতে পারবে, দরকার হলে দরজা ধরে নাড়া দিতে পারবে। আর কিছু না হোক, ই-মেইল করে অভিযোগ জানাতে পারবে। সরকার বা সরকারি দলের লোকজন যদি ভুল করে, সে ভুল ধরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব হবে তার। লাঠিসোঁটা হয়তো তার থাকবে না, সে যে পথে হাঁটবে, তার আগে-পিছে সিপাই-সান্ত্রীও ছুটবে না। কিন্তু তাকে দেখে সাধারণ মানুষ হ্যাঁ, এমনকি বনের পশুপাখিও হেসে সালাম দেবে, আপন ভেবে দুকথা বলবে।
এমনও কি সম্ভব?
সম্ভব কি না জানি না, তবে আমি যে নিউইয়র্ক রাজ্যে থাকি তার একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ দিতে চাই এ কথা বোঝাতে যে কম করে হলেও কী সম্ভব। সম্প্রতি এই রাজ্যের সাবেক কম্পট্রোলার জেনারেল এরেন হেভেসিকে চার বছরের জন্য জেলবাসের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রাজ্যের প্রধান হিসাবরক্ষক তিনি, রাজ্যের তাবৎ জমানো টাকা কোথায় কীভাবে বিনিয়োগ করা হবে, সে নির্দেশ দেওয়া তাঁর দায়িত্ব। হেভেসির অপরাধ, তাঁর চেনাশোনা কয়েকজন বন্ধুকে তিনি রাজ্যের পেনশন ফান্ডের অর্থ বিনিয়োগের অনুমতি দিয়েছিলেন। বিনিময়ে প্রায় এক লাখ ডলারের মতো ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নেন। নগদ টাকা নয়, বিনা খরচে প্রমোদভ্রমণ বা রেস্তোরাঁয় খাবার পর বিলটা তাঁর হয়ে অন্য কেউ দিয়ে দিয়েছে। তাঁর নির্বাচনী তহবিলেও সে সব বন্ধুবান্ধব মোটা অঙ্কের চাঁদা দেয়। আরও ভয়ংকর (!) অভিযোগ হলো, তাঁর অসুস্থ স্ত্রীকে সরকারি গাড়ি করে হাসপাতাল ও বাড়িতে আনা-নেওয়া করা হয়েছে। এ বাবদ কোনো অর্থ তিনি সরকারের কাছে জমা দেননি।
নিউইয়র্কের বর্তমান গভর্নর একজন ডেমোক্র্যাট। অধিকাংশ সরকারি হর্তাকর্তাও ডেমোক্রেটিক দলের। তাঁরা চাইলে নিজের দলের এমন এক চাঁইকে জেলে না ঢুকিয়ে বাঁচিয়ে দিতে পারতেন। তেমন সুযোগ আসেনি, তার আসল কারণ, ব্যাপারটা প্রথমে নাগরিকদের গোচরে আনেন এই রাজ্যের এথিক্স কমিশন। এমনিতে এই কমিশনের কোনো প্রশাসনিক বা বিচারিক ক্ষমতা নেই। তবে তা রাজ্যের স্বার্থ জড়িত যেকোনো বিষয়ে উপদেশমূলক নির্দেশনা দিতে পারে। কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কি না, তা দেখার কাজ বিচার বিভাগের, কিন্তু বিচার বিভাগ পর্যন্ত সে অভিযোগ সর্বদা পৌঁছায় না। এথিক্স কমিশন, যা এখন পাবলিক ইন্টেগ্রিটি কমিশন নামে পরিচিত—সে ব্যাপারে বিচার বিভাগের বা রাজ্যের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে।
এথিক্স কমিশন ছাড়াও রয়েছে পাবলিক অ্যাডভোকেট ও অম্বুডসম্যান বা ন্যায়পাল। তাঁরা সবাই জনস্বার্থমূলক যেকোনো বিষয়ে মতামত জানাতে পারেন, প্রয়োজনবোধে নাক গলাতে পারেন, সরকারি হস্তক্ষেপ দাবি করতে পারেন। বড় ধরনের দুর্নীতি যাতে না হয়, অথবা বড় ধরনের অপরাধ ধাপাচাপা না পড়ে, সে উদ্দেশ্যে তাঁরা আলাদাভাবে কাজ করে থাকেন। যাঁরা এসব দায়িত্ব পালন করেন, তাঁদের অধিকাংশই রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন। কোনো দল বা সরকারি কর্তার দয়া বা আনুকূল্যের ওপর তাঁদের নির্ভর করতে হয় না। অনেকেই অবসরভোগী, সামাজিকভাবে সম্মানিত, কোনো স্পষ্ট রাজনৈতিক ক্ষমতাচক্রের বাইরের হওয়ায় গলা উঁচিয়ে কথা বলতে তাঁদের দ্বিতীয়বার ভাবতে হয় না। এর পরেও যে অসংখ্য অপরাধ ঘটে চলেছে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। দরজায় তালা দেওয়ার পরেও তো চুরি হয়। কিন্তু যদি তালাই না থাকে, তাহলে চুরি তো হবেই। এঁরা হলেন অনেকটা ওই তালার মতো।
পত্রিকায় নিশ্চয় দেখেছেন, একজন নিরপেক্ষ ও সর্বজনমান্য ন্যায়পাল নিয়োগের জন্য ভারতের প্রবীণ রাজনীতিক ও সমাজকর্মী আন্না হাজারে আমৃত্যু অনশনে নেমেছিলেন। তাঁর দাবি ছিল, এমন একজন ন্যায়পাল নিয়োগ করা হোক, যিনি কেবল নিরপেক্ষই হবেন না, তিনি সাধারণ নাগরিকদের কাছ থেকে অভিযোগ গ্রহণ ও তা তদন্ত করে রায় দেওয়ার অধিকারও রাখবেন। ক্ষমতাসীন দল চেয়েছিল, তাদের পছন্দমতো ন্যায়পাল নিয়োগ হোক। আন্না হাজারে বললেন, তা হবে না। এ ব্যাপারে সুশীল সমাজের অর্থাৎ রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ মানুষদের মতামত নিয়েই ন্যায়পাল নিয়োগ করতে হবে। লাখ লাখ মানুষ তাঁর সমর্থনে মিছিল করেছে। পেশাদার রাজনীতিকেরাও ছুটে এসেছিলেন, কিন্তু লোকজন তাঁদের দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছেন। জনতার এমন বিপুল সমর্থন দেখে দিল্লিরাজ কিছুটা ভড়কেই গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত কোনো ওজর-আপত্তি ছাড়াই আন্না হাজারের দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। এখন জোরেশোরে কাজ শুরু হয়েছে সর্বজনমান্য ন্যায়পাল নিয়োগব্যবস্থার জন্য আইন তৈরি করতে।
একজন দলনিরপেক্ষ ন্যায়পাল বাংলাদেশেও ভীষণ দরকার। বাংলাদেশের সংবিধানেই ন্যায়পাল নিয়োগের কথা বলা আছে। ১৯৮০ সালে এ নিয়ে একটি আইনও গৃহীত হয়েছিল। ব্যস, ওই পর্যন্তই। চারদিকে দুর্নীতির পাহাড় দেখে যাঁরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন, তাঁরা ন্যায়পাল নিয়োগের প্রস্তাব শুনে হয়তো বলবেন, এ হলো সরকারি দলের ভেতরে কেউ একজনকে বড় একটা চাকরি বাগিয়ে দেওয়ার ফন্দি আর কি! কিন্তু ঘটনাটা যাতে সেই দিকে না গড়ায়, অর্থাৎ শুধু বড় চাকরি বাগানোর ব্যাপার না হয়—তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের, ঠিক যেভাবে আন্না হাজারে ন্যায়পাল নিয়োগের প্রশ্নে সুশীল সমাজের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করেছেন।
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
দ্বিতীয় ঘটনা রাশিয়ার। একসময়ের ধনকুবের মিখাইল খদরকভস্কিকে দ্বিতীয়বারের মতো জেলে পাঠানো হয়েছে। অর্থ পাচার ও কর ফাঁকির অভিযোগে ২০০৩ সাল থেকে তিনি জেলে। ছাড়া পাওয়ার সময় হয়ে এসেছিল। তার আগেই দ্বিতীয় দফা শাস্তি হলো ওই একই অভিযোগে। এই খদরকভস্কি ইয়েলৎসিনের আমলে কম দামে সরকারি তেল-গ্যাস কোম্পানি কিনে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যান। ভালোই ছিলেন, হঠাৎ তাঁর মাথায় কী দুর্বুদ্ধি এল, ঠিক করলেন রাজনীতি করবেন। তত দিনে ইয়েলৎসিনের দিন শেষ, ক্রেমলিনে নতুন জার হয়ে এসেছেন পুতিন। সে ভদ্রলোক ব্যাপারটাকে ব্যক্তিগত অপমান ধরে নিয়ে খদরকভস্কিকে জেলে পুরলেন আর তাঁর কোম্পানি কয়েক টুকরো করে সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলেন। জেলের মেয়াদ যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, তখন নতুন করে মামলা ঠোকা হলো। গত বছরের ডিসেম্বরে সেই মামলার রায়ে খদরকভস্কিকে যে দ্বিতীয় দফা দণ্ড দেওয়া হয়, তাতে ২০১৭ সালের আগে জেল থেকে তাঁর বেরোনোর সম্ভাবনা নেই। কিন্তু খবর এটা নয়। জানা গেছে, মামলার কী রায় হবে, তা মান্যবর বিচারক মহোদয়কে অক্ষরে অক্ষরে বলে দেওয়া হয়েছিল। ভিক্তর দানিলকিন নামের এই বিচারকের সহকারী নাতালিয়া ভাসিলিয়েভার কাছ থেকে এ কথা জানা গেছে। একটি রুশ পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে নাতালিয়া জানিয়েছেন, রাশিয়ার বিচারব্যবস্থায় এটা কোনো নতুন ঘটনা নয়। বিচারকেরা সবাই খুব ভালো করেই জানেন, এ ধরনের মামলায় কী রায় দিতে হবে, কারণ সে রায় তাদের আগেভাগেই জানিয়ে দেওয়া হয়। এখানে বিচারক বাহাদুর যদি হন বাঘ, তো পেছন থেকে যাঁরা তাঁকে সে রায় লিখে দেন, তাঁরা হলেন বাঘের বাবা ঘোগ।
এই দুটি ঘটনা থেকে দেখা যাচ্ছে, ঘোগ রয়েছে দুই ধরনের—প্রথম ধরনের ঘোগ হলো তারা, যারা সরকারের বাইরে থেকে ছায়া সরকারের মতো কাজ করে। অর্থমন্ত্রী আছেন, কিন্তু অর্থবিষয়ক সিদ্ধান্ত সেই ছায়া সরকারের সম্মতি ছাড়া নেওয়া যাবে না। পূর্তমন্ত্রী আছেন, কিন্তু বেআইনি জেনেও তিনি গৃহনির্মাণের অনুমতি দেবেন, কারণ লাল টেলিফোনে নির্দেশ এসে গেছে ওই ঘোগদের একজনের কাছ থেকে। তাদের নামধাম আমরা জানি, কিন্তু কোথাও তাদের নাম নেওয়া যাবে না। মুখ ফুটে বলা যাবে না—এই আপা বা ওই ভাইয়ের নির্দেশে পুলিশ প্রধান চোরকে ছেড়ে দিয়েছে বা মাননীয় বিচারক খুনের আসামিকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত, সরকার নিজেই যখন নিজের বানানো আইন ভাঙার প্রয়োজন দেখে, তখন বাঘের ছাল খুলে ঘোগের জামা পরে নেয়। এই জামা পরার একটা সুবিধা হলো, সে জামার বুকে কারও নাম-ঠিকানা লেখা থাকে না। গুম খুন হচ্ছে, মিছিলে গুলি ছুটছে, চলন্ত ট্রাক তুলে দেওয়া হচ্ছে মানুষের ওপর। কে করছে জিজ্ঞেস করুন, কোনো উত্তর নেই। এই ঘোগের খবর মেলে সরকার পতনের পর। পুতিন না যাওয়া পর্যন্ত জানা যাবে না খদরকভস্কির রায় কার নির্দেশে লেখা হয়েছিল। বাংলাদেশে বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ১৮ ট্রাক বেআইনি অস্ত্রের চোরাচালান ধরা পড়েছিল। তখন জানা যায়নি সে অস্ত্র কে এনেছিল, তা খালাসের নির্দেশ কে দিয়েছিল এবং কোথায় যাচ্ছিল সে অস্ত্র। আমরা ধরে নিয়েছি, এ হলো ঘোগের কাণ্ড। সে সরকার আর ক্ষমতায় নেই, এখন সেসব ঘোগের নাম এক এক করে বেরোচ্ছে। এদের কেউ মন্ত্রী, কেউ বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা, এমনকি তিন তারা জেনারেলও আছেন। কথা ছিল, তাঁরা সব আইন মাথায় তুলে রাখবেন, কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, উলটো তারাই সব আইন কিমা বানিয়ে গুলে খেয়েছেন।
কিন্তু অবস্থাটা পালটে যায়, যদি বাঘের ওপর একটা সত্যিকারের ঘোগ বসানো যায়। সরকারের ওপর নজর রাখা হবে এই ঘোগের কাজ। এ হবে এমন এক ঘোগ, যাকে সবাই চিনবে, জানবে। এমনিতে ভয়ে সরকারি কর্তাদের ধারে-কাছে আসা যায় না, সাধারণ মানুষের তো তার নাম শুনেই হূৎকম্প শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু এই ঘোগ হবে সেই রকম একজন, যার কাছে যে কেউ যোগাযোগ করতে পারবে, দরকার হলে দরজা ধরে নাড়া দিতে পারবে। আর কিছু না হোক, ই-মেইল করে অভিযোগ জানাতে পারবে। সরকার বা সরকারি দলের লোকজন যদি ভুল করে, সে ভুল ধরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব হবে তার। লাঠিসোঁটা হয়তো তার থাকবে না, সে যে পথে হাঁটবে, তার আগে-পিছে সিপাই-সান্ত্রীও ছুটবে না। কিন্তু তাকে দেখে সাধারণ মানুষ হ্যাঁ, এমনকি বনের পশুপাখিও হেসে সালাম দেবে, আপন ভেবে দুকথা বলবে।
এমনও কি সম্ভব?
সম্ভব কি না জানি না, তবে আমি যে নিউইয়র্ক রাজ্যে থাকি তার একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ দিতে চাই এ কথা বোঝাতে যে কম করে হলেও কী সম্ভব। সম্প্রতি এই রাজ্যের সাবেক কম্পট্রোলার জেনারেল এরেন হেভেসিকে চার বছরের জন্য জেলবাসের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রাজ্যের প্রধান হিসাবরক্ষক তিনি, রাজ্যের তাবৎ জমানো টাকা কোথায় কীভাবে বিনিয়োগ করা হবে, সে নির্দেশ দেওয়া তাঁর দায়িত্ব। হেভেসির অপরাধ, তাঁর চেনাশোনা কয়েকজন বন্ধুকে তিনি রাজ্যের পেনশন ফান্ডের অর্থ বিনিয়োগের অনুমতি দিয়েছিলেন। বিনিময়ে প্রায় এক লাখ ডলারের মতো ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নেন। নগদ টাকা নয়, বিনা খরচে প্রমোদভ্রমণ বা রেস্তোরাঁয় খাবার পর বিলটা তাঁর হয়ে অন্য কেউ দিয়ে দিয়েছে। তাঁর নির্বাচনী তহবিলেও সে সব বন্ধুবান্ধব মোটা অঙ্কের চাঁদা দেয়। আরও ভয়ংকর (!) অভিযোগ হলো, তাঁর অসুস্থ স্ত্রীকে সরকারি গাড়ি করে হাসপাতাল ও বাড়িতে আনা-নেওয়া করা হয়েছে। এ বাবদ কোনো অর্থ তিনি সরকারের কাছে জমা দেননি।
নিউইয়র্কের বর্তমান গভর্নর একজন ডেমোক্র্যাট। অধিকাংশ সরকারি হর্তাকর্তাও ডেমোক্রেটিক দলের। তাঁরা চাইলে নিজের দলের এমন এক চাঁইকে জেলে না ঢুকিয়ে বাঁচিয়ে দিতে পারতেন। তেমন সুযোগ আসেনি, তার আসল কারণ, ব্যাপারটা প্রথমে নাগরিকদের গোচরে আনেন এই রাজ্যের এথিক্স কমিশন। এমনিতে এই কমিশনের কোনো প্রশাসনিক বা বিচারিক ক্ষমতা নেই। তবে তা রাজ্যের স্বার্থ জড়িত যেকোনো বিষয়ে উপদেশমূলক নির্দেশনা দিতে পারে। কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কি না, তা দেখার কাজ বিচার বিভাগের, কিন্তু বিচার বিভাগ পর্যন্ত সে অভিযোগ সর্বদা পৌঁছায় না। এথিক্স কমিশন, যা এখন পাবলিক ইন্টেগ্রিটি কমিশন নামে পরিচিত—সে ব্যাপারে বিচার বিভাগের বা রাজ্যের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে।
এথিক্স কমিশন ছাড়াও রয়েছে পাবলিক অ্যাডভোকেট ও অম্বুডসম্যান বা ন্যায়পাল। তাঁরা সবাই জনস্বার্থমূলক যেকোনো বিষয়ে মতামত জানাতে পারেন, প্রয়োজনবোধে নাক গলাতে পারেন, সরকারি হস্তক্ষেপ দাবি করতে পারেন। বড় ধরনের দুর্নীতি যাতে না হয়, অথবা বড় ধরনের অপরাধ ধাপাচাপা না পড়ে, সে উদ্দেশ্যে তাঁরা আলাদাভাবে কাজ করে থাকেন। যাঁরা এসব দায়িত্ব পালন করেন, তাঁদের অধিকাংশই রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন। কোনো দল বা সরকারি কর্তার দয়া বা আনুকূল্যের ওপর তাঁদের নির্ভর করতে হয় না। অনেকেই অবসরভোগী, সামাজিকভাবে সম্মানিত, কোনো স্পষ্ট রাজনৈতিক ক্ষমতাচক্রের বাইরের হওয়ায় গলা উঁচিয়ে কথা বলতে তাঁদের দ্বিতীয়বার ভাবতে হয় না। এর পরেও যে অসংখ্য অপরাধ ঘটে চলেছে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। দরজায় তালা দেওয়ার পরেও তো চুরি হয়। কিন্তু যদি তালাই না থাকে, তাহলে চুরি তো হবেই। এঁরা হলেন অনেকটা ওই তালার মতো।
পত্রিকায় নিশ্চয় দেখেছেন, একজন নিরপেক্ষ ও সর্বজনমান্য ন্যায়পাল নিয়োগের জন্য ভারতের প্রবীণ রাজনীতিক ও সমাজকর্মী আন্না হাজারে আমৃত্যু অনশনে নেমেছিলেন। তাঁর দাবি ছিল, এমন একজন ন্যায়পাল নিয়োগ করা হোক, যিনি কেবল নিরপেক্ষই হবেন না, তিনি সাধারণ নাগরিকদের কাছ থেকে অভিযোগ গ্রহণ ও তা তদন্ত করে রায় দেওয়ার অধিকারও রাখবেন। ক্ষমতাসীন দল চেয়েছিল, তাদের পছন্দমতো ন্যায়পাল নিয়োগ হোক। আন্না হাজারে বললেন, তা হবে না। এ ব্যাপারে সুশীল সমাজের অর্থাৎ রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ মানুষদের মতামত নিয়েই ন্যায়পাল নিয়োগ করতে হবে। লাখ লাখ মানুষ তাঁর সমর্থনে মিছিল করেছে। পেশাদার রাজনীতিকেরাও ছুটে এসেছিলেন, কিন্তু লোকজন তাঁদের দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছেন। জনতার এমন বিপুল সমর্থন দেখে দিল্লিরাজ কিছুটা ভড়কেই গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত কোনো ওজর-আপত্তি ছাড়াই আন্না হাজারের দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। এখন জোরেশোরে কাজ শুরু হয়েছে সর্বজনমান্য ন্যায়পাল নিয়োগব্যবস্থার জন্য আইন তৈরি করতে।
একজন দলনিরপেক্ষ ন্যায়পাল বাংলাদেশেও ভীষণ দরকার। বাংলাদেশের সংবিধানেই ন্যায়পাল নিয়োগের কথা বলা আছে। ১৯৮০ সালে এ নিয়ে একটি আইনও গৃহীত হয়েছিল। ব্যস, ওই পর্যন্তই। চারদিকে দুর্নীতির পাহাড় দেখে যাঁরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন, তাঁরা ন্যায়পাল নিয়োগের প্রস্তাব শুনে হয়তো বলবেন, এ হলো সরকারি দলের ভেতরে কেউ একজনকে বড় একটা চাকরি বাগিয়ে দেওয়ার ফন্দি আর কি! কিন্তু ঘটনাটা যাতে সেই দিকে না গড়ায়, অর্থাৎ শুধু বড় চাকরি বাগানোর ব্যাপার না হয়—তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের, ঠিক যেভাবে আন্না হাজারে ন্যায়পাল নিয়োগের প্রশ্নে সুশীল সমাজের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করেছেন।
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments