সময়ের প্রতিধ্বনি-জারদারির মাজার ডিপ্লোম্যাসি by মোস্তফা কামাল

ভারতের আজমিরে খাজা মঈনুদ্দিন চিশতির (রহ.) মাজার জিয়ারত করতে এসে সাড়া ফেলে দিয়েছেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি। সফরটি ব্যক্তিগত হলেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করে এর গুরুত্ব বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন।


তিনি প্রায় ৪০ মিনিট একান্ত বৈঠক করেন মনমোহনের সঙ্গে। নয়াদিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে মধ্যাহ্নভোজের আগে অনুষ্ঠিত বৈঠকে দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁরা আলোচনা করেন। দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে এই বৈঠক অত্যন্ত ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে উপমহাদেশের দৃষ্টি ছিল জারদারির ভারত সফরের দিকে। ভারতীয়রাও বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিল তাঁর সফরটিকে। এর মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণিত হয়েছে, উপমহাদেশের পারমাণবিক শক্তিধর দুই দেশের বিরোধপূর্ণ সম্পর্ককে স্বাভাবিক করতে আগ্রহী উভয় পক্ষ। সে জন্যই আসিফ জারদারির মাজার জিয়ারতের সফরটিকে কাজে লাগিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন। এর আগে ২০০৫ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ ভারত সফর করেন। তখন সেনানায়কের সঙ্গে বৈঠকের ব্যাপারে ভারতের আপত্তি থাকলেও দুই দেশের সম্পর্কের স্বার্থে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ পারভেজ মোশাররফকে আমন্ত্রণ জানাতে সম্মত হয়েছিল। তাঁর পর আসিফ জারদারিই প্রথম পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট (নির্বাচিত) যিনি ভারত সফর করলেন।
২০০৮ সালের নভেম্বরে মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বা জড়িত ছিল বলে অভিযোগ করে ভারত। সেই হামলায় ১৬৫ জন নিহত (কোনো কোনো সূত্রের মতে নিহতের সংখ্যা ১৯৫) এবং ৩০৮ জনের বেশি আহত হয়। ভারত বলে আসছে, লস্কর-ই-তৈয়বার প্রধান হাফিজ সাইদসহ সংশ্লিষ্ট অন্যদের বিরুদ্ধে পাকিস্তান ব্যবস্থা না নিলে দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে না। মূলত ওই ঘটনার পর থেকেই দুই দেশের সম্পর্কে বড় ধরনের ফাটল ধরে। মাঝেমধ্যে দুই দেশের কর্মকর্তা ও মন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠক-আলোচনা হলেও সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়নি। উপরন্তু দুই দেশ পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ করে সম্পর্ককে আরো খারাপ অবস্থায় নিয়ে গেছে। একটা পর্যায়ে দুই দেশের সম্পর্কের পারদ তলানিতে গিয়ে ঠেকে।
আমরা যদি দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ইতিহাসের দিকে তাকাই, তাহলে আমাদের কাছে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। একদা ভারতবর্ষ ১৯৪৭ সালের বিভাজনের পর থেকেই ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিবাদ শুরু। আর সেই বিবাদের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল ব্রিটিশ শাসকরা। তারা দেশ ছাড়ার আগমুহূর্তে দুই দেশের সীমানা রেখা টানতে গিয়ে বিবাদ জিইয়ে রেখেছিল। উপমহাদেশকে তারই খেসারত দিতে হচ্ছে যুগ যুগ ধরে। কাশ্মীর ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে তিনটি বড় ধরনের যুদ্ধ হয়েছে। এ ছাড়া ছোটখাটো বিবাদ তো লেগেই আছে।
এবারও পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে বিরোধপূর্ণ কাশ্মীর, সিয়াচেন এবং পানি ইস্যুর মীমাংসা চেয়েছেন। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীও মুম্বাই সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জারদারিকে অনুরোধ করেছেন। তিনি বলেছেন, এ বিষয়ে পাকিস্তান কী পদক্ষেপ নিচ্ছে তার ওপর নির্ভর করছে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের গতি-প্রকৃতি। তবে দুই নেতাই যে দুই দেশের মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক দেখতে চান এবং তা ধরে রাখতে চান, তা স্পষ্টই প্রতীয়মান হয়েছে।
পাক-ভারতের শীর্ষ দুই নেতার বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতিতে মনমোহন বলেছেন, 'যেসব বিষয় ভারত ও পাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে প্রভাব ফেলে, জারদারি এবং আমি সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে।' তিনি বলেন, 'পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট আমাকে তাঁর দেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন এবং সুবিধাজনক সময়ে সফর করব বলে জানিয়েছি। আমি মনে করি, এখন দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়া উচিত।' মনমোহন স্বীকার করেছেন যে দুই দেশের মধ্যে কিছু মতবিরোধ আছে এবং সেগুলো আলোচনা করে সমাধান করা হবে।
একই সুরে কথা বলেছেন পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট। মনমোহন সিং তাঁকে মধ্যাহ্নভোজের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বলে তিনি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেছেন, 'আমরা দুটি প্রতিবেশী দেশ। আমরা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তুলতে ও ধরে রাখতে চাই। সেটা অবশ্যই সম্ভব। মনমোহনের সঙ্গে আমার অনেক বিষয়ে বন্ধুত্বসুলভ আলোচনা হয়েছে।' দুই নেতা এটাও বলেছেন, দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা থাকলেও বাণিজ্য সম্প্রসারণে কোনো বাধা নেই। এ জন্য তাঁরা একসঙ্গে কাজ করবেন বলে ঐকমত্যে পেঁৗছেছেন। এ ক্ষেত্রে জারদারি চীনের উদাহরণ টেনে বলেছে, চীন ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা রয়েছে। তার পরও প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। বিগত এক দশকে চীন ও ভারতের বাণিজ্য বেড়ে ৬০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। একই প্রক্রিয়ায় পাকিস্তানের সঙ্গেও ভারতের বাণিজ্য সম্প্রসারণ করা যেতে পারে।
আসিফ জারদারির সফরসঙ্গী হিসেবে ভারত সফরে আসেন তাঁর পুত্র ও পিপিপির চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রেহমান মালিক, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রাব্বানি খার প্রমুখ। বিলাওয়াল কংগ্রেস সাধারণ সম্পাদক রাহুল গান্ধীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বিলাওয়াল রাহুলকে পাকিস্তান সফরের আমন্ত্রণ জানালে তিনি তা গ্রহণ করেন। তিনি হয়তো শিগগিরই পাকিস্তান সফর করবেন।
উল্লেখ্য, উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী গান্ধী ও ভুট্টো পরিবারের প্রতিনিধি রাহুল ও বিলাওয়ালের প্রতি সবারই বিশেষ দৃষ্টি ছিল। পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণেই তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠা স্বাভাবিক। আর সেই পারিবারিক সম্পর্ক দুই দেশের স্বার্থে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বৈকি! বলা হয়ে থাকে, তাঁরা দুজনই দুই দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার। ভবিষ্যতে তাঁরাই ভারত ও পাকিস্তানের হাল ধরবেন। আমরা নিশ্চয়ই সেদিনের অপেক্ষায় থাকব।
একই সঙ্গে বলতে চাই, উপমহাদেশের শান্তি প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত হচ্ছে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক। আর এটা নির্ভর করছে উভয় দেশের নেতৃত্বের ওপর। তাঁরা পারমাণবিক শক্তির বিস্তার ঘটাতে প্রতিযোগিতা না করে এ অঞ্চলের দারিদ্র্য বিমোচনে একযোগে কাজ করতে পারেন। এ অঞ্চলের দেড় শ কোটি মানুষের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তাঁরা গঠনমূলক এবং দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবেন বলে আশা করি। আমরা দেখতে চাই, ভারতের প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তান সফরে গিয়ে দুই দেশের মতবিরোধ আলোচনার টেবিলে মীমাংসা করবেন। বিশেষ কোনো ইস্যুতে কোনো পক্ষই গো ধরে থাকবে না। উদারনীতি এবং খোলামন নিয়ে আলোচনায় বসলে যেকোনো সমস্যাই মিটিয়ে ফেলা সম্ভব।
বাংলাদেশ কেন নয়? : বর্তমানে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্ক বেশ শীতল। বিগত তিন বছরে কোনো পক্ষ থেকেই সম্পর্ক স্বাভাবিক করার তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। দুই দেশের কর্মকর্তা ও মন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠক-আলোচনা হলেও তা তেমন ফলপ্রসূ হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের বেশ অবনতি হয়েছে। পাকিস্তান যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তা ছাড়া ১৯৯১ সালে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে নির্বাচনী তহবিল দেওয়ার ব্যাপারে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইকে অভিযুক্ত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকাশ্যে বক্তব্য দিয়েছেন। যদিও তা ছিল গণমাধ্যমের রিপোর্ট। তার পরও শেখ হাসিনার বক্তব্যের কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে পাকিস্তান। এতে দুই দেশের সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
দুই দেশের সম্পর্ক আরো অবনতি হওয়ার আগেই কূটনৈতিক পর্যায়ে উদ্যোগ নেওয়া উচিত। উদ্যোগটি বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও নেওয়া যেতে পারে।
পররাষ্ট্রনীতিতে চিরশত্রু কিংবা চিরস্থায়ী বন্ধু বলে কিছু নেই। তাহলে তো বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতেন না। জুলফিকার আলী ভুট্টোকে বাংলাদেশের মাটিতে লালগালিচা সংবর্ধনা দিতেন না। এমনকি ভারতের প্রবল আপত্তি থাকা সত্ত্বেও ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত ওআইসির বিশেষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু যোগদান করতেন না।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল স্লোগানই হচ্ছে, 'সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়।' সেই নীতি মেনে আমাদের অগ্রসর হওয়া উচিত।
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে এত বিরোধ থাকার পরও তারা যদি সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নিতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ কেন গো ধরে বসে থাকবে? পাকিস্তান না চাইলেও বাংলাদেশকে একধাপ এগিয়ে যেতে হবে। তাতে কূটনৈতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বাড়বে। তবে পাকিস্তানের বর্তমান প্রশাসন বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করতে আগ্রহী বলে আমরা জানি। এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে বাংলাদেশ সরকারকে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.