ধর্ম-শ্রমের মর্যাদা ও শ্রমিকের অধিকার by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

ইহকালীন জীবনে উন্নতির শিখরে আরোহণ করার মূল চাবিকাঠি মানুষের কর্মদক্ষতা। মানবজাতির অস্তিত্ব, প্রগতি, সভ্যতা, উন্নয়ন—সবকিছুর মূলে রয়েছে শ্রম। ইসলাম শ্রমকে অপরিসীম মর্যাদা দিয়েছে। সভ্য জগতের মানুষ যখন শ্রমের মর্যাদা ও শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বুকের রক্ত দিয়ে আত্মত্যাগ করেছিল,


এর বহুকাল আগেই বিশ্বজনীন জীবনাদর্শ ইসলাম শ্রমের মর্যাদা ও শ্রমিক বা মেহনতি মানুষের অধিকার নিশ্চিত করেছে। উপার্জনের দিকে ধর্মপ্রাণ মানুষকে উৎসাহিত করে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন নামাজ শেষ হয়ে যায়, তখন তোমরা ভূপৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড়ো আর আল্লাহর অনুগ্রহ অন্বেষণে ব্যাপৃত হয়ে যাও।’ (সূরা আল-জুমুআ, আয়াত: ১০)
হজরত আদম (আ.) ও বিবি হাওয়া (আ.) পৃথিবীতে সর্বপ্রথম মানব-মানবীরূপে বসতি স্থাপন করেন। অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের জন্য শ্রমের প্রয়োজন হয়। কোনো কিছু পাওয়ার জন্য কঠিন পরিশ্রম করার স্পৃহা মানবসত্তায় সঞ্চারিত হয়। যদিও ফেরেশতা জিব্রাইল (আ.) আদি মানব হজরত আদম (আ.)-কে খাদ্য উৎপাদন, বস্ত্রায়ন, গৃহনির্মাণ এবং বিবি হাওয়া (আ.)-কে বস্ত্র সেলাই, রান্নাবান্না, সন্তান লালন-পালন প্রভৃতি নিয়মকানুন শিখিয়ে দেন। তখন থেকেই উপার্জনে এবং সমাজ-সংসার গড়ে তোলার প্রয়োজনে কায়িক শ্রমের বা মেহনতের গুরুত্ব প্রকট হয়ে ওঠে। তাঁদের মাধ্যমে মানব বংশধারা বৃদ্ধি পেয়ে ক্রমান্বয়ে সমাজে বিভিন্ন জাতি, গোষ্ঠী ও জনপদ গঠিত হতে থাকে। সবাই মিলেমিশে যৌথ পরিশ্রমে খাদ্য সংগ্রহ, উৎপাদন ও জীবন-জীবিকার সবকিছুতে আত্মনিয়োগ করে এবং সমতার ভিত্তিতে ভাগ-বাটোয়ারার মাধ্যমে বসবাস করতে থাকে। কিন্তু কালক্রমে একপর্যায়ে এসে সমাজের ভেতরে শক্তিধরের উদ্ভব ঘটে। ফলে শ্রমিক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উৎপাদন করে আর তার বেশির ভাগ সম্পদ ভোগ করে মালিকপক্ষের শক্তিধর শোষক ও শাসক।
পবিত্র কোরআনে বেশ কয়েকজন নবীর কায়িক শ্রমের উল্লেখ রয়েছে। মহানবী (সা.) নিজে শ্রম ব্যয় করে জীবিকা অর্জন করতেন। একদা নবীজি তাঁর ফোসকা পড়া পবিত্র হাত দেখিয়ে সাহাবায়ে কিরামের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘এটি এমন একটি হাত, যা আল্লাহ ও তাঁর রাসুল পছন্দ করেন।’ তাই মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজে নিজে উপার্জন করে খায়, আল্লাহ তার প্রতি সুপ্রসন্ন।’ পরিশ্রমলব্ধ জীবিকাই সর্বোত্তম। একবার রাসুলে করিম (সা.)-এর কাছে জিজ্ঞেস করা হলো—হে রাসুল! কোন ধরনের উপার্জন শ্রেষ্ঠতর? তিনি জবাবে বললেন, ‘নিজের শ্রমলব্ধ উপার্জন।’ ফলে মানুষকে সৎভাবে বাঁচতে হলে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কাজকর্মের ও শ্রমশীলতার মাধ্যমে সম্মানজনকভাবে জীবনযাপন করতে হবে। নবী করিম (সা.) শ্রমের প্রতি গুরুত্ব আরোপ ও শ্রমিকের কর্তব্য সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন, ‘নিজের হাতের কাজ ও শ্রম দ্বারা উপার্জিত খাদ্য খাওয়া অপেক্ষা উত্তম খাদ্য কেউ খেতে পারে না। হজরত দাউদ (আ.) নিজের হাতের শ্রমের উপার্জিত খাবার খেতেন।’ (বুখারি)
ইসলাম যেমনিভাবে মানুষকে পরিশ্রম করে সৎভাবে উপার্জনের দিকে উৎসাহিত করেছে, একে প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখেছে, তেমনি কোনো রকম উপার্জন না করে সমাজের গলগ্রহ হয়ে থাকা ইসলামের দৃষ্টিতে অত্যন্ত ঘৃণ্য কাজ, বেকার থাকা ইসলাম কোনোক্রমেই পছন্দ করে না। যে ব্যক্তি সারা দিন পরিশ্রম করে ক্লান্ত সন্ধ্যা যাপন করে, সে ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়েই তার সন্ধ্যা অতিবাহিত করে। একজন সাহাবির প্রশ্নের জবাবে রাসুলে করিম (সা.) বলেন, ‘নিজের পরিজনদের নিমিত্ত হালাল রুজি উপার্জনে ব্যাপৃত থাকো, কেননা, এই উপার্জন নিশ্চয়ই আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করার মতোই। একজন শান্ত সৎকর্মী শ্রমিক যখন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আসে, তখন আল্লাহ তার প্রতি এমন সন্তুষ্ট হন যে তার গুনাহের খাতা তিনি মাফ করে দেন।’ একজন শ্রমজীবীর কাছে এর চেয়ে আবেদনময় অমিয় বাণী আর কী হতে পারে?
আল্লাহ তাআলা সব মানুষকে সমান অধিকার দিয়েছেন। কেউ খাবে আর কেউ খাবে না—এ অসমনীতির বিরুদ্ধে ইসলাম সোচ্চার হয়েছে এবং এমন এক সুষম ব্যবস্থা সংহত করেছে, যার মাধ্যমে একটি ভারসাম্যপূর্ণ শ্রমনীতির বিকাশ লাভ করেছে। যে নীতিতে মালিক-শ্রমিকের ব্যবধান ও বৈষম্য দূরীভূত করে ইনসাফভিত্তিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তারা (মজুর, শ্রমিক ও অধীনস্থ বেতনভোগী কর্মচারীরা) তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদের দায়িত্ব তোমাদের ওপর অর্পণ করেছেন। অতএব, যার কোনো ভাইকে তার অধীন করে দেওয়া হয়েছে, সে যেন তাকে তা-ই আহার করতে দেয়, যা সে নিজে আহার করে। যেন সেই পরিধেয় পরিধান করতে দেয়, যা সে নিজে পরিধান করে থাকে। আর তাকে যেন এমন কাজ করতে বাধ্য না করে, যা করলে সে পর্যুদস্ত হবে। আর যদি এমন কাজ করতে তাকে বাধ্য করে, তাহলে যেন সে তাকে সহযোগিতা করে।’ (বুখারি)
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনাদর্শ হিসেবে শ্রমজীবীদের সব সমস্যার সার্বিক ও ন্যায়ানুগ সমাধানের দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। ইসলাম চায় শ্রমিক ও নিয়োগকর্তার সৌহার্দ্যমূলক পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে এমন এক বিধানের প্রচলন করতে, যেখানে শোষণ-নিপীড়ন সর্বোপরি দুর্বলকে পিষ্ট করার জঘন্য প্রবণতা থাকবে না। পার্থিব জগতে কোনো উন্নতি শ্রম ব্যতিরেকে সম্ভব নয়। তাই ইসলামে শ্রমের গুরুত্ব ও মর্যাদা অত্যন্ত তাৎপর্যময়। ইসলামি বিধানমতে, মালিকের কর্তব্য হচ্ছে শ্রমিক নিয়োগের আগে অবশ্যই তার মজুরি নির্ধারণ করে নেওয়া। নবী করিম (সা.) নির্দেশ প্রদান করেছেন, ‘কাজের পারিতোষিক নির্ধারণ ব্যতিরেকে কোনো শ্রমিককে কাজে নিয়োগ করবে না।’ ইসলামের দৃষ্টিতে কাজ শেষ করামাত্রই শ্রমিককে তার পারিশ্রমিক প্রদান করা মালিকের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব, তবে অগ্র্রিম বা অন্য কোনো রকম শর্ত থাকলে তা ভিন্ন কথা। নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘শ্রমিকের কাজ বা কাজের মেয়াদ শেষ হলেই তার মজুরি পুরোপুরি দিতে হবে।’ (মুসনাদে আহমাদ)
শ্রমিকেরা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে কাজ করে। তারা নিজেদের ও পরিবারের যাবতীয় প্রয়োজন পূরণের জন্য কায়িক পরিশ্রম করে এবং মজুরিই তাদের একমাত্র অবলম্বন। এ অবস্থায় তারা যদি পরিশ্রম করে যথাযথ মজুরি না পায় কিংবা প্রয়োজন অপেক্ষা কম পায় অথবা নির্দিষ্ট সময়মতো ন্যায্যপ্রাপ্য না পায়, তাহলে তাদের দুর্দশার অন্ত থাকে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) শ্রমিকের মজুরি সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ঘোষণা করেছেন, ‘তোমরা শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকানোর আগেই তার প্রাপ্য পারিশ্রমিক দিয়ে দাও।’ (বায়হাকি)
বিশ্বনবী (সা.)-এর তাগিদের মধ্যে শ্রমিকের বৈষয়িক প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি একটি সুশৃঙ্খল, ভারসাম্যপূর্ণ ইনসাফভিত্তিক কল্যাণমূলক সমাজের বীজও লুকায়িত রয়েছে। ইসলাম শ্রমের মর্যাদা ও শ্রমিকের যে অধিকার দিয়েছে, তা হূদ্যতা ও ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে সমুন্নত। সুতরাং, ইসলামের দেওয়া সর্বজনীন শ্রমনীতি গ্রহণ করার মাধ্যমে পৃথিবীতে বিরাজমান শ্রমিক-মালিক অসন্তোষ বহুলাংশে দূরীভূত করা সম্ভব।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.