রম্য-দখলভোগ by সাইফুল আলম
এটা চাইল্ড সাইকোলজির প্রতিফলন। বাচ্চাদের মনের পর্দায় পারিপাশর্ি্বক পরিবেশ প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলে। আমার মন্তব্যের কোনো জবাব না দিয়ে ও বলল, 'দোস্ত, দখলভোগের মোহ মানুষের চরিত্রকে আঁস্তাকুড়েই কবর দেয়। নিশ্চয় লক্ষ্য করেছ, খোদ রাজধানীতেই অনেক মহারথী কপালে ভূমিদস্যুর খেতাব এঁটে বেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে।
তাদের চরিত্রে এ বিষয়ে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই
আমাদের দুর্নীতিগ্রস্ত সামাজিক সমস্যাগুলোকে নিয়ে কিশমিশ আলীর দুর্ভাবনা যেন ওর বয়সের মতোই দিন দিন ভারি হয়ে উঠছে। আর অতি পুরনো বন্ধুত্বের বিনা সুতোর টানে আমার সঙ্গেই যেন তার এ বিষয়গুলো নিয়ে আলাপচারিতার আসর বসে।
দু'দিন আগে টেলিফোনের ডাকে সাড়া দিয়ে ওর বাসায় মিলিত হলাম। তখন পড়ন্ত বিকেলটা যেন সন্ধ্যার সঙ্গে লুকোচুরি খেলছিল। আমার মুখ দর্শনে ওর আপাদমস্তকবিশিষ্ট দেহখানা যেন পুলকিত হয়ে দুলতে লাগল। ওর ডান হাতটা আমার নাভি বরাবর এগিয়ে দিতেই আমিও ত্বরিত হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। ও যেন পৌনে এক টন ওজনের একটা ঝাঁকি দিয়ে হ্যান্ডশেকের পর্বটা শেষ করে ওর লিভিং রুমটায় আমাকে নিয়ে সাদরে বসিয়ে দিল। আমি লক্ষ্য করলাম, সামনের সেন্টার টেবিলটায় দুটি খালি কাপ আর একটা হোলমেটাল বডির থার্মোফ্লাস্ক শোভা পাচ্ছে। ওদিকে নজর ফেলতেই আমার নজরটাকে কেড়ে নিয়ে কিশমিশ বলল, 'দোস্ত, তুমি আসবে বলে আমি নিজ হাতে কফি রেঁধে রেখেছি। এখন কাপে ঢেলে দু'ঠোঁটে চুমুক দেওয়াটাই সময়ের ব্যপার।' আমি অবাক হয়ে শুধালাম, কেন, তোমার গৃহপরিচারক কালাম কোথায়?
'ও বেচারার বড্ড বিপদ!'
'কেন? কী বিষয়?' আমি চমকে উঠে জানতে চাইলাম। উত্তরে ও বলল, 'বিষয়টা শুধু জাতীয় নয়, আন্তর্জাতিক সমস্যাও বলতে পার।' কিশমিশের কথাটা আলো-আঁধারে স্নান করছিল। আমিও যেন রহস্যের কৃষ্ণসাগরে হাবুডুবু খেতে খেতে বললাম, 'দোস্ত, বিষয়টা খোলাসা করেই বর্ণনা কর না।' আমার কথার কোনো প্রত্যক্ষ জবাব না দিয়ে কিশমিশ নিবিড় মনোযোগ সহকারে খালি কাপ দুটোয় খানিকটা কফি ঢেলে আমার পানে একটাকে এগিয়ে ধরল। তারপর ওর বয়োজ্যেষ্ঠ ঠোঁট দুটোয় ছটাক খানেক পাতলা হাসি মেখে বলল,
'দোস্ত, দখলভোগ বোঝ?'
'দখলভোগ বুঝি নে, তবে ভোগদখল বুঝি।'
'ভোগদখল তো আইন মোতাবেক হয়, আর দখলভোগ কোনো আইন মানে না। এখানে পেশিশক্তি আর প্রতিপত্তিই সর্বোচ্চ আইন। যত পার দখল কর, আর মন ভরিয়ে ভোগ কর।'
আমি কফির কাপটায় একটা হালকা চুমুক দিয়ে বললাম, 'কিন্তু এখানে এ প্রসঙ্গ আসছে কেন?' কিশমিশ এবার তার কাপটায় চুমুক দিতে গিয়েও থেমে গিয়ে বলল, 'আমাদের কালাম তো ঐ সমস্যারই শিকার।'
- 'সে কী!'
-'হ্যাঁ। গ্রামের বাড়িতে ওর আপন বলতে পিতৃপ্রদত্ত বিঘাতিনেক জমি আছে। কিন্তু ওর বাপের অকালমৃত্যুর সুযোগে ওর আপন চাচার আপন দু'ছেলে সেটা দখল করে আপন করার পাঁয়তারা করছে। বিষয়টা জানতে পেরে কালাম ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটেছে গ্রামের দিকে।
_ 'তবে তো ওর মহাসমস্যা।' কিশমিশ এবার তার কাপটায় ধারাবাহিক চুমুক দিয়ে কফিটুকু নিঃশেষ করে বলল, দোস্ত, এটা তো সামান্য তিন বিঘা জমি। অথচ আন্তর্জাতিক মহাশক্তিগুলো অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলোকে কূটনৈতিক আক্রমণ করে শুধু তাদের প্রাকৃতিক সম্পদকেই দখল করছে না; পারলে পুরো দেশটাকেই হজম করে ফেলার ষড়যন্ত্র করছে।'
- 'তা যথার্থ বলেছ। বিশ্বজুড়ে যেন দখলবাজদের রঙ্গলীলা চলছে।'
আমার বাক্যটা যেন কিশমিশের মনের স্কোর বোর্ডে ছক্কা মারার মতোই ডিসপ্লে হয়ে উঠল। দুটি নয়নতারায় ঝিলিক তুলে ও বলল, 'দেশজুড়ে জমি দখল, নদী দখল, ফুটপাত দখল, বাড়ি দখল, চেয়ার দখল, ক্ষমতা দখল_ যেন দখলের মহামারী চলছে। তাছাড়া'... এটুকু বলে কিশমিশ এবার কণ্ঠটাকে নিচু করে বাক্যটাকে যেন অসমাপ্ত রাখল। আমি শুধালাম,
- 'তাছাড়া কী? বলেই ফেল না!' কিশমিশ আমার কানে ফিসফিসিয়ে বলল, 'তাছাড়া অনেক সময় পরকীয়ায় মত্ত হয়ে অনেক স্বামী-স্ত্রীও দখলভোগ হয়ে যাচ্ছে।' আমি ওর রসিকতায় আঁতকে উঠে বললাম, 'সামাজিক অবক্ষয়'। কিশমিশ বলল_
-'অথচ সমাজপতি আর ক্ষমতায় উপবিষ্টদের কোনো মাথাব্যথা নেই। আর থাকবেই-বা কেন? তাদের ছাতার নিচেই তো দখলবাজদের নিরাপদ বসবাস।' কথাগুলো উদ্গিরণ করতে গিয়ে কিশমিশের ফেসিয়াল মাসলগুলো যেন সংকুচিত হয়ে গেল। আমি বললাম, 'দোস্ত, দখলবাজদের বাজিখেলা কিন্তু আধুনিক কোনো প্রক্রিয়া নয়। অতি পুরাতন যুগ থেকেই এটা হয়ে আসছে।'
_' হ্যাঁ। কথাটার মধ্যে কোনো রাসায়নিক ভেজাল নেই। সনাতনী যুগ থেকেই রাজ্য দখল, সিংহাসন দখল থেকে শুরু করে গ্রাম-গঞ্জে হাঁস-মুরগি আর গরু-ছাগলও বেদখল হয়ে যাচ্ছে।'
_'হেঃ হেঃ হেঃ'। কথাগুলো বলে কিশমিশ যেন এক ডেসিবল মাত্রার খানিকটা অট্টহাসি চারদিকের শব্দ দূূষণে মিশিয়ে দিল। আমি তার হর্ষমুখরিত বদনখানার দিকে দৃষ্টি ফেলে বললাম, 'দোস্ত, আমাদের দেশের চর দখল কিন্তু বেশ পুরাতন একটা ঐতিহ্যবাহী কর্মকাণ্ড। আর এ ঘটনাগুলোকে পুঁজি করে অনেক গল্প লেখক নানান রোমহর্ষক গল্প ফেঁদে বেশ পয়সা কামিয়ে নিচ্ছেন।' আমার বাক্য নিক্ষেপটা শেষ হতেই কিশমিশ উঠে দাঁড়িয়ে শরীরে খানিকটা আড়মোড়া ভেঙে আবার বসে পড়ে বলল, 'দোস্ত, লাঠিয়াল বাহিনীর নাম শুনেছ?'
_'তা তো সেই ছোটকাল থেকেই শুনে আসছি। আরও শুনে এসেছি এসব লাঠিয়াল বাহিনীকে ভাড়া করা হয় অন্যের জমি দখল, চর দখল আর ক্ষেতের পাকা ধান দখল করার কাজে।'
আমার কথাটা সমর্থন করে ও বলল, 'তুমি যথার্থই বলেছ। এ প্রসঙ্গে আমার ছোটবেলার একটা স্মৃতিপট যেন মনের জানালায় উঁকিঝুঁকি মারছে।'
আমি এবার আগ্রহকে সঙ্গী করে বললাম, 'তা স্মৃতিপটটা জানলা থেকে টেনে এনে মনের মেঝেতে দাঁড় করিয়ে বর্ণনা কর না দোস্ত; শুনে তৃপ্ত হই !'
কিশমিশ এবার একটু নড়ে বসে বলল, 'ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে ১২-১৩ বছরের এক গৃহভৃত্য ছিল। ওর বাবার নাম জিজ্ঞেস করতেই বলত, আমার বাপজানের নাম মোমিন লাঠিয়াল। আমি মোমিন লাঠিয়ালের ছাওয়াল। শেষের কথাগুলো বলার সময় ওর কচি চোখমুখে যেন একটা গর্বের রেশ দেখা দিত।'
_'এটা চাইল্ড সাইকোলজির প্রতিফলন। বাচ্চাদের মনের পর্দায় পারিপাশর্ি্বক পরিবেশ প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলে।' আমার মন্তব্যের কোনো জবাব না দিয়ে ও বলল, 'দোস্ত, দখলভোগের মোহ মানুষের চরিত্রকে আঁস্তাকুড়েই কবর দেয়। নিশ্চয় লক্ষ্য করেছ, খোদ রাজধানীতেই অনেক মহারথী কপালে ভূমিদস্যুর খেতাব এঁটে বেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের চরিত্রে এ বিষয়ে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। আর কোনো অ্যান্টি অ্যালার্জিক ড্রাগেরও প্রয়োজন হয় না।'
কিশমিশের বাক্যতরঙ্গ আমার কানের ড্রাম দুটোয় যেন একজন পপশিল্পীর দুর্বোধ্য স্বরলিপির মূর্ছনা তুলে দিল। আমি দু'কানে আঙুল দিয়ে ওর দিকে ঝুঁকে বললাম, 'দোস্ত, দখলভোগের এ খ্যামটা নাচের মুদ্রাটাকে নিস্তেজ করার কোনো উপায় কি তোমার জানা আছে?'
কিশমিশ ইশারায় আমাকে কানের আঙুল সরাতে বলে ওর মাথার সাড়ে আটানব্বই ভাগ পাকা চুলগুলোয় দু'বার ডান হাতের আঙুল চালনা করে বলল,
-'দোস্ত, কত মহাজ্ঞানী মানবকুলের এ সমস্যার সমাধান খুঁজতে খুঁজতে পরপারে পাল উড়ালেন! আর আমি তো একটা তেলাপোকার সমান।' আমি এবার তাকে উদ্দীপনা ছিটিয়ে বললাম, 'নিজেকে এতটা ক্ষুদ্র মনে কর কেন? কোনো সমস্যা সমাধানে পরামর্শের জন্য প্রয়োজন বুদ্ধি আর নিবিড় ভাবনা। কিশমিশ এবার শান্ত কণ্ঠে বলল, 'দোস্ত, বিবেক! মানুষের বিবেক যতদিন না তার সামনে এসে অবৈধ কর্মকাণ্ডের কৈফিয়ত চাইবে, ততদিন যত আইনই প্রয়োগ করা হোক, সুফল দুরাশায় মিশে যাবে। মনে রাখতে হবে, এ জীবন চিরদিনের নয়।'
আমি কিশমিশের কথার কোনো উত্তর খুঁজে পেলাম না। শূন্য দৃষ্টি ফেলে সামনের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করলাম, কিশমিশের ঘরের দেয়ালে টাঙানো প্রাচীন দেয়ালঘড়িটার চিরদোদুল্যমান পেন্ডুলামটা দুলে দুলে যেন জানান দিচ্ছে এ জীবন চিরদিনের নয়_ এ জীবন দোদুল্যমান।
ডা. সাইফুল আলম :ডেন্টাল সার্জন
আমাদের দুর্নীতিগ্রস্ত সামাজিক সমস্যাগুলোকে নিয়ে কিশমিশ আলীর দুর্ভাবনা যেন ওর বয়সের মতোই দিন দিন ভারি হয়ে উঠছে। আর অতি পুরনো বন্ধুত্বের বিনা সুতোর টানে আমার সঙ্গেই যেন তার এ বিষয়গুলো নিয়ে আলাপচারিতার আসর বসে।
দু'দিন আগে টেলিফোনের ডাকে সাড়া দিয়ে ওর বাসায় মিলিত হলাম। তখন পড়ন্ত বিকেলটা যেন সন্ধ্যার সঙ্গে লুকোচুরি খেলছিল। আমার মুখ দর্শনে ওর আপাদমস্তকবিশিষ্ট দেহখানা যেন পুলকিত হয়ে দুলতে লাগল। ওর ডান হাতটা আমার নাভি বরাবর এগিয়ে দিতেই আমিও ত্বরিত হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। ও যেন পৌনে এক টন ওজনের একটা ঝাঁকি দিয়ে হ্যান্ডশেকের পর্বটা শেষ করে ওর লিভিং রুমটায় আমাকে নিয়ে সাদরে বসিয়ে দিল। আমি লক্ষ্য করলাম, সামনের সেন্টার টেবিলটায় দুটি খালি কাপ আর একটা হোলমেটাল বডির থার্মোফ্লাস্ক শোভা পাচ্ছে। ওদিকে নজর ফেলতেই আমার নজরটাকে কেড়ে নিয়ে কিশমিশ বলল, 'দোস্ত, তুমি আসবে বলে আমি নিজ হাতে কফি রেঁধে রেখেছি। এখন কাপে ঢেলে দু'ঠোঁটে চুমুক দেওয়াটাই সময়ের ব্যপার।' আমি অবাক হয়ে শুধালাম, কেন, তোমার গৃহপরিচারক কালাম কোথায়?
'ও বেচারার বড্ড বিপদ!'
'কেন? কী বিষয়?' আমি চমকে উঠে জানতে চাইলাম। উত্তরে ও বলল, 'বিষয়টা শুধু জাতীয় নয়, আন্তর্জাতিক সমস্যাও বলতে পার।' কিশমিশের কথাটা আলো-আঁধারে স্নান করছিল। আমিও যেন রহস্যের কৃষ্ণসাগরে হাবুডুবু খেতে খেতে বললাম, 'দোস্ত, বিষয়টা খোলাসা করেই বর্ণনা কর না।' আমার কথার কোনো প্রত্যক্ষ জবাব না দিয়ে কিশমিশ নিবিড় মনোযোগ সহকারে খালি কাপ দুটোয় খানিকটা কফি ঢেলে আমার পানে একটাকে এগিয়ে ধরল। তারপর ওর বয়োজ্যেষ্ঠ ঠোঁট দুটোয় ছটাক খানেক পাতলা হাসি মেখে বলল,
'দোস্ত, দখলভোগ বোঝ?'
'দখলভোগ বুঝি নে, তবে ভোগদখল বুঝি।'
'ভোগদখল তো আইন মোতাবেক হয়, আর দখলভোগ কোনো আইন মানে না। এখানে পেশিশক্তি আর প্রতিপত্তিই সর্বোচ্চ আইন। যত পার দখল কর, আর মন ভরিয়ে ভোগ কর।'
আমি কফির কাপটায় একটা হালকা চুমুক দিয়ে বললাম, 'কিন্তু এখানে এ প্রসঙ্গ আসছে কেন?' কিশমিশ এবার তার কাপটায় চুমুক দিতে গিয়েও থেমে গিয়ে বলল, 'আমাদের কালাম তো ঐ সমস্যারই শিকার।'
- 'সে কী!'
-'হ্যাঁ। গ্রামের বাড়িতে ওর আপন বলতে পিতৃপ্রদত্ত বিঘাতিনেক জমি আছে। কিন্তু ওর বাপের অকালমৃত্যুর সুযোগে ওর আপন চাচার আপন দু'ছেলে সেটা দখল করে আপন করার পাঁয়তারা করছে। বিষয়টা জানতে পেরে কালাম ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটেছে গ্রামের দিকে।
_ 'তবে তো ওর মহাসমস্যা।' কিশমিশ এবার তার কাপটায় ধারাবাহিক চুমুক দিয়ে কফিটুকু নিঃশেষ করে বলল, দোস্ত, এটা তো সামান্য তিন বিঘা জমি। অথচ আন্তর্জাতিক মহাশক্তিগুলো অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলোকে কূটনৈতিক আক্রমণ করে শুধু তাদের প্রাকৃতিক সম্পদকেই দখল করছে না; পারলে পুরো দেশটাকেই হজম করে ফেলার ষড়যন্ত্র করছে।'
- 'তা যথার্থ বলেছ। বিশ্বজুড়ে যেন দখলবাজদের রঙ্গলীলা চলছে।'
আমার বাক্যটা যেন কিশমিশের মনের স্কোর বোর্ডে ছক্কা মারার মতোই ডিসপ্লে হয়ে উঠল। দুটি নয়নতারায় ঝিলিক তুলে ও বলল, 'দেশজুড়ে জমি দখল, নদী দখল, ফুটপাত দখল, বাড়ি দখল, চেয়ার দখল, ক্ষমতা দখল_ যেন দখলের মহামারী চলছে। তাছাড়া'... এটুকু বলে কিশমিশ এবার কণ্ঠটাকে নিচু করে বাক্যটাকে যেন অসমাপ্ত রাখল। আমি শুধালাম,
- 'তাছাড়া কী? বলেই ফেল না!' কিশমিশ আমার কানে ফিসফিসিয়ে বলল, 'তাছাড়া অনেক সময় পরকীয়ায় মত্ত হয়ে অনেক স্বামী-স্ত্রীও দখলভোগ হয়ে যাচ্ছে।' আমি ওর রসিকতায় আঁতকে উঠে বললাম, 'সামাজিক অবক্ষয়'। কিশমিশ বলল_
-'অথচ সমাজপতি আর ক্ষমতায় উপবিষ্টদের কোনো মাথাব্যথা নেই। আর থাকবেই-বা কেন? তাদের ছাতার নিচেই তো দখলবাজদের নিরাপদ বসবাস।' কথাগুলো উদ্গিরণ করতে গিয়ে কিশমিশের ফেসিয়াল মাসলগুলো যেন সংকুচিত হয়ে গেল। আমি বললাম, 'দোস্ত, দখলবাজদের বাজিখেলা কিন্তু আধুনিক কোনো প্রক্রিয়া নয়। অতি পুরাতন যুগ থেকেই এটা হয়ে আসছে।'
_' হ্যাঁ। কথাটার মধ্যে কোনো রাসায়নিক ভেজাল নেই। সনাতনী যুগ থেকেই রাজ্য দখল, সিংহাসন দখল থেকে শুরু করে গ্রাম-গঞ্জে হাঁস-মুরগি আর গরু-ছাগলও বেদখল হয়ে যাচ্ছে।'
_'হেঃ হেঃ হেঃ'। কথাগুলো বলে কিশমিশ যেন এক ডেসিবল মাত্রার খানিকটা অট্টহাসি চারদিকের শব্দ দূূষণে মিশিয়ে দিল। আমি তার হর্ষমুখরিত বদনখানার দিকে দৃষ্টি ফেলে বললাম, 'দোস্ত, আমাদের দেশের চর দখল কিন্তু বেশ পুরাতন একটা ঐতিহ্যবাহী কর্মকাণ্ড। আর এ ঘটনাগুলোকে পুঁজি করে অনেক গল্প লেখক নানান রোমহর্ষক গল্প ফেঁদে বেশ পয়সা কামিয়ে নিচ্ছেন।' আমার বাক্য নিক্ষেপটা শেষ হতেই কিশমিশ উঠে দাঁড়িয়ে শরীরে খানিকটা আড়মোড়া ভেঙে আবার বসে পড়ে বলল, 'দোস্ত, লাঠিয়াল বাহিনীর নাম শুনেছ?'
_'তা তো সেই ছোটকাল থেকেই শুনে আসছি। আরও শুনে এসেছি এসব লাঠিয়াল বাহিনীকে ভাড়া করা হয় অন্যের জমি দখল, চর দখল আর ক্ষেতের পাকা ধান দখল করার কাজে।'
আমার কথাটা সমর্থন করে ও বলল, 'তুমি যথার্থই বলেছ। এ প্রসঙ্গে আমার ছোটবেলার একটা স্মৃতিপট যেন মনের জানালায় উঁকিঝুঁকি মারছে।'
আমি এবার আগ্রহকে সঙ্গী করে বললাম, 'তা স্মৃতিপটটা জানলা থেকে টেনে এনে মনের মেঝেতে দাঁড় করিয়ে বর্ণনা কর না দোস্ত; শুনে তৃপ্ত হই !'
কিশমিশ এবার একটু নড়ে বসে বলল, 'ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে ১২-১৩ বছরের এক গৃহভৃত্য ছিল। ওর বাবার নাম জিজ্ঞেস করতেই বলত, আমার বাপজানের নাম মোমিন লাঠিয়াল। আমি মোমিন লাঠিয়ালের ছাওয়াল। শেষের কথাগুলো বলার সময় ওর কচি চোখমুখে যেন একটা গর্বের রেশ দেখা দিত।'
_'এটা চাইল্ড সাইকোলজির প্রতিফলন। বাচ্চাদের মনের পর্দায় পারিপাশর্ি্বক পরিবেশ প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলে।' আমার মন্তব্যের কোনো জবাব না দিয়ে ও বলল, 'দোস্ত, দখলভোগের মোহ মানুষের চরিত্রকে আঁস্তাকুড়েই কবর দেয়। নিশ্চয় লক্ষ্য করেছ, খোদ রাজধানীতেই অনেক মহারথী কপালে ভূমিদস্যুর খেতাব এঁটে বেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের চরিত্রে এ বিষয়ে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। আর কোনো অ্যান্টি অ্যালার্জিক ড্রাগেরও প্রয়োজন হয় না।'
কিশমিশের বাক্যতরঙ্গ আমার কানের ড্রাম দুটোয় যেন একজন পপশিল্পীর দুর্বোধ্য স্বরলিপির মূর্ছনা তুলে দিল। আমি দু'কানে আঙুল দিয়ে ওর দিকে ঝুঁকে বললাম, 'দোস্ত, দখলভোগের এ খ্যামটা নাচের মুদ্রাটাকে নিস্তেজ করার কোনো উপায় কি তোমার জানা আছে?'
কিশমিশ ইশারায় আমাকে কানের আঙুল সরাতে বলে ওর মাথার সাড়ে আটানব্বই ভাগ পাকা চুলগুলোয় দু'বার ডান হাতের আঙুল চালনা করে বলল,
-'দোস্ত, কত মহাজ্ঞানী মানবকুলের এ সমস্যার সমাধান খুঁজতে খুঁজতে পরপারে পাল উড়ালেন! আর আমি তো একটা তেলাপোকার সমান।' আমি এবার তাকে উদ্দীপনা ছিটিয়ে বললাম, 'নিজেকে এতটা ক্ষুদ্র মনে কর কেন? কোনো সমস্যা সমাধানে পরামর্শের জন্য প্রয়োজন বুদ্ধি আর নিবিড় ভাবনা। কিশমিশ এবার শান্ত কণ্ঠে বলল, 'দোস্ত, বিবেক! মানুষের বিবেক যতদিন না তার সামনে এসে অবৈধ কর্মকাণ্ডের কৈফিয়ত চাইবে, ততদিন যত আইনই প্রয়োগ করা হোক, সুফল দুরাশায় মিশে যাবে। মনে রাখতে হবে, এ জীবন চিরদিনের নয়।'
আমি কিশমিশের কথার কোনো উত্তর খুঁজে পেলাম না। শূন্য দৃষ্টি ফেলে সামনের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করলাম, কিশমিশের ঘরের দেয়ালে টাঙানো প্রাচীন দেয়ালঘড়িটার চিরদোদুল্যমান পেন্ডুলামটা দুলে দুলে যেন জানান দিচ্ছে এ জীবন চিরদিনের নয়_ এ জীবন দোদুল্যমান।
ডা. সাইফুল আলম :ডেন্টাল সার্জন
No comments