পাহাড়ধস-মৃত্যুর এ মিছিল থামতেই হবে by অলক পাল ও রানা আব্বাস

গত ১ জুলাই চট্টগ্রাম নগরীর বাটালী পাহাড়ে ভয়াবহ পাহাড় ধসে ১৭ জন মারা যাওয়ার ঘটনায় শোকে মুহ্যমান পুরো চট্টগ্রাম। পাহাড়ধস ঠেকাতে এবং আশপাশের জনবসতি রক্ষায় গত তিন বছর ধরে বাটালী পাহাড়ে ৩৬০ ফুট দীর্ঘ প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মাণ করছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন।


দুর্ভাগ্যের বিষয়, নির্মাণাধীন ওই দেয়াল রক্ষাকবচ না হয়ে প্রাণহন্তারক হিসেবে আবির্ভাব হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, দেয়ালটির নির্মাণ ত্রুটি (অবশ্য এ কারণে ইতিমধ্যে পাঁচজন প্রকৌশলীকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন) এবং দেয়াল ঘেঁষে অবৈধ জনবসতি গড়ে ওঠার কারণেই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এ মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়? এভাবে কি পাহাড় ধসে মানুষ মরতেই থাকবে? এর কি কোনো প্রতিকার নেই? কাল-স্থানভেদে চট্টগ্রামে পাহাড়ি ভূমি ধসে এ ধরনের মৃত্যুর ঘটনা বেড়েই চলেছে। কিন্তু এ দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে সামান্যই। প্রাচীনকাল থেকেই নদী, সাগর, সমভূমি ও পাহাড়ের অপূর্ব মিলন বিশেষভাবে আকর্ষণীয় করে তুলেছে চট্টগ্রামকে। প্রকৃতির সঙ্গে এ সখ্য কেন যেন ধরে রাখা গেল না। পাহাড় হয়ে উঠল লোভের আর লাভের। প্রকৃতিও নেতিবাচক মানসিকতা মেনে নিতে না পেরে ক্রূরভাবে প্রতিশোধ নিল। আজকের এ মৃত্যুর মিছিল তারই ফল। পাহাড় ধসে গত ১৫ বছরে চট্টগ্রাম নগরীতেই মারা গেছে ৩০০ জন।
১১ জুন ২০০৭-এর ভয়াবহ সে পাহাড় ধসের দুঃসহ স্মৃতি চট্টলাবাসীর কাছে এখনও টাটকা। স্মরণকালের সর্বাধিক ও ভারী বর্ষণের (৪২৫.২০ মিলিমিটার) ফলে পাহাড়ি ভূমিধসে ওই সময় ১২৭ জনের তরতাজা প্রাণ মুহূর্তেই ঝরে গেল। স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছিল চট্টগ্রামের আকাশ-বাতাস। এরপর ২০০৮-এর ১৮ আগস্ট নগরীতে মারা গিয়েছিল ১১ জন। দুঃখের বিষয়, ভয়াবহ এসব পাহাড়ধস আমাদের বিবেককে বিন্দুমাত্র শিক্ষা দিতে পারেনি। ফলে পাহাড় কাটার প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
পাহাড় দখল, কাটা এবং পাহাড়ধস এখন শুধু চট্টগ্রাম নগরীর সমস্যা নয়। এটা এখন পুরো চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। গত বছরের ১৫ জুন পাহাড়ি ভূমিধসে বান্দরবান ও কক্সবাজারে মারা গিয়েছিল ৫৫ জন। ২০০৯-এর জুলাইয়ে বান্দরবানের লামায় পাহাড় ধসের ফলে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০০৮-এর জুলাইয়ে কক্সবাজার ও টেকনাফে মারা গিয়েছিল ১৬ জন। এখনও পাহাড়ের ঢালে এসব এলাকায় চূড়ায় লাখ লাখ মানুষ মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে।
২০০৭ সালে চট্টগ্রামে বড় ধরনের পাহাড় ধসের ফলে তৎকালীন প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশে গঠিত দুটি তদন্ত কমিটি ৩৬ দফা এবং পাহাড় ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ কমিটি ৩০ দফা সুপারিশ করেছিল। অভিন্ন এ সুপারিশগুলোর মধ্যে ছিল : নগরীর দশ কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা এবং পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে আবাসন প্রকল্প গড়ে না তোলা, পাহাড়ি এলাকার বস্তি পর্যায়ক্রমে উচ্ছেদ ও পুনর্বাসন করা, নতুন বস্তি গড়তে না দেওয়া, অবৈধভাবে পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, পাহাড়ের পাদদেশে ১০০ মিটার প্রশস্ত 'বাফার' বনাঞ্চল তৈরি, পাহাড়ের গাছ কাটা বন্ধ করা প্রভৃতি। কিন্তু গত চার বছরে এসব সুপারিশের সিকিভাগও বাস্তবায়ন হয়নি, তা কেবল কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। পাহাড় দখলকারীদের বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা হলেও সেসব মামলা কখনোই আলোর মুখ দেখেনি।
বিগত চার যুগে চট্টগ্রামের পাহাড়ি ভূদৃশ্যে ব্যাপক রদবদল হয়েছে। চট্টগ্রামে পাহাড় কাটার প্রবণতা বাড়তে থাকে মূলত ষাটের দশক থেকে। শিল্পায়নের নামে যথেচ্ছ পাহাড় কাটা শুরু হয় তখন থেকেই। পরবর্তীকালে পাহাড় কাটার এ মহোৎসবে যোগ দেয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, হাউজিং সোসাইটি এবং সর্বশেষ ডেভেলপাররা, যা এখনও বিদ্যমান। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) মতে, বর্তমানে চট্টগ্রামে ১৫৬টি পাহাড় ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় আছে। এসব পাহাড়ের মোট আয়তন ২১ হাজার ৬১৩ একর। দশ বছরে শুধু চট্টগ্রামেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে ৩৫টি পাহাড়। শুধু ভূমিদস্যুরাই নয়, পাহাড় কাটাতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের জড়িত থাকার অভিযোগও পত্রপত্রিকায় চাউর হতে দেখা গেছে। ভূমিদস্যুরা প্রতিনিয়ত এই পাহাড়কে কেটেছেঁটে একেকটি মৃত্যুকূপ তৈরি করেছে। পাহাড়ের ঢাল যেখানে ৪৫ক্ক-এর বেশি হলেই ভূমিধসের আশঙ্কা থাকে, সেখানে চট্টগ্রামে কোথাও কোথাও পাহাড় কেটে খাড়া ৯০ক্ক করা হয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রামের পাহাড়ের গঠন মূলত বালুমাটি হওয়ায় এবং কোথাও কোথাও তা স্তরায়িত (স্ট্রাটিফাইয়েড) থাকায় সামান্য চাপের কারণেই ধস নামার প্রবণতা থাকে। বর্ষায় বৃষ্টিপাতের সময়, বিশেষত মৌসুমের প্রথম বৃষ্টিপাতের সময় পাহাড় ধসের ঝুঁকিটা সবচেয়ে বেশি থাকে। এরূপ ঝুঁকির আশঙ্কা জেনেও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অনেকেই কাটা পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করছে। অন্যদিকে পাহাড় দখল এবং পাহাড় কাটার ফলে একদিকে যেমন জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে, তেমনি নষ্ট হচ্ছে নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।
বর্তমান সময়ে পাহাড় দখলের ক্ষেত্রে পাহাড়খেকোরাও তাদের কৌশল বদলেছে। তারা এখন পাহাড় দখলে ব্যবহার করছে ছিন্নমূল এবং নিম্ন আয়ের মানুষদের। চট্টগ্রাম নগরীর জঙ্গল সলিমপুর, মতিঝর্ণা, কুসুমবাগ, বিশ্ব কলোনি, লালখানবাজার, টাংকির পাহাড়, খুলশি, বায়েজিদ বোস্তামী, হামজারবাগ, নবীনগর কলোনি, বার্মা কলোনি, জিলাপির পাহাড়, একে খান পাহাড়, চন্দনগর পাহাড়, রৈফাবাদ পাহাড়, ষোলশহর এলাকার শতাধিক বস্তিসহ বিভিন্ন স্থানে ছিন্নমূলদের ব্যবহার করে পাহাড় দখল করে চলেছে ভূমিদস্যুরা। পাহাড় ধসের পুনরাবৃত্তি রোধ করতে হলে পরিবেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ পাহাড়কে রক্ষা করার বিকল্প নেই। এ জন্য পাহাড় দখলকারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের অধিক তৎপর হওয়া এবং সে সঙ্গে বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা ভীষণ জরুরি।

ড. অলক পাল : সভাপতি, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ, চবি
alak1973@ yahoo.com
রানা আব্বাস : এমএস শিক্ষার্থী, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ, rana_geographer@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.