জবাবদিহি-গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কবে পেশাদার হয়ে উঠবে? by শেখ হাফিজুর রহমান
সাম্প্রতিককালে যে খবরটি আমাদের মনে কৌতূহল সৃষ্টি করেছে, তা হলো ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক মামলায় গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তাদের আটক ও জিজ্ঞাসাবাদের ঘটনা। যেকোনো দেশে গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্ব দেশ ও জনগণের নিরাপত্তার বিরুদ্ধে হুমকি বা নাশকতা মোকাবিলা করা। সেখানে গোয়েন্দা
বিভাগের লোকজনই যদি এ ধরনের গুরুতর অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হন, জনমনে তা গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করে বৈকি।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই আমরা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে একের পর এক নৃশংস সব হত্যাকাণ্ড হতে দেখলাম। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নৃশংসভাবে খুন হলেন। কারাগারের অভ্যন্তরে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হলো জাতীয় চার নেতাকে। চট্টগ্রামে নিহত হলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। ’৭৭ সালে এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানের দায়ে বিমানবাহিনীর অনেক সদস্যকে জীবন দিতে হয়েছে। এর পরও নানা অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানে বিমানবাহিনী ও সেনাবাহিনীর অনেক সদস্যকে নির্বিচারে হত্যা করা হলো। কিছুদিন আগে, অর্থাৎ ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি, পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে। এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে একদিকে বাংলাদেশের প্রশাসন, রাজনীতি, রাজনৈতিক সংগঠন ও সামরিক বাহিনীর অন্তর্গত ও সাংগঠনিক দুর্বলতাগুলো যেমন প্রকাশ পেয়েছে, তেমনি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর চরম ব্যর্থতা।
রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নৃশংস সব হত্যাকাণ্ডের আগাম তথ্য দিতে না পারা, ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক মামলায় জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার (এনএসআই) কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা, বিডিআর বিদ্রোহের আগাম তথ্য দিতে ব্যর্থতা এবং রমনা বটমূল ও উদীচী বোমা হামলার ব্যাপারে কোনো তথ্য দিতে না পারা বাংলাদেশে সক্রিয় বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার জবাবদিহি ও তাদের কর্মপদ্ধতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সামরিক ও অনির্বাচিত সরকারের আমলেই নয়, নির্বাচিত সরকারের আমলেও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো হয়ে উঠেছে ‘রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্র’। দুটি উদাহরণ এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হবে। বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা তদন্তে গঠিত সরকারের কমিটি ঘটনার পেছনের মূল কারণ উদ্ঘাটন করতে পারেনি। এর অন্যতম কারণ হিসেবে কমিটি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা না পাওয়ার কথা উল্লেখ করেছে। (প্রথম আলো, ২৪ মে, ২০০৯) গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের কর্মপরিধি এবং কর্মপদ্ধতি নিয়েও দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। গোয়েন্দা সংস্থার একের পর এক ব্যর্থতা ও তাদের জবাবদিহিহীনতা বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সম্পর্কে ঔৎসুক্য তৈরি করে। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আমি দুটি কলাম লিখি, যা ২০০৯ সালে প্রথম আলো পত্রিকায় ছাপা হয়। একটি লেখার শিরোনাম ছিল ‘গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে ঢেলে সাজাতে হবে’। অপরটির শিরোনাম ছিল ‘গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যেন রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্র হয়ে না ওঠে’।
১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ডিরেক্টরেট অব ফোর্সেস ইন্টিলিজেন্স বা ডিএফআই সশস্ত্র বাহিনীর অধীনে ছিল। পরে এটি রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের অধীনে নিয়ে আসা হয়। ১৯৯১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু হলে এটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েরও অধীনে চলে যায়। ১৯৭৭ সালে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টিলিজেন্স বা ডিজিএফআই। প্রথম মহাপরিচালক ছিলেন এয়ারভাইস মার্শাল কেএম আমিনুল ইসলাম।
২০০৯ সালের নভেম্বর মাসে আমি যখন সুইজারল্যান্ডে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছিলাম, তখন লন্ডনভিত্তিক মুক্তাঙ্গন ব্লগে প্রকাশিত ডিজিএফআই-সম্পর্কিত একটি ছোট প্রবন্ধ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এর লেখক মাসুদ করিম লিখেছেন, ‘১৯৭৭ সালে পাকিস্তানের সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট জেনারেল গোলাম জিলানি খান বাংলাদেশ সফরে আসেন। তিনি ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের সর্বোচ্চ গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালে গোলাম জিলানী খান ইস্টার্ন কমান্ডের চিফ অব স্টাফ ছিলেন। সামরিক পদবিতে তখন তিনি ব্রিগেডিয়ার। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের গণহত্যার অন্যতম পরিকল্পনাকারী এবং বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে তাঁর ছিল সক্রিয় ভূমিকা। ১৯৭১ সালের মাঝামাঝি সময়ে তাঁকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে
পাকিস্তানের সর্বোচ্চ গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের মহাপরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।’ (http://warcriminalin bangladesh.blogspot.com)
মাসুদ করিম আরও লিখেছেন, ‘শুরুতে ডিএফআইয়ের (অর্থাৎ ডিজিএফআই) সকল অফিসারের প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিল পাকিস্তানের আইএসআই। এখন ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইংল্যান্ডে।’ ডব্লিউ ডব্লিউ ডব্লিউ ডট বিডি মিলিটারি ডট কম থেকে মাসুদ করিমের দেওয়া তথ্যের সমর্থন পাচ্ছি। তবে ডিজিএফআই আইএসআইয়ের আদলে প্রতিষ্ঠিত কি না, ডিজিএফআইয়ের ওপর আইএসআইয়ের কতটা নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, এ ব্যাপারে এ ওয়েবসাইটে কোনো তথ্য নেই। তবে ডিজিএফআইয়ের ঘাড়ে পাকিস্তানের ভূত রয়েছে বলে মাসুদ করিম যে তথ্য দিয়েছেন, তার সমর্থন পাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা একটি বইয়ে।
১৯৯৩ সালে আগামী প্রকাশনী থেকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের জন্ম শীর্ষক একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ওই গ্রন্থের ৩০ পৃষ্ঠায় শেখ হাসিনা লিখেছিলেন, ‘(রাষ্ট্রপতি জিয়া) গোয়েন্দা সংস্থাকে দিয়ে দল গঠন করা এবং রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রক্রিয়া শুরু করেন... এবং এনএসআই ও ডিজিএফআইকে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের মডেলে তৈরি করেন।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘আজও দেশের রাজনীতি গোয়েন্দা সংস্থার নিয়ন্ত্রণে। স্বৈরশাসকদের চরিত্র হচ্ছে কাউকে বিশ্বাস না করা। জিয়া ও এরশাদ কাউকে বিশ্বাস করতেন না বলেই গোয়েন্দা সংস্থার ওপর নির্ভর করতেন।’
সামরিক বাহিনীর সর্বোচ্চ গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে ডিজিএফআইয়ের দায়িত্ব হচ্ছে সশস্ত্র বাহিনীর ভেতরে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে সরকারকে পরামর্শ প্রদান করা। কিন্তু আমরা দেখলাম যে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ড, এক ডজন সেনা অভ্যুত্থান, সাম্প্রতিক বিডিআর বিদ্রোহের আগাম তথ্য প্রদান করতে ডিজিএফআই চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। উপরন্তু বিভিন্ন সরকারের আমলে ডিজিএফআই নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে ডিজিএফআইয়ের প্রধান কাজ ছিল তাঁর ক্ষমতার ভিত পাকা করতে একটি রাজনৈতিক দল গঠনে সাহায্য করা। ১৯৭৮ সালে তিনি ডানপন্থী ও বামপন্থী রাজনৈতিক নেতাদের সমন্বয়ে গড়ে তোলেন একটি নতুন দল। শুরু হয় বিএনপির পদযাত্রা। জিয়াউর রহমানের বিয়োগান্ত মৃত্যুর কয়েক মাস পর ক্ষমতার রঙ্গমঞ্চে জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আগমন ঘটে। তিনিও ডিজিএফআইয়ের সহায়তায় বিভিন্ন দল থেকে লোক ভাগিয়ে নিয়ে জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৯০ সালে সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হওয়ার পর জাতীয় রাজনীতিতে সামরিক বাহিনী ও ডিজিএফআইয়ের আগের প্রাধান্য কিছুটা খর্ব হলেও তাদের প্রভাব থেকে যায়। প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের বিরোধের সূত্র ধরে ২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর ডিজিএফআই আবার আলোচনায় চলে আসে। তাদের উদ্ভাবিত ‘মাইনাস টু থিওরি’ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে দীর্ঘদিন আলোচনা ও সমালোচনার বিষয় হয়ে থাকবে।
আমরা যে কথাটি বলতে চাই, তা হচ্ছে, সশস্ত্র বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে ডিজিএফআই তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব দক্ষতার সঙ্গে পালনের চেষ্টা করবে। আমরা চাইব, ডিজিএফআই সশস্ত্র বাহিনীর ভেতরে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে সরকারকে পরামর্শ দেবে। আমরা চাইব, তাদের গোয়েন্দা তৎপরতা ও আগাম তথ্য প্রদানের ফলে কোনো রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান আর খুন হবেন না, আর কোনো সেনা অভ্যুত্থান ঘটবে না কিংবা ব্যর্থ করা সম্ভব হবে বিডিআর বিদ্রোহের মতো নৃশংস ও বিয়োগান্ত ঘটনা। কিন্তু আমরা কোনোভাবেই চাইব না, ডিজিএফআই জবাবদিহিহীন একটি সংস্থা হয়ে থাকুক।
শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। hrkarzon@yahoo.com
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই আমরা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে একের পর এক নৃশংস সব হত্যাকাণ্ড হতে দেখলাম। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নৃশংসভাবে খুন হলেন। কারাগারের অভ্যন্তরে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হলো জাতীয় চার নেতাকে। চট্টগ্রামে নিহত হলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। ’৭৭ সালে এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানের দায়ে বিমানবাহিনীর অনেক সদস্যকে জীবন দিতে হয়েছে। এর পরও নানা অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানে বিমানবাহিনী ও সেনাবাহিনীর অনেক সদস্যকে নির্বিচারে হত্যা করা হলো। কিছুদিন আগে, অর্থাৎ ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি, পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে। এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে একদিকে বাংলাদেশের প্রশাসন, রাজনীতি, রাজনৈতিক সংগঠন ও সামরিক বাহিনীর অন্তর্গত ও সাংগঠনিক দুর্বলতাগুলো যেমন প্রকাশ পেয়েছে, তেমনি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর চরম ব্যর্থতা।
রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নৃশংস সব হত্যাকাণ্ডের আগাম তথ্য দিতে না পারা, ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক মামলায় জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার (এনএসআই) কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা, বিডিআর বিদ্রোহের আগাম তথ্য দিতে ব্যর্থতা এবং রমনা বটমূল ও উদীচী বোমা হামলার ব্যাপারে কোনো তথ্য দিতে না পারা বাংলাদেশে সক্রিয় বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার জবাবদিহি ও তাদের কর্মপদ্ধতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সামরিক ও অনির্বাচিত সরকারের আমলেই নয়, নির্বাচিত সরকারের আমলেও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো হয়ে উঠেছে ‘রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্র’। দুটি উদাহরণ এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হবে। বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা তদন্তে গঠিত সরকারের কমিটি ঘটনার পেছনের মূল কারণ উদ্ঘাটন করতে পারেনি। এর অন্যতম কারণ হিসেবে কমিটি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা না পাওয়ার কথা উল্লেখ করেছে। (প্রথম আলো, ২৪ মে, ২০০৯) গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের কর্মপরিধি এবং কর্মপদ্ধতি নিয়েও দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। গোয়েন্দা সংস্থার একের পর এক ব্যর্থতা ও তাদের জবাবদিহিহীনতা বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সম্পর্কে ঔৎসুক্য তৈরি করে। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আমি দুটি কলাম লিখি, যা ২০০৯ সালে প্রথম আলো পত্রিকায় ছাপা হয়। একটি লেখার শিরোনাম ছিল ‘গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে ঢেলে সাজাতে হবে’। অপরটির শিরোনাম ছিল ‘গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যেন রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্র হয়ে না ওঠে’।
১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ডিরেক্টরেট অব ফোর্সেস ইন্টিলিজেন্স বা ডিএফআই সশস্ত্র বাহিনীর অধীনে ছিল। পরে এটি রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের অধীনে নিয়ে আসা হয়। ১৯৯১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু হলে এটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েরও অধীনে চলে যায়। ১৯৭৭ সালে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টিলিজেন্স বা ডিজিএফআই। প্রথম মহাপরিচালক ছিলেন এয়ারভাইস মার্শাল কেএম আমিনুল ইসলাম।
২০০৯ সালের নভেম্বর মাসে আমি যখন সুইজারল্যান্ডে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছিলাম, তখন লন্ডনভিত্তিক মুক্তাঙ্গন ব্লগে প্রকাশিত ডিজিএফআই-সম্পর্কিত একটি ছোট প্রবন্ধ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এর লেখক মাসুদ করিম লিখেছেন, ‘১৯৭৭ সালে পাকিস্তানের সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট জেনারেল গোলাম জিলানি খান বাংলাদেশ সফরে আসেন। তিনি ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের সর্বোচ্চ গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালে গোলাম জিলানী খান ইস্টার্ন কমান্ডের চিফ অব স্টাফ ছিলেন। সামরিক পদবিতে তখন তিনি ব্রিগেডিয়ার। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের গণহত্যার অন্যতম পরিকল্পনাকারী এবং বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে তাঁর ছিল সক্রিয় ভূমিকা। ১৯৭১ সালের মাঝামাঝি সময়ে তাঁকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে
পাকিস্তানের সর্বোচ্চ গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের মহাপরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।’ (http://warcriminalin bangladesh.blogspot.com)
মাসুদ করিম আরও লিখেছেন, ‘শুরুতে ডিএফআইয়ের (অর্থাৎ ডিজিএফআই) সকল অফিসারের প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিল পাকিস্তানের আইএসআই। এখন ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইংল্যান্ডে।’ ডব্লিউ ডব্লিউ ডব্লিউ ডট বিডি মিলিটারি ডট কম থেকে মাসুদ করিমের দেওয়া তথ্যের সমর্থন পাচ্ছি। তবে ডিজিএফআই আইএসআইয়ের আদলে প্রতিষ্ঠিত কি না, ডিজিএফআইয়ের ওপর আইএসআইয়ের কতটা নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, এ ব্যাপারে এ ওয়েবসাইটে কোনো তথ্য নেই। তবে ডিজিএফআইয়ের ঘাড়ে পাকিস্তানের ভূত রয়েছে বলে মাসুদ করিম যে তথ্য দিয়েছেন, তার সমর্থন পাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা একটি বইয়ে।
১৯৯৩ সালে আগামী প্রকাশনী থেকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের জন্ম শীর্ষক একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ওই গ্রন্থের ৩০ পৃষ্ঠায় শেখ হাসিনা লিখেছিলেন, ‘(রাষ্ট্রপতি জিয়া) গোয়েন্দা সংস্থাকে দিয়ে দল গঠন করা এবং রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রক্রিয়া শুরু করেন... এবং এনএসআই ও ডিজিএফআইকে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের মডেলে তৈরি করেন।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘আজও দেশের রাজনীতি গোয়েন্দা সংস্থার নিয়ন্ত্রণে। স্বৈরশাসকদের চরিত্র হচ্ছে কাউকে বিশ্বাস না করা। জিয়া ও এরশাদ কাউকে বিশ্বাস করতেন না বলেই গোয়েন্দা সংস্থার ওপর নির্ভর করতেন।’
সামরিক বাহিনীর সর্বোচ্চ গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে ডিজিএফআইয়ের দায়িত্ব হচ্ছে সশস্ত্র বাহিনীর ভেতরে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে সরকারকে পরামর্শ প্রদান করা। কিন্তু আমরা দেখলাম যে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ড, এক ডজন সেনা অভ্যুত্থান, সাম্প্রতিক বিডিআর বিদ্রোহের আগাম তথ্য প্রদান করতে ডিজিএফআই চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। উপরন্তু বিভিন্ন সরকারের আমলে ডিজিএফআই নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে ডিজিএফআইয়ের প্রধান কাজ ছিল তাঁর ক্ষমতার ভিত পাকা করতে একটি রাজনৈতিক দল গঠনে সাহায্য করা। ১৯৭৮ সালে তিনি ডানপন্থী ও বামপন্থী রাজনৈতিক নেতাদের সমন্বয়ে গড়ে তোলেন একটি নতুন দল। শুরু হয় বিএনপির পদযাত্রা। জিয়াউর রহমানের বিয়োগান্ত মৃত্যুর কয়েক মাস পর ক্ষমতার রঙ্গমঞ্চে জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আগমন ঘটে। তিনিও ডিজিএফআইয়ের সহায়তায় বিভিন্ন দল থেকে লোক ভাগিয়ে নিয়ে জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৯০ সালে সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হওয়ার পর জাতীয় রাজনীতিতে সামরিক বাহিনী ও ডিজিএফআইয়ের আগের প্রাধান্য কিছুটা খর্ব হলেও তাদের প্রভাব থেকে যায়। প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের বিরোধের সূত্র ধরে ২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর ডিজিএফআই আবার আলোচনায় চলে আসে। তাদের উদ্ভাবিত ‘মাইনাস টু থিওরি’ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে দীর্ঘদিন আলোচনা ও সমালোচনার বিষয় হয়ে থাকবে।
আমরা যে কথাটি বলতে চাই, তা হচ্ছে, সশস্ত্র বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে ডিজিএফআই তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব দক্ষতার সঙ্গে পালনের চেষ্টা করবে। আমরা চাইব, ডিজিএফআই সশস্ত্র বাহিনীর ভেতরে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে সরকারকে পরামর্শ দেবে। আমরা চাইব, তাদের গোয়েন্দা তৎপরতা ও আগাম তথ্য প্রদানের ফলে কোনো রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান আর খুন হবেন না, আর কোনো সেনা অভ্যুত্থান ঘটবে না কিংবা ব্যর্থ করা সম্ভব হবে বিডিআর বিদ্রোহের মতো নৃশংস ও বিয়োগান্ত ঘটনা। কিন্তু আমরা কোনোভাবেই চাইব না, ডিজিএফআই জবাবদিহিহীন একটি সংস্থা হয়ে থাকুক।
শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। hrkarzon@yahoo.com
No comments