বিলেতের স্ন্যাপশট-এবং রবীন্দ্রনাথ by শামীম আজাদ

বিলেতে বসন্তের মুখে সোনার বাটির মতো ড্যাফোডিল ফুল ফোটে। তারই একটি প্রজাতির নাম নার্সিসি-নার্সিসাস। খালের পাড়ে পাড়ে, পার্কের ঢালে, সরল সবুজ ডাঁটায় সে ফুল মাথা বাঁকিয়ে নিচের দিকে, তার গোড়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। কথিত আছে, রাজকুমার নার্সিসাস নাকি ঝিলের জলে নিজের রূপের দিকে ওভাবেই চেয়ে চেয়ে শেষ হয়ে


গিয়েছিলেন। একদিন বহু বছর পর সে ঝিলের পাড়েই, সে স্থানেই জেগে উঠল এক নতুন চারা। দেখা দিল কলি। ফুটে উঠল সোনালি ফুল। কিন্তু সে ফুল সূর্যের দিকে নয়, হাওয়ার মোড়ে মোড়ে নয়, চেয়ে রইল নিজের দিকেই। তাই তার নাম হলো ‘নার্সিসাস’। তাই ওই ড্যাফোডিল ফুল দেখলেই আমার তাঁর কথা মনে হয়। রবীন্দ্রনাথের কথা মনে হয়, যে রবীন্দ্রনাথ নিজের রূপের স্বরূপ প্রত্যক্ষ করেছেন নিজ সৃষ্টিতেই বারবার—তৃপ্ত বোধ করেছেন। তিনি মূলত তাহাকেই ভালোবাসিয়াছেন শতরূপে শতবার।
রবীন্দ্রনাথ ৭০ বছর (১২৮৩ থেকে ১৩৪৮) ধরে যা লিখেছেন, তাতে সৌন্দর্যের আর কিছু বাকি থাকেনি। অতগুলো বছরে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, গান, সংগীত, চিত্র, নাটক এবং তাত্ত্বিক প্রবন্ধ—যা কিছু লিখেছেন, তার সবই ‘কবি’ রবীন্দ্রনাথেরই লেখা। তাত্ত্বিক প্রাবন্ধিক বা নাট্যকার বা ঔপন্যাসিক রবীন্দ্রনাথ কবিতা লেখেননি। তাঁর সৃষ্টির সব জায়গায়ই এক বিমুগ্ধ ও নিপুণ কবি-কারিগরের সত্তা ভাস্বর হয়ে আছে।
তাঁরই কথা ছিল ‘প্রকাশই কবিত্ব’। আর সে কথা জ্ঞানের নয়, ভাবের। জ্ঞানের কথা প্রমাণ করতে হয়, ভাবের কথা ধারণ করতে হয়—তারপর তাঁর সঞ্চার হয় ভাবগাছের শাখায় শাখায় লতাপাতা ও ফুলে। জ্ঞানের কথা প্রমাণ করে দিলে জানা হয়ে যায়। আত্মস্থ হয়ে গেলে তা আর জানতে হয় না। তা প্রমাণ করার দরকার না হলে আবার তা পড়ার ইচ্ছেও করে না। অনেকটা ‘ফটো’র মতো। চলমান জীবনের ফটো তুলে এনে তার ওপর আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়ি। কিন্তু সেই একবারই। প্রয়োজন না হলে আমরা সেই ফটোগুলো আবার দেখি না। কিন্তু গান বারবার শুনি। একই গান সারা জীবনে বহুবার। পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে নবরূপে তা ধরা দেয়। আমার কাছে বিশুদ্ধ সাহিত্যকে ‘ফটো’ আর ভাবের সাহিত্যকে ‘গান’ মনে হয়। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য-কবিতা আমাদের তেমন এক ধরনের গান। পড়লেও মনে মনে তা শুনতে পাই। তাই তাঁর কবিতা আমরা একবার দেখি আর বারবার শুনি। বারবার পড়ি আর বহুবার ‘বুঝি’।
‘মূর্ধন্য’ প্রকাশনী বাংলাদেশ থেকে তাঁর সার্ধশততম বার্ষিকীতে রবীন্দ্রনাথের ওপর লেখা ১৫১টি গ্রন্থ প্রকাশ করছে। আমি তাঁর একটি—তাঁর জন্মদিনে এ নিয়ে কাজ করেছি এই বিলেতে-লন্ডনে বসে, যেখানে কবি তাঁর প্রথম যৌবনে এসেছিলেন পড়তে। যে দেশের সঙ্গে তাঁর বাবা ও দাদার ছিল মর্মের যোগ। যে দেশের শত কাজের সঙ্গে তাঁর ছবি, গান ও কবিতার বহু যোগাযোগ। এই বিশাল আয়োজনের সম্পাদক সাহিত্যিক মঞ্জুরে মওলা। তাঁরা যখন আমাকে তাঁদের এই শিল্পযাত্রার সঙ্গী করে নিয়েছেন, তখন মার্চ মাস। এখানে বসন্ত। দুর্দান্ত ডাকাতের মতো আমার সারা বাগানটাই ড্যাফোডিলের দখলে। সে বড় আশ্চর্য যোগ এবং এ আমার এক পরম আনন্দের সুযোগ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবিতকালে প্রকাশিত এটিই শেষ কাব্যগ্রন্থ, যাতে মৃত্যুর কাছাকাছি সময়ের রচনাও রয়েছে। তাঁর অন্যান্য কাব্যের তুলনায় জন্মদিনে চিন্তায় বহুরৈখিক না হলেও এতে পাওয়া যায় এক সুতোয় বোনা কবিজীবন। এ গ্রন্থে আমরা পেয়েছি তাঁর জীবনবাদ, বিভিন্ন জন্মদিনের স্মৃতি, সমসাময়িক প্রসঙ্গ, কবির আত্মোপলব্ধি ও অনুশোচনা, মৃত্যু-ভাবনা, যুদ্ধ ও বৈশ্বিক সংকটসহ নানা বিষয়। কিন্তু সবই এসেছে প্রকৃতির নরম পালকে মুড়ে। এ গ্রন্থ রবীন্দ্রপিপাসুদের চোখে তাঁর সেই অলৌকিক আয়নায় আলো ফেলতে উদ্বুদ্ধ হতে প্ররোচনা দেবে বলে আমার ভাবতে ইচ্ছে হয়। আমাদের মনকে বারবার হরণ করে। লৌকিক নয়, অলৌকিক স্বপ্নের মতো। স্বপ্ন-কারিগরের সুনির্মাণের কারণে তা যেকোনো সুখস্বপ্নের মতোই তাই সবাই দেখতে চায়। আর চাইলেই তা পারে। জন্মদিনের তাঁর এ অনন্ত যাত্রার ‘ফটো’ বাদ দিলে তা আমাদের সবার হয়ে যায়। হয়ে উঠেছে।
এখানে তাঁকে নিয়ে অনুষ্ঠান, আলোচনা, উৎসব জমে উঠেছে। দেড় শ বছর পর নতুন প্রজন্ম তাঁকে তাদের চিন্তা-চেতনায় মিলিয়ে দেখছে। পুরোনোরাও আছেন আশপাশে। সত্যেন সেন স্কুল অব পারফর্মিং আর্টস, উদীচী, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ভারতীয় বিদ্যাভবন, সংহতি সাহিত্য পরিষদ—সবাই ব্যস্ত। উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী ইউকে কয়েক মাস ধরে তাঁর ওপর অনুষ্ঠান করে চলেছে। তাতে অতিথি হয়ে এসেছিলেন রবীন্দ্র অনুবাদক কেতকী কুশারি ডাইসন। রবীন্দ্র গবেষক প্রফেসর উইলিয়াম রাদিচের সঙ্গে জন্মদিনে নিয়ে কথা বলার জন্য ই-মেইল করে তাঁর উত্তরে দেখি, তিনি তা-ই নিয়ে প্রায় বিশ্ব ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এদিকে লন্ডন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ২৫ বৈশাখে তাদের বার্ষিক ‘বই-লিট’ ২০১১ উৎসবে (বৈশাখী লিটারেচার ফেস্টিভ্যাল) এ নিয়ে আসছে রবীন্দ্রনাথের ওপর স্টোরিটেলিং, ইংরেজি-বাংলায় শেষের কবিতার সঙ্গে নতুন আঙ্গিকে তাঁর গান, ছবি ও ফ্যাশন। মজার কথা হলো, এদিনই লন্ডনে হচ্ছে বাংলাদেশিদের সবচেয়ে বড় উৎসব বৈশাখী মেলা। গত বছর যাতে ৮০ হাজার মানুষের সমাগম হয়েছিল। আর এই বিশাল আয়োজনেও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র নিয়ে যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথের ছড়া, কবিতা ও নাচ।
এদিকে বাগানে সে ফুলের কাল শেষ হয়ে এখন টিউলিপ ফুটছে, ব্লুবেল ফুটছে। আমি তাদের মিথ জানি না। কিন্তু তাঁর মতোই চির নতুনের ডাক এই বৈশাখে দেশ থেকে এত দূরে থেকেও পেয়ে যাই।
লন্ডন
শামীম আজাদ: কবি ও সাংবাদিক।
shetuli@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.