ওষুধের নিম্নমান ও মূল্যবৃদ্ধি by রেজাউল ফরিদ খান

ওষুধ যেকোনো জাতির স্বাস্থ্যরক্ষায় মৌলিক, অপরিহার্য ও প্রয়োজনীয় উপাদান- বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এ মন্তব্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রোগমুক্তির জন্য ওষুধের কোনো বিকল্প নেই। অসুখ হলে ওষুধ কিনতে হবে ও নিয়মমতো গ্রহণ করতে হবে; কিন্তু রোগজনিত কষ্ট লাঘব ও নিরাময়ের জন্য গুণগত মানসম্পন্ন ওষুধের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।


ওষুধ অন্যান্য পণ্যের মতো নয়, এটি স্বাস্থ্যসেবার একটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বস্তু। আমাদের জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে ওষুধ গভীরভাবে জড়িত। মানসম্পন্ন Active Pharmaceutical Ingredient বা ওষুধের মূল উপাদান অবশ্যই যথাযথ গুণসম্পন্ন হতে হবে। ওষুধ উৎপাদনের সার্বিক ব্যবস্থাপনা অর্থাৎ প্লান্ট বা ফ্যাক্টরি, উন্নত যন্ত্রপাতি, স্টেরালাইজেশনসহ Total Quality Control নিশ্চিত করেই ওষুধ প্রস্তুত করা হয়। মাননিয়ন্ত্রণে একটু গরমিল হলেই ওষুধের কার্যকর গুণাবলি থাকে না, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, এমনকি মৃত্যুও ঘটতে পারে। সার্বিক বিবেচনায় রোগ নিরাময়ে গুণগত ওষুধের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির বৈঠকের (২২ মার্চ ২০১২) সিদ্ধান্ত অনুযায়ী 'নিম্নমানের ওষুধ তৈরির অভিযোগে ২৬ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর।' সূত্র দৈনিক প্রথম আলো, ২৩ মার্চ ২০১২, পৃষ্ঠা ২১। ওষুধ উৎপাদক কম্পানিগুলো তদন্তের জন্য ২৯ জুলাই ২০০৯ সালে একটা উপকমিটি গঠন করা হয়। ৩ জুলাই ২০১১ সালে দেশের ১৫১টি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সার্বিক চিত্রের প্রতিবেদন সংসদীয় উপকমিটিতে উপস্থাপিত হয়েছিল। উপকমিটি ৬২টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে।
নিম্নমানের ওষুধ বিষয়ের সংবাদটি কিছুটা সত্য হলেও আতঙ্কের কারণ। ওষুধ হচ্ছে জীবনরক্ষাকারী উপাদান, এটির গুণগত মান নিয়ে তদন্তের তথ্যাবলি সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ভালোভাবে কাভারেজ পাওয়া উচিত ছিল। তদন্তের তালিকায় অধিকাংশ মধ্যম ও ছোট কম্পানি থাকলেও শীর্ষ ১০টির একটি ছিল। ২৭ মার্চ ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত 'সংবাদের প্রতিবাদ' শিরোনামে ওই শীর্ষ ওষুধ কম্পানির নাম দেওয়াকে মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেছেন। কোনো অধিদপ্তর কোনো কম্পানিকে বিরাট জায়গাজুড়ে প্রথম পৃষ্ঠায় প্রতিবাদ দিতে পারে কি না কিংবা কোড অব ফার্মাসিউটিক্যালস এথিকস অনুমোদন করে কি না জানা দরকার। ওই প্রতিবাদে অন্য কোনো কম্পানি সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি।
ওষুধের বিষয়টি স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন তৈরি, সংসদীয় বৈঠকে উপস্থাপন, দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত ইত্যাদি শুরু হয়েছে ২০০৯ সালে। ২০১২ সালে জনগণ কিছু কম্পানির নাম জানল, ওষুধের মূল উপাদান, মাননিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি কোনটিতে তাদের ত্রুটি সেটি জনগণকে জানানো হলো না। ঢালাওভাবে নিম্নমান বা মানসম্পন্ন ওষুধ তৈরি করে না- এ জাতীয় মন্তব্য কতটুকু যৌক্তিক, ভেবে দেখা দরকার। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক 'সংবাদের রিজয়েনডার' শিরোনামে আরেকটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সংবাদ প্রকাশের আগে ওষুধ প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে সংবাদ প্রকাশের জন্য বলেছেন। যে বৈঠকে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সচিব উপস্থিত থেকে রিপোর্ট প্রদান করেন, সংসদীয় কমিটির সে রিপোর্ট আবার ওষুধ অধিদপ্তর থেকে অনুমোদন নিতে হবে কেন, এটা বোধগম্য নয়। চিকিৎসার জন্য মানসম্পন্ন ওষুধ অত্যাবশ্যক। এ ব্যাপারে ওষুধ প্রশাসনের জোরদার ভূমিকা দরকার। নিয়মিত উৎপাদক কম্পানিগুলোর কার্যক্রম পরিদর্শন, মাননিয়ন্ত্রণ পর্যবেক্ষণ ও তদারকি প্রয়োজন। অধিদপ্তরে যথেষ্ট জনবল নেই এটা আংশিক সত্য, তবে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
গত ৫ এপ্রিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংবাদ সম্মেলনে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর একটি কম্পানির পক্ষে বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে যে বিজ্ঞাপন ছেপেছে তার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। এ সময় মন্ত্রী বলেন, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এ রকম বিজ্ঞাপন না ছাপলেও পারত।
ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি : সম্প্রতি বেশ কিছু জীবন রক্ষাকারী ওষুধসহ অন্যান্য ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি করেছে দেশের ওষুধ কম্পানিগুলো। বিশেষ করে ক্রনিক রোগের জন্য গ্রহণকারী ওষুধগুলো, বিশেষ করে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ইত্যাদি ওষুধের দাম অনেক বাড়ানো হয়েছে। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকার মুখ্য ভূমিকা পালনের সুযোগ পেত। ১৯৯১ সালে সরকারি নির্দেশনায় আটটি শর্ত সাপেক্ষে বলা হয়েছে, অত্যাবশ্যকীয় ১১৭টি ওষুধের মধ্যে কমপক্ষে ৬০টি ওষুধ যে কম্পানি তৈরি করবে তারা ওই ওষুধের মূল্য নির্ধারণের সুযোগ পাবে। দেশের অধিকাংশ ওষুধ উৎপাদক কম্পানিই অত্যাবশ্যকীয় ৬০টি ওষুধ উৎপাদন করে না বলে বিভিন্ন তথ্যে জানা গেছে। ১৯৯১ সালের নির্দেশনাটি পরিমার্জনা করা অত্যন্ত জরুরি, যা ওষুধের মূল্যবৃদ্ধিতে কিছুটা নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করবে। বাংলাদেশে বর্তমানে ২১ হাজার ব্র্যান্ডের ওষুধ তৈরি করে থাকে প্রায় ২৫০টি কম্পানি। কোনো ঘোষণা ছাড়াই অধিকাংশ কম্পানি ক্যান্সার, কিডনির ওষুধসহ বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিকের দাম বাড়িয়েছে। বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতি বিভিন্ন কম্পানির সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে অল্প পরিমাণে ওষুধের দাম বৃদ্ধি করে সেটি সংবাদপত্রের মাধ্যমে জনগণকে জানানো উচিত ছিল।
ওষুধ কেউ শখ করে কেনে না, রোগ নিরাময়ের জন্যই ওষুধের দরকার। একধাপে অত্যধিক মূল্যবৃদ্ধি রোগীর জন্য বাড়তি বোঝা। স্বাস্থ্য মানুষের মৌলিক চাহিদা, আর ওষুধ প্রয়োজনীয় উপাদান। ওষুধের ন্যায্য মূল্য অবশ্যই নির্ধারিত হবে; কিন্তু অযৌক্তিকভাবে নয়। বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতি ওষুধের মূল্যবৃদ্ধির বেশ কয়েক দিন পর পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে বলেছে, দেশে উৎপাদিত ২১ হাজার ব্র্যান্ডের ৫ শতাংশের বেশি দাম বাড়ানো হয়নি। কিন্তু কোন ওষুধের মূল্য কত শতাংশ বৃদ্ধি করেছে কম্পানিগুলো সেটা এড়িয়ে গেছে।

লেখক : জনস্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষক

No comments

Powered by Blogger.