শিবের গীত-নড়েচড়ে বসা, ছিনিমিনি খেলা by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
একটি জাতীয় দৈনিকে ‘অপরাধ জগতের নতুন আস্তানা’ নিয়ে একটি খবর বেরিয়েছে এপ্রিলের ৬ তারিখে। ফার্মগেটের একটি হোটেলে থানা গেড়ে এক অপরাধী চক্র দীর্ঘদিন অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিল। হোটেলটিতে একটি টর্চার সেলও ছিল, যেখানে অপহূতদের ধরে এনে শারীরিক নির্যাতন করা হতো।
অবাক কাণ্ড, তেজগাঁও থানা থেকে দু-তিন শ গজ দূরত্বের এই হোটেলে যে এমন ভয়ানক কাজ চলছে, পুলিশ তা এত দিন টেরই পায়নি। যা হোক, দেরিতে হলেও পুলিশ অপরাধীদের নয়জনকে ধরেছে। যদিও পালের গোদা পালিয়ে গেছে।
এ পর্যন্ত ঠিকই ছিল। নয়জন ধরা পড়েছে, পলাতককেও নিশ্চয় ধরে ফেলত পুলিশ। কিন্তু দৈনিকটি যখন লিখল, ‘রাজধানীতে এ ধরনের টর্চার সেল আবিষ্কার হওয়ার পর নড়েচড়ে বসেছে গোয়েন্দারা’ তখনই বোঝা গেল, ঘটনার এখানেই ইতি। সমস্যাটা ওই ‘নড়েচড়ে বসা’য়। এর আগে সংঘবদ্ধ গাড়িচোর দল এবং জাল নোটের কারবারিদের ক্ষেত্রে ওই নড়েচড়ে বসার পর গাড়ি চুরির ঘটনা এবং জাল নোটের প্রসার বেড়েছে। সাংবাদিক দম্পতি রুনি ও সাগর হত্যার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৪৮ ঘণ্টায় খুনি (রা) ধরা পড়বে বলে আশ্বাস দেওয়ার পর পুলিশ নড়েচড়ে বসায় ৪৮ দিন পরও হত্যারহস্যের একটা সুতাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। গুলশানে সৌদি কূটনীতিবিদ হত্যার পরও পুলিশ নড়েচড়ে বসেছিল এবং এই নড়েচড়ে বসাটাই ছিল ভুল। এখন সৌদি আরব থেকে তদন্ত দল এসে চেষ্টা করছে হত্যারহস্যের জট খুলতে।
যেসব মামলার খবরে পুলিশের নড়েচড়ে বসার উল্লেখ আছে, সেগুলো অনিষ্পন্ন থেকে গেছে। তাই নড়েচড়ে বসার ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যার দাবি রাখে। যদি এ রকম হতো, পুলিশ নড়ে উঠে জিপে বা মোটরসাইকেলে চড়ে বসল, তাহলে সমস্যা ছিল না। গাড়ি বা মোটরসাইকেল চালিয়ে অপরাধস্থলে যাওয়া যেত, অপরাধীকে ধাওয়া দেওয়া যেত। অর্থাৎ অপরাধীকে ধরার একটা চেষ্টা চলত। কিন্তু নড়েচড়ে বসা মানে ঝিম মারার অবস্থা থেকে খানিক উত্তেজনায় জেগে উঠে বসে থাকা। বসা মানে চেয়ারে বসা এবং বসে থাকা। চেয়ারে বসে থেকে দুনিয়ার কোন পুলিশ কবে দুর্ধর্ষ অপরাধীদের পাকড়াও করেছে, বলুন? বাংলা ভাই, গালকাটা কামাল, বা এরশাদ শিকদার—এদের কি চেয়ারে বসে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ?
পুলিশের নড়েচড়ে বসার খবরে অপরাধীরা খুশি হয়। পুলিশকে চেয়ারে বসিয়ে রাখার জন্য যা করার তখন তারা তা করে, যেমন তারা পালায়। তাই পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি অমলিন করতে হলে এর সদস্যদের নড়েচড়ে বসার পরিবর্তে নড়েচড়ে দাঁড়ানোর রেওয়াজটি চালু করতে হবে। নড়েচড়ে দাঁড়ালে পুলিশ চাইলেই একটা দৌড় দিতে পারে। বাংলাদেশে এই দৌড়ের কোনো বিকল্প নেই। ক্রমাগত দৌড়ের ওপর থাকলেই পুলিশ অপরাধীদের থেকে এগিয়ে থাকবে।
আমাদের পত্রপত্রিকাও পারে এ ব্যাপারে পুলিশকে সাহায্য করতে।
২. আমাদের শীর্ষ রাজনীতিকদের কথাবার্তায় ‘ছিনিমিনি খেলা’র বহুল ব্যবহার দেখে খেলাটি আসলে কী, তা জানতে উৎসাহ হলো। অভিধান খুলে দেখলাম, ছিনিমিনির অর্থ ‘জলে খোলামকুচি ছুড়িয়া খেলা: ইহাতে খোলাখণ্ড এমনভাবে ফেলিতে হয় যে তা জলের উপরিভাগ দিয়া জল কাটিতে কাটিতে বহুদূর যায়।’ খুবই সাধারণ, নিরীহ, যদিও অর্থহীন, এই খেলাকে কেন এত নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়? যেমন, প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, বিরোধী নেত্রী জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন এবং বিরোধী নেত্রী যখন বলেন, প্রধানমন্ত্রী জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন, তখন নিশ্চয় তাঁরা একে অপরের প্রশংসা করেন না। অথবা জাতিকে নিয়ে একটা নিরীহ গোছের কিছু করছেন, তাও বোঝান না। জাতিকে খোলামকুচির মতো ‘জলে ছুড়িয়া ফেলিতেছেন’—এ রকম ইঙ্গিতই তাঁরা দেন। লক্ষ করেছি, প্রতিদিনের কাগজে এবং টেলিভিশন সংবাদে ছিনিমিনি খেলার উল্লেখ থাকে। ছিনিমিনি তাহলে নেতা-নেত্রীদের প্রিয় একটি খেলা। এই খেলাটি এখন অলিম্পিকে ঢোকানো গেলে এর স্বর্ণপদকটি নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশ জিতে নেবে। আমরা যদি হা-ডু-ডু এবং খো খো খেলাকে আঞ্চলিক প্রতিযোগিতামূলক সূচিতে ঢোকাতে পারি, তাহলে ছিনিমিনি খেলাকেও নিশ্চয় অলিম্পিকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারব এবং সেই খেলায় অংশগ্রহণের জন্য সরকার ও বিরোধী দলের সব বড় নেতা-নেত্রীই বিদেশে যেতে পারবেন। এতে তাঁদের ভেতর সৌহার্দ্য বাড়বে। আমি দেখেছি, বিরোধী দল সংসদ বর্জন করলেও সংসদীয় কোনো ডেলিগেশন বিদেশ গেলে তাতে বিরোধীদলীয় সদস্যরা থাকেন। বিদেশ-ভ্রমণের সুযোগ পেলে সাংসদেরা দল-মতনির্বিশেষে সানন্দে অংশগ্রহণ করেন। এতে তাদের প্রবল দেশপ্রেম প্রকাশ পায়। ছিনিমিনিজনিত সফরেও এই ধারা নিশ্চয় অব্যাহত থাকবে।
এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করতে সে জানাল, ছিনিমিনি খেলা একজনেরই খেলা, তাশ নিয়ে সলিটেয়ার বা প্যাশেন্স খেলার মতো। কিন্তু আমি তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বললাম, তাহলে ছিনিমিনিকে শুধু ছিনি খেলা অথবা মিনি খেলা বলা হতো। আমার ধারণা, এই খেলা যেহেতু দুজনে মিলে হয়, সেহেতু এর নাম ছিনিমিনি। একদলের নেতৃত্বে থাকে ‘ছিনি’ অন্যদলের ‘মিনি’। যদি এই খেলায় খোলামকুচির মতো কোনো কিছুকে, যথা একটি ফড়িং অথবা প্রজাপতির ভবিষ্যৎকে, জলে ‘ছুড়িয়া ফেলিতে’ হয়, তাহলে একা একা তা করলে আনন্দ পাওয়াটা কঠিন হবে। প্রতিদ্বন্দ্বী দুজন হলে আনন্দটা হবে প্রকৃত। আর খেলাধুলাতে যদি আনন্দই না থাকে, তাহলে খেলে কী লাভ, বলুন?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এ পর্যন্ত ঠিকই ছিল। নয়জন ধরা পড়েছে, পলাতককেও নিশ্চয় ধরে ফেলত পুলিশ। কিন্তু দৈনিকটি যখন লিখল, ‘রাজধানীতে এ ধরনের টর্চার সেল আবিষ্কার হওয়ার পর নড়েচড়ে বসেছে গোয়েন্দারা’ তখনই বোঝা গেল, ঘটনার এখানেই ইতি। সমস্যাটা ওই ‘নড়েচড়ে বসা’য়। এর আগে সংঘবদ্ধ গাড়িচোর দল এবং জাল নোটের কারবারিদের ক্ষেত্রে ওই নড়েচড়ে বসার পর গাড়ি চুরির ঘটনা এবং জাল নোটের প্রসার বেড়েছে। সাংবাদিক দম্পতি রুনি ও সাগর হত্যার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৪৮ ঘণ্টায় খুনি (রা) ধরা পড়বে বলে আশ্বাস দেওয়ার পর পুলিশ নড়েচড়ে বসায় ৪৮ দিন পরও হত্যারহস্যের একটা সুতাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। গুলশানে সৌদি কূটনীতিবিদ হত্যার পরও পুলিশ নড়েচড়ে বসেছিল এবং এই নড়েচড়ে বসাটাই ছিল ভুল। এখন সৌদি আরব থেকে তদন্ত দল এসে চেষ্টা করছে হত্যারহস্যের জট খুলতে।
যেসব মামলার খবরে পুলিশের নড়েচড়ে বসার উল্লেখ আছে, সেগুলো অনিষ্পন্ন থেকে গেছে। তাই নড়েচড়ে বসার ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যার দাবি রাখে। যদি এ রকম হতো, পুলিশ নড়ে উঠে জিপে বা মোটরসাইকেলে চড়ে বসল, তাহলে সমস্যা ছিল না। গাড়ি বা মোটরসাইকেল চালিয়ে অপরাধস্থলে যাওয়া যেত, অপরাধীকে ধাওয়া দেওয়া যেত। অর্থাৎ অপরাধীকে ধরার একটা চেষ্টা চলত। কিন্তু নড়েচড়ে বসা মানে ঝিম মারার অবস্থা থেকে খানিক উত্তেজনায় জেগে উঠে বসে থাকা। বসা মানে চেয়ারে বসা এবং বসে থাকা। চেয়ারে বসে থেকে দুনিয়ার কোন পুলিশ কবে দুর্ধর্ষ অপরাধীদের পাকড়াও করেছে, বলুন? বাংলা ভাই, গালকাটা কামাল, বা এরশাদ শিকদার—এদের কি চেয়ারে বসে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ?
পুলিশের নড়েচড়ে বসার খবরে অপরাধীরা খুশি হয়। পুলিশকে চেয়ারে বসিয়ে রাখার জন্য যা করার তখন তারা তা করে, যেমন তারা পালায়। তাই পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি অমলিন করতে হলে এর সদস্যদের নড়েচড়ে বসার পরিবর্তে নড়েচড়ে দাঁড়ানোর রেওয়াজটি চালু করতে হবে। নড়েচড়ে দাঁড়ালে পুলিশ চাইলেই একটা দৌড় দিতে পারে। বাংলাদেশে এই দৌড়ের কোনো বিকল্প নেই। ক্রমাগত দৌড়ের ওপর থাকলেই পুলিশ অপরাধীদের থেকে এগিয়ে থাকবে।
আমাদের পত্রপত্রিকাও পারে এ ব্যাপারে পুলিশকে সাহায্য করতে।
২. আমাদের শীর্ষ রাজনীতিকদের কথাবার্তায় ‘ছিনিমিনি খেলা’র বহুল ব্যবহার দেখে খেলাটি আসলে কী, তা জানতে উৎসাহ হলো। অভিধান খুলে দেখলাম, ছিনিমিনির অর্থ ‘জলে খোলামকুচি ছুড়িয়া খেলা: ইহাতে খোলাখণ্ড এমনভাবে ফেলিতে হয় যে তা জলের উপরিভাগ দিয়া জল কাটিতে কাটিতে বহুদূর যায়।’ খুবই সাধারণ, নিরীহ, যদিও অর্থহীন, এই খেলাকে কেন এত নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়? যেমন, প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, বিরোধী নেত্রী জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন এবং বিরোধী নেত্রী যখন বলেন, প্রধানমন্ত্রী জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন, তখন নিশ্চয় তাঁরা একে অপরের প্রশংসা করেন না। অথবা জাতিকে নিয়ে একটা নিরীহ গোছের কিছু করছেন, তাও বোঝান না। জাতিকে খোলামকুচির মতো ‘জলে ছুড়িয়া ফেলিতেছেন’—এ রকম ইঙ্গিতই তাঁরা দেন। লক্ষ করেছি, প্রতিদিনের কাগজে এবং টেলিভিশন সংবাদে ছিনিমিনি খেলার উল্লেখ থাকে। ছিনিমিনি তাহলে নেতা-নেত্রীদের প্রিয় একটি খেলা। এই খেলাটি এখন অলিম্পিকে ঢোকানো গেলে এর স্বর্ণপদকটি নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশ জিতে নেবে। আমরা যদি হা-ডু-ডু এবং খো খো খেলাকে আঞ্চলিক প্রতিযোগিতামূলক সূচিতে ঢোকাতে পারি, তাহলে ছিনিমিনি খেলাকেও নিশ্চয় অলিম্পিকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারব এবং সেই খেলায় অংশগ্রহণের জন্য সরকার ও বিরোধী দলের সব বড় নেতা-নেত্রীই বিদেশে যেতে পারবেন। এতে তাঁদের ভেতর সৌহার্দ্য বাড়বে। আমি দেখেছি, বিরোধী দল সংসদ বর্জন করলেও সংসদীয় কোনো ডেলিগেশন বিদেশ গেলে তাতে বিরোধীদলীয় সদস্যরা থাকেন। বিদেশ-ভ্রমণের সুযোগ পেলে সাংসদেরা দল-মতনির্বিশেষে সানন্দে অংশগ্রহণ করেন। এতে তাদের প্রবল দেশপ্রেম প্রকাশ পায়। ছিনিমিনিজনিত সফরেও এই ধারা নিশ্চয় অব্যাহত থাকবে।
এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করতে সে জানাল, ছিনিমিনি খেলা একজনেরই খেলা, তাশ নিয়ে সলিটেয়ার বা প্যাশেন্স খেলার মতো। কিন্তু আমি তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বললাম, তাহলে ছিনিমিনিকে শুধু ছিনি খেলা অথবা মিনি খেলা বলা হতো। আমার ধারণা, এই খেলা যেহেতু দুজনে মিলে হয়, সেহেতু এর নাম ছিনিমিনি। একদলের নেতৃত্বে থাকে ‘ছিনি’ অন্যদলের ‘মিনি’। যদি এই খেলায় খোলামকুচির মতো কোনো কিছুকে, যথা একটি ফড়িং অথবা প্রজাপতির ভবিষ্যৎকে, জলে ‘ছুড়িয়া ফেলিতে’ হয়, তাহলে একা একা তা করলে আনন্দ পাওয়াটা কঠিন হবে। প্রতিদ্বন্দ্বী দুজন হলে আনন্দটা হবে প্রকৃত। আর খেলাধুলাতে যদি আনন্দই না থাকে, তাহলে খেলে কী লাভ, বলুন?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments