কালের পুরাণ-ডাকসু নির্বাচন হয় না কেন? by সোহরাব হাসান

মঙ্গলবার ভোররাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে যে ভয়ংকর সংঘর্ষ হয়, তার সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের চর দখলের লড়াইয়ের তুলনা করা যেতে পারে। কেননা, চর দখলে যেসব রামদা, ছোরা, চাপাতি ব্যবহার করা হয়, সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের ছাত্র নামধারী ছাত্রলীগকর্মীরাও সেসব ব্যবহার করেছেন।


লাঠিয়ালদের পেছনে জোতদার থাকে, অস্ত্রধারী ক্যাডারদের নেপথ্যে আছে কথিত ছাত্রনেতৃত্ব। এত দিন আমরা প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রসংগঠনের কর্মীদের মধ্যে মারামারি, লাঠালাঠি, ছুরি-পিস্তল চালাচালি হতে দেখেছি। এখন প্রতিদ্বন্দ্বী না পেয়ে নিজেরাই দুই বা ততোধিক গ্রুপে ভাগ হয়ে এসব অঘটন ঘটাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ঘটনাকে বীভৎস বলে অভিহিত করেছেন। প্রশ্ন হলো, দেশের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বীভৎস ঘটনা কীভাবে ঘটল? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, হল প্রশাসন, প্রক্টর, প্রাধ্যক্ষরা কী করেছেন? ছাত্রাবাসে এই বিপুল পরিমাণ দেশি-বিদেশি অস্ত্রই বা কীভাবে ছাত্র নামধারীরা মজুদ করল?
মুহসীন হলের এ ঘটনা ৩৬ বছর আগের আরেকটি ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিল। ১৯৭৪ সালে এই মুহসীন হলেই ছাত্রলীগের এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের সাতজনকে হত্যা করেছিল ব্রাশফায়ারে। সেই হত্যাকাণ্ডের অন্যতম আসামি ছিলেন শফিউল আলম প্রধান, তৎকালীন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। বিচারে তাঁর কারাদণ্ড হয়েছিল। কিন্তু পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জিয়াউর রহমান তাঁকে সসম্মানে জেলখানা থেকে বের করে এনে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। সেই থেকে এককালের বঙ্গবন্ধুর সৈনিক জিয়া-খালেদার আশপাশেই ঘোরাঘুরি করছেন এবং সুযোগ পেলেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিষবাণ ছুড়ছেন। ছাত্রলীগ করার সময় প্রধানরা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের বাইরের সবাইকে দেশদ্রোহী মনে করতেন। অন্য সংগঠনের কর্মী কিংবা সাধারণ ছাত্রদেরও ছাত্রলীগের মিছিলে যেতে বাধ্য করতেন। ছাত্রলীগ প্রধানকে ত্যাগ করলেও তাঁর আদর্শ ত্যাগ করেনি। কয়েক মাস আগে ফজলুল হক হলে সংগঠনের মিছিলে যোগ না দেওয়ার শাস্তি হিসেবে বেশ কিছু ছাত্রকে তাদের আশ্রয়স্থল অতিথিকক্ষ থেকে মধ্যরাতে বের করে দিয়েছিল ছাত্রলীগ হল শাখার নেতৃত্ব। ১৯৭৪-এ সাত খুনের আসামি না হলে প্রধান এখন আওয়ামী লীগই করতেন এবং বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে তার জিহ্বা ছিঁড়ে ফেলতেন। যাক, সাত খুনের বিনিময়ে কিছু জিহ্বা তো রক্ষা পেল!
৩৬ বছর আগের ও পরের এই ঘটনা দুটোর মধ্যে একটি মিল লক্ষণীয়। দুটোই ঘটেছে নির্বাচিত ছাত্র সংসদের অনুপস্থিতিতে। ১৯৭৩ সালে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন যখন দেখল তাদের যৌথ প্যানেলের পরাজয় অবধারিত, তখন ব্যালট বাক্স ছিনতাই করল। আজীবন অহিংস বিপ্লবের অনুসারী ছাত্র ইউনিয়নের গায়ে কলঙ্ক লেপন হলো সেই একবারই, যা ঘষে ওঠাতে অনেক সময় লেগেছে। তবে ছাত্রলীগ ওসবের ধার ধারে না। দিনবদলের সহযাত্রীরা রামদা-চাপাতিতেই ভরসা রাখে।

২.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদকে (ডাকসু) বলা হয় দেশের দ্বিতীয় পার্লামেন্ট। পাকিস্তান আমল থেকে এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও ছাত্র-আন্দোলনে অনন্য ভূমিকা রেখেছে। ঊনসত্তরে স্বৈরাচারী আইয়ুবের বিরুদ্ধে যে ছাত্র-গণ-অভ্যুত্থান হয়, তার নেতৃত্বে ছিল ডাকসু, সে সময়ে ডাকসুর সহসভাপতি ছিলেন তোফায়েল আহমেদ। এরপর ডাকসুর সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হন যথাক্রমে আ স ম আবদুর রব ও আবদুল কুদ্দুস মাখন। পরবর্তীকালে আদর্শচ্যুতি ঘটলেও সে সময়ে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছেন এই দুই ছাত্রনেতা। স্বাধীনতার পর প্রথম ডাকসু নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও মাহবুব জামান। দীর্ঘ বিরতির পর ১৯৭৯ সালের ডাকসু নির্বাচনে সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন যথাক্রমে মাহমুদুর রহমান মান্না ও আখতারুজ্জামান, জাসদ-সমর্থিত ছাত্রলীগ থেকে (তাঁরা দুজনই এখন আওয়ামী লীগ নেতা)।
তখন রাজনৈতিক দল হিসেবে জাসদ বিরাট কিছু না হলেও ছাত্র-তরুণদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব ছিল। বিশেষ করে, সমাজবিপ্লব ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান অনেককেই আকৃষ্ট করত। পরপর তিনবার জাসদ-সমর্থিত ছাত্রলীগের প্যানেল ডাকসুতে বিজয়ী হয়। আবার এই ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে জিয়াউদ্দিন বাবলু ১৯৮৩ সালে স্বৈরাচারী এরশাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে প্রথমে ছাত্র উপদেষ্টা এবং পরে মন্ত্রী হন।
কেবল ডাকসু নয়, জিয়া-এরশাদের সামরিক শাসনামলে প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদের নির্বাচন হতো। নির্বাচন হতো কলেজ ছাত্র সংসদগুলোতেও। আশির দশকে এরশাদের বিরুদ্ধে যে ব্যাপক ছাত্র-আন্দোলন সংঘটিত হয়, তাতে নির্বাচিত ছাত্র সংসদগুলো অগ্রণী ভূমিকা পালন করে; যদিও ছাত্রনেতাদের কেউ কেউ দালালিও করেছেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের একপর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে পরিচিত রাজনৈতিক দলগুলো মিলে ১৫ দলীয় জোট গঠন করে এবং তাদের সমর্থক ছাত্রসংগঠনগুলো জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করে বিভিন্ন ছাত্রসংসদে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরকে পরাজিত করে। ডাকসুতে একবার সুলতান মোহাম্মদ মুনসুর সহসভাপতি ও মুশতাক হোসেন সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পরই ডাকসু ভবনে ছবি টাঙানোসহ তুচ্ছ বিষয়াদি নিয়ে মতভেদ দেখা দেয়। ফলে পরেরবার আলাদাভাবে নির্বাচন করে উভয় পক্ষ হেরে যায় এবং আমানউল্লাহ আমানের নেতৃত্বে বিএনপি-সমর্থক ছাত্রদলই জয়ী হয়। আমানই ডাকসুর সর্বশেষ নির্বাচিত সহসভাপতি। সেই নির্বাচনও হয়েছিল এরশাদ শাসনের শেষ বছর, ১৯৯০ সালে। এরপর ২১টি বছর পেরিয়ে গেলেও ডাকসুর নির্বাচন হয়নি। নির্বাচন হয়নি অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদেরও।
ক্ষমতাসীন দলের গণতন্ত্রপ্রেমী নেতারা কথায় কথায় জিয়া-এরশাদকে স্বৈরাচার বলে গাল দেন। তাঁরা যে স্বৈরাচার, এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই। সেই স্বৈরাচারের আমলে যদি ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচন হতে পারে, গণতান্ত্রিক আমলে হবে না কেন? স্বৈরাচারী আমলে যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচিত উপাচার্য পেতে পারে, এখন পাবে না কেন? সিন্ডিকেট তাদের দখলে, সিনেট তাদের দখলে, আচার্য তাদের—তার পরও এত ভয় কেন? দীর্ঘদিন ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ আছে কেন?
প্রতিবার ক্ষমতা বদলের পর কিছুদিন ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে কথাবার্তা শোনা যায়। তারপর চলে মারামারি লাঠালাঠি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এর কী জবাব দেবে? কী জবাব দেবে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ? তারা কি কখনো নির্বাচনের উদ্যোগ নিয়েছে? না নিলে কেন নেয়নি? আর নিয়ে থাকলে কারা বাধা দিয়েছেন? শিক্ষামন্ত্রী? প্রধানমন্ত্রী? এসব প্রশ্নের উত্তর তাদের দিতে হবে।
গত ২১ বছর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ভাগাভাগি করে দেশ শাসন করে আসছে। কখনো এককভাবে, কখনো শরিকদের নিয়ে। এই ২১ বছরেও কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নির্বাচন তারা করেনি। একে অপরের ওপর দোষ চাপিয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের দাবি, ছাত্র-শ্রমিকসহ সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যে তাদের বিপুল সমর্থন আছে। কিন্তু এই সমর্থনটি প্রমাণের উপায় কী? নির্বাচন। অথচ তারা ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচন কেন দিচ্ছে না। ডাকসুতে ছাত্রলীগ হেরে যাবে—এই ভয়ে? তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগ পরাজিত হলো। তাতে কি আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটবে?
ডাকসু নির্বাচন তথা প্রতিনিধি বাছাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩০ হাজার শিক্ষার্থীর অধিকার। সেই অধিকার থেকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা সরকার—কেউ তাদের বঞ্চিত করতে পারে না। নিয়মিত ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচন হলে ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতা থাকত, ক্যাম্পাসে সন্ত্রাস-মাস্তানি কমত। নির্বাচন হলে ছাত্রসংগঠনগুলো সাধারণ ছাত্রদের কাছে নিজ নিজ কর্মসূচি নিয়ে যেতে পারত। কোন সংগঠনের নীতি-আদর্শ, কর্মসূচি ভালো, তা পরখ করে দেখার সুযোগ পেত তারা। কিন্তু নির্বাচন না হওয়ায় ছাত্রনেতারা যা খুশি করছেন। হলে হলে মাস্তানি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চলছে। এর দায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা সরকার কী করে এড়াবে? বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসা দলটি তার সমর্থক ছাত্রসংগঠনটির জনপ্রিয়তা যাচাইয়ে এত ভয় পাচ্ছে কেন?
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ছাত্রসংগঠনগুলোর হানাহানি দেখে একবার ছাত্ররাজনীতি বন্ধের কথা বলায় সব দল ও সংগঠন হইচই করে উঠেছিল। বলেছিল, গেল গেল, গণতন্ত্র গেল। এখন যে ছাত্রসংগঠনগুলো বিভিন্ন হলে, ক্যাম্পাসে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, খুনোখুনি করছে, তাতে কি গণতন্ত্র সমুন্নত হলো? বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পাসে রামদা-চাপাতির মহড়ায় সায় দিলেও নির্বাচনের মাধ্যমে যোগ্য ছাত্রনেতৃত্ব বাছাই করতে দিতে চায় না। এর রহস্য কী? আওয়ামী লীগের আমলে ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে মাস্তানি করবে, বিএনপির আমলে ছাত্রদল সন্ত্রাস চালাবে—সেই গণতন্ত্র কারও কাম্য হতে পারে না।
কে বলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে মতাদর্শগত ঐক্য নেই? সংবিধান সংশোধনসহ অনেক ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও ছাত্র সংসদ নির্বাচন না করার ব্যাপারে মহা ঐক্য দেখা যাচ্ছে। এই অশুভ ঐক্যটি কে ভাঙবে?
সদাশয় সরকার, ও মাননীয় উপাচার্যের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলছি, আপনারা ডাকসু নির্বাচন দিয়ে প্রমাণ করুক, আপনারা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, অপনারা ক্যাম্পাসে সুস্থ ছাত্ররাজনীতির চর্চা চান এবং যোগ্য ছাত্রনেতৃত্ব গড়ে তুলতে আগ্রহী।
২১ বছর ধরে ডাকসু নির্বাচন হয় না। আর কত দিন অপেক্ষা করতে হবে? কতকাল?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.