অর্থনীতি-চৈত্রে শ্রাবণধারা এবং ধান্য-কৃষিচিত্র by মাহবুব হোসেন
ধানের বাম্পার ফলনের সম্ভাবনার মুখে সরকারের জন্য নীতিগত যে সিদ্ধান্ত জরুরি সেটা হচ্ছে কোনোভাবেই চাল আমদানি না করা। একই সঙ্গে বোরো ধান ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই বাজারে নেমে পড়তে হবে ১০-১৫ লাখ টন খাদ্যশস্য সংগ্রহ করার জন্য। এ কেনার কাজ যদি ধান কৃষকের ঘরে থাকার সময়ে করা যায় তাহলে দেশকে বাম্পার ফলন
উপহার দিয়েও কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। সরকারকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, বিশ্ববাজার থেকে জরুরি ভিত্তিতে বেশি দামে কেনার পরিবর্তে সময়মতো দেশীয় বাজার থেকে কিনলেই কৃষকের মঙ্গল, অর্থনীতির জন্যও তা ভালো
পরপর কয়েকদিন বৃষ্টি গেল। আবহাওয়ার আচরণ কী অস্বাভাবিক? এ প্রশ্ন করছেন অনেকে এবং বিশেষজ্ঞদের উত্তরও মিলছে চটজলদি। বৈশাখে কালবৈশাখী হয়, এটা সুবিদিত। চৈত্রেও হয়, তবে সেটাও বৈশাখের ঝড় হিসেবেই পরিচিত। একেবারে দিন-ক্ষণ-ঋতু অনুসারে প্রকৃতি চলে না কোনোকালেই। চৈত্র-বৈশাখের ঝড়ের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে হঠাৎ মেঘ করে এবং বৃষ্টি নামে ঝমঝমিয়ে। বাতাস জোরে বয় এবং কখনও কখনও সঙ্গে থাকে শিলাবৃষ্টি।
এবারে চৈত্রের শেষ দিনগুলোর বর্ষাচিত্র কিন্তু শ্রাবণের মতো। ঘন কালো মেঘ আকাশের একটি অংশ নয়, গোটাটাই ছেয়ে ফেলছিল। একদিন নয়, টানা কয়েকদিন আমরা এ অপরূপ দৃশ্য দেখলাম, যেন বর্ষাকাল এসে গেছে মৌসুমি বায়ুর ওপর ভর করে। বৃষ্টিতে ধুলা মরেছে, কমেছে তাপমাত্রা। যাদের ঘরে এয়ারকন্ডিশনড মেশিন রয়েছে, তারা লোডশেডিংয়ের শঙ্কামুক্ত ছিলেন। রাতে অনেক বাসাবাড়িতে ফ্যান চালাতে হয়নি।
সরকারের জন্য এ বৃষ্টি প্রকৃতির আশীর্বাদ ছিল_ এমন কথা বলেছেন কেউ কেউ। চৈত্রের তাপদাহ বিদ্যুতের চাহিদা বিপুলভাবে বাড়িয়ে দিয়েছিল। কয়েকদিনের অঝোরে বৃষ্টি জনমনে স্বস্তি দিয়েছে, সরকারও তার সুশীতল পরশ পেয়েছে।
তবে সবচেয়ে লাভ হয়েছে কৃষির। এখন গোটা বাংলাদেশ যেন সবুজ গালিচা। বোরো মৌসুমে নানা জাতের ধান লাগানো হয়েছে। এ ধানের চাষ সেচনির্ভর। প্রচুর পানি দিতে হয় সেচযন্ত্র ব্যবহার করে। এ যন্ত্র চালাতে বিদ্যুৎ কিংবা ডিজেল লাগে। দুটিই মহার্ঘ_ দামে চড়া, পেতেও সমস্যা নানাবিধ। এর সরাসরি প্রভাব দেখা গেছে ইরি ধানের ক্ষেতে। সপ্তাহ দুয়েক আগে বাংলাদেশের অন্যতম শস্যভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত সুনামগঞ্জে দেখেছি ইরি ধানের সবুজ ক্ষেত কিছুটা হলুদ বর্ণ ধারণ করছে। স্পষ্টতই প্রয়োজনীয় পানিপ্রাপ্তিতে সমস্যা হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে গত অক্টোবর থেকেই বৃষ্টি বন্ধ রয়েছে। মাঝে কোথাও কোথাও সামান্য বৃষ্টি হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট ছিল না। এ ধরনের বৃষ্টিতে ধুলাও মরে না। তাছাড়া দেশের সর্বত্রও তা হয়নি। টানা খরার কারণে পানির স্তর আরও নেমে যাচ্ছিল এবং এর প্রভাবে ইরি চাষের জন্য মৌসুমের শেষ দিকে সব এলাকায় গভীর ও অগভীর নলকূপ থেকে পানি নাও মিলতে পারে বলে শঙ্কা সৃষ্টি হয়। অথচ এ সময়টাতেই গাছে ধান আসতে থাকে বা তার কাছাকাছি পর্যায়ে থাকে বিধায় গোড়ায় পানি অবশ্যই থাকতে হয়। গত কয়েকদিনে দেশব্যাপী বৃষ্টি হওয়ায় এক দফা সেচের পানি দেওয়ার খরচ থেকে বেশিরভাগ কৃষক রেহাই পেলেন। এর ফলে তাদের ব্যয়ও সাশ্রয় হবে। প্রকৃতি-পরিবেশেরও এতে লাভ হলো_ গত কয়েক মাসে ভূগর্ভের পানির স্তর যেটুকু নেমে গিয়েছিল, তার কিছু অংশ মাঝারি ও ভারী বর্ষণের কারণে পূরণ হয়ে যাবে।
গত বছরে দেখেছি, প্রকৃতি যথেষ্ট সদয় আচরণ করেছিল। বোরোর আগে আমন মৌসুমও বাম্পার ফসল দিয়েছিল। বন্যা ছিল না। বৃষ্টি ছিল পরিমিত। গত কয়েক দিন যেভাবে বৃষ্টি হয়েছে, সপ্তাহ দুয়েক পর যদি এ ধরনের আরেক দফা বৃষ্টি হয়, তাহলে নতুন করে সেচের তেমন প্রয়োজন পড়বে না। এর ফলে সীমিত হলেও উৎপাদন ব্যয় কম রাখা সম্ভব হবে এবং বিশেষভাবে প্রভাব পড়বে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায়। বোরো মৌসুমের চাহিদা মেটাতে সরকারের নির্দেশে বিদ্যুৎ বিভাগ গ্রামে সরবরাহ বাড়ায়। কৃষির জন্য এ ধরনের পদক্ষেপ সঠিক বিবেচিত হলেও ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে বিশেষভাবে শহরের মানুষের ক্ষোভ বাড়ে। বিদ্যুতের ঘাটতির কারণে শুধু গরমেই কষ্ট ভোগ করতে হয় না, শিল্প-কারখানাতেও উৎপাদন বিঘি্নত হয়। সেচের জন্য বাড়তি বিদ্যুৎ সরবরাহের যুক্তি দেখিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার চিঠি দিয়েছে। এর প্রতিক্রিয়া ভালো হয়নি। এখন প্রচুর বৃষ্টি হওয়ায় এ খাতেও কিছুটা স্বস্তি মিলবে।
সেচের প্রয়োজন কমায় জ্বালানি তেলের ওপর চাপ কিছুটা কমবে। গত কয়েক বছর ধরে বিশ্ববাজারে ডিজেল-পেট্রোলের দাম কেবল বাড়ছেই। অথচ আমাদের এ পণ্যের চাহিদার প্রায় সবটাই আমদানি করতে হয়। এ সমস্যার কারণ বৈদেশিক মুদ্রার মজুদেও চাপ পড়ছে। কয়েকদিনের প্রবল বর্ষণের কারণে সেচের জন্য জ্বালানি তেলের ব্যবহার কমবে এবং সেটাকেও আমরা অর্থনীতির জন্য সুখবর বলতে পারি।
এখন আসি ধান-চালের বাজার প্রসঙ্গে। গত সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ধানের দাম হঠাৎ করে পড়ে যাওয়ায় শঙ্কা দেখা দেয়, বোরো মৌসুমে খাদ্যশস্যের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব হবে তো? তবে দেশের নানা প্রান্ত থেকে যে খবর মিলছে তাতে বলা যায়, ধানের আবাদে তেমন হেরফের নেই। সময়মতো বৃষ্টির কারণে গত মৌসুমের মতোই বাম্পার ফলন মিলবে বলে ধারণা করা যায়। তবে এবারেও শঙ্কা রয়েছে_ ধানের দাম কমে যেতে পারে। তাতে কৃষকের জন্য ক্ষতি। সার্বিক অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তবে এবারে গম আমদানি হলেও চালের আমদানি নেই। বাজারে ও গুদামে পর্যাপ্ত চাল মিলছে বলেই এমন অবস্থা। গম আমদানির মূল কারণ অবশ্য বিস্কুট-রুটিসহ বেকারি পণ্য তৈরিতে এর ব্যাপক ব্যবহার। আগামীতে গমের আমদানি আরও বাড়বে বলেই ধারণা করা যায়। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি তাতে এ বছর চাল আমদানির প্রয়োজন পড়বে না। তারপরও প্রশ্ন থেকেই যায়_ বোরো মৌসুমের চাল ও ধান বাজারে আসার পর দাম কমে যাবে না তো? আমার ধারণায় তেমনটি ঘটবে না। গত বছর দাম পড়ে যাওয়ার একটি কারণ ছিল আমাদের চালে যে ঘাটতি ছিল তার চেয়ে বেশি আমদানি। তাছাড়া বাজার স্থিতিশীল করতে যে সময় এ চাল দেশে আসা উচিত ছিল, এসেছে তার চেয়ে পড়ে। আর ঠিক এ সময়টাতেই বোরোর বাম্পার ফলন বাজারে এসেছে। সাধারণত আশা করা হয়, বাজারে সরকারের হস্তক্ষেপ ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কিন্তু গত বছর সরকার যেভাবে এ কাজটি করেছে তাতে কৃষকের ক্ষতি হয়েছে। আশা করব যে, এবারে এমন কিছু ঘটবে না এবং সে কারণে বোরো ধানের বাজারে ধসের শঙ্কাও থাকবে না।
গত বছরের এ সময়টিতে অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত (বোরো ওঠার আগের সময়ে) ধানের দাম ছিল যথেষ্ট ভালো। বলা যায়, ধানের দর ছিল বাম্পার। ৪০ কেজি ধান বিক্রি করে মিলেছে ৯০০ থেকে ১০০০ টাকা। এটা উৎপাদন ব্যয়ের প্রায় দ্বিগুণ। ধানের ভালো দাম মিললে কৃষকের পকেটে বা ট্যাকে বাজার থেকে অন্য পণ্য কেনার মতো অর্থ থাকে। আর এটাও মনে রাখতে হবে যে, আমাদের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক কোনো না কোনোভাবে কৃষি কাজের সঙ্গে যুক্ত। তাদের হাতে বাড়তি অর্থ এলে সেটা ব্যয় হয় দেশীয় পণ্য কেনার জন্য। যারা কলকারখানা গড়ে তুলেছেন বা এ পথে যেতে চান তাদের জন্য এ পরিস্থিতি উৎসাহব্যঞ্জক। এর প্রভাবে গ্রামীণ অর্থনীতিও জোরদার হয়_ সেখানে ব্যবসা বাড়ে।
বোরো ধান উঠলে ৪০ কেজি ধানের দাম ৭৫০-৮০০ টাকা হতে পারে বলে আমার ধারণা। এ দাম কৃষকের জন্য গ্রহণযোগ্য। ৮৫০ টাকা দর উঠলে তারা বেশ খুশি হবে।
তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে, গত বছরের তুলনায় এ বছর উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। এর কারণ বোধগম্য_ কৃষক বেশি দামে সার, ডিজেল ও বিদ্যুৎ কিনেছে। আর এসবের জোগান আসে সরকারের কাছ থেকে। সরকার সার, ডিজেল ও বিদ্যুতে ভর্তুকি কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ায় কৃষি অর্থনীতিতে তার প্রভাব পড়েছে। আমার ধারণা, এ বছর ধান উৎপাদন ব্যয় গত বছরের চেয়ে ১০-১৫ শতাংশ বেশি পড়বে। একই সঙ্গে আরেকটি বিষয় বলা দরকার। ধান উৎপাদনের ব্যয়ের ৭০ শতাংশ শ্রমের মজুরি খাতে যায় এবং ৩০ শতাংশ হচ্ছে উপকরণ খরচ। এ কারণে উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি ততটা প্রভাব ফেলে না। সাম্প্রতিক সময়ে কৃষি খাতে মজুরি বেড়েছে কি-না এবং বাড়লে কী হারে বেড়েছে, সে হিসাব হাতের কাছে নেই। তবে অভিজ্ঞতা বলে যে, ধানের দাম কম থাকলে কৃষি মজুরি তেমন বাড়ে না। এবারে ধানের দাম যেহেতু কিছুটা কমেছে তাই কৃষি মজুরি খুব একটা বাড়ার কথা নয়। যেসব হিসাব রয়েছে তাতে ধারণা করা যায় যে, বোরো ধানের উৎপাদন ব্যয় ৪০ কেজিতে ৫০০-৬০০ টাকা পড়বে। ফলন বাম্পার হলে উৎপাদন ব্যয়ে যেটুকু বাড়তি যোগ হচ্ছে সেটা কৃষকরা পুষিয়ে নিতে পারবেন। সাম্প্রতিক বৃষ্টিও তাদের উৎপাদন কমিয়ে রাখার সহায়ক হবে।
ধান থেকে উপরি পাওনা হচ্ছে বিচালি বা খড়। এ দ্রব্য এখন মূল্যবান পণ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। অতীতে অনেক কৃষক তাদের খড় দান করে দিত বা সামান্য মূল্য পেলেই বিক্রি করত। কিন্তু এখন চিত্র পাল্টে গেছে। এটাও মনে রাখতে হবে যে, গ্রামের চিত্র পাল্টে যাচ্ছে। এখন কৃষক ধানের বাইরেও উৎপাদনমূলক বিভিন্ন কাজে যুক্ত থাকতে পারছে। এক খাতে আয় একটু কম পড়লে অন্য খাত থেকে সেটা পুষিয়ে নেওয়ার সুযোগ বাড়ছে।
ধানের বাম্পার ফলনের সম্ভাবনার মুখে সরকারের জন্য নীতিগত যে সিদ্ধান্ত জরুরি সেটা হচ্ছে কোনোভাবেই চাল আমদানি না করা। একই সঙ্গে বোরো ধান ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই বাজারে নেমে পড়তে হবে ১০-১৫ লাখ টন খাদ্যশস্য সংগ্রহ করার জন্য। এ কেনার কাজ যদি ধান কৃষকের ঘরে থাকার সময়ে করা যায় তাহলে দেশকে বাম্পার ফলন উপহার দিয়েও কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। সরকারকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, বিশ্ববাজার থেকে জরুরি ভিত্তিতে বেশি দামে কেনার পরিবর্তে সময়মতো দেশীয় বাজার থেকে কিনলেই কৃষকের মঙ্গল, অর্থনীতির জন্যও তা ভালো।
ড. মাহবুব হোসেন : কৃষি অর্থনীতিবিদ এবং ব্র্যাকের প্রধান নির্বাহী
পরপর কয়েকদিন বৃষ্টি গেল। আবহাওয়ার আচরণ কী অস্বাভাবিক? এ প্রশ্ন করছেন অনেকে এবং বিশেষজ্ঞদের উত্তরও মিলছে চটজলদি। বৈশাখে কালবৈশাখী হয়, এটা সুবিদিত। চৈত্রেও হয়, তবে সেটাও বৈশাখের ঝড় হিসেবেই পরিচিত। একেবারে দিন-ক্ষণ-ঋতু অনুসারে প্রকৃতি চলে না কোনোকালেই। চৈত্র-বৈশাখের ঝড়ের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে হঠাৎ মেঘ করে এবং বৃষ্টি নামে ঝমঝমিয়ে। বাতাস জোরে বয় এবং কখনও কখনও সঙ্গে থাকে শিলাবৃষ্টি।
এবারে চৈত্রের শেষ দিনগুলোর বর্ষাচিত্র কিন্তু শ্রাবণের মতো। ঘন কালো মেঘ আকাশের একটি অংশ নয়, গোটাটাই ছেয়ে ফেলছিল। একদিন নয়, টানা কয়েকদিন আমরা এ অপরূপ দৃশ্য দেখলাম, যেন বর্ষাকাল এসে গেছে মৌসুমি বায়ুর ওপর ভর করে। বৃষ্টিতে ধুলা মরেছে, কমেছে তাপমাত্রা। যাদের ঘরে এয়ারকন্ডিশনড মেশিন রয়েছে, তারা লোডশেডিংয়ের শঙ্কামুক্ত ছিলেন। রাতে অনেক বাসাবাড়িতে ফ্যান চালাতে হয়নি।
সরকারের জন্য এ বৃষ্টি প্রকৃতির আশীর্বাদ ছিল_ এমন কথা বলেছেন কেউ কেউ। চৈত্রের তাপদাহ বিদ্যুতের চাহিদা বিপুলভাবে বাড়িয়ে দিয়েছিল। কয়েকদিনের অঝোরে বৃষ্টি জনমনে স্বস্তি দিয়েছে, সরকারও তার সুশীতল পরশ পেয়েছে।
তবে সবচেয়ে লাভ হয়েছে কৃষির। এখন গোটা বাংলাদেশ যেন সবুজ গালিচা। বোরো মৌসুমে নানা জাতের ধান লাগানো হয়েছে। এ ধানের চাষ সেচনির্ভর। প্রচুর পানি দিতে হয় সেচযন্ত্র ব্যবহার করে। এ যন্ত্র চালাতে বিদ্যুৎ কিংবা ডিজেল লাগে। দুটিই মহার্ঘ_ দামে চড়া, পেতেও সমস্যা নানাবিধ। এর সরাসরি প্রভাব দেখা গেছে ইরি ধানের ক্ষেতে। সপ্তাহ দুয়েক আগে বাংলাদেশের অন্যতম শস্যভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত সুনামগঞ্জে দেখেছি ইরি ধানের সবুজ ক্ষেত কিছুটা হলুদ বর্ণ ধারণ করছে। স্পষ্টতই প্রয়োজনীয় পানিপ্রাপ্তিতে সমস্যা হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে গত অক্টোবর থেকেই বৃষ্টি বন্ধ রয়েছে। মাঝে কোথাও কোথাও সামান্য বৃষ্টি হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট ছিল না। এ ধরনের বৃষ্টিতে ধুলাও মরে না। তাছাড়া দেশের সর্বত্রও তা হয়নি। টানা খরার কারণে পানির স্তর আরও নেমে যাচ্ছিল এবং এর প্রভাবে ইরি চাষের জন্য মৌসুমের শেষ দিকে সব এলাকায় গভীর ও অগভীর নলকূপ থেকে পানি নাও মিলতে পারে বলে শঙ্কা সৃষ্টি হয়। অথচ এ সময়টাতেই গাছে ধান আসতে থাকে বা তার কাছাকাছি পর্যায়ে থাকে বিধায় গোড়ায় পানি অবশ্যই থাকতে হয়। গত কয়েকদিনে দেশব্যাপী বৃষ্টি হওয়ায় এক দফা সেচের পানি দেওয়ার খরচ থেকে বেশিরভাগ কৃষক রেহাই পেলেন। এর ফলে তাদের ব্যয়ও সাশ্রয় হবে। প্রকৃতি-পরিবেশেরও এতে লাভ হলো_ গত কয়েক মাসে ভূগর্ভের পানির স্তর যেটুকু নেমে গিয়েছিল, তার কিছু অংশ মাঝারি ও ভারী বর্ষণের কারণে পূরণ হয়ে যাবে।
গত বছরে দেখেছি, প্রকৃতি যথেষ্ট সদয় আচরণ করেছিল। বোরোর আগে আমন মৌসুমও বাম্পার ফসল দিয়েছিল। বন্যা ছিল না। বৃষ্টি ছিল পরিমিত। গত কয়েক দিন যেভাবে বৃষ্টি হয়েছে, সপ্তাহ দুয়েক পর যদি এ ধরনের আরেক দফা বৃষ্টি হয়, তাহলে নতুন করে সেচের তেমন প্রয়োজন পড়বে না। এর ফলে সীমিত হলেও উৎপাদন ব্যয় কম রাখা সম্ভব হবে এবং বিশেষভাবে প্রভাব পড়বে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায়। বোরো মৌসুমের চাহিদা মেটাতে সরকারের নির্দেশে বিদ্যুৎ বিভাগ গ্রামে সরবরাহ বাড়ায়। কৃষির জন্য এ ধরনের পদক্ষেপ সঠিক বিবেচিত হলেও ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে বিশেষভাবে শহরের মানুষের ক্ষোভ বাড়ে। বিদ্যুতের ঘাটতির কারণে শুধু গরমেই কষ্ট ভোগ করতে হয় না, শিল্প-কারখানাতেও উৎপাদন বিঘি্নত হয়। সেচের জন্য বাড়তি বিদ্যুৎ সরবরাহের যুক্তি দেখিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার চিঠি দিয়েছে। এর প্রতিক্রিয়া ভালো হয়নি। এখন প্রচুর বৃষ্টি হওয়ায় এ খাতেও কিছুটা স্বস্তি মিলবে।
সেচের প্রয়োজন কমায় জ্বালানি তেলের ওপর চাপ কিছুটা কমবে। গত কয়েক বছর ধরে বিশ্ববাজারে ডিজেল-পেট্রোলের দাম কেবল বাড়ছেই। অথচ আমাদের এ পণ্যের চাহিদার প্রায় সবটাই আমদানি করতে হয়। এ সমস্যার কারণ বৈদেশিক মুদ্রার মজুদেও চাপ পড়ছে। কয়েকদিনের প্রবল বর্ষণের কারণে সেচের জন্য জ্বালানি তেলের ব্যবহার কমবে এবং সেটাকেও আমরা অর্থনীতির জন্য সুখবর বলতে পারি।
এখন আসি ধান-চালের বাজার প্রসঙ্গে। গত সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ধানের দাম হঠাৎ করে পড়ে যাওয়ায় শঙ্কা দেখা দেয়, বোরো মৌসুমে খাদ্যশস্যের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব হবে তো? তবে দেশের নানা প্রান্ত থেকে যে খবর মিলছে তাতে বলা যায়, ধানের আবাদে তেমন হেরফের নেই। সময়মতো বৃষ্টির কারণে গত মৌসুমের মতোই বাম্পার ফলন মিলবে বলে ধারণা করা যায়। তবে এবারেও শঙ্কা রয়েছে_ ধানের দাম কমে যেতে পারে। তাতে কৃষকের জন্য ক্ষতি। সার্বিক অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তবে এবারে গম আমদানি হলেও চালের আমদানি নেই। বাজারে ও গুদামে পর্যাপ্ত চাল মিলছে বলেই এমন অবস্থা। গম আমদানির মূল কারণ অবশ্য বিস্কুট-রুটিসহ বেকারি পণ্য তৈরিতে এর ব্যাপক ব্যবহার। আগামীতে গমের আমদানি আরও বাড়বে বলেই ধারণা করা যায়। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি তাতে এ বছর চাল আমদানির প্রয়োজন পড়বে না। তারপরও প্রশ্ন থেকেই যায়_ বোরো মৌসুমের চাল ও ধান বাজারে আসার পর দাম কমে যাবে না তো? আমার ধারণায় তেমনটি ঘটবে না। গত বছর দাম পড়ে যাওয়ার একটি কারণ ছিল আমাদের চালে যে ঘাটতি ছিল তার চেয়ে বেশি আমদানি। তাছাড়া বাজার স্থিতিশীল করতে যে সময় এ চাল দেশে আসা উচিত ছিল, এসেছে তার চেয়ে পড়ে। আর ঠিক এ সময়টাতেই বোরোর বাম্পার ফলন বাজারে এসেছে। সাধারণত আশা করা হয়, বাজারে সরকারের হস্তক্ষেপ ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কিন্তু গত বছর সরকার যেভাবে এ কাজটি করেছে তাতে কৃষকের ক্ষতি হয়েছে। আশা করব যে, এবারে এমন কিছু ঘটবে না এবং সে কারণে বোরো ধানের বাজারে ধসের শঙ্কাও থাকবে না।
গত বছরের এ সময়টিতে অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত (বোরো ওঠার আগের সময়ে) ধানের দাম ছিল যথেষ্ট ভালো। বলা যায়, ধানের দর ছিল বাম্পার। ৪০ কেজি ধান বিক্রি করে মিলেছে ৯০০ থেকে ১০০০ টাকা। এটা উৎপাদন ব্যয়ের প্রায় দ্বিগুণ। ধানের ভালো দাম মিললে কৃষকের পকেটে বা ট্যাকে বাজার থেকে অন্য পণ্য কেনার মতো অর্থ থাকে। আর এটাও মনে রাখতে হবে যে, আমাদের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক কোনো না কোনোভাবে কৃষি কাজের সঙ্গে যুক্ত। তাদের হাতে বাড়তি অর্থ এলে সেটা ব্যয় হয় দেশীয় পণ্য কেনার জন্য। যারা কলকারখানা গড়ে তুলেছেন বা এ পথে যেতে চান তাদের জন্য এ পরিস্থিতি উৎসাহব্যঞ্জক। এর প্রভাবে গ্রামীণ অর্থনীতিও জোরদার হয়_ সেখানে ব্যবসা বাড়ে।
বোরো ধান উঠলে ৪০ কেজি ধানের দাম ৭৫০-৮০০ টাকা হতে পারে বলে আমার ধারণা। এ দাম কৃষকের জন্য গ্রহণযোগ্য। ৮৫০ টাকা দর উঠলে তারা বেশ খুশি হবে।
তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে, গত বছরের তুলনায় এ বছর উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। এর কারণ বোধগম্য_ কৃষক বেশি দামে সার, ডিজেল ও বিদ্যুৎ কিনেছে। আর এসবের জোগান আসে সরকারের কাছ থেকে। সরকার সার, ডিজেল ও বিদ্যুতে ভর্তুকি কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ায় কৃষি অর্থনীতিতে তার প্রভাব পড়েছে। আমার ধারণা, এ বছর ধান উৎপাদন ব্যয় গত বছরের চেয়ে ১০-১৫ শতাংশ বেশি পড়বে। একই সঙ্গে আরেকটি বিষয় বলা দরকার। ধান উৎপাদনের ব্যয়ের ৭০ শতাংশ শ্রমের মজুরি খাতে যায় এবং ৩০ শতাংশ হচ্ছে উপকরণ খরচ। এ কারণে উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি ততটা প্রভাব ফেলে না। সাম্প্রতিক সময়ে কৃষি খাতে মজুরি বেড়েছে কি-না এবং বাড়লে কী হারে বেড়েছে, সে হিসাব হাতের কাছে নেই। তবে অভিজ্ঞতা বলে যে, ধানের দাম কম থাকলে কৃষি মজুরি তেমন বাড়ে না। এবারে ধানের দাম যেহেতু কিছুটা কমেছে তাই কৃষি মজুরি খুব একটা বাড়ার কথা নয়। যেসব হিসাব রয়েছে তাতে ধারণা করা যায় যে, বোরো ধানের উৎপাদন ব্যয় ৪০ কেজিতে ৫০০-৬০০ টাকা পড়বে। ফলন বাম্পার হলে উৎপাদন ব্যয়ে যেটুকু বাড়তি যোগ হচ্ছে সেটা কৃষকরা পুষিয়ে নিতে পারবেন। সাম্প্রতিক বৃষ্টিও তাদের উৎপাদন কমিয়ে রাখার সহায়ক হবে।
ধান থেকে উপরি পাওনা হচ্ছে বিচালি বা খড়। এ দ্রব্য এখন মূল্যবান পণ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। অতীতে অনেক কৃষক তাদের খড় দান করে দিত বা সামান্য মূল্য পেলেই বিক্রি করত। কিন্তু এখন চিত্র পাল্টে গেছে। এটাও মনে রাখতে হবে যে, গ্রামের চিত্র পাল্টে যাচ্ছে। এখন কৃষক ধানের বাইরেও উৎপাদনমূলক বিভিন্ন কাজে যুক্ত থাকতে পারছে। এক খাতে আয় একটু কম পড়লে অন্য খাত থেকে সেটা পুষিয়ে নেওয়ার সুযোগ বাড়ছে।
ধানের বাম্পার ফলনের সম্ভাবনার মুখে সরকারের জন্য নীতিগত যে সিদ্ধান্ত জরুরি সেটা হচ্ছে কোনোভাবেই চাল আমদানি না করা। একই সঙ্গে বোরো ধান ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই বাজারে নেমে পড়তে হবে ১০-১৫ লাখ টন খাদ্যশস্য সংগ্রহ করার জন্য। এ কেনার কাজ যদি ধান কৃষকের ঘরে থাকার সময়ে করা যায় তাহলে দেশকে বাম্পার ফলন উপহার দিয়েও কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। সরকারকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, বিশ্ববাজার থেকে জরুরি ভিত্তিতে বেশি দামে কেনার পরিবর্তে সময়মতো দেশীয় বাজার থেকে কিনলেই কৃষকের মঙ্গল, অর্থনীতির জন্যও তা ভালো।
ড. মাহবুব হোসেন : কৃষি অর্থনীতিবিদ এবং ব্র্যাকের প্রধান নির্বাহী
No comments