বার্মার গণতন্ত্র by ভারত ভুষণ

ইয়াঙ্গুনের ট্যাক্সিগুলো অধিকাংশই নব্বইয়ের দশকের টয়োটা করোলা এবং ক্যামরিজ। দেখলেই বোঝা যায়, অতি পুরনো। অতি ব্যবহারে স্টিয়ারিং হুইল তেলতেলে ধাতব পদার্থের মতো, জানালাগুলো ভাঙা, দরজার হাতল কাজ করে না, ড্যাশবোর্ড থেকে ঝুলে আছে তার, চামড়ার সিটগুলো খসে পচা তরমুজের মতো বের হয়ে আছে।


কিন্তু রাস্তায় পরিবর্তনের হাওয়া। নতুন করে চীনের চেরি কিউ কিউ-৩ গাড়ি আমদানি করে যোগ হচ্ছে। যাদের পয়সা আছে, তারা জাপানি রিকন্ডিশনড গাড়ি ব্যবহার করছে।
ট্যাক্সির স্টেরিওতে উঁচূ স্বরে বাজছে, 'মাদার সু ইজ কামিং ব্যাক।' গানটি গেয়েছেন নির্বাসিত বার্মার কণ্ঠশিল্পী লাসিও থেই অঙ। সুকির মুক্তি উপলক্ষে গানটি রেকর্ড করা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে। এই গান দেশে ঝড় তুলেছে। ইয়াঙ্গুনের রাস্তার গরম ও দূষণের মধ্যে এক অনুভূতি কাজ করছে, ন্যাশনাল লিগ অব ডেমোক্র্যাসি পার্লামেন্টে যাচ্ছে। দেশ এখন গণতন্ত্রের দ্বারপ্রান্তে।
এনএলডি যে ৪৪টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল, তার ৪৩টিতেই জয়লাভ করেছে। এ থেকেই বোঝা যায়, বাতাস কোন দিকে বইছে। দলটি নতুন রাজধানী নেপিদাওয়ের চারটি আসনেই জয়লাভ করেছে, যেখানে বিপুলসংখ্যক সরকার সমর্থনকারী আমলা এবং সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা বসবাস করেন। ইয়াঙ্গুনের ছয়টি আসনের সব কয়টিতে জয়লাভ করেছে এনএলডি। যদিও এ গণতন্ত্রে উত্তরণ সেনাবাহিনীর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, কিন্তু মিয়ানমারের জনগণ বিশ্বাস করছে, এবার আর এ জয়কে পাল্টে দেওয়া যাবে না।
১৯৯২ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা মিয়ানমারের মিলিটারি স্বৈরশাসক থান সুয়ে সরে যাওয়ার পর বর্তমান প্রেসিডেন্ট থেই সেইকে প্রেসিডেন্ট পদে মনোনীত করা হয়। যদিও তাঁর হৃদরোগসংক্রান্ত বিষয় ছিল, কিন্তু একটি সতর্ক গণতন্ত্রে উত্তরণের কথা তিনিও ভেবেছিলেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও একটি গভীর আশা করেছিল। এটা ভেবেই আসিয়ান নেতারা মিয়ানমারে গণতন্ত্র সংস্করণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৯৭ সালেই মিয়ানমার আসিয়ানে যোগদানের সময় গণতন্ত্রের পথ সংস্কার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। মিয়ানমারে ২০১৩ সালে ২৭তম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ান গেইমস অনুষ্ঠিত হবে। দেশটি ২০১৪ সালে আসিয়ানের চেয়ারম্যানশিপের আশা করছে।
মিয়ানমারের ওপর অর্থনৈতিক আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা এসেছিল ২০০৩ সালে। তাতে যথেষ্ট খেসারত দিতে হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গার্মেন্ট খাতে ৫০০ ফ্যাক্টরির মধ্যে ৩০০ বন্ধ হয়ে যায়। বিদেশি ব্যাংকগুলো মিয়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেন করতে অপারগতা প্রকাশ করে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় কম্পানিগুলো মিয়ানমার থেকে চলে যায়। এ ছাড়া সেনাবাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা এবং তাদের দোসররা মিয়ানমারে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন, যাঁরা রাজনীতি ও বাণিজ্যের মুখ্য শক্তি, তারাও এখন তাঁদের সম্পদকে উপভোগ করতে চাচ্ছেন। একজন রাজনৈতিক ভাষ্যকারের মতে, তারা এখন ভ্রমণ, শিক্ষা গ্রহণের জন্য অথবা স্বাস্থ্যগত কারণে যুক্তরাষ্ট্রে গমন করতে পারছেন না। যখন তাদের অর্থনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবে, তখন তারা অন্য সবার মতোই এ সুবিধা ভোগ করবে।
কিন্তু মিয়ানমারের সেনাবাহিনী গণতন্ত্রে উত্তরণের এ গতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ২০০৮ সালে সংবিধান রচনাকালে, যে কারণে ২০১০ সালের সাধারণ নির্বাচন এনএলডি বয়কট করেছিল। সে সময় সরকারে আসা ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির সঙ্গে ছিল সেনাবাহিনীর বিশেষ সংযোগ। দলটি প্রকৃত অর্থে সেনাবাহিনীর দল। ২০১০ সালের সে নির্বাচনে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষেই ৭০ শতাংশ আসন তারা পেয়েছিল। উভয় কক্ষেরই বাকি ২৫ শতাংশ মনোনীত আসন ছিল সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের জন্য। মন্ত্রিপরিষদের ৩২ জন মন্ত্রীর মধ্যে মাত্র আটজন বেসামরিক ব্যক্তি রয়েছেন।
এভাবেই সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ করছে আইন ও নির্বাহী বিভাগ। বিচার বিভাগের নিয়োগও তারা দিয়ে থাকে। সুতরাং এটি অত্যন্ত আস্থার সঙ্গে বসা সেনা নেতৃত্ব।

লেখক : ভারতের নিবন্ধকার
আউটলুক পত্রিকা থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ।

No comments

Powered by Blogger.