বেকারদের পাশে দাঁড়ানোর ভুল পদ্ধতি by ড. তুহিন ওয়াদুদ

মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর দুই বছর মেয়াদি ন্যাশনাল সার্ভিস নামে একটি সার্ভিস চালু করেছে। ১৮ থেকে ৩৫ বছরের এসএসসি থেকে মাস্টার্স পাস বেকারদের কর্মসংস্থান করার লক্ষ্যে সরকার এ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। প্রথম অবস্থায় কুড়িগ্রাম, বরগুনা এবং গোপালগঞ্জ_এ তিনটি জেলায় এ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।


তিনটি জেলায় মোট ৩৬ হাজার বেকারের কর্মসংস্থান হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সারা দেশে এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে। শুরুতে তাদের তিন মাসের প্রশিক্ষণ শেষে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও সমাজসেবামূলক মৌলিক ধারণা, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা, শিক্ষা ও শারীরিক ধারণা, কৃষি, বন ও পরিবেশ, জননিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা, ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদে মোট ১০ ধরনের কাজে লাগানো হচ্ছে। প্রশিক্ষণকালীন দৈনিক ১০০ টাকা এবং প্রশিক্ষণ শেষে মাসিক ছয় হাজার টাকা করে পাচ্ছে। ন্যাশনাল সার্ভিসের নামে বেকারদের কর্মসংস্থানের কথা শুনতে যত স্বস্তিদায়ক মনে হোক না কেন, এর বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ দুই-ই অশুভ। প্রথম অবস্থায় মাস শেষে ছয় হাজার টাকা দেওয়া হতো। এখন প্রতি মাসে দুই হাজার করে টাকা কেটে রাখা হয়। দুই বছর শেষে তাদের কেটে নেওয়া টাকাসহ ওই টাকার সুদ দেওয়া হবে। মাসিক ছয় হাজার টাকার সুযোগ পেয়ে যারা বিভিন্ন এনজিওতে ছোট ছোট চাকরি করত, তারা তা ছেড়ে এসে ন্যাশনাল সার্ভিসে কাজ নিয়েছে। অনেকে ন্যাশনাল সার্ভিসে কাজ পাওয়ার কারণে অন্য কোনো চাকরির চেষ্টা করছে না।
ন্যাশনাল সার্ভিসের মাধ্যমে তারা যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে, তারা সেখানে প্রয়োজনীয় পদের অতিরিক্ত। ফলে তারা অফিসে যাওয়ার কারণে অফিস কোনো লাভবান হচ্ছে না। যে কাজ অফিসের সাতজনকে দিয়ে হতো, সেই কাজ এখন হয়তো ১৫ জনে করে। ন্যাশনাল সার্ভিসে যাওয়ার প্রয়োজন না থাকলে বর্তমান ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মীরা গৃহের অনেক কাজ হয়তো করত। কিন্তু বর্তমানে তা হচ্ছে না। ফল দাঁড়াল এই, এই কর্মীদের অধিকাংশই না দেশের জন্য, না গৃহের জন্য কোনো গঠনমূলক সময় দিতে পারছে এ দু-বছরে। যারা কাজ করছে, তাদের থেকে সেই কাজটুকু করে নেওয়ার অর্থ হচ্ছে দেশের ক্ষতি করা। যেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই কর্মীদের অনেকে কাজ করছে। শিশুনিকেতন থেকে শুরু করে স্নাতক সম্মান শ্রেণী পর্যন্ত এই কর্মীদের দিয়ে পাঠদান করানো হচ্ছে। একটি প্রতিষ্ঠানে ৩০ জন শিক্ষক হয়তো আছেন, সেখানে ন্যাশনাল সার্ভিসের হয়তো আরো ৩০ জন কর্মী দেওয়া হলো। তখন নিশ্চয়ই অর্ধেক ক্লাস করাবেন নতুন নিয়োগ পাওয়া কর্মীরা। বাংলাদেশ সরকার সব সময়ই মনে করেছে শিক্ষাদানের চেয়ে সহজ কাজ আর কিছু হয় না। ফলে শিক্ষকতা করাটা চাকরি না হওয়ার পর্যায়ে ফেলে নির্মম রসিকতা করতেও বাধে না। কোথাও চাকরি হয়নি বলে যারা বেকারত্বের অভিশাপ থেকে রক্ষা পাচ্ছে না, তাদের দিয়ে যাদের পাঠদান করানো হচ্ছে, তারা শিক্ষার্থীদের জন্য অনেক বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার বোঝা যাবে। যেমন_কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজে ন্যাশনাল সার্ভিসের কর্মীরা স্নাতক সম্মান শ্রেণীর ক্লাস নিচ্ছেন। কলেজটিতে মাস্টার্স খোলা হচ্ছে। নিশ্চয়ই মাস্টার্সের ক্লাসেও এরাই পাঠদান করবেন। এ ক্ষতির ফল তাৎক্ষণিক বোঝা যাবে না, কিন্তু সমাজের মধ্যে এ ক্ষতি ঠিকই প্রভাব ফেলবে। ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সের মধ্যে এখন যারা লেখাপড়া করছে, তারা সবাই কলেজে যাওয়ার পরিবর্তে ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মী হচ্ছে। যেহেতু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না গেলেও পরীক্ষা দেওয়া যায়, সেহেতু পরীক্ষার সময় পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলেই চলবে। তা ছাড়া ন্যাশনাল সার্ভিসের সহকর্মীরাই তো পাঠদান করছে। ন্যাশনাল সার্ভিসের মেয়াদ দুই বছর। দুই বছর পর তাদের আবার বেকার জীবনে ফিরে যেতে হবে। তখন হয়তো তারা ৫০ হাজার টাকা পাবেন। কিন্তু সেই ৫০ হাজার টাকা ব্যবসায় বিনিয়োগ করার মতো এমন কোনো অভিজ্ঞতা তারা আগের দুই বছরে অর্জন করেননি, যা দিয়ে তারা ৫০ হাজার টাকা ব্যবসায় বিনিয়োগ করে মুনাফা অর্জন করতে পারবেন। বরং প্রতি মাসে নিয়মিত যে টাকা পেতেন, সেই টাকা পাওয়া বন্ধ হলে তাদের তাৎক্ষণিক যে সমস্যা তৈরি হবে, তা বরং সমাজে নানা অপরাধকর্মকে বাড়াতে পারে।
সরকার বেকারদের প্রতি সদয় হয়েছে, সে জন্য সরকারকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু যে পদ্ধতিতে বেকারদের পাশে দাঁড়ানো হচ্ছে, তাতে বেকারদের উপকার করার চেয়ে ক্ষতির আশঙ্কাই বেশি। দুই বছর তারা যে ধরনের শ্রমে অভিজ্ঞ হচ্ছে, তা তাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কাজে আসবে না। সরকার দুই বছরে ন্যাশনাল সার্ভিসের প্রত্যেক কর্মীর জন্য প্রায় দুই লাখ টাকা করে ব্যয় করছে এবং এর বিনিময়ে কিছু শ্রম পাওয়ার চেষ্টা করছে। যেহেতু তাদের শ্রম বিশেষ কোনো কাজে আসছে না, সেহেতু বেকারদের পাশে দাঁড়ানোর কৌশল পরিবর্তন করা প্রয়োজন। সরকার যে টাকা বেকারদের জন্য বিনিয়োগ করছে, সেই টাকায় কিছু শিল্প-কলকারখানা স্থাপন করে সেখানে বেকারদের স্থায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে। অথবা যেহেতু টাকাটা এককালীন দেওয়া হচ্ছে, সেই টাকা মাসে মাসে না ভেঙে একই সঙ্গে দুই লাখ করে টাকা দিতে পারলে তারা হয়তো এই মোটা অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করে কোনো একটা কাজ করতে পারত। অথবা কয়েকজনের টাকা একত্র করে বেকারদের উদ্যোক্তা হিসেবে কৃষি উন্নয়ন কিংবা কুটির শিল্পে সময় ও শ্রম বিনিয়োগের মাধ্যমে বেকারদের কর্মমুখী করে তোলা যেত। এতে শুধু তারাই নয়, অন্য অনেকেরও কর্মসংস্থান হতো। প্রশিক্ষণের নামে তিন মাসে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে সেই অর্থ বেকারদের কর্মসংস্থানের কাজে ব্যবহার করলে ফল সুদূরপ্রসারী ইতিবাচক হতো।

লেখক : শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

No comments

Powered by Blogger.