বাল্যবিবাহ : নারীর ক্ষমতায়নে বাধা by ড. এম আজিজুর রহমান
ইউএন সংজ্ঞা অনুসারে ১৮ বছরের কম বয়সের ছেলেমেয়েদের শিশু হিসেবে পরিগণিত করা হয়। ১৮ বছরের কম বয়সের মেয়ে-শিশুদের বিয়েকে বাল্যবিবাহ বলে। বাংলাদেশে পুরুষের তুলনায় নারীরা কম ক্ষমতার অধিকারী। একটা দেশের উন্নয়নের জন্য নারী শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য উন্নয়নের দিকে জোর দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নারীর উন্নয়ন ছাড়া মানবজাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়। মানব সভ্যতার উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহ যে একটি বিরাট বাধা, তা এখন সারা বিশ্বের
আলোচিত বিষয়। বিশ্ব উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অর্জনের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ উভয়ই সমান কৃতিত্বের দাবিদার। কবি নজরুলের ভাষায়-'বিশ্বে যা কিছু মহান চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।' পারিবারিক জীবনে নারী বা পুরুষ কাউকেই অবহেলা করা যাবে না। কায়িক শ্রমনির্ভর কাজগুলোতে নারীর তুলনায় পুরুষরা এগিয়ে। মেধানির্ভর কাজগুলোতে যেমন-ব্যবসা ও বড় পেশাগুলোতে পুরুষদের তুলনায় নারীরাও কোনো অংশে কম নয়। নারীরাও আস্তে আস্তে পুরুষদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করছে। সম্প্রতি প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষ শ্রমিক ও উন্নত মানব সম্পদের গুরুত্ব অনেক বেড়েছে। উদাহরণস্বরূপ চীনসহ বেশ কিছু দেশে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটেছে তাদের শিক্ষিত ও দক্ষ মানব সম্পদের জন্য। নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে প্রচুর উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতার কারণেই পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে এ অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটেছে। এটা বড়ই পরিতাপের বিষয় যে দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্য-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। এর পেছনে অনেক কারণ আছে। এর মধ্যে বাল্যবিবাহ অন্যতম। বেশির ভাগ পরিবারেই নারীর শ্রমকে আয়ের উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। মা-বাবা তাঁদের কন্যাসন্তানের দায়ভার ও দেখাশোনার দায়িত্ব নিতে পারেন না বলেই অপ্রাপ্ত বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিতে আগ্রহী হন। এভাবে বিবাহিত এবং অপরিপক্ব মেয়েরা মা-বাবার সংসার ছেড়ে শ্বশুরালয়ে প্রবেশ করে। তাই উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোতে বাল্যবিবাহ অপেক্ষাকৃত বেশি, যা নারীর ক্ষমতায়নে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশ যেমন-আফগানিস্তান, পাকিস্তান, সৌদি আরব এবং ইরানকে অর্থনৈতিকভাবে এখনো অনুন্নত দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এসব দেশে বেশি মাত্রার বাল্যবিবাহ উৎসাহব্যঞ্জক কোনো ঘটনা নয়। বাংলাদেশসহ এসব দেশে বাল্যবিবাহ (১৮ বছরের কম বয়স) আইনগতভাবে নিষিদ্ধ। এই আইন যথাযথভাবে না মানার কারণে বাল্যবিবাহের মাত্রা বেড়েই চলেছে। ২০০৭ সালের জরিপ রিপোর্ট অনুযায়ী বাল্যবিবাহের হার বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন মাত্রায় যেমন- পাকিস্তানে ৩৪ শতাংশ এবং বাংলাদেশে ৪০ শতাংশ, মধ্য-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে ৪২ শতাংশ এবং ইরানে ৩৯ শতাংশ। বাংলাদেশের বেশির ভাগ নারীই মুসলমান, যাদের অধিকাংশই বিবাহিত এবং কম শিক্ষিত। উলি্লখিত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার তুলনামূলক বেশি। এই বাল্যবিবাহ নারী জাগরণ, উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের রীতিনীতি ও রক্ষণশীল সংস্কৃতিতে নারীরা খুব একটা উৎপাদনশীল জীবন যাপন করতে পারে না। বাল্যবিবাহ নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে কোনো আশাব্যঞ্জক দিক নয়। নারীর ক্ষমতায়নের অন্যতম উপায় হচ্ছে তাদের যথাযথ শিক্ষিত করে তোলা। বিশেষ করে কর্মমুখী শিক্ষার দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার উক্তি অনুযায়ী শিক্ষা মানুষকে বদলে দেয়। শিক্ষিত নর-নারী সবাই জানবে, সমাজে তাদের ভাগ্যের উন্নয়ন কিভাবে করতে হবে। নারী শিক্ষা, নারী জাগরণ এবং নারীর ক্ষমতায়ন দেশের সুশাসন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
লেখক : উপাচার্য, উত্তরা ইউনিভার্সিটি, ঢাকা
লেখক : উপাচার্য, উত্তরা ইউনিভার্সিটি, ঢাকা
No comments