সহজ-সরল-দেশ নিয়ে কি গর্ব করব না? by কনকচাঁপা
আমাদের দেশের প্রবাসী ভাইয়েরা যাঁরা রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশকে সমৃদ্ধশালী করছেন, তাঁরা মাঝেমধ্যেই অনেক ভালোবেসে তাঁদের প্রিয় শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানান। সেই সুবাদে আমার সারা পৃথিবী ঘোরা। তো যখন প্রবাসীদের আমন্ত্রণে তাঁদের কাছে যাই, অবধারিতভাবেই এয়ারপোর্টে তাঁরা আমাদের নিতে আসেন। ২৭ বছরের যে অভিজ্ঞতা, তাতে প্রাথমিক অভ্যর্থনার পর যে কথোপকথন হয়, তা নিম্নরূপ। ভাই জার্নিতে কোনো কষ্ট হয়নি তো? হাসিমুখে জবাব দিই
না_কষ্ট হয়নি। তবে লম্বা জার্নিতে একটু ক্লান্ত। ততক্ষণে গাড়িতে মালামালসহ উঠে বসেছি। এবার দুলাভাইকে (আমার জীবনসঙ্গী সুরকার মইনুল ইসলাম খান) প্রশ্ন : তা দুলাভাই দেশের অবস্থা কী? এই তো খুব গরম পড়েছে, দুলাভাইয়ের জবাব। না, গরম-ঠাণ্ডা বলছি না_রাজনৈতিক অবস্থা কী? যাই বলেন ভাই, আমাদের দেশের বোধ হয় আর কিছু হবে না, নেতা-নেত্রীরা যা করেন, আর বলেন! আমরা তো সবই খবর পাই, খুনখারাবি-হরতাল। এই দুই মাস আগে বউ-বাচ্চাসহ দেশে গেলাম। বুঝলেন, এয়ারপোর্টে নেমে দেখি হরতাল...। দুই মাস থাকব_এ যানজট-গরম-ভেজাল, শেষে বাচ্চাটার এমন ডায়রিয়া হলো যে ছুটি শেষ না হতেই চলে এসেছি। আমি সত্যিই ক্লান্ত হতে থাকি। ভাই, আপনারা এখানে এসে পড়েন। এখানে অন্তত খেয়েপরে-ঘুমিয়ে শান্তি। কেউ ট্রাফিক আইন অমান্য করে না। এই যে লাইট দেখলেন, ক্রস করলেই টিকিট সোজা আপনার বাসায়। লাইসেন্সে দাগ পড়লে তো খবরই আছে। আর খাবার-দাবার ফলমূল-বেহেশত_বুঝলেন! যে ভেজাল খান শেষ বয়সে কী হবে তা তো...। চিকিৎসা...কোনো চিন্তা নেই। তবে সব কিছুতে নিয়ম ও আইনের প্রয়োগ খুব কড়া। বাঙালিদের ঘুষ, দুর্নীতি, চোরামি_সব অভ্যাস বিমানবন্দরে রেখে আসতে হবে, বুঝলেন? তো আপা, আপনি এত চুপচাপ! না, আমি শুনছি। এ রকম অনেক কথা হতে থাকে, যা সর্বৈব সত্য_কোথাও কোনো ভুল নেই। কিন্তু বিদেশের মাটিতে পা দিয়ে ভ্রমণজনিত ক্লান্ত শরীরে দেশকে নিয়ে এ রকম কথা শুনতে ভালো লাগে না। স্পষ্টবাদী জীবনসঙ্গী এর মধ্যে যখন আরো নৈরাশ্যের ঢিল ছুড়তে থাকে_তখন মাথা ঘুরতে থাকে। ক্লান্তি-ক্রোধে রূপান্তরিত হয় গাড়িতে বসে ভ্রমণজনিত তরলতায় চোখে পানি চলে আসে। মাঝেমধ্যে ঝগড়া বাধিয়ে দিই। মেজবানকে তো কিছু বলি না। আমার পথের সাথির সঙ্গে মতের অমিল দেখা দেয়। বলি, যা কিছু বলো, বিদেশ তো আর কম দেখলাম না, খেয়েপরে বাঁচার মতো মালকড়ি থাকলে কে আর বিদেশে আসে বলো? আর আমি? আমার দেশ যেমনই হোক_তা আমার অনেক ভালোবাসার। আমার মা-বাবা বৃদ্ধ হয়ে গেলে কি আমি ফেলে যাব? তেমনি আমার দেশেই আমি মরণ পর্যন্ত থাকব। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা যে মাটিতে ঘুমাচ্ছেন_তার পাশেই আমি বাস করব_সমাহিত হব। এমতাবস্থায় প্রশ্ন আসে, আপা, আপনি কি আওয়ামী লীগ করেন। আমি ভাবি, মানুষ কি নিরপেক্ষ থাকতেই পারে না? হয় বিএনপি, না হয় আওয়ামী লীগ হতে হবে? আমি বিরক্ত হই। এই আমি বাংলাদেশি। আমার পতাকার রং সবুজ জমিনে রক্তফোঁটায় অলংকৃত। ১৬ ডিসেম্বর আমি মানুষের মর্যাদা পেয়েছি। মেহমান আপ্যায়ন ও অনাবিল হাসিতে আমার কোনো কার্পণ্য নেই। এই আমার পরিচয়। এই পরিচয়েই আমায় চেনা যায়? কিন্তু মনের অজান্তে ভাবনার মোড় ঘুরে যায়। আমার অববাহিকার নদীগুলো আর নদী নেই। শৈশবের প্রিয় ঝিকঝিক ট্রেন স্টেশনের বাইরে অন্য জায়গায় থামে। তার পেটের ভেতরকার মাদক উগরে দিতে। বুক ফোলানো অহংকারের সমুদ্রসৈকতে ঢেউয়ে আমার ভাই হারিয়ে যায়। ভেজাল খেয়ে আমার আত্মীয় রোজ কিডনি ডায়ালিসিস করে মূল্যবান প্রাণ হেলাফেলায় লাশ হয়ে পড়ে থাকে। মা তাঁর ছেলের বিরুদ্ধে মামলা করে জেলে পুরে দেন অতিষ্ঠ হয়ে। বাড়ির বাইরে বের হলে বাড়িতে ফিরব কি না এই ভয়ে নন্দলাল হয়ে যেতে হয়। এখন থেকে তাহলে কি আমার প্রবাসী ভাইদের কথার প্রতিবাদ করব না? করব না। কারণ গ্লোবাল ভিলেজের আওতায় আমাদের দেশের পচা-দুর্গন্ধ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। আমি কি তাহলে দেশ নিয়ে আর গর্বও করব না?
লেখক : সংগীতশিল্পী
লেখক : সংগীতশিল্পী
No comments