যে নির্বাচনে হেরেছেন আমাদের দুই নেত্রী! by ফজলুল বারী
কুমিল্লার প্রথম মেয়র মনিরুল হক সাক্কুকে অভিনন্দন। নির্বাচন কমিশন আর কুমিল্লা সিটির ভোটারদের অভিনন্দন এমন একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেওয়ার জন্য। এটি দেশের ইতিহাসে প্রথম একটি সম্পূর্ণ ইভিএম তথা প্রযুক্তিনির্ভর সফল নির্বাচন। একযোগে পুরো সিটি করপোরেশনে ইভিএমের সাহায্যে নিরুপদ্রব ভোট নেওয়ার পাশাপাশি, পাঁচঘণ্টার মধ্যে সম্পূর্ণ ফল ঘোষণা সম্ভব হয়েছে।
আমাদের ভোটারদের যারা কম জানেন বোঝেন, তাদের শক্তি-বুদ্ধিমত্তার প্রতি সংশয় অথবা অনাস্থা আমাদের যে সব জাতীয় নেতানেত্রীদের, এ নির্বাচন তাদের মুখে আরেকটি সজোর চটেপাঘাত! এবং আমাদের রাজনীতির প্রধান দুই কাণ্ডারি নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলের নেত্রী খালেদা জিয়া দু’জনেই প্রকারান্তরে নির্বাচনটিতে হেরেছেন! ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রচার-প্রপাগান্ডার নেত্রীর পছন্দ করা এনালগ ঘরানার প্রার্থীকে ভোটের মাধ্যমে প্রত্যাখ্যান করেছেন নবগঠিত কুমিল্লা সিটির ভোটাররা। নারায়ণগঞ্জের পর শাসকদের উদ্দেশে গোমতি পাড়ের শহর থেকে আবার যে বার্তাটি এসেছে তা হলো, সময় থাকতে বদলান। ক্ষমতা আছে বলেই যাকে খুশি প্রতিনিধি করার বা চাপিয়ে দেওয়ার দিন শেষ! যা খুশি করার, স্বেচ্ছাচারিতার বিষয়টি ভোটার জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। নারায়ণগঞ্জের অভিজ্ঞতার পর কুমিল্লায় সম্ভাবনাময় একাধিক তরুণ প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও শাসকদল কেন আফজল খানের মতো বিতর্কিত ব্যক্তিকে বেছে নিল? যিনি একই সঙ্গে ডিগবাজি বিশারদ, বয়স্ক এবং শারীরিকভাবে অক্ষম-অসুস্থ! তাকে নিয়ে সেখানে দলে স্পষ্ট কোন্দল, গোলমেলে বিষয়াদিও ছিল! এখন এসব নিয়ে ক্ষমতাওয়ালারা আত্মসমালোচনা, ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার ক্রিয়া-কর্ম ঢের করতে পারবেন। কিন্তু ঘটনা যা ঘটে গেছে তা হলো, ক্ষমতার তৃতীয় বছর শেষে একটি পরিষ্কার হার দিয়ে চতুর্থ বছর শুরু করল শেখ হাসিনার সরকার। নেগেটিভ অ্যান্ড নেগেটিভ!
জনতার ভোট নয়, সহজ একটি যন্ত্রের বিরুদ্ধে গোস্বা করে এ নির্বাচনেও খালেদা জিয়া খেলেননি! যদ্দুর জানা গেছে, বাংলাদেশে মিশুক অটো বাজারজাতকরণের পাইওনিয়ার, সামরিক শাসকদের কূটবুদ্ধিদাতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এই ইভিএম পদ্ধতির বিরুদ্ধে প্রথম খালেদা জিয়ার কান ভারী করেন। যেন ‘সাংঘাতিক মারাত্মক একটা মেশিন ম্যাডাম, আপনার ধানের শীষের সব ভোট ডিজিটাল পদ্ধিতে নৌকায় ট্রান্সফার করার জন্য এটা শেখ হাসিনার ফন্দি!’ আমাদের বিরোধীদলের নেত্রী আবার আপোসহীন! একবার যা বুঝেছেন অথবা বলেছেন তো, ঈমানদার মুসলমানদের এক কথা। অতএব প্রথম দিন থেকেই ইভিএম ‘না’! না না না।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার শামসুল হুদা অবশ্য শুরুতে এ নিয়ে আরেকটি সমস্যার কথা বলেছিলেন। শেখ হাসিনাসহ সরকারি দলের নেতারা যখন ইভিএমের পক্ষে কথা বলা শুরু করেন, তখন শামসুল হুদা হতাশা প্রকাশ করে বলেছিলেন, তারা এভাবে কাজটি ঠিক করছেন না। কারণ আমাদের প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতিটি হলো, সরকারি দল যখন যা বলবে বা যার পক্ষে বলবে, বিরোধীদল ছিদ্রান্বেষণ করে এর বিরুদ্ধে বলবেই। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ প্রতিবেশী ভারতেও দীর্ঘদিন ধরে সফলভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসা ইভিএম যেন শুরু থেকে বাংলাদেশে এমন একটি রাজনৈতিক জেদাজেদির মধ্যেই পড়েছে। এখন আবার ইভিএমকে নিজেদের সুবিধামতো কাজেও লাগাচ্ছে বিএনপি! অথবা তারা এখন এর ঢালাও বিরোধিতার ভিকটিম!
যেমন নারায়ণগঞ্জের ভোটে আইভী জোয়ারে বিএনপির প্রার্থী তৈমুর আলম খোন্দকারের কোন সম্ভবনাই ছিল না। তৃতীয় স্থান ছিল মাস্ট! সে কারণে প্রথমে ইভিএম বিরোধিতায় দলের প্রার্থীকে বসিয়ে দিতে না পারলেও পরে সেনাবাহিনী ইস্যুতে তারা শেষ পর্যন্ত তাতে কামিয়াব-সমর্থ হয়! কারণ শুরু থেকে বিএনপির মনে সেই যে ভয় ঢুকেছে, তাহলো কোনো একটি নির্বাচনে তাদের উপস্থিতিতে ইভিএম কোনো একবার জায়েজ হয়ে গেলে পরে এড়িয়ে চলার নৈতিক জায়গা তথা ঈমানটি তাদের ফুটো অথবা দুর্বল হয়ে যাবে! অতএব আংশিক ইভিএম যুক্ত চট্টল সিটি নির্বাচনের মেয়র নির্বাচনের বিজয় উপভোগ করলেও আর কোথাও তারা সিম্পল যন্ত্রটির আশেপাশেও ঘেঁষতে চাইছে না! সামনের নরসিংদী পৌর নির্বাচনেও তাদের কোনো সম্ভাবনা নেই!
কারণ সেখানকার জনপ্রিয় মেয়র লোকমান হত্যাকে কেন্দ্র করে সেখানে তার প্রতি সেমপ্যাথি ভোটের নির্বাচন হবে। নিহত লোকমানের ভাই সেখানে যেহেতু প্রার্থী, তাই সিমপ্যাথি ভোট সমগ্র তার পক্ষেই যাবে। সরকার কী করেছে না করছে এসব কোনো ফ্যাক্টর হবে না! তাই পরাজয় আগেভাগে জেনেই ইভিএমকে দোষ দিয়ে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে দলের প্রার্থী! কিন্তু কুমিল্লায়তো তাদের সম্ভাবনাময় প্রার্থী ছিলেন এবং তিনি জিতেছেনও। এরপরও সেখানে নির্বাচন না করা খালেদা জিয়ার এক ধরনের পরাজয়! ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট দিতে গিয়ে সেখানে সাধারণ নিরক্ষর প্রার্থীরাও যে স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাসের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, তা খালেদা জিয়ার অবস্থানের বিরুদ্ধে। আর সেখানে জনতার ভোটে বিজয়ী প্রার্থী ইভিএম ভোটিংয়ের পক্ষে যে স্বতঃস্ফূর্ত সনদ দিয়েছেন, তাতে করে তেত্রিশ বছর দল করা একজনের বিজয় উপভোগের নৈতিক অবস্থান কী বিএনপি রাখে? কুমিল্লার অভিজ্ঞতায় কী দল তার অবস্থান বদলাবে? না চালিয়ে যাবে ভুল এক এনালগ জেদাজেদি?
কুমিল্লার পরাজয় স্বীকার করে নিয়ে বিজয়ী নতুন সিটি মেয়রকে সবার আগে অভিনন্দন জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ। এর সঙ্গে বলেছেন, সেখানে সরকারের নৈতিক বিজয় হওয়ার কথা! হানিফ বলেন, ‘ইভিএম পদ্ধতি নিয়ে বিএনপি যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল, অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সেটা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। নির্বাচনে কে হারলো কে জিতলো সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো এই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। বর্তমান সরকারের সময় নির্বাচন কমিশন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে পারছে। জয় পরাজয় জনগণের ভোটে নির্ধারিত হয়। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার জন্যে সরকার যে প্রক্রিয়াগুলো চালিয়েছে তা সঠিক ছিল’ ইত্যাদি।
মাহবুব-উল-আলম হানিফের কথায় একটি সত্যতা আছে, রাজনৈতিক নৈতিকতার ওপর এখনও দাঁড়িয়ে আছে এ সরকার, তাহলো দৃশ্যত এই সরকার এখন পর্যন্ত কোনো নির্বাচনে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করেনি। ক্ষমতায় থেকেও ইউপি, পৌর নির্বাচনে তুলনামূলক খারাপ রেজাল্ট করা, হবিগঞ্জের একটি সংসদীয় আসন খোয়ানো, চট্টল, নারায়ণগঞ্জ সিটি ইলেকশনে হেরে যাওয়ার পরেও নয়। নারায়ণগঞ্জে দলীয় প্রার্থী শামীম ওসমান যাতে কোনো অঘটন ঘটানোর চেষ্টা করতে না পারেন সে কারণে ভোটের দিন দুপুর বেলাতেই র্যাব দিয়ে তাকে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে আসা হয়। এর সবই একশতভাগ সত্য।
কিন্তু একটা দল একটি নির্বাচনে অংশ নেয়, একজন ভালো প্রার্থী ঠিক করে তো জয়ের আশায়। একটি ক্ষমতাসীন দলের জন্য একটি সুষ্ঠু নির্বাচনে জয়লাভ নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। এর অন্যতম হচ্ছে, ভোটে জিতে দাবি করা তার পক্ষের জনগণের আস্থা-সমর্থন অটুট আছে। কিন্তু নারায়ণগঞ্জ আর কুমিল্লায় সরকারি দলের উদ্দেশে জনগণের বার্তাটি কী? আওয়ামী লীগের গণ্ডায় গণ্ডায় কেন্দ্রীয় নেতা, ঢাবি-ইডেনের মেয়ে মহল, সমস্ত অঙ্গসংগঠন দিয়ে প্রচার চালিয়ে নারায়ণগঞ্জে দলের প্রার্থী দল এক রকম অপাংক্তেয় করে দেওয়া একজন নারী প্রার্থীর কাছে লক্ষাধিক ভোটে হেরেছে! কুমিল্লায় সাক্কু দলের ইভিএম-সেনাবাহিনী ইস্যুর প্রেস্টিজ রাখতে দল থেকে অব্যাহতি নেওয়ায় বিএনপির একজন নেতাও তার পক্ষে প্রচারনা চালাননি। আওয়ামী লীগের কুমিল্লার এমপিরা সবাই মিলে দলের প্রার্থীর পক্ষে ভোট চেয়েছেন। ঢাকা থেকে নেতারা গেছেন। এসবের কারণে কী দলের হতাশ শাসনের পাপ-তাপে সেখানে দলীয় প্রার্থীর এমন ভরাডুবি ঘটেছে? না এমন স্বাভাবিক ভরাডুবির জন্য বিতর্কিত প্রার্থী আর তার ছেলেরা-সাঙ্গপাঙ্গদের আমলনামাই ছিল যথেষ্ট?
এই যে বড় আশা নিয়ে আওয়ামী লীগ নামের দলটিকে গত নির্বাচনে উজাড় করে প্রায় সব ভোট দিয়ে দেওয়াতে এই দলটি দেশের মানুষকে আর মানুষ মনে করে না। অকল্পনীয় দ্রব্যমূল্য, ছাত্রলীগ নামধারীদের অপ্রতিরোধ্য গুণ্ডামি, শেয়ারবাজার লুটপাট সত্ত্বেও সরকারের নির্লিপ্ত রহস্যজনক আচরণ, এক মন্ত্রীর বিশ্বব্যাংক-ঘোষিত দুর্নীতি সত্ত্বেও তাকে প্রটেকশন দেওয়া, একাধিক মন্ত্রীর বেপরোয়া কথাবার্তা, কামাল মজুমদারদের মতো এমপিদের প্রকাশ্যে মস্তানি, এসব কী ভোটারদের স্পর্শ করে না? এই সরকারের আমলেই কী কুমিল্লায় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত প্রার্থীর প্রশ্রয়ে সংঘটিত একটি খুনের ঘটনা নারায়ণগঞ্জের ‘উনাকে’ দিয়ে ধামাচাপা দেওয়া হয়নি? এসব কুমিল্লার লোকজন জানলেও সরকারি লোকজন কী জানে না?
যিনি জিতেছেন কুমিল্লায় তার চরিত্রও ফুলের মতো পবিত্র না। কিন্তু বলা হয়েছে, যিনি সরকারি দলের নমিনেশন পেয়েছেন, তিনি এবং তার পোষ্যদের কাণ্ডকীর্তি এই সরকারের জমানাতেই এত বিশ্রী পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে এসবের আড়ালে তা ঢেকে গেছে। সরকারি দলের মেয়র প্রার্থী আবার একা নয়, নিজেসহ পরিবারের চার সদস্য মিলে নির্বাচন করেছেন! এসব তাকে ভোটারদের কাছে আরো লোভী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কুমিল্লার জনগণ সব দেখেশুনে এমন একজন লোভী মানুষ বা তার পরিবারের কাছে কেন তাদের সিটি করপোরেশন বর্গা দেবে? এমন অনেক প্রশ্ন সরকারের উদ্দেশে ছুড়ে দিয়েছে এই নির্বাচন। আগামীতে আরও কথাবার্তা বেরুবে। সরকারি লোকজন সুষ্ঠু নির্বাচনের আত্মতুষ্টি নিয়ে যত বড়াই, গর্ব দেখাক না কেন, সর্বশেষ এই নির্বাচনও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, সরকারের জনপ্রিয়তা পড়তির দিকে। সরকারি লোকজন এটি মানলে পড়তি ফর্মের সেখান থেকে উঠে আসার চেষ্টা করতে পারবেন। আর যদি কিছুই হয়নি, স্থানীয় সংস্থার নির্বাচন জনপ্রিয়তা বাড়ার কমার মাপকাঠি না, জাতীয় লোক দেখানো মেকি বক্তৃতা দিয়ে বেড়ান, তাহলে কিন্তু নিচের দিকে শুধু নামতেই থাকবেন। রাজনীতিতে এই নিচের দিকে নামার সরল-সোজা শব্দটি হলো ‘আউট’।
জনতার ভোট নয়, সহজ একটি যন্ত্রের বিরুদ্ধে গোস্বা করে এ নির্বাচনেও খালেদা জিয়া খেলেননি! যদ্দুর জানা গেছে, বাংলাদেশে মিশুক অটো বাজারজাতকরণের পাইওনিয়ার, সামরিক শাসকদের কূটবুদ্ধিদাতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এই ইভিএম পদ্ধতির বিরুদ্ধে প্রথম খালেদা জিয়ার কান ভারী করেন। যেন ‘সাংঘাতিক মারাত্মক একটা মেশিন ম্যাডাম, আপনার ধানের শীষের সব ভোট ডিজিটাল পদ্ধিতে নৌকায় ট্রান্সফার করার জন্য এটা শেখ হাসিনার ফন্দি!’ আমাদের বিরোধীদলের নেত্রী আবার আপোসহীন! একবার যা বুঝেছেন অথবা বলেছেন তো, ঈমানদার মুসলমানদের এক কথা। অতএব প্রথম দিন থেকেই ইভিএম ‘না’! না না না।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার শামসুল হুদা অবশ্য শুরুতে এ নিয়ে আরেকটি সমস্যার কথা বলেছিলেন। শেখ হাসিনাসহ সরকারি দলের নেতারা যখন ইভিএমের পক্ষে কথা বলা শুরু করেন, তখন শামসুল হুদা হতাশা প্রকাশ করে বলেছিলেন, তারা এভাবে কাজটি ঠিক করছেন না। কারণ আমাদের প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতিটি হলো, সরকারি দল যখন যা বলবে বা যার পক্ষে বলবে, বিরোধীদল ছিদ্রান্বেষণ করে এর বিরুদ্ধে বলবেই। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ প্রতিবেশী ভারতেও দীর্ঘদিন ধরে সফলভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসা ইভিএম যেন শুরু থেকে বাংলাদেশে এমন একটি রাজনৈতিক জেদাজেদির মধ্যেই পড়েছে। এখন আবার ইভিএমকে নিজেদের সুবিধামতো কাজেও লাগাচ্ছে বিএনপি! অথবা তারা এখন এর ঢালাও বিরোধিতার ভিকটিম!
যেমন নারায়ণগঞ্জের ভোটে আইভী জোয়ারে বিএনপির প্রার্থী তৈমুর আলম খোন্দকারের কোন সম্ভবনাই ছিল না। তৃতীয় স্থান ছিল মাস্ট! সে কারণে প্রথমে ইভিএম বিরোধিতায় দলের প্রার্থীকে বসিয়ে দিতে না পারলেও পরে সেনাবাহিনী ইস্যুতে তারা শেষ পর্যন্ত তাতে কামিয়াব-সমর্থ হয়! কারণ শুরু থেকে বিএনপির মনে সেই যে ভয় ঢুকেছে, তাহলো কোনো একটি নির্বাচনে তাদের উপস্থিতিতে ইভিএম কোনো একবার জায়েজ হয়ে গেলে পরে এড়িয়ে চলার নৈতিক জায়গা তথা ঈমানটি তাদের ফুটো অথবা দুর্বল হয়ে যাবে! অতএব আংশিক ইভিএম যুক্ত চট্টল সিটি নির্বাচনের মেয়র নির্বাচনের বিজয় উপভোগ করলেও আর কোথাও তারা সিম্পল যন্ত্রটির আশেপাশেও ঘেঁষতে চাইছে না! সামনের নরসিংদী পৌর নির্বাচনেও তাদের কোনো সম্ভাবনা নেই!
কারণ সেখানকার জনপ্রিয় মেয়র লোকমান হত্যাকে কেন্দ্র করে সেখানে তার প্রতি সেমপ্যাথি ভোটের নির্বাচন হবে। নিহত লোকমানের ভাই সেখানে যেহেতু প্রার্থী, তাই সিমপ্যাথি ভোট সমগ্র তার পক্ষেই যাবে। সরকার কী করেছে না করছে এসব কোনো ফ্যাক্টর হবে না! তাই পরাজয় আগেভাগে জেনেই ইভিএমকে দোষ দিয়ে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে দলের প্রার্থী! কিন্তু কুমিল্লায়তো তাদের সম্ভাবনাময় প্রার্থী ছিলেন এবং তিনি জিতেছেনও। এরপরও সেখানে নির্বাচন না করা খালেদা জিয়ার এক ধরনের পরাজয়! ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট দিতে গিয়ে সেখানে সাধারণ নিরক্ষর প্রার্থীরাও যে স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাসের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, তা খালেদা জিয়ার অবস্থানের বিরুদ্ধে। আর সেখানে জনতার ভোটে বিজয়ী প্রার্থী ইভিএম ভোটিংয়ের পক্ষে যে স্বতঃস্ফূর্ত সনদ দিয়েছেন, তাতে করে তেত্রিশ বছর দল করা একজনের বিজয় উপভোগের নৈতিক অবস্থান কী বিএনপি রাখে? কুমিল্লার অভিজ্ঞতায় কী দল তার অবস্থান বদলাবে? না চালিয়ে যাবে ভুল এক এনালগ জেদাজেদি?
কুমিল্লার পরাজয় স্বীকার করে নিয়ে বিজয়ী নতুন সিটি মেয়রকে সবার আগে অভিনন্দন জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ। এর সঙ্গে বলেছেন, সেখানে সরকারের নৈতিক বিজয় হওয়ার কথা! হানিফ বলেন, ‘ইভিএম পদ্ধতি নিয়ে বিএনপি যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল, অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সেটা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। নির্বাচনে কে হারলো কে জিতলো সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো এই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। বর্তমান সরকারের সময় নির্বাচন কমিশন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে পারছে। জয় পরাজয় জনগণের ভোটে নির্ধারিত হয়। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার জন্যে সরকার যে প্রক্রিয়াগুলো চালিয়েছে তা সঠিক ছিল’ ইত্যাদি।
মাহবুব-উল-আলম হানিফের কথায় একটি সত্যতা আছে, রাজনৈতিক নৈতিকতার ওপর এখনও দাঁড়িয়ে আছে এ সরকার, তাহলো দৃশ্যত এই সরকার এখন পর্যন্ত কোনো নির্বাচনে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করেনি। ক্ষমতায় থেকেও ইউপি, পৌর নির্বাচনে তুলনামূলক খারাপ রেজাল্ট করা, হবিগঞ্জের একটি সংসদীয় আসন খোয়ানো, চট্টল, নারায়ণগঞ্জ সিটি ইলেকশনে হেরে যাওয়ার পরেও নয়। নারায়ণগঞ্জে দলীয় প্রার্থী শামীম ওসমান যাতে কোনো অঘটন ঘটানোর চেষ্টা করতে না পারেন সে কারণে ভোটের দিন দুপুর বেলাতেই র্যাব দিয়ে তাকে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে আসা হয়। এর সবই একশতভাগ সত্য।
কিন্তু একটা দল একটি নির্বাচনে অংশ নেয়, একজন ভালো প্রার্থী ঠিক করে তো জয়ের আশায়। একটি ক্ষমতাসীন দলের জন্য একটি সুষ্ঠু নির্বাচনে জয়লাভ নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। এর অন্যতম হচ্ছে, ভোটে জিতে দাবি করা তার পক্ষের জনগণের আস্থা-সমর্থন অটুট আছে। কিন্তু নারায়ণগঞ্জ আর কুমিল্লায় সরকারি দলের উদ্দেশে জনগণের বার্তাটি কী? আওয়ামী লীগের গণ্ডায় গণ্ডায় কেন্দ্রীয় নেতা, ঢাবি-ইডেনের মেয়ে মহল, সমস্ত অঙ্গসংগঠন দিয়ে প্রচার চালিয়ে নারায়ণগঞ্জে দলের প্রার্থী দল এক রকম অপাংক্তেয় করে দেওয়া একজন নারী প্রার্থীর কাছে লক্ষাধিক ভোটে হেরেছে! কুমিল্লায় সাক্কু দলের ইভিএম-সেনাবাহিনী ইস্যুর প্রেস্টিজ রাখতে দল থেকে অব্যাহতি নেওয়ায় বিএনপির একজন নেতাও তার পক্ষে প্রচারনা চালাননি। আওয়ামী লীগের কুমিল্লার এমপিরা সবাই মিলে দলের প্রার্থীর পক্ষে ভোট চেয়েছেন। ঢাকা থেকে নেতারা গেছেন। এসবের কারণে কী দলের হতাশ শাসনের পাপ-তাপে সেখানে দলীয় প্রার্থীর এমন ভরাডুবি ঘটেছে? না এমন স্বাভাবিক ভরাডুবির জন্য বিতর্কিত প্রার্থী আর তার ছেলেরা-সাঙ্গপাঙ্গদের আমলনামাই ছিল যথেষ্ট?
এই যে বড় আশা নিয়ে আওয়ামী লীগ নামের দলটিকে গত নির্বাচনে উজাড় করে প্রায় সব ভোট দিয়ে দেওয়াতে এই দলটি দেশের মানুষকে আর মানুষ মনে করে না। অকল্পনীয় দ্রব্যমূল্য, ছাত্রলীগ নামধারীদের অপ্রতিরোধ্য গুণ্ডামি, শেয়ারবাজার লুটপাট সত্ত্বেও সরকারের নির্লিপ্ত রহস্যজনক আচরণ, এক মন্ত্রীর বিশ্বব্যাংক-ঘোষিত দুর্নীতি সত্ত্বেও তাকে প্রটেকশন দেওয়া, একাধিক মন্ত্রীর বেপরোয়া কথাবার্তা, কামাল মজুমদারদের মতো এমপিদের প্রকাশ্যে মস্তানি, এসব কী ভোটারদের স্পর্শ করে না? এই সরকারের আমলেই কী কুমিল্লায় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত প্রার্থীর প্রশ্রয়ে সংঘটিত একটি খুনের ঘটনা নারায়ণগঞ্জের ‘উনাকে’ দিয়ে ধামাচাপা দেওয়া হয়নি? এসব কুমিল্লার লোকজন জানলেও সরকারি লোকজন কী জানে না?
যিনি জিতেছেন কুমিল্লায় তার চরিত্রও ফুলের মতো পবিত্র না। কিন্তু বলা হয়েছে, যিনি সরকারি দলের নমিনেশন পেয়েছেন, তিনি এবং তার পোষ্যদের কাণ্ডকীর্তি এই সরকারের জমানাতেই এত বিশ্রী পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে এসবের আড়ালে তা ঢেকে গেছে। সরকারি দলের মেয়র প্রার্থী আবার একা নয়, নিজেসহ পরিবারের চার সদস্য মিলে নির্বাচন করেছেন! এসব তাকে ভোটারদের কাছে আরো লোভী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কুমিল্লার জনগণ সব দেখেশুনে এমন একজন লোভী মানুষ বা তার পরিবারের কাছে কেন তাদের সিটি করপোরেশন বর্গা দেবে? এমন অনেক প্রশ্ন সরকারের উদ্দেশে ছুড়ে দিয়েছে এই নির্বাচন। আগামীতে আরও কথাবার্তা বেরুবে। সরকারি লোকজন সুষ্ঠু নির্বাচনের আত্মতুষ্টি নিয়ে যত বড়াই, গর্ব দেখাক না কেন, সর্বশেষ এই নির্বাচনও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, সরকারের জনপ্রিয়তা পড়তির দিকে। সরকারি লোকজন এটি মানলে পড়তি ফর্মের সেখান থেকে উঠে আসার চেষ্টা করতে পারবেন। আর যদি কিছুই হয়নি, স্থানীয় সংস্থার নির্বাচন জনপ্রিয়তা বাড়ার কমার মাপকাঠি না, জাতীয় লোক দেখানো মেকি বক্তৃতা দিয়ে বেড়ান, তাহলে কিন্তু নিচের দিকে শুধু নামতেই থাকবেন। রাজনীতিতে এই নিচের দিকে নামার সরল-সোজা শব্দটি হলো ‘আউট’।
No comments