মৃদুকণ্ঠ : মহাজোট সরকারের ৩ বছর-একনজরে তিন বছরের অর্থনীতি by খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ
অনেক ত্যাগ-বঞ্চনার পর ১৯৭২ সালে হিমালয় পরিমাণ আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল বাংলাদেশ। ৪০ বছরের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে আলোচনা চলছে। বছর ধরেই চলবে। আশা যখন কল্পনার ডানা মেলে অসীম শূন্যে উঠে যায়, তখন যৌক্তিক অর্জনের মধ্যেও অপ্রাপ্তি থেকে যায়। তবু ৪০ বছরের অর্জনকে অনেকেই আশাপ্রদ বলে মত রেখেছেন। কেউ কেউ আশাতীতও বলেছেন। আরো একটি প্রেক্ষিত এখন আলোচনায় এসেছে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত
একটি গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে সন্ত্রাস, মানবাধিকার লঙ্ঘন, দুর্নীতি এবং স্বেচ্ছাচার যেকোনো বিচারে সীমা অতিক্রম করেছিল। ফলে দুই বছর অগণতান্ত্রিক সরকারের অধীনে চলতে হয়েছে। তারপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে মোট ভোটারসংখ্যার ৮৭.১৬ শতাংশ মানুষ ভোটকেন্দ্রে এসে ভোট দিয়ে ভোটবিপ্লব সাধন করেছিল। ভোটকে গণতান্ত্রিক অস্ত্রে পরিণত করার এমন দৃষ্টান্ত বিরল। এতদঞ্চলে এত অধিক হারে ভোটদানের নজির মেলে না। তিন-চতুর্থাংশ সংসদ-আসনে জয়ী হয়ে ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে আওযামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গঠন করেছিল।
এই সরকারকে ক্ষমতাসীন করার পেছনে জনসমর্থন যেমন সুউচ্চ ছিল, তেমনি ক্ষমতারোহণলগ্নে জনগণের প্রত্যাশাও ছিল গগনচুম্বী। যেকোনো সরকারের জন্য এমন পরিস্থিতি একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ। ২০১২ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে মহাজোট সরকারের তিন বছর পূর্ণ হবে। তিন বছর আগের অবস্থার সঙ্গে আমরা মিলিয়ে দেখব বর্তমান অবস্থা, বিশেষ করে অর্থনীতির অঙ্গনের অবস্থা। অর্থনৈতিক স্বস্তি-অস্বস্তির বিষয়গুলো একনজরে দেখার চেষ্টা করা যাক।
স্মরণ করা যাক তিন বছর আগের বিদ্যুতের অবস্থার দিকে। চারদলীয় জোট সরকারের আমল থেকে প্রলম্বিত হয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর সময়েও বাংলাদেশে বিদ্যুতের অবস্থা ছিল মেঘাচ্ছন্ন আকাশে বিদ্যুৎ চমকের মতো। কয়েক সেকেন্ড বিদ্যুৎ চমকের পর যেমন ঘন মেঘের অন্ধকারে সব ঢেকে যায়, তেমনি ঢাকার অবস্থা ছিল এক ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের পর এক ঘণ্টা আলো। মফস্বলের অবস্থা আরো নাজুক। মফস্বল শহরগুলোতে দিনে দু-এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকত। গ্রামগঞ্জে বিদ্যুতের কোনো খবর ছিল না। এমন অবস্থার মধ্যে ২০০৯ সালের গ্রীষ্মের আগমনের শুরুতেই ঢাকায় বিদ্যুতের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো পানির সংকট। পানির পাম্প চালানোর মতো বিদ্যুৎও ছিল না। জনস্মৃতি বড়ই স্বল্পজীবী। তবু স্মরণ করছি, ঢাকার মহল্লায় মহল্লায় কলসিমিছিল, হাঁড়ি-পাতিলের মিছিল, বাতির অভাবে সন্ধ্যায় মশাল মিছিল। বিরোধী দলকে তখন বেজায় খুশি মনে হয়েছিল। বিদ্যুৎ বেগেই বুঝি সরকার পড়ে যাবে। সরকারের অবস্থা নাজুক। আশার বাণী শোনানো দুষ্কর। স্বল্প সময়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতকরণ ছিল অসম্ভব। সরকার বলেছিল, দুই বছরে তারা আলো দেবে।
তিন বছর পর অবস্থা মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করা যাক। ঢাকায় এখন ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিং হয় না। কখনো কখনো হলেও তা যৌক্তিক সীমার মধ্যে। মফস্বল শহরগুলোতে প্রায় অবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা। এমনকি গ্রামগঞ্জে কুঁড়েঘরে, বাজার-দোকানে মিটমিট করে জ্বলছে বিদ্যুৎসাশ্রয়ী বাল্ব। কৃষকরা সেচের সময় রাতের নির্দিষ্ট সময়ে অবিচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ পেয়ে থাকেন। তিন বছর আগের তুলনায় পরিবর্তনটা নাটকীয়। তিন বছর আগের লোডশেডিংয়ের জন্য বিক্ষোভ আর সরকারের মুণ্ডুপাত আমরা করেছিলাম।
এখন কি অভাবিত উন্নতির জন্য প্রশংসা করছি? আকাশ-মিডিয়া এবং প্রিন্ট মিডিয়ায় তেমনটা চোখে পড়ে না। সভা-সেমিনারেও তো শুনি না। সরকারের কঠোর সমালোচক একজন তথাকথিত 'নিরপেক্ষবাদী' কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, 'বিদ্যুৎ সচল থাকবে, আলো জ্বলবে-এটাই তো স্বাভাবিক। এর জন্য প্রশংসা কেন? বিদ্যুৎ না থাকাটা অস্বাভাবিক, সেটা সমালোচনাযোগ্য।' অবশ্য চারদলীয় জোট আমলে যখন লোডশেডিং লেগেই থাকত, তখন তাঁর মুখ বা কলম থেকে এমন অমৃতবাণী বের হয়নি!
এ গেল মুদ্রার এক পিঠ। অন্য পিঠের চিত্র ভিন্ন। মাত্র দুই-আড়াই বছরে লোডশেডিং সামাল দিতে গিয়ে সরকার কুইক রেন্টাল পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ সংগ্রহ করেছে অত্যন্ত উচ্চমূল্যে। সরকারের তেল আমদানি-ব্যয় মেটাতে ব্যাংকঋণ বেড়ে গেছে, সাবসিডিও বৃদ্ধি পেয়েছে অসহনীয়ভাবে। এটি অর্থনীতিকে বিরাট ঝাঁকুনি দিয়েছে বলা যায়, এটিই অর্থনীতির বিষবৃক্ষ, যা থেকে জন্ম নিচ্ছে অনেক সমস্যা। তবে স্বল্প সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে এর বিকল্পও ছিল না। স্বাভাবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে বিদ্যুৎ পেতে কমপক্ষে পাঁচ বছর লাগত, যা সাধারণ মানুষ মেনে নিত না। তাই সরকারকে এ ধরনের ট্রেড অফ করতে হয়েছে।
জিডিপি বা জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি দেশের অর্থনীতির বহুল ব্যবহৃত পরিমাপক। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সময়কালে (সেনা ও স্বৈরশাসক আমলে) বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩.২ শতাংশ। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত (গণতান্ত্রিক ও তত্ত্বাবধায়ক আমলে) জাতীয় আয়ের গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছিল ৪.৫ শতাংশে। বর্তমান সরকারের আমলে গত তিন বছরে বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ শতাংশের বেশি। জিডিপি সূচকে গত তিন বছরের অর্জন চমকপ্রদ। পূর্ববর্তী যেকোনো সরকারের আমলের চেয়ে বেশি।
সমসাময়িক সময়ে উপমহাদেশের রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে প্রতীয়মান হচ্ছে যে জাতীয় আয় প্রবৃদ্ধির হারের দিক থেকে এ অঞ্চলে একমাত্র ভারতের পর বাংলাদেশের অবস্থান। বর্তমান অর্থবছরে সমন্বয়ের পর ভারতের প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশের আশেপাশে থাকবে। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ অর্জিত না হলেও ৬.৮ শতাংশের মতো থাকবে। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও মালদ্বীপের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান ওপরে। সর্বনিম্নে অবস্থান করছে পাকিস্তান, ৪ শতাংশ বৃদ্ধি টার্গেট পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে ৩.৭ শতাংশে, যা নেমে ৩.৫-এ দাঁড়াতে পারে।
মুদ্রাস্ফীতির উচ্চহার নিয়ে বিরূপ সমালোচনা তীব্র। হওয়ারও কথা। কারণ বাজারে গিয়ে যখন পকেটে টান পড়ে, তখন ক্ষুব্ধ হওয়া স্বাভাবিক। তবে এ কথা মনে রাখতে হবে যে আমরা মঙ্গলগ্রহের বাসিন্দা নই। পৃথিবী নামক গ্রহেই বাংলাদেশের অবস্থান। অন্যান্য দেশের অবস্থা কেমন? ইউরোপের অনেক দেশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধিতে চলে গেছে। দূরের দেশের কথা বাদ দিই। পড়শী দেশগুলোর অবস্থা কেমন? এ উপমহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ও ভারত উচ্চ মুদ্রাস্ফীতিতে অনেকটা সমপর্যায়ে রয়েছে। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও মালদ্বীপের মুদ্রাস্ফীতি বাংলাদেশ ও ভারতের তুলনায় অনেক বেশি। পাকিস্তান ১৫ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে কাতরাচ্ছে। দেশে মুদ্রাস্ফীতির কষাঘাত তীব্র। তবে প্রতিবেশীদের চেয়ে আমরা অপেক্ষাকৃত কম কষ্টে আছি-এটুকু সান্ত্বনা তো নিতেই পারি।
দরিদ্র দেশে খাদ্যমূল্যস্ফীতি সবচেয়ে বেদনাদায়ক। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়। খাদ্যমূল্যস্ফীতির বেদনাকে অবদমিত রাখার প্রয়াস ও সাফল্য উল্লেখ করতেই হয়। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষক খাদ্যের জন্য বাজারনির্ভর ছিল না। স্ব-উৎপাদিত খাদ্যশস্যে ক্ষুণি্নবৃত্তি নিবারণ করেছে। খাদ্যমূল্যস্ফীতি কৃষককে আঘাত করেনি। বরং উচ্চমূল্যে উদ্বৃত্ত শস্য বিক্রি করে আয় বৃদ্ধি করেছে। দরিদ্র অকৃষকদের জন্য সরকার বাজারের চেয়ে অনেক কম মূল্যে খোলাবাজারে চাল বিক্রি করেছে অত্যন্ত সফলভাবে। সঠিক সময়ে, সঠিক পরিমাণে, সঠিক স্থানে এবং সঠিক টার্গেট গ্রুপের কাছে ন্যায্যমূল্যে চাল পেঁৗছে দেয়াটা ছিল একটা সার্থক প্রয়াস। সরকারি উদ্যোগে এমন সাফল্য কমই চোখে পড়ে। জমিতে অধিক ফলন এবং বাজারে সফল অপারেশন মিলে খাদ্যমূল্যস্ফীতির তীব্রতা প্রশমিত করতে পেরেছে দরিদ্র কৃষক এবং অকৃষক উভয় ধরনের দুর্বল জনগোষ্ঠীর মধ্যে। খাদ্যমূল্যস্ফীতি রোধে সক্ষম না হলেও এর উত্তাপ থেকে দুর্বল ভুক্তভোগীদের রক্ষা করার কৃতিত্ব সরকার পেতে পারে।
চারদলীয় জোট সরকারের শেষ বছরে অর্থাৎ ২০০৫-০৬ অর্থবছরে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ৪.৮৭ বিলিয়ন ডলার। ২০১০-১১ অর্থবছরে রেমিট্যান্সের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১.৬৫ বিলিয়ন ডলারে। ২০১১-১২ অর্থবছরে সাড়ে বারো বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ২০০৮-০৯ অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২২.৪২ শতাংশ। ২০০৯-১০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১৩.৪০ শতাংশ। ইধংব বা ভিত্তি অনেক বেড়ে গেলে প্রবৃদ্ধির হার হ্রাসপ্রাপ্ত হয়, যদিও প্রবৃদ্ধি হয় সন্তোষজনক। কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো, অনেক মিডিয়ায় স্ফীত ভিত্তির ওপর 'প্রবৃদ্ধির হার' হ্রাস পাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে এবং প্রকৃত প্রবৃদ্ধির পরিমাণ অনেক ক্ষেত্রে উল্লেখ করা হয়নি।
২০০৬ সালে (চারদলীয় সরকারের শেষ সময়) বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল পাঁচ বিলিয়ন ডলার, যা ২০১১ সালের ডিসেম্বরে এসে দাঁড়িয়েছে ৯.৫ বিলিয়ন ডলারে। পাঁচ বছরে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। অথচ মিডিয়া রিপোর্টিংয়ে রিজার্ভ ১০ বিলিয়ন ডলার থেকে নেমে যাওয়ায় ক্রমাগত শঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। ভাবখানা এমন যে রিজার্ভ আবার ওঠানামা করবে কেন? উপাত্ত যেমন হ্রাস-বৃদ্ধিযোগ্য, ফলাফলও তেমনি। রিজার্ভের বর্তমান অবস্থান অর্থনৈতিক বিচারে যথেষ্ট শক্তিশালী।
চারদলীয় সরকারের শেষ বছরে ২০০৬ সালে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু আয় ছিল ৪৮৭ মার্কিন ডলার। ২০১১ সালে এসে মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ৮১৮ ডলারে। বর্তমান সরকারের তিন বছর জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি নিরবচ্ছিন্নভাবে উচ্চমাত্রায় ছিল বলেই মাথাপিছু আয় এতটা সন্তোষজনক।
প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান সরকারের আরেক দিক পরিবর্তনকারী মাইলফলক সাফল্য হলো, আয়-বণ্টনব্যবস্থা। চার বছর আগে আয়-বণ্টন পরিমাপক গিনি কোয়েফিশিয়েন্ট একটি চরম বিষম বণ্টন ইঙ্গিত করত। আরো ভয়ংকর ছিল পূর্ববর্তী বছরগুলোতে গিনি কোয়েফিশিয়েন্টের ট্রেন্ড বা গতি-প্রকৃতি, যা ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী ছিল। অতি সাম্প্রতিককালে বৈষম্যের ক্রমবৃদ্ধির প্রক্রিয়ায় ছেদ পড়েছে। গিনি কোয়েফিশিয়েন্ট ঘুরে দাঁড়িয়েছে, যদিও তা সামান্য। যার অর্থ হলো, বৈষম্যের ঊর্ধ্বগতি থেমে গেছে। বৈষম্যের সংকোচন এখনো প্রবলভাবে চোখে পড়ে না। তবে দৃষ্টি এড়ায়ও না। তিন বছর ধরে মঙ্গার কথা শোনা যায় না। অনাহারে মৃত্যুর খবর আসে না। বরং পল্লী এলাকায় আয়বৃদ্ধিসহ জীবন যাপনের মান বৃদ্ধি দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
গত ২০০৮ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে বছরে পাঁচ হাজার কোটি টাকার অধিক কৃষিতে ভর্তুকি দিয়েছে। গত বছর ১২ হাজার কোটি টাকা কৃষিঋণ বিতরণ করেছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী উল্লেখযোগ্য পরিমাণে স্ফীত করেছে। ফলে পল্লী এলাকায় অর্থপ্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে, উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে, ক্ষুদ্র মূলধন গড়ে উঠেছে। এ ছাড়া ১০ টাকার ব্যাংক হিসাব খোলাসহ কিছু সংস্কারকর্মের ফলে দুর্নীতি হ্রাস পেয়েছে, দক্ষতা বেড়েছে, সঞ্চয়প্রবণতা বিকশিত হচ্ছে, সর্বোপরি মৃতপ্রায় গ্রামীণ অর্থনীতি প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। গ্রামীণ অর্থনীতির ক্রমবিকাশের মাধ্যমে ধীরে ধীরে আয়বৈষম্য হ্রাস পাবে। বাংলাদেশ সত্যিকারভাবে একটি কল্যাণরাষ্ট্র গঠনের পথে পরিচালিত হবে। গত তিন বছরে তেমন একটি সম্ভাবনার ক্ষীণ সূচনা দৃষ্ট হয়।
গত তিন বছরের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় অস্থিরতা এবং অব্যবস্থাপনা ঘটেছিল পুঁজিবাজারে। সেই সঙ্গে অপপ্রচারও হয়েছিল। বলা হয়েছিল যে ৩৩ লাখ বিও হিসাবধারী নাকি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা সর্বৈব মিথ্যা। প্রকৃতপক্ষে ১১.৮২ লাখ বিও অ্যাকাউন্টে লেনদেন হয়েছে এবং অনেকেই লাভবান হয়েছেন। ব্যবসায় লাভ-লোকসান থাকে। কাজেই অনেকেই লোকসান গুনেছেন। লাভ-লোকসানের চেয়ে বড় কথা হলো, পুঁজিবাজারের দুর্বল এবং দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবস্থাপনা। সেই সঙ্গে দুর্বলতার সুযোগে শক্ত অবস্থা করে নেওয়া জনাকয়েক ব্যক্তির একটি সিন্ডিকেট বা কার্টেল। নিয়ন্ত্রক সংস্থা ছিল তাদের প্রভাবাধীন। প্রাক-আইপিও ম্যানিপুলেশনের মধ্যে ছিল সম্পদের অধিমূল্যায়ন, অডিটরদের অনৈতিক নিরীক্ষা, 'কার্ব মার্কেটে' প্লেসমেন্ট ক্রয়-বিক্রয়, প্রভাবশালীদের মধ্যে প্লেসমেন্ট শেয়ার বণ্টনের মাধ্যমে দুর্নীতি বিস্তার, ডাইরেক্ট লিস্টিং, বুকবিল্ডিং প্রভৃতি। এ ছাড়া সিরিয়াল ট্রেডিং, ব্লক প্লেসমেন্ট, রিপিট আইপিও ইকুইটিতে লোন কনভার্শন, প্রেফারেন্স শেয়ার ইস্যুতে অনিয়ম, ট্রিগার সেল, অমনিবাস অ্যাকাউন্টের অস্বচ্ছ লেনদেন প্রভৃতি উপায়ে পুঁজিবাজার হয়ে উঠেছিল অপ্রতিরোধ্য। ২০১০ সালের ক্রম-ঊর্ধ্বগতিকে বলা হয়েছিল সাবলীল বাজারশক্তি! মুখ থুবড়ে পড়ার পর সবার বোধোদয় হলো। এই হলো বাজারধসের পূর্বকথা।
সরকার এসইসি পুনর্গঠনসহ কিছু পদক্ষেপ নিলেও সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা এবং বিশেষজ্ঞদের পর্যালোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে-ক. পুঁজিবাজার পতনের নায়করা ঘোলাজলে এখনো মৎস্য শিকারে ব্যস্ত, তারা নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ কর্তৃপক্ষকে প্রভাবিত করে যাচ্ছে। খ. পুঁজিবাজারে বর্তমানে মূল সংকট তারল্য বা অর্থের অভাব নয়, আস্থার সংকটই প্রধান। গ. পুঁজিবাজার ধ্বংসের নায়করা কেউ কেউ ব্যক্তি খাতের ব্যাংকের মালিকানায় রয়েছে। তারা ব্যাংকিং সেক্টর থেকে আরো অর্থ বের করে গলাধঃকরণের চেষ্টায় লিপ্ত। ঘ. পুঁজিবাজার নষ্ট করার পর ব্যাংকিং খাত আঘাতপ্রাপ্ত হলে দেশের সার্বিক অর্থনীতি ভেঙে পড়বে। ঙ. পুঁজিবাজারের খলনায়করা সরকারকে বোঝাচ্ছে যে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন 'অনুমাননির্ভর' বিধায় বাস্তবায়নযোগ্য নয়। অথচ ধারণা (চবৎপবঢ়ঃরড়হ) এবং অনুমান (ধংংঁসঢ়ঃরড়হ) সমার্থক শব্দ নয়। ধারণা বা পার্সেপশন গবেষণার স্বীকৃত রীতি। অনুমান তা নয়। চ. খলনায়করা সরকারকে বুঝিয়েছে যে তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী শাস্তি দিলে বাজারের পতন হবে। অথচ শাস্তি না দিয়েও বাজারের পতন ঠেকানো যাচ্ছে না। ছ. কর্তৃপক্ষ খলনায়কদের পরামর্শেই চলছে।
সাম্প্রতিককালে মার্কিন পুঁজিবাজারে এক শ্রীলঙ্কান খেলোয়াড় বাজারে শেয়ারের দাম বাড়ানোর চেষ্টা করেছিল। তার একমাত্র প্রমাণ ছিল, টেলিফোনে সে 'বাই' (ক্রয় করো) কথাটি উচ্চারণ করেছিল। বাক্যটি পূরণ বা ব্যাখ্যাও করেনি। ওই 'বাই' শব্দ উচ্চারণকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করে তাকে ১১ বছর জেল দেওয়া হয়েছে। সে জেল খাটছে। বাংলাদেশে হলে কর্তৃপক্ষ বলত, 'বাই' অর্থ ক্রয় করো। কেক বা পেস্ট্রি ক্রয় করার কথাও তো হতে পারে। শেয়ার ক্রয়ের কথা তো বলেনি। অতএব 'অনুমাননির্ভর' কথার ওপর শাস্তি হয় না। পুঁজিবাজারের মতো ঝুঁকিপূর্ণ বাজারের জন্য সারা বিশ্বেই আইন ও তার প্রয়োগ কঠিন। বাংলাদেশে তা হয় না। নিয়ন্ত্রক সংস্থা এ কথা না বুঝলে, ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
সময়ের দাবি হলো, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশনের ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা। মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা গ্যাম্বলার ও বড় খেলোয়াড়দের প্রভাবে চলে-এ ধারণার অবসান না হলে, পুঁজিবাজার স্থিতিশীল হবে না। হলেও আবার ভেঙে পড়বে। একজন আইনজীবী সন্ত্রাসী, ডাকাত-সবার সঙ্গে মিশতে পারেন। কিন্তু তিনি যখন বিচারপতির আসনে বসেন, তখন তিনি সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে যান। নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। এসইসির কমিশন সদস্য ও চেয়ারম্যানের পদায়নের পর বাজার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হবে। শক্তিশালী, পেশাদার, দক্ষ ও সৎ কমিশনই বাজারের আস্থা অর্জন করতে পারে। বোধোদয় ঘটলে, ২০১২ সালে বাজার স্থিতিশীল হওয়ার সুযোগ পাবে।
লেখক : সাবেক ডেপুটি গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থনীতির বিশ্লেষক
এই সরকারকে ক্ষমতাসীন করার পেছনে জনসমর্থন যেমন সুউচ্চ ছিল, তেমনি ক্ষমতারোহণলগ্নে জনগণের প্রত্যাশাও ছিল গগনচুম্বী। যেকোনো সরকারের জন্য এমন পরিস্থিতি একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ। ২০১২ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে মহাজোট সরকারের তিন বছর পূর্ণ হবে। তিন বছর আগের অবস্থার সঙ্গে আমরা মিলিয়ে দেখব বর্তমান অবস্থা, বিশেষ করে অর্থনীতির অঙ্গনের অবস্থা। অর্থনৈতিক স্বস্তি-অস্বস্তির বিষয়গুলো একনজরে দেখার চেষ্টা করা যাক।
স্মরণ করা যাক তিন বছর আগের বিদ্যুতের অবস্থার দিকে। চারদলীয় জোট সরকারের আমল থেকে প্রলম্বিত হয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর সময়েও বাংলাদেশে বিদ্যুতের অবস্থা ছিল মেঘাচ্ছন্ন আকাশে বিদ্যুৎ চমকের মতো। কয়েক সেকেন্ড বিদ্যুৎ চমকের পর যেমন ঘন মেঘের অন্ধকারে সব ঢেকে যায়, তেমনি ঢাকার অবস্থা ছিল এক ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের পর এক ঘণ্টা আলো। মফস্বলের অবস্থা আরো নাজুক। মফস্বল শহরগুলোতে দিনে দু-এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকত। গ্রামগঞ্জে বিদ্যুতের কোনো খবর ছিল না। এমন অবস্থার মধ্যে ২০০৯ সালের গ্রীষ্মের আগমনের শুরুতেই ঢাকায় বিদ্যুতের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো পানির সংকট। পানির পাম্প চালানোর মতো বিদ্যুৎও ছিল না। জনস্মৃতি বড়ই স্বল্পজীবী। তবু স্মরণ করছি, ঢাকার মহল্লায় মহল্লায় কলসিমিছিল, হাঁড়ি-পাতিলের মিছিল, বাতির অভাবে সন্ধ্যায় মশাল মিছিল। বিরোধী দলকে তখন বেজায় খুশি মনে হয়েছিল। বিদ্যুৎ বেগেই বুঝি সরকার পড়ে যাবে। সরকারের অবস্থা নাজুক। আশার বাণী শোনানো দুষ্কর। স্বল্প সময়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতকরণ ছিল অসম্ভব। সরকার বলেছিল, দুই বছরে তারা আলো দেবে।
তিন বছর পর অবস্থা মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করা যাক। ঢাকায় এখন ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিং হয় না। কখনো কখনো হলেও তা যৌক্তিক সীমার মধ্যে। মফস্বল শহরগুলোতে প্রায় অবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা। এমনকি গ্রামগঞ্জে কুঁড়েঘরে, বাজার-দোকানে মিটমিট করে জ্বলছে বিদ্যুৎসাশ্রয়ী বাল্ব। কৃষকরা সেচের সময় রাতের নির্দিষ্ট সময়ে অবিচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ পেয়ে থাকেন। তিন বছর আগের তুলনায় পরিবর্তনটা নাটকীয়। তিন বছর আগের লোডশেডিংয়ের জন্য বিক্ষোভ আর সরকারের মুণ্ডুপাত আমরা করেছিলাম।
এখন কি অভাবিত উন্নতির জন্য প্রশংসা করছি? আকাশ-মিডিয়া এবং প্রিন্ট মিডিয়ায় তেমনটা চোখে পড়ে না। সভা-সেমিনারেও তো শুনি না। সরকারের কঠোর সমালোচক একজন তথাকথিত 'নিরপেক্ষবাদী' কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, 'বিদ্যুৎ সচল থাকবে, আলো জ্বলবে-এটাই তো স্বাভাবিক। এর জন্য প্রশংসা কেন? বিদ্যুৎ না থাকাটা অস্বাভাবিক, সেটা সমালোচনাযোগ্য।' অবশ্য চারদলীয় জোট আমলে যখন লোডশেডিং লেগেই থাকত, তখন তাঁর মুখ বা কলম থেকে এমন অমৃতবাণী বের হয়নি!
এ গেল মুদ্রার এক পিঠ। অন্য পিঠের চিত্র ভিন্ন। মাত্র দুই-আড়াই বছরে লোডশেডিং সামাল দিতে গিয়ে সরকার কুইক রেন্টাল পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ সংগ্রহ করেছে অত্যন্ত উচ্চমূল্যে। সরকারের তেল আমদানি-ব্যয় মেটাতে ব্যাংকঋণ বেড়ে গেছে, সাবসিডিও বৃদ্ধি পেয়েছে অসহনীয়ভাবে। এটি অর্থনীতিকে বিরাট ঝাঁকুনি দিয়েছে বলা যায়, এটিই অর্থনীতির বিষবৃক্ষ, যা থেকে জন্ম নিচ্ছে অনেক সমস্যা। তবে স্বল্প সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে এর বিকল্পও ছিল না। স্বাভাবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে বিদ্যুৎ পেতে কমপক্ষে পাঁচ বছর লাগত, যা সাধারণ মানুষ মেনে নিত না। তাই সরকারকে এ ধরনের ট্রেড অফ করতে হয়েছে।
জিডিপি বা জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি দেশের অর্থনীতির বহুল ব্যবহৃত পরিমাপক। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সময়কালে (সেনা ও স্বৈরশাসক আমলে) বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩.২ শতাংশ। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত (গণতান্ত্রিক ও তত্ত্বাবধায়ক আমলে) জাতীয় আয়ের গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছিল ৪.৫ শতাংশে। বর্তমান সরকারের আমলে গত তিন বছরে বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ শতাংশের বেশি। জিডিপি সূচকে গত তিন বছরের অর্জন চমকপ্রদ। পূর্ববর্তী যেকোনো সরকারের আমলের চেয়ে বেশি।
সমসাময়িক সময়ে উপমহাদেশের রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে প্রতীয়মান হচ্ছে যে জাতীয় আয় প্রবৃদ্ধির হারের দিক থেকে এ অঞ্চলে একমাত্র ভারতের পর বাংলাদেশের অবস্থান। বর্তমান অর্থবছরে সমন্বয়ের পর ভারতের প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশের আশেপাশে থাকবে। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ অর্জিত না হলেও ৬.৮ শতাংশের মতো থাকবে। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও মালদ্বীপের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান ওপরে। সর্বনিম্নে অবস্থান করছে পাকিস্তান, ৪ শতাংশ বৃদ্ধি টার্গেট পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে ৩.৭ শতাংশে, যা নেমে ৩.৫-এ দাঁড়াতে পারে।
মুদ্রাস্ফীতির উচ্চহার নিয়ে বিরূপ সমালোচনা তীব্র। হওয়ারও কথা। কারণ বাজারে গিয়ে যখন পকেটে টান পড়ে, তখন ক্ষুব্ধ হওয়া স্বাভাবিক। তবে এ কথা মনে রাখতে হবে যে আমরা মঙ্গলগ্রহের বাসিন্দা নই। পৃথিবী নামক গ্রহেই বাংলাদেশের অবস্থান। অন্যান্য দেশের অবস্থা কেমন? ইউরোপের অনেক দেশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধিতে চলে গেছে। দূরের দেশের কথা বাদ দিই। পড়শী দেশগুলোর অবস্থা কেমন? এ উপমহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ও ভারত উচ্চ মুদ্রাস্ফীতিতে অনেকটা সমপর্যায়ে রয়েছে। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও মালদ্বীপের মুদ্রাস্ফীতি বাংলাদেশ ও ভারতের তুলনায় অনেক বেশি। পাকিস্তান ১৫ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে কাতরাচ্ছে। দেশে মুদ্রাস্ফীতির কষাঘাত তীব্র। তবে প্রতিবেশীদের চেয়ে আমরা অপেক্ষাকৃত কম কষ্টে আছি-এটুকু সান্ত্বনা তো নিতেই পারি।
দরিদ্র দেশে খাদ্যমূল্যস্ফীতি সবচেয়ে বেদনাদায়ক। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়। খাদ্যমূল্যস্ফীতির বেদনাকে অবদমিত রাখার প্রয়াস ও সাফল্য উল্লেখ করতেই হয়। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষক খাদ্যের জন্য বাজারনির্ভর ছিল না। স্ব-উৎপাদিত খাদ্যশস্যে ক্ষুণি্নবৃত্তি নিবারণ করেছে। খাদ্যমূল্যস্ফীতি কৃষককে আঘাত করেনি। বরং উচ্চমূল্যে উদ্বৃত্ত শস্য বিক্রি করে আয় বৃদ্ধি করেছে। দরিদ্র অকৃষকদের জন্য সরকার বাজারের চেয়ে অনেক কম মূল্যে খোলাবাজারে চাল বিক্রি করেছে অত্যন্ত সফলভাবে। সঠিক সময়ে, সঠিক পরিমাণে, সঠিক স্থানে এবং সঠিক টার্গেট গ্রুপের কাছে ন্যায্যমূল্যে চাল পেঁৗছে দেয়াটা ছিল একটা সার্থক প্রয়াস। সরকারি উদ্যোগে এমন সাফল্য কমই চোখে পড়ে। জমিতে অধিক ফলন এবং বাজারে সফল অপারেশন মিলে খাদ্যমূল্যস্ফীতির তীব্রতা প্রশমিত করতে পেরেছে দরিদ্র কৃষক এবং অকৃষক উভয় ধরনের দুর্বল জনগোষ্ঠীর মধ্যে। খাদ্যমূল্যস্ফীতি রোধে সক্ষম না হলেও এর উত্তাপ থেকে দুর্বল ভুক্তভোগীদের রক্ষা করার কৃতিত্ব সরকার পেতে পারে।
চারদলীয় জোট সরকারের শেষ বছরে অর্থাৎ ২০০৫-০৬ অর্থবছরে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ৪.৮৭ বিলিয়ন ডলার। ২০১০-১১ অর্থবছরে রেমিট্যান্সের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১.৬৫ বিলিয়ন ডলারে। ২০১১-১২ অর্থবছরে সাড়ে বারো বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ২০০৮-০৯ অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২২.৪২ শতাংশ। ২০০৯-১০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১৩.৪০ শতাংশ। ইধংব বা ভিত্তি অনেক বেড়ে গেলে প্রবৃদ্ধির হার হ্রাসপ্রাপ্ত হয়, যদিও প্রবৃদ্ধি হয় সন্তোষজনক। কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো, অনেক মিডিয়ায় স্ফীত ভিত্তির ওপর 'প্রবৃদ্ধির হার' হ্রাস পাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে এবং প্রকৃত প্রবৃদ্ধির পরিমাণ অনেক ক্ষেত্রে উল্লেখ করা হয়নি।
২০০৬ সালে (চারদলীয় সরকারের শেষ সময়) বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল পাঁচ বিলিয়ন ডলার, যা ২০১১ সালের ডিসেম্বরে এসে দাঁড়িয়েছে ৯.৫ বিলিয়ন ডলারে। পাঁচ বছরে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। অথচ মিডিয়া রিপোর্টিংয়ে রিজার্ভ ১০ বিলিয়ন ডলার থেকে নেমে যাওয়ায় ক্রমাগত শঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। ভাবখানা এমন যে রিজার্ভ আবার ওঠানামা করবে কেন? উপাত্ত যেমন হ্রাস-বৃদ্ধিযোগ্য, ফলাফলও তেমনি। রিজার্ভের বর্তমান অবস্থান অর্থনৈতিক বিচারে যথেষ্ট শক্তিশালী।
চারদলীয় সরকারের শেষ বছরে ২০০৬ সালে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু আয় ছিল ৪৮৭ মার্কিন ডলার। ২০১১ সালে এসে মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ৮১৮ ডলারে। বর্তমান সরকারের তিন বছর জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি নিরবচ্ছিন্নভাবে উচ্চমাত্রায় ছিল বলেই মাথাপিছু আয় এতটা সন্তোষজনক।
প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান সরকারের আরেক দিক পরিবর্তনকারী মাইলফলক সাফল্য হলো, আয়-বণ্টনব্যবস্থা। চার বছর আগে আয়-বণ্টন পরিমাপক গিনি কোয়েফিশিয়েন্ট একটি চরম বিষম বণ্টন ইঙ্গিত করত। আরো ভয়ংকর ছিল পূর্ববর্তী বছরগুলোতে গিনি কোয়েফিশিয়েন্টের ট্রেন্ড বা গতি-প্রকৃতি, যা ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী ছিল। অতি সাম্প্রতিককালে বৈষম্যের ক্রমবৃদ্ধির প্রক্রিয়ায় ছেদ পড়েছে। গিনি কোয়েফিশিয়েন্ট ঘুরে দাঁড়িয়েছে, যদিও তা সামান্য। যার অর্থ হলো, বৈষম্যের ঊর্ধ্বগতি থেমে গেছে। বৈষম্যের সংকোচন এখনো প্রবলভাবে চোখে পড়ে না। তবে দৃষ্টি এড়ায়ও না। তিন বছর ধরে মঙ্গার কথা শোনা যায় না। অনাহারে মৃত্যুর খবর আসে না। বরং পল্লী এলাকায় আয়বৃদ্ধিসহ জীবন যাপনের মান বৃদ্ধি দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
গত ২০০৮ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে বছরে পাঁচ হাজার কোটি টাকার অধিক কৃষিতে ভর্তুকি দিয়েছে। গত বছর ১২ হাজার কোটি টাকা কৃষিঋণ বিতরণ করেছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী উল্লেখযোগ্য পরিমাণে স্ফীত করেছে। ফলে পল্লী এলাকায় অর্থপ্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে, উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে, ক্ষুদ্র মূলধন গড়ে উঠেছে। এ ছাড়া ১০ টাকার ব্যাংক হিসাব খোলাসহ কিছু সংস্কারকর্মের ফলে দুর্নীতি হ্রাস পেয়েছে, দক্ষতা বেড়েছে, সঞ্চয়প্রবণতা বিকশিত হচ্ছে, সর্বোপরি মৃতপ্রায় গ্রামীণ অর্থনীতি প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। গ্রামীণ অর্থনীতির ক্রমবিকাশের মাধ্যমে ধীরে ধীরে আয়বৈষম্য হ্রাস পাবে। বাংলাদেশ সত্যিকারভাবে একটি কল্যাণরাষ্ট্র গঠনের পথে পরিচালিত হবে। গত তিন বছরে তেমন একটি সম্ভাবনার ক্ষীণ সূচনা দৃষ্ট হয়।
গত তিন বছরের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় অস্থিরতা এবং অব্যবস্থাপনা ঘটেছিল পুঁজিবাজারে। সেই সঙ্গে অপপ্রচারও হয়েছিল। বলা হয়েছিল যে ৩৩ লাখ বিও হিসাবধারী নাকি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা সর্বৈব মিথ্যা। প্রকৃতপক্ষে ১১.৮২ লাখ বিও অ্যাকাউন্টে লেনদেন হয়েছে এবং অনেকেই লাভবান হয়েছেন। ব্যবসায় লাভ-লোকসান থাকে। কাজেই অনেকেই লোকসান গুনেছেন। লাভ-লোকসানের চেয়ে বড় কথা হলো, পুঁজিবাজারের দুর্বল এবং দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবস্থাপনা। সেই সঙ্গে দুর্বলতার সুযোগে শক্ত অবস্থা করে নেওয়া জনাকয়েক ব্যক্তির একটি সিন্ডিকেট বা কার্টেল। নিয়ন্ত্রক সংস্থা ছিল তাদের প্রভাবাধীন। প্রাক-আইপিও ম্যানিপুলেশনের মধ্যে ছিল সম্পদের অধিমূল্যায়ন, অডিটরদের অনৈতিক নিরীক্ষা, 'কার্ব মার্কেটে' প্লেসমেন্ট ক্রয়-বিক্রয়, প্রভাবশালীদের মধ্যে প্লেসমেন্ট শেয়ার বণ্টনের মাধ্যমে দুর্নীতি বিস্তার, ডাইরেক্ট লিস্টিং, বুকবিল্ডিং প্রভৃতি। এ ছাড়া সিরিয়াল ট্রেডিং, ব্লক প্লেসমেন্ট, রিপিট আইপিও ইকুইটিতে লোন কনভার্শন, প্রেফারেন্স শেয়ার ইস্যুতে অনিয়ম, ট্রিগার সেল, অমনিবাস অ্যাকাউন্টের অস্বচ্ছ লেনদেন প্রভৃতি উপায়ে পুঁজিবাজার হয়ে উঠেছিল অপ্রতিরোধ্য। ২০১০ সালের ক্রম-ঊর্ধ্বগতিকে বলা হয়েছিল সাবলীল বাজারশক্তি! মুখ থুবড়ে পড়ার পর সবার বোধোদয় হলো। এই হলো বাজারধসের পূর্বকথা।
সরকার এসইসি পুনর্গঠনসহ কিছু পদক্ষেপ নিলেও সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা এবং বিশেষজ্ঞদের পর্যালোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে-ক. পুঁজিবাজার পতনের নায়করা ঘোলাজলে এখনো মৎস্য শিকারে ব্যস্ত, তারা নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ কর্তৃপক্ষকে প্রভাবিত করে যাচ্ছে। খ. পুঁজিবাজারে বর্তমানে মূল সংকট তারল্য বা অর্থের অভাব নয়, আস্থার সংকটই প্রধান। গ. পুঁজিবাজার ধ্বংসের নায়করা কেউ কেউ ব্যক্তি খাতের ব্যাংকের মালিকানায় রয়েছে। তারা ব্যাংকিং সেক্টর থেকে আরো অর্থ বের করে গলাধঃকরণের চেষ্টায় লিপ্ত। ঘ. পুঁজিবাজার নষ্ট করার পর ব্যাংকিং খাত আঘাতপ্রাপ্ত হলে দেশের সার্বিক অর্থনীতি ভেঙে পড়বে। ঙ. পুঁজিবাজারের খলনায়করা সরকারকে বোঝাচ্ছে যে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন 'অনুমাননির্ভর' বিধায় বাস্তবায়নযোগ্য নয়। অথচ ধারণা (চবৎপবঢ়ঃরড়হ) এবং অনুমান (ধংংঁসঢ়ঃরড়হ) সমার্থক শব্দ নয়। ধারণা বা পার্সেপশন গবেষণার স্বীকৃত রীতি। অনুমান তা নয়। চ. খলনায়করা সরকারকে বুঝিয়েছে যে তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী শাস্তি দিলে বাজারের পতন হবে। অথচ শাস্তি না দিয়েও বাজারের পতন ঠেকানো যাচ্ছে না। ছ. কর্তৃপক্ষ খলনায়কদের পরামর্শেই চলছে।
সাম্প্রতিককালে মার্কিন পুঁজিবাজারে এক শ্রীলঙ্কান খেলোয়াড় বাজারে শেয়ারের দাম বাড়ানোর চেষ্টা করেছিল। তার একমাত্র প্রমাণ ছিল, টেলিফোনে সে 'বাই' (ক্রয় করো) কথাটি উচ্চারণ করেছিল। বাক্যটি পূরণ বা ব্যাখ্যাও করেনি। ওই 'বাই' শব্দ উচ্চারণকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করে তাকে ১১ বছর জেল দেওয়া হয়েছে। সে জেল খাটছে। বাংলাদেশে হলে কর্তৃপক্ষ বলত, 'বাই' অর্থ ক্রয় করো। কেক বা পেস্ট্রি ক্রয় করার কথাও তো হতে পারে। শেয়ার ক্রয়ের কথা তো বলেনি। অতএব 'অনুমাননির্ভর' কথার ওপর শাস্তি হয় না। পুঁজিবাজারের মতো ঝুঁকিপূর্ণ বাজারের জন্য সারা বিশ্বেই আইন ও তার প্রয়োগ কঠিন। বাংলাদেশে তা হয় না। নিয়ন্ত্রক সংস্থা এ কথা না বুঝলে, ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
সময়ের দাবি হলো, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশনের ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা। মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা গ্যাম্বলার ও বড় খেলোয়াড়দের প্রভাবে চলে-এ ধারণার অবসান না হলে, পুঁজিবাজার স্থিতিশীল হবে না। হলেও আবার ভেঙে পড়বে। একজন আইনজীবী সন্ত্রাসী, ডাকাত-সবার সঙ্গে মিশতে পারেন। কিন্তু তিনি যখন বিচারপতির আসনে বসেন, তখন তিনি সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে যান। নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। এসইসির কমিশন সদস্য ও চেয়ারম্যানের পদায়নের পর বাজার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হবে। শক্তিশালী, পেশাদার, দক্ষ ও সৎ কমিশনই বাজারের আস্থা অর্জন করতে পারে। বোধোদয় ঘটলে, ২০১২ সালে বাজার স্থিতিশীল হওয়ার সুযোগ পাবে।
লেখক : সাবেক ডেপুটি গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থনীতির বিশ্লেষক
No comments