অর্জন অনেক, জনমনে প্রত্যাশা আরও ছিল
লুৎফর রহমান: সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য। সমপ্রতি দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন নবগঠিত রেল যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের। সরকারের ভেতর এবং বাইরে থেকে দেখা এই প্রবীণ নেতা মহাজোট সরকারের তিন পৃষ্ঠা ৮ কলাম ১
বছরের মূল্যায়ন করে বলেছেন, এই তিন বছরে সরকারের অর্জন অনেক। তবে মানুষের আরও প্রত্যাশা ছিল। সরকার তার নিজস্ব অবস্থান থেকে কাজ করেছে। এই কাজ কারও প্রত্যাশিত হয়েছে, আবার কারও জন্য হয়তো প্রত্যাশিত হয়নি। তিনি জানিয়েছেন, কৃষি, শিক্ষা, বিদ্যুৎসহ অনেক ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য অভাবনীয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, মানবাধিকার ও দ্রব্যমূল্য নিয়ে সমালোচনার বিষয়ে অভিজ্ঞ এই নেতা জানিয়েছেন, সমপ্রতি যে গুম ও হত্যার ঘটনা ঘটছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের আরও সক্রিয় হতে হবে। আর দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতিযোগিতায় আসতে হবে। একই সঙ্গে মন্ত্রী ও সংশ্লিষ্টদের আচরণ ও কথাবার্তায় সহনশীল হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়ে তিনি বলেন, সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সরকার এখানে আরও বেশি মনোযোগী হতে পারতো বলে অনেকে মনে করেন। বিচারকাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
সরকারের তিন বছরের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মূল্যায়ন করে তিনি বলেন, মানুষের আরও প্রত্যাশা ছিল। একেক জনের একেক রকম স্টাইল থাকে। শেখ হাসিনা তার নিজস্বতা নিয়ে সরকার পরিচালনা করছেন। তিনি তার মতো করছেন। এটি অনেক জায়গায় মানুষের প্রত্যাশার সঙ্গে মিলেছে, আবার মিলেনি। এটি গণতন্ত্রে থাকবেই।
অন্যদিকে সরকারের তিন বছরের অর্জনের মধ্যে সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে কৃষিতে। কৃষিতে তিন বছরে সরকারকে অনেক সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। সারের দাম কমাতে হয়েছে। কৃষি ঋণ বিতরণ, ১০ টাকায় একাউন্ট করে দেয়াসহ অনেক বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে এই তিন বছরে। বিগত বছরে পর পর বাম্পার ফলন হয়েছে। তা না হলে আমরা খাদ্যে মহাসঙ্কটে পড়ে যেতাম। আমাদের সে সমস্যা হয়নি। আমরা এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে এগোচ্ছি। শিক্ষায়ও সরকারের অসাধারণ সাফল্য রয়েছে। বছরের প্রথমেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়া হয়েছে। অতীতে দেখা গেছে, বই দিতেই তিন মাস চলে গেছে। শিক্ষার্থীদের এই তিন মাস পড়াশোনাই করানো যায়নি। দেশে বিদ্যমান বিরোধিতা ও সংঘাতপূর্ণ রাজনীতির মধ্যেই এটি একটি বড় সাফল্য। এই সাফল্য আমাদের সকলের।
যুদ্ধাপরাধের বিচার বিলম্ব হচ্ছে- এমন সমালোচনার বিষয়ে জানতে চাইলে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, যুদ্ধাপরাদের বিচারে দুু’টি দিক আছে। আন্তর্জাতিক আইনে দেশীয় আদালতে এই বিচার হচ্ছে। এই ধরনের বিচারে আমাদের অতীত কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। ফলে প্রস্তুতিতে সময় লেগেছে। অন্যদিকে সরকার এ বিষয়ে আরও মনোযোগী হতে পারতো। আরও গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টিকে দেখতে পারতো- এ রকম আলোচনা আছে। এখনও সুযোগ আছে- প্রবীণ ও দক্ষ আইনজীবীদের এই বিচার প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করার। এটি যেমন সরকারের দায়িত্ব, তেমনি প্রবীণ আইনজীবীদেরও দায়িত্ব মুক্তিযুদ্ধের দায়বোধ থেকে এ কাজে নিজে থেকে এগিয়ে আসা। আদালতও চাইলে তাদেরকে এমিকাস কিউরি হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।
ভারতের টিপাইমুখ প্রকল্পের বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, টিপাইমুখ ড্যাম হলে প্রতিক্রিয়া হবে ভাটি বাংলার। সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলায় এর প্রভাব পড়বে। এ অঞ্চলে প্রাকৃতিক নিয়মে যে বর্ষা হয়, হাওর বিলের পানি দিয়ে বোরো চাষ হয় তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে ঠিক কি পরিমাণ ক্ষতি হবে- তা এখনই বলা যাবে না। হয়তো সেখানে একটির জায়গায় দু’টি ফসলও হতে পারে। তবে এটি নিশ্চিত যে, টিপাইমুখে বাঁধ বা ড্যাম যা-ই হোক এতে এই অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য, প্রাণী বৈচিত্র্য ও পরিবেশ বৈচিত্র্য হারাবে। আমি মনে করি এ বিষয়টি নিয়ে একটি যৌথ সমীক্ষার প্রয়োজন। ‘বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন কিছু করবে না ভারত’- ওই বিবৃতিটিই যথেষ্ট নয়। এ জন্য যৌথ সমীক্ষা প্রয়োজন। ভারত আমাদের বন্ধু। তাদের কাছ থেকে আমরা বন্ধুসুলভ আচরণই আশা করি।
আমি ভাটি বাংলার মানুষ। আমি নিজে একজন ভিকটিম হিসেবে বলবো- বিষয়টি যত না রাজনৈতিক, তার চেয়ে বেশি সামাজিক। এ নিয়ে ভারতকেও একটু গভীরভাবে ভাবতে হবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিরোধী দল অনড়, সরকার চাইছে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে- এ অবস্থায় সমাধান কোন পথে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার মাধ্যমে আমরা সুপ্রিম কোর্টকে ধ্বংস করে দিচ্ছি। এ থেকে আমাদের ফিরে আসতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। এ নিয়ে পার্লামেন্টেও আলোচনা করেছি। আমরা বিরোধী দলের জন্যও অপেক্ষা করেছি। তারা যায়নি। এ ছাড়া রায়ে বলা হয়েছে, এই তত্ত্বাবধায়কে প্রধান বিচারপতিদের রাখা যাবে- না। তাদের রাখা না গেলে কাদের রাখা যাবে? আমরা যদি বলি রাজনৈতিক দল থেকে নেয়া যাবে তাহলে এক্ষেত্রেও তারা বিরোধিতা করবে। বলবে, আমাদের তো জিজ্ঞাসা করা হলো না। তারা আলোচনায়ও আসবেন না, সংসদেও আসবেন না- তাহলে সমাধানটা কিভাবে হবে? তাদের এ ধরনের পরামর্শ যারা দেন, তারা রাজনীতিতেও বিশ্বাস করেন না, রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতিবাচক পরিবর্তনেও বিশ্বাস করেন না। সংঘাত ও সংঘর্ষের রাজনীতি থেকে ফিরে আসতে হলে এই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা থেকে ফিরে আসতেই হবে।
তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে আমরা ফিরে গেছি। এই অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কোড অব কন্ডাক্ট করা হবে কিনা এ বিষয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। বিরোধী দল এ বিষয়টিকে আরও গভীরভাবে দেখবে বলে আমরা আশা করি। তিনি আরও বলেন, অতীতের কোন সরকার নির্বাচন কমিশন নিয়ে আলোচনা করেনি। প্রেসিডেন্ট সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশন গঠনে আলোচনার জন্য। পৃথিবীর সব দেশেই নির্বাচন কমিশন নির্বাচন করে। সরকার নির্বাচন করে না। উনারা এখন বলছেন, আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিতে হবে। তাদের এই বক্তব্যের তো যুক্তি নেই।
সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তনের, গত তিন বছরে প্রত্যাশিত পরিবর্তন হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাজনীতিতে আলোচনা-সমালোচনা আছে। এখানে বিরোধিতা করার সুযোগ আছে। এই যে চট্টগ্রামে পলো গ্রাউন্ড এ বিএনপি’র সমাবেশ করার অনুমতির জন্য তারা আমার কাছে এলো- আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে তাদের সে সুযোগ দিয়েছি। এটিও তো একটা ইতিবাচক পরিবর্তন। কারণ আমরা সরকারে। বিরোধী দলের রাজনৈতিক অধিকার রক্ষা করাও তো আমাদের দায়িত্ব। এই ইতিবাচক চিন্তা এবং ধারা এগুলোকে প্রকাশ করতে হবে। তুলে ধরতে হবে। এসব বিষয়ে আমাদের আরও সহনশীল হতে হবে, সাহসী হতে হবে।
রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন এটি একার বিষয় নয়। এটি উভয়পক্ষকে করতে হবে। সকলের আচরণের মাধ্যমে প্রত্যেকের নিজের স্বার্থে, গণতন্ত্রের বিকাশের স্বার্থে ইতিবাচক রাজনীতি করতে হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন করতে হবে।
তিনি বলেন, এখন গণতন্ত্রের বড় শক্তি মিডিয়া। আগের আর্মি রুলের মতো, জিয়াউর রহমানের ইয়েস-নো ভোট আর দেশে ফিরবে না। খালেদা জিয়ার সেই আইজ্যা মার্কা নির্বাচন আর দেশে আসবে না। যে দেড় কোটি জাল ভোটের আয়োজন হয়েছিল সেটিও আর ফেরত আসবে না। ইতিবাচক রাজনীতির সংস্কৃতি গড়তে হলে বিরোধী দলকেও ইতিবাচক রাজনীতি করতে হবে।
মন্ত্রিসভায় যুক্ত হওয়ার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, মন্ত্রিসভায় আমি এসেছি। আমি গড্ডলিকা প্রবাহে যাবো না। সেই কারণেই এই কয়দিনের মধ্যে আমি আমার রোডম্যাপ দিয়েছি। এটি এদেশের ক্ষমতার সংস্কৃতিতে একটি নতুন অধ্যায়। এই রোডম্যাপের মাধ্যমে আমি বলে দিয়েছি- কি করতে চাই এবং কি করবো। আমার সামর্থ্য কি আছে। কারণ আমি জনগণের কাছে দায়বদ্ধ, সংসদের কাছে দায়বদ্ধ। প্রধানমন্ত্রীর কাছে দায়বদ্ধ না। এটি হলো আমার দৃষ্টি। অন্যরা করলে করতেও পারে, আবার না-ও পারে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সরকারের বিশাল অর্জন আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ঝুঁকি নিয়ে আইন করে প্রধানমন্ত্রী জরুরি ভিত্তিতে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন। এখন প্রশ্ন তোলা হচ্ছে- দাম বাড়ালো কেন, ফার্নেস অয়েল আনা হলো কেন? দাম বাড়ালেও হবে না, তেল দিয়ে করলেও হবে না, আবার না দিলেও হবে না- তাহলে হবেটা কি?
দ্রব্যমূল্য নিয়ে সমালোচনার বিষয়ে প্রবীণ এ নেতা বলেন, এটি অনেকটা আন্তর্জাতিক দামের ওপর নির্ভর করে। মুক্ত বাজার অর্থনীতি মানে একেবারে মুক্ত স্বাধীন অর্থনীতি নয়। এখানে সরকারি এবং বেসরকারি খাতের প্রতিযোগিতার প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু সংবিধান আর স্বাধীনতাই দেননি- তিনি বিএডিসি ও টিসিবি’র মতো প্রতিষ্ঠান উপহার দিয়েছিলেন। এ দু’টি জিনিস আমাদের জন্য অপরিহার্য। এসব প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর করে সরকারকেও প্রতিযোগিতায় থাকতে হবে। এছাড়া মন্ত্রীদের কথাবার্তায় ও আচরণে সহনশীল হতে হবে। আরও একটা বিষয় হলো, বাজার অর্থনীতির নামে আমাদের ব্যবসায়ী সমাজও প্রাতিষ্ঠানিকতার মধ্যে আসেনি। ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, আমদানি ও রপ্তানিকারকরা যদি নিজ নিজ অবস্থানে থেকে দেশপ্রেম নিয়ে কাজ করেন, তাহলে মানুষের উপকার হবে। অহেতুক মূল্যবৃদ্ধি হবে না। এই বিষয়টির সঙ্গে গণতন্ত্রের সম্পর্ক খুবই নিবিড়। আইনশৃঙ্খলা ও মানবাধিকার পরিস্থিতির অবিমিশ্র মূল্যায়ন করে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, মানবাধিকার বিষয়টি আপেক্ষিক। সামপ্রতিক সময়ে গুম হয়ে যাচ্ছে। হত্যাকাণ্ড হচ্ছে। এগুলো অবশ্যই আমাদের দেখতে হবে। এটি করা যায় না। আবার দু’-একটা এক্সেস ঘটনা যে ঘটবে না- তা-ও তো বলা যাবে না। তারপরও আমরা একটি স্বাধীন মানবাধিকার কমিশন গঠন করেছি। এই কমিশন অত্যন্ত দায়িত্বশীলভাবে কাজ করছে।
তিন বছরে দলীয় কর্মকাণ্ডের মূল্যায়ন জানতে চাইলে তিনি বলেন, দলকে ও জোটকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। তাদের দ্বারাই জনসংযোগটা করতে হবে। স্লোগান দিয়ে যদি কিছু অদক্ষ লোক ঢুকে যায় তাহলে তো হবে না। এটি আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনাকেই দেখতে হবে। নির্বাচন ছাড়া সাংবিধানিক রাজনীতিতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আর কোন উপায় নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিরোধী দলকে আহ্বান করবো- আপনারাও সংসদে ফিরে আসুন। আমরা একটা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি নির্মাণ করি।
সংসদকে পাশ কাটিয়ে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে ইতিবাচক রাজনৈিতক সংস্কৃতি গড়ে তোলা যায় না। সব কিছুর পরও দেশটা আমাদের। দেশকে সামনে এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব আমাদের। সব বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে আমরা সামনে এগিয়ে যেতে পারবো।
বছরের মূল্যায়ন করে বলেছেন, এই তিন বছরে সরকারের অর্জন অনেক। তবে মানুষের আরও প্রত্যাশা ছিল। সরকার তার নিজস্ব অবস্থান থেকে কাজ করেছে। এই কাজ কারও প্রত্যাশিত হয়েছে, আবার কারও জন্য হয়তো প্রত্যাশিত হয়নি। তিনি জানিয়েছেন, কৃষি, শিক্ষা, বিদ্যুৎসহ অনেক ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য অভাবনীয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, মানবাধিকার ও দ্রব্যমূল্য নিয়ে সমালোচনার বিষয়ে অভিজ্ঞ এই নেতা জানিয়েছেন, সমপ্রতি যে গুম ও হত্যার ঘটনা ঘটছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের আরও সক্রিয় হতে হবে। আর দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতিযোগিতায় আসতে হবে। একই সঙ্গে মন্ত্রী ও সংশ্লিষ্টদের আচরণ ও কথাবার্তায় সহনশীল হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়ে তিনি বলেন, সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সরকার এখানে আরও বেশি মনোযোগী হতে পারতো বলে অনেকে মনে করেন। বিচারকাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
সরকারের তিন বছরের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মূল্যায়ন করে তিনি বলেন, মানুষের আরও প্রত্যাশা ছিল। একেক জনের একেক রকম স্টাইল থাকে। শেখ হাসিনা তার নিজস্বতা নিয়ে সরকার পরিচালনা করছেন। তিনি তার মতো করছেন। এটি অনেক জায়গায় মানুষের প্রত্যাশার সঙ্গে মিলেছে, আবার মিলেনি। এটি গণতন্ত্রে থাকবেই।
অন্যদিকে সরকারের তিন বছরের অর্জনের মধ্যে সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে কৃষিতে। কৃষিতে তিন বছরে সরকারকে অনেক সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। সারের দাম কমাতে হয়েছে। কৃষি ঋণ বিতরণ, ১০ টাকায় একাউন্ট করে দেয়াসহ অনেক বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে এই তিন বছরে। বিগত বছরে পর পর বাম্পার ফলন হয়েছে। তা না হলে আমরা খাদ্যে মহাসঙ্কটে পড়ে যেতাম। আমাদের সে সমস্যা হয়নি। আমরা এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে এগোচ্ছি। শিক্ষায়ও সরকারের অসাধারণ সাফল্য রয়েছে। বছরের প্রথমেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়া হয়েছে। অতীতে দেখা গেছে, বই দিতেই তিন মাস চলে গেছে। শিক্ষার্থীদের এই তিন মাস পড়াশোনাই করানো যায়নি। দেশে বিদ্যমান বিরোধিতা ও সংঘাতপূর্ণ রাজনীতির মধ্যেই এটি একটি বড় সাফল্য। এই সাফল্য আমাদের সকলের।
যুদ্ধাপরাধের বিচার বিলম্ব হচ্ছে- এমন সমালোচনার বিষয়ে জানতে চাইলে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, যুদ্ধাপরাদের বিচারে দুু’টি দিক আছে। আন্তর্জাতিক আইনে দেশীয় আদালতে এই বিচার হচ্ছে। এই ধরনের বিচারে আমাদের অতীত কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। ফলে প্রস্তুতিতে সময় লেগেছে। অন্যদিকে সরকার এ বিষয়ে আরও মনোযোগী হতে পারতো। আরও গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টিকে দেখতে পারতো- এ রকম আলোচনা আছে। এখনও সুযোগ আছে- প্রবীণ ও দক্ষ আইনজীবীদের এই বিচার প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করার। এটি যেমন সরকারের দায়িত্ব, তেমনি প্রবীণ আইনজীবীদেরও দায়িত্ব মুক্তিযুদ্ধের দায়বোধ থেকে এ কাজে নিজে থেকে এগিয়ে আসা। আদালতও চাইলে তাদেরকে এমিকাস কিউরি হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।
ভারতের টিপাইমুখ প্রকল্পের বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, টিপাইমুখ ড্যাম হলে প্রতিক্রিয়া হবে ভাটি বাংলার। সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলায় এর প্রভাব পড়বে। এ অঞ্চলে প্রাকৃতিক নিয়মে যে বর্ষা হয়, হাওর বিলের পানি দিয়ে বোরো চাষ হয় তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে ঠিক কি পরিমাণ ক্ষতি হবে- তা এখনই বলা যাবে না। হয়তো সেখানে একটির জায়গায় দু’টি ফসলও হতে পারে। তবে এটি নিশ্চিত যে, টিপাইমুখে বাঁধ বা ড্যাম যা-ই হোক এতে এই অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য, প্রাণী বৈচিত্র্য ও পরিবেশ বৈচিত্র্য হারাবে। আমি মনে করি এ বিষয়টি নিয়ে একটি যৌথ সমীক্ষার প্রয়োজন। ‘বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন কিছু করবে না ভারত’- ওই বিবৃতিটিই যথেষ্ট নয়। এ জন্য যৌথ সমীক্ষা প্রয়োজন। ভারত আমাদের বন্ধু। তাদের কাছ থেকে আমরা বন্ধুসুলভ আচরণই আশা করি।
আমি ভাটি বাংলার মানুষ। আমি নিজে একজন ভিকটিম হিসেবে বলবো- বিষয়টি যত না রাজনৈতিক, তার চেয়ে বেশি সামাজিক। এ নিয়ে ভারতকেও একটু গভীরভাবে ভাবতে হবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিরোধী দল অনড়, সরকার চাইছে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে- এ অবস্থায় সমাধান কোন পথে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার মাধ্যমে আমরা সুপ্রিম কোর্টকে ধ্বংস করে দিচ্ছি। এ থেকে আমাদের ফিরে আসতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। এ নিয়ে পার্লামেন্টেও আলোচনা করেছি। আমরা বিরোধী দলের জন্যও অপেক্ষা করেছি। তারা যায়নি। এ ছাড়া রায়ে বলা হয়েছে, এই তত্ত্বাবধায়কে প্রধান বিচারপতিদের রাখা যাবে- না। তাদের রাখা না গেলে কাদের রাখা যাবে? আমরা যদি বলি রাজনৈতিক দল থেকে নেয়া যাবে তাহলে এক্ষেত্রেও তারা বিরোধিতা করবে। বলবে, আমাদের তো জিজ্ঞাসা করা হলো না। তারা আলোচনায়ও আসবেন না, সংসদেও আসবেন না- তাহলে সমাধানটা কিভাবে হবে? তাদের এ ধরনের পরামর্শ যারা দেন, তারা রাজনীতিতেও বিশ্বাস করেন না, রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতিবাচক পরিবর্তনেও বিশ্বাস করেন না। সংঘাত ও সংঘর্ষের রাজনীতি থেকে ফিরে আসতে হলে এই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা থেকে ফিরে আসতেই হবে।
তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে আমরা ফিরে গেছি। এই অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কোড অব কন্ডাক্ট করা হবে কিনা এ বিষয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। বিরোধী দল এ বিষয়টিকে আরও গভীরভাবে দেখবে বলে আমরা আশা করি। তিনি আরও বলেন, অতীতের কোন সরকার নির্বাচন কমিশন নিয়ে আলোচনা করেনি। প্রেসিডেন্ট সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশন গঠনে আলোচনার জন্য। পৃথিবীর সব দেশেই নির্বাচন কমিশন নির্বাচন করে। সরকার নির্বাচন করে না। উনারা এখন বলছেন, আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিতে হবে। তাদের এই বক্তব্যের তো যুক্তি নেই।
সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তনের, গত তিন বছরে প্রত্যাশিত পরিবর্তন হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাজনীতিতে আলোচনা-সমালোচনা আছে। এখানে বিরোধিতা করার সুযোগ আছে। এই যে চট্টগ্রামে পলো গ্রাউন্ড এ বিএনপি’র সমাবেশ করার অনুমতির জন্য তারা আমার কাছে এলো- আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে তাদের সে সুযোগ দিয়েছি। এটিও তো একটা ইতিবাচক পরিবর্তন। কারণ আমরা সরকারে। বিরোধী দলের রাজনৈতিক অধিকার রক্ষা করাও তো আমাদের দায়িত্ব। এই ইতিবাচক চিন্তা এবং ধারা এগুলোকে প্রকাশ করতে হবে। তুলে ধরতে হবে। এসব বিষয়ে আমাদের আরও সহনশীল হতে হবে, সাহসী হতে হবে।
রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন এটি একার বিষয় নয়। এটি উভয়পক্ষকে করতে হবে। সকলের আচরণের মাধ্যমে প্রত্যেকের নিজের স্বার্থে, গণতন্ত্রের বিকাশের স্বার্থে ইতিবাচক রাজনীতি করতে হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন করতে হবে।
তিনি বলেন, এখন গণতন্ত্রের বড় শক্তি মিডিয়া। আগের আর্মি রুলের মতো, জিয়াউর রহমানের ইয়েস-নো ভোট আর দেশে ফিরবে না। খালেদা জিয়ার সেই আইজ্যা মার্কা নির্বাচন আর দেশে আসবে না। যে দেড় কোটি জাল ভোটের আয়োজন হয়েছিল সেটিও আর ফেরত আসবে না। ইতিবাচক রাজনীতির সংস্কৃতি গড়তে হলে বিরোধী দলকেও ইতিবাচক রাজনীতি করতে হবে।
মন্ত্রিসভায় যুক্ত হওয়ার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, মন্ত্রিসভায় আমি এসেছি। আমি গড্ডলিকা প্রবাহে যাবো না। সেই কারণেই এই কয়দিনের মধ্যে আমি আমার রোডম্যাপ দিয়েছি। এটি এদেশের ক্ষমতার সংস্কৃতিতে একটি নতুন অধ্যায়। এই রোডম্যাপের মাধ্যমে আমি বলে দিয়েছি- কি করতে চাই এবং কি করবো। আমার সামর্থ্য কি আছে। কারণ আমি জনগণের কাছে দায়বদ্ধ, সংসদের কাছে দায়বদ্ধ। প্রধানমন্ত্রীর কাছে দায়বদ্ধ না। এটি হলো আমার দৃষ্টি। অন্যরা করলে করতেও পারে, আবার না-ও পারে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সরকারের বিশাল অর্জন আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ঝুঁকি নিয়ে আইন করে প্রধানমন্ত্রী জরুরি ভিত্তিতে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন। এখন প্রশ্ন তোলা হচ্ছে- দাম বাড়ালো কেন, ফার্নেস অয়েল আনা হলো কেন? দাম বাড়ালেও হবে না, তেল দিয়ে করলেও হবে না, আবার না দিলেও হবে না- তাহলে হবেটা কি?
দ্রব্যমূল্য নিয়ে সমালোচনার বিষয়ে প্রবীণ এ নেতা বলেন, এটি অনেকটা আন্তর্জাতিক দামের ওপর নির্ভর করে। মুক্ত বাজার অর্থনীতি মানে একেবারে মুক্ত স্বাধীন অর্থনীতি নয়। এখানে সরকারি এবং বেসরকারি খাতের প্রতিযোগিতার প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু সংবিধান আর স্বাধীনতাই দেননি- তিনি বিএডিসি ও টিসিবি’র মতো প্রতিষ্ঠান উপহার দিয়েছিলেন। এ দু’টি জিনিস আমাদের জন্য অপরিহার্য। এসব প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর করে সরকারকেও প্রতিযোগিতায় থাকতে হবে। এছাড়া মন্ত্রীদের কথাবার্তায় ও আচরণে সহনশীল হতে হবে। আরও একটা বিষয় হলো, বাজার অর্থনীতির নামে আমাদের ব্যবসায়ী সমাজও প্রাতিষ্ঠানিকতার মধ্যে আসেনি। ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, আমদানি ও রপ্তানিকারকরা যদি নিজ নিজ অবস্থানে থেকে দেশপ্রেম নিয়ে কাজ করেন, তাহলে মানুষের উপকার হবে। অহেতুক মূল্যবৃদ্ধি হবে না। এই বিষয়টির সঙ্গে গণতন্ত্রের সম্পর্ক খুবই নিবিড়। আইনশৃঙ্খলা ও মানবাধিকার পরিস্থিতির অবিমিশ্র মূল্যায়ন করে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, মানবাধিকার বিষয়টি আপেক্ষিক। সামপ্রতিক সময়ে গুম হয়ে যাচ্ছে। হত্যাকাণ্ড হচ্ছে। এগুলো অবশ্যই আমাদের দেখতে হবে। এটি করা যায় না। আবার দু’-একটা এক্সেস ঘটনা যে ঘটবে না- তা-ও তো বলা যাবে না। তারপরও আমরা একটি স্বাধীন মানবাধিকার কমিশন গঠন করেছি। এই কমিশন অত্যন্ত দায়িত্বশীলভাবে কাজ করছে।
তিন বছরে দলীয় কর্মকাণ্ডের মূল্যায়ন জানতে চাইলে তিনি বলেন, দলকে ও জোটকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। তাদের দ্বারাই জনসংযোগটা করতে হবে। স্লোগান দিয়ে যদি কিছু অদক্ষ লোক ঢুকে যায় তাহলে তো হবে না। এটি আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনাকেই দেখতে হবে। নির্বাচন ছাড়া সাংবিধানিক রাজনীতিতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আর কোন উপায় নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিরোধী দলকে আহ্বান করবো- আপনারাও সংসদে ফিরে আসুন। আমরা একটা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি নির্মাণ করি।
সংসদকে পাশ কাটিয়ে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে ইতিবাচক রাজনৈিতক সংস্কৃতি গড়ে তোলা যায় না। সব কিছুর পরও দেশটা আমাদের। দেশকে সামনে এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব আমাদের। সব বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে আমরা সামনে এগিয়ে যেতে পারবো।
No comments