কৃষি ও শিক্ষায় পদক্ষেপ ছিল উজ্জ্বল
কাফি কামাল: মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। প্রধান বিরোধীদল বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব। কৃষক
পৃষ্ঠা ৮ কলাম ৩
নেতা ও সাবেক এ মন্ত্রী এমন এক সময়ে বিএনপি’র মহাসচিবের দায়িত্ব পেয়েছেন যখন রাজনীতিতে পদে পদে ভুল আর ভয়ের দ্বৈরথ। মহাজোট সরকারের তিন বছরের মূল্যায়ন করে তিনি বলেছেন, এ তিন বছর জনগণের হতাশা আর সরকারের ব্যর্থতার সময়কাল। নির্বাচনের আগে দেয়া বহু বর্ণিল প্রতিশ্রুতির একটিও বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। উল্টো দেশবিরোধী চুক্তি, একতরফা সংবিধান সংশোধনসহ জনমতের বিরুদ্ধে নিয়েছে নানা সিদ্ধান্ত। কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টে ভর্তুকি দিতে গিয়ে বিদ্যুৎ-গ্যাস ও জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ানো এবং মূল্যস্ফীতির কারণে দ্রব্যমূল্য এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে। রেমিটেন্স ও বৈদেশিক রিজার্ভে ভাটার টান, শেয়ারবাজারে ধস এবং সরকারের ব্যাংক ঋণ নির্ভরতার কারণে দেশের অর্থনীতি চরম বিপর্যয়ের মুখে। কূটনৈতিক ব্যর্থতায় হাতছাড়া নানা জাতীয় সম্পদ। অনেকে ধারণা করছেন, আগামী মার্চ মাসের মধ্যে সরকার বড় ধরনের ব্রেক থ্রু দিতে না পারলে দেশে অর্থনৈতিক বিপর্যয় অনিবার্য। এর মধ্যেই সরকারের দুটি খাত কিছুটা সফল। কৃষিতে প্রথম দুই বছর এবং শিক্ষায় পুরো তিন বছর ইতিবাচক পদক্ষেপ আছে।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের মূল্যায়ন করে তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা জনশক্তি রপ্তানি খাতে। কারণ দেশের বৈদেশিক আয়ের বড় খাত রেমিটেন্স। এ সরকারের সময়ে নানা দেশ থেকে বিশেষ করে সৌদি আরব, লিবিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্য থেকে বিপুল সংখ্যক জনশক্তি ফিরে এসেছে। নতুন বাজার সৃষ্টি হচ্ছে না, মালয়েশিয়ায়ও বাজার ফিরে পাইনি। ফলে রেমিটেন্সের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিনিয়োগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ ছিল ঊর্ধ্বমুখী। আমরা বিনিয়োগ আকৃষ্ট পরিবেশ ও আস্থা সৃষ্টি করতে পেরেছিলাম, যা এ সরকার পারেনি। ফলে বিনিয়োগ স্তিমিত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে গৃহায়ণ খাতে। বিদ্যুৎ-গ্যাসের দামবৃদ্ধির কারণে বন্ধ হয়েছে বহু কলকারখানা। এর পরিপ্রেক্ষিতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি। আবার সরকার বিপুল পরিমাণে ঋণ নিয়ে ব্যাংককে সঙ্কটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ব্যাংকের তারল্য সঙ্কট ভয়াবহ অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছে। বিনিয়োগকারীরা ঋণ পাচ্ছেন না। কোন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বললে শুনবেন ব্যাংক টাকা দিতে পারছে না। ফলে ক্ষুদ্র বিনিয়োগে বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে। দেশের সার্বিক ঊর্ধ্বমুখী ধারাটি এখন নিচের দিকে নেমে এসেছে।
সাবেক এ অধ্যাপক বলেন, দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গত দুই দশকে কখনও দুই অঙ্কের নিচে নামেনি। এবার রেকর্ড হচ্ছে। রেকর্ড হচ্ছে ডলারের অস্বাভাবিক দামেও। কিন্তু সরকার রিজার্ভের দিকে নজর না দিয়ে নতুন করে নোট ছাপাচ্ছে। খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, মূল্যস্ফীতিই অর্থনীতির সবচেয়ে বাজে ঘটনা। এতে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। সেই মূল্যস্ফীতিতেও রেকর্ড করেছে সরকার। ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থাকে এ সরকার প্রথম থেকেই নেতিবাচকভাবে দেখেছে। নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের ঘটনা, ক্ষুদ্র ঋণের ব্যাপারে অপপ্রচার গ্রামীণ অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করেছে। বিদেশী সাহায্য সংস্থাগুলো অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছে। এডিপি বাস্তবায়ন হারে পতন ঘটেছে সাংঘাতিভাবে। পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ হয়ে যাওয়া আমাদের জন্য একটি বিপর্যয়কর পরিস্থিতি। দ্রব্যমূল্য নিয়ে তিনি বলেন, জনগণের হতাশাটা এখানেই যে ক্ষমতায় আসার আগে মহাজোট বড় বড় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এখন দফায় দফায় জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বাড়ায় সাধারণ মানুষের জীবনযাপন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষকে ভোগানো দ্রব্যমূল্যের বিষয়টি এতই জটিল হয়ে পড়েছে যে, সবাই বুঝতে পারে সরকারের হাতে এর নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু কেন এ সমস্যা? সরকার বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখার নামে বিনা টেন্ডারে ইনডেমনিটিসহ দলীয় লোকজনকে কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট বসানোর অনুমোদন দিয়েছে। সেখানে দুর্নীতির বিশাল ঘটনা ঘটেছে। যার মাশুল দিতে হচ্ছে এদেশের মানুষকে। পণ্যমূল্য আর ভর্তুকির পুরোটাই যাচ্ছে জনগণের পকেট থেকে।
কূটনৈতিক অদূরদর্শিতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে বর্তমান সরকারের বন্ধুত্ব একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। সবাই ভেবেছিল এবার ভারতের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন হবে সমমর্যাদার ভিত্তিতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হলো একতরফা। মহাজোট সরকার ভারতের সব চাহিদা পূরণ করলেও প্রাপ্তির খাতায় শূন্য। চট্টগ্রাম, মংলাবন্দর ও আশুগঞ্জ স্থলবন্দর ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়েছে জনগণের দৃষ্টিকে আড়াল করে। কখনও তা জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি। একটি কথা পরিষ্কার বলতে চাই, আমরা এসব ক্ষেত্রে নেতিবাচক নই। অর্থনীতির জন্য কানেকটিভিটির প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে- বন্দর ও করিডোর ব্যবহার করতে দিয়ে আমরা কি পাবো? বলা হয়েছিল, এসব ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে যে আয় হবে তাতে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা কি? একটি পয়সাও আমরা পাচ্ছি না। এতে জনগণের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খারাপ হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে টানাপড়েনের নেপথ্যে কাজ করেছে- কূটনৈতিক সম্পর্ক ভেঙে পড়া ও মধ্যপ্রাচ্যের সামপ্রতিক উত্থান-পতন। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে ‘মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক’ বাতিলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কে টানাপড়েনের সৃষ্টি হয়েছে। আমেরিকার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক সবচেয়ে খারাপ হয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে কেন্দ্র করে। আমেরিকাসহ সারাবিশ্বে ড. ইউনূসকে একজন সৃষ্টিশীল, মেধাবী মানুষ হিসাবে জানে, সম্মানের চোখে দেখে। বিশ্ব এখন ইউনূসের নামে বাংলাদেশকে চেনে, বাংলাদেশের নামে তাকে নয়; এটাই বাস্তবতা। আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যক্তিগত বন্ধু ড. ইউনূসের সঙ্গে সরকারের কলুষিত আচরণ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্কে চিড় ধরিয়েছে।
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে স্মরণকালের ভয়াবহ দাবি করে তিনি বলেন, এখন যতটা খারাপ আগে কখনও এতটা খারাপ ছিল না। এর জন্য দায়ী সরকারের ভুল নীতি। তারা পুলিশ-র্যাবকে ব্যবহার করেছে বিরোধীদল নিপীড়নের কাজে। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে স্বেচ্ছাচারিতার সৃষ্টি হচ্ছে। যার ফলাফল লিমন, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র কাদেরকে পঙ্গু করার ঘটনা। পুলিশি আটক ব্যক্তিকে গণপিটুনির জন্য বিক্ষুব্ধ মানুষের হাতে তুলে দেয়ার মতো অবিশ্বাস্য ঘটনাও ঘটছে। প্রতিনিয়ত গুম, খুন হচ্ছে। আগে লাশ পাওয়া যেতো এখন লাশও মিলছে না। একটি সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশে এমনটি হতে পারে না।
মহাজোট সরকারের সাফল্যের দিকগুলো তুলে ধরতে গিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, সাফল্য কিছুটা দেখা যায় শিক্ষা ও কৃষি দু’টি ক্ষেত্রে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রথম বছরের কিছু পদক্ষেপ ছিল ইতিবাচক। যেমন- কৃষকদের কার্ড করে দেয়া। এর ভিত্তিতে বিদ্যুৎ, তেল ও সার পাওয়া নিশ্চিত হয়। ব্যক্তিগতভাবে এ পদক্ষেপকে ইতিবাচক বিবেচনা করি। কিন্তু গত বছর থেকে দেখছি সারের মূল্যবৃদ্ধিতে সে সাফল্য মার খাচ্ছে। এ সময় প্রতি বস্তা ইউরিয়ার দাম বেড়েছে ৮০০ টাকা। কৃষকের খরচ বেড়েছে কিন্তু সে অনুপাতে কৃষিপণ্যের দাম পাচ্ছেন না। এছাড়া সরকারের প্রকিউরমেন্ট সব সময়ই মধ্যস্বত্বভোগীদের পক্ষেই গেছে, কৃষকের পক্ষে নয়। তবে শিক্ষাক্ষেত্রে ভাল কাজ হচ্ছে। সরকার বছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছে দিচ্ছে। এ সাফল্যও ম্লান হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সন্ত্রাসী ঘটনার কারণে। মারামারি, দুর্নীতি আর অনৈতিক কাজে বাধ্য করার মতো ঘটনাও ঘটছে।
সংসদীয় পদ্ধতিতে বিরোধীদল হিসাবে বিএনপি দায়িত্বপূর্ণ আচরণ করতে পারছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে দলটির মহাসচিব বলেন, আমরা প্রথম অধিবেশনেই সংসদে গেছি, সহযোগিতা করতে চেয়েছি। সরকার উল্টো আমাদের নেতাদের ব্যাপারে এমন কটূক্তি করেছে, যা সংসদীয় রীতিনীতির মধ্যেই পড়ে না। সবচেয়ে বড় কথা, আলোচনার জন্য আমাদের দেয়া ৩০০০-এর বেশি নোটিশের একটিও গ্রহণ করেননি স্পিকার। জাতীয় ইস্যুতে আলোচনার সুযোগই দেননি। তাই বাধ্য হয়েই অধিবেশনে অনুপস্থিত থাকছি। তবে সংসদীয় কমিটির মিটিংয়ে যাচ্ছি, দায়িত্ব পালন করছি। আমরা সংসদে যেতে চাই, ফেরানোর উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। পরিবেশ সৃষ্টি ও কথা বলার সুযোগ দিতে হবে।
আন্দোলনে দোদুল্যমানতা নিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, রাজনৈতিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমাদের রাজনীতিবিদ ও গণমাধ্যমের মাইন্ড সেট একই ধরনের। মনে করা হয়, লাগাতার হরতাল ও নৈরাজ্যই হচ্ছে কার্যকর আন্দোলন কর্মসূচি। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার কারণে একটি গুণগত উত্তরণ হয়েছিল। মেয়াদ শেষে নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং তত্ত্বাবধায়কের অধীনেই নির্বাচন হওয়া। নির্বাচনের মাধ্যমেই জনগণ তাদের মতামতের প্রতিফলন ঘটাতে চায়। ফলে রাজপথের আন্দোলন আগের সে ভূমিকা রাখতে পারছে না। এটাই বাস্তবতা। আন্দোলন ও নৈরাজ্যের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ আওয়ামী লীগ মেয়াদপূর্তির একদিন আগেও আমাদের সরাতে পারেনি। তাই আমরা সচেতনভাবেই ওই ধরনের কর্মসূচি থেকে দূরে থাকতে চাইছি। নেতিবাচক কোন কর্মসূচি দিতে চাই না।
বিএনপি’র আন্দোলন বিক্ষিপ্ত নয় দাবি করে তিনি বলেন, বিএনপি এখন একটি মাত্র ইস্যুতেই আন্দোলনকে কেন্দ্রীভূত করেছে। সেটা হচ্ছে- তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল। এ দাবিতে আমাদের রোড মার্চ সফল হচ্ছে। সাধারণ মানুষ, গ্রামের মহিলারা এতে অংশ নিচ্ছেন। পঞ্চদশ সংশোধনীর পর অনেকেই বলেছিলেন বিএনপি আসুক না আসুক, নির্বাচন হবে। এখন কিন্তু সে কথা কেউ বলতে পারছেন না। জাতিসংঘের মহাসচিব বলেছেন, সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। মার্কিন রাষ্ট্রদূতও বলেছেন। এমনকি কয়েক দিন আগে একজন প্রখ্যাত সাংবাদিকও বলেছেন, একদলীয় নির্বাচন করতে গেলে জনগণই তা রুখে দেবে। এছাড়া সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবীসহ প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলো বলছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহালের দাবি জানাচ্ছে সিপিবি-গণফোরামের মত দলগুলোও। এটাই আমাদের অর্জন, আন্দোলনের সাফল্য। আর সরকারের ফ্যাসিবাদী আচরণের কারণে আন্দোলন জোরালো করা যাচ্ছে না। সরকার গুম-খুন করছে, মামলা দিচ্ছে। একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের পক্ষে যা মোকাবেলা করা কঠিন।
পৃষ্ঠা ৮ কলাম ৩
নেতা ও সাবেক এ মন্ত্রী এমন এক সময়ে বিএনপি’র মহাসচিবের দায়িত্ব পেয়েছেন যখন রাজনীতিতে পদে পদে ভুল আর ভয়ের দ্বৈরথ। মহাজোট সরকারের তিন বছরের মূল্যায়ন করে তিনি বলেছেন, এ তিন বছর জনগণের হতাশা আর সরকারের ব্যর্থতার সময়কাল। নির্বাচনের আগে দেয়া বহু বর্ণিল প্রতিশ্রুতির একটিও বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। উল্টো দেশবিরোধী চুক্তি, একতরফা সংবিধান সংশোধনসহ জনমতের বিরুদ্ধে নিয়েছে নানা সিদ্ধান্ত। কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টে ভর্তুকি দিতে গিয়ে বিদ্যুৎ-গ্যাস ও জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ানো এবং মূল্যস্ফীতির কারণে দ্রব্যমূল্য এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে। রেমিটেন্স ও বৈদেশিক রিজার্ভে ভাটার টান, শেয়ারবাজারে ধস এবং সরকারের ব্যাংক ঋণ নির্ভরতার কারণে দেশের অর্থনীতি চরম বিপর্যয়ের মুখে। কূটনৈতিক ব্যর্থতায় হাতছাড়া নানা জাতীয় সম্পদ। অনেকে ধারণা করছেন, আগামী মার্চ মাসের মধ্যে সরকার বড় ধরনের ব্রেক থ্রু দিতে না পারলে দেশে অর্থনৈতিক বিপর্যয় অনিবার্য। এর মধ্যেই সরকারের দুটি খাত কিছুটা সফল। কৃষিতে প্রথম দুই বছর এবং শিক্ষায় পুরো তিন বছর ইতিবাচক পদক্ষেপ আছে।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের মূল্যায়ন করে তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা জনশক্তি রপ্তানি খাতে। কারণ দেশের বৈদেশিক আয়ের বড় খাত রেমিটেন্স। এ সরকারের সময়ে নানা দেশ থেকে বিশেষ করে সৌদি আরব, লিবিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্য থেকে বিপুল সংখ্যক জনশক্তি ফিরে এসেছে। নতুন বাজার সৃষ্টি হচ্ছে না, মালয়েশিয়ায়ও বাজার ফিরে পাইনি। ফলে রেমিটেন্সের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিনিয়োগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ ছিল ঊর্ধ্বমুখী। আমরা বিনিয়োগ আকৃষ্ট পরিবেশ ও আস্থা সৃষ্টি করতে পেরেছিলাম, যা এ সরকার পারেনি। ফলে বিনিয়োগ স্তিমিত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে গৃহায়ণ খাতে। বিদ্যুৎ-গ্যাসের দামবৃদ্ধির কারণে বন্ধ হয়েছে বহু কলকারখানা। এর পরিপ্রেক্ষিতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি। আবার সরকার বিপুল পরিমাণে ঋণ নিয়ে ব্যাংককে সঙ্কটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ব্যাংকের তারল্য সঙ্কট ভয়াবহ অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছে। বিনিয়োগকারীরা ঋণ পাচ্ছেন না। কোন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বললে শুনবেন ব্যাংক টাকা দিতে পারছে না। ফলে ক্ষুদ্র বিনিয়োগে বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে। দেশের সার্বিক ঊর্ধ্বমুখী ধারাটি এখন নিচের দিকে নেমে এসেছে।
সাবেক এ অধ্যাপক বলেন, দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গত দুই দশকে কখনও দুই অঙ্কের নিচে নামেনি। এবার রেকর্ড হচ্ছে। রেকর্ড হচ্ছে ডলারের অস্বাভাবিক দামেও। কিন্তু সরকার রিজার্ভের দিকে নজর না দিয়ে নতুন করে নোট ছাপাচ্ছে। খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, মূল্যস্ফীতিই অর্থনীতির সবচেয়ে বাজে ঘটনা। এতে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। সেই মূল্যস্ফীতিতেও রেকর্ড করেছে সরকার। ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থাকে এ সরকার প্রথম থেকেই নেতিবাচকভাবে দেখেছে। নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের ঘটনা, ক্ষুদ্র ঋণের ব্যাপারে অপপ্রচার গ্রামীণ অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করেছে। বিদেশী সাহায্য সংস্থাগুলো অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছে। এডিপি বাস্তবায়ন হারে পতন ঘটেছে সাংঘাতিভাবে। পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ হয়ে যাওয়া আমাদের জন্য একটি বিপর্যয়কর পরিস্থিতি। দ্রব্যমূল্য নিয়ে তিনি বলেন, জনগণের হতাশাটা এখানেই যে ক্ষমতায় আসার আগে মহাজোট বড় বড় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এখন দফায় দফায় জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বাড়ায় সাধারণ মানুষের জীবনযাপন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষকে ভোগানো দ্রব্যমূল্যের বিষয়টি এতই জটিল হয়ে পড়েছে যে, সবাই বুঝতে পারে সরকারের হাতে এর নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু কেন এ সমস্যা? সরকার বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখার নামে বিনা টেন্ডারে ইনডেমনিটিসহ দলীয় লোকজনকে কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট বসানোর অনুমোদন দিয়েছে। সেখানে দুর্নীতির বিশাল ঘটনা ঘটেছে। যার মাশুল দিতে হচ্ছে এদেশের মানুষকে। পণ্যমূল্য আর ভর্তুকির পুরোটাই যাচ্ছে জনগণের পকেট থেকে।
কূটনৈতিক অদূরদর্শিতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে বর্তমান সরকারের বন্ধুত্ব একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। সবাই ভেবেছিল এবার ভারতের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন হবে সমমর্যাদার ভিত্তিতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হলো একতরফা। মহাজোট সরকার ভারতের সব চাহিদা পূরণ করলেও প্রাপ্তির খাতায় শূন্য। চট্টগ্রাম, মংলাবন্দর ও আশুগঞ্জ স্থলবন্দর ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়েছে জনগণের দৃষ্টিকে আড়াল করে। কখনও তা জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি। একটি কথা পরিষ্কার বলতে চাই, আমরা এসব ক্ষেত্রে নেতিবাচক নই। অর্থনীতির জন্য কানেকটিভিটির প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে- বন্দর ও করিডোর ব্যবহার করতে দিয়ে আমরা কি পাবো? বলা হয়েছিল, এসব ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে যে আয় হবে তাতে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা কি? একটি পয়সাও আমরা পাচ্ছি না। এতে জনগণের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খারাপ হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে টানাপড়েনের নেপথ্যে কাজ করেছে- কূটনৈতিক সম্পর্ক ভেঙে পড়া ও মধ্যপ্রাচ্যের সামপ্রতিক উত্থান-পতন। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে ‘মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক’ বাতিলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কে টানাপড়েনের সৃষ্টি হয়েছে। আমেরিকার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক সবচেয়ে খারাপ হয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে কেন্দ্র করে। আমেরিকাসহ সারাবিশ্বে ড. ইউনূসকে একজন সৃষ্টিশীল, মেধাবী মানুষ হিসাবে জানে, সম্মানের চোখে দেখে। বিশ্ব এখন ইউনূসের নামে বাংলাদেশকে চেনে, বাংলাদেশের নামে তাকে নয়; এটাই বাস্তবতা। আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যক্তিগত বন্ধু ড. ইউনূসের সঙ্গে সরকারের কলুষিত আচরণ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্কে চিড় ধরিয়েছে।
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে স্মরণকালের ভয়াবহ দাবি করে তিনি বলেন, এখন যতটা খারাপ আগে কখনও এতটা খারাপ ছিল না। এর জন্য দায়ী সরকারের ভুল নীতি। তারা পুলিশ-র্যাবকে ব্যবহার করেছে বিরোধীদল নিপীড়নের কাজে। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে স্বেচ্ছাচারিতার সৃষ্টি হচ্ছে। যার ফলাফল লিমন, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র কাদেরকে পঙ্গু করার ঘটনা। পুলিশি আটক ব্যক্তিকে গণপিটুনির জন্য বিক্ষুব্ধ মানুষের হাতে তুলে দেয়ার মতো অবিশ্বাস্য ঘটনাও ঘটছে। প্রতিনিয়ত গুম, খুন হচ্ছে। আগে লাশ পাওয়া যেতো এখন লাশও মিলছে না। একটি সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশে এমনটি হতে পারে না।
মহাজোট সরকারের সাফল্যের দিকগুলো তুলে ধরতে গিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, সাফল্য কিছুটা দেখা যায় শিক্ষা ও কৃষি দু’টি ক্ষেত্রে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রথম বছরের কিছু পদক্ষেপ ছিল ইতিবাচক। যেমন- কৃষকদের কার্ড করে দেয়া। এর ভিত্তিতে বিদ্যুৎ, তেল ও সার পাওয়া নিশ্চিত হয়। ব্যক্তিগতভাবে এ পদক্ষেপকে ইতিবাচক বিবেচনা করি। কিন্তু গত বছর থেকে দেখছি সারের মূল্যবৃদ্ধিতে সে সাফল্য মার খাচ্ছে। এ সময় প্রতি বস্তা ইউরিয়ার দাম বেড়েছে ৮০০ টাকা। কৃষকের খরচ বেড়েছে কিন্তু সে অনুপাতে কৃষিপণ্যের দাম পাচ্ছেন না। এছাড়া সরকারের প্রকিউরমেন্ট সব সময়ই মধ্যস্বত্বভোগীদের পক্ষেই গেছে, কৃষকের পক্ষে নয়। তবে শিক্ষাক্ষেত্রে ভাল কাজ হচ্ছে। সরকার বছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছে দিচ্ছে। এ সাফল্যও ম্লান হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সন্ত্রাসী ঘটনার কারণে। মারামারি, দুর্নীতি আর অনৈতিক কাজে বাধ্য করার মতো ঘটনাও ঘটছে।
সংসদীয় পদ্ধতিতে বিরোধীদল হিসাবে বিএনপি দায়িত্বপূর্ণ আচরণ করতে পারছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে দলটির মহাসচিব বলেন, আমরা প্রথম অধিবেশনেই সংসদে গেছি, সহযোগিতা করতে চেয়েছি। সরকার উল্টো আমাদের নেতাদের ব্যাপারে এমন কটূক্তি করেছে, যা সংসদীয় রীতিনীতির মধ্যেই পড়ে না। সবচেয়ে বড় কথা, আলোচনার জন্য আমাদের দেয়া ৩০০০-এর বেশি নোটিশের একটিও গ্রহণ করেননি স্পিকার। জাতীয় ইস্যুতে আলোচনার সুযোগই দেননি। তাই বাধ্য হয়েই অধিবেশনে অনুপস্থিত থাকছি। তবে সংসদীয় কমিটির মিটিংয়ে যাচ্ছি, দায়িত্ব পালন করছি। আমরা সংসদে যেতে চাই, ফেরানোর উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। পরিবেশ সৃষ্টি ও কথা বলার সুযোগ দিতে হবে।
আন্দোলনে দোদুল্যমানতা নিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, রাজনৈতিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমাদের রাজনীতিবিদ ও গণমাধ্যমের মাইন্ড সেট একই ধরনের। মনে করা হয়, লাগাতার হরতাল ও নৈরাজ্যই হচ্ছে কার্যকর আন্দোলন কর্মসূচি। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার কারণে একটি গুণগত উত্তরণ হয়েছিল। মেয়াদ শেষে নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং তত্ত্বাবধায়কের অধীনেই নির্বাচন হওয়া। নির্বাচনের মাধ্যমেই জনগণ তাদের মতামতের প্রতিফলন ঘটাতে চায়। ফলে রাজপথের আন্দোলন আগের সে ভূমিকা রাখতে পারছে না। এটাই বাস্তবতা। আন্দোলন ও নৈরাজ্যের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ আওয়ামী লীগ মেয়াদপূর্তির একদিন আগেও আমাদের সরাতে পারেনি। তাই আমরা সচেতনভাবেই ওই ধরনের কর্মসূচি থেকে দূরে থাকতে চাইছি। নেতিবাচক কোন কর্মসূচি দিতে চাই না।
বিএনপি’র আন্দোলন বিক্ষিপ্ত নয় দাবি করে তিনি বলেন, বিএনপি এখন একটি মাত্র ইস্যুতেই আন্দোলনকে কেন্দ্রীভূত করেছে। সেটা হচ্ছে- তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল। এ দাবিতে আমাদের রোড মার্চ সফল হচ্ছে। সাধারণ মানুষ, গ্রামের মহিলারা এতে অংশ নিচ্ছেন। পঞ্চদশ সংশোধনীর পর অনেকেই বলেছিলেন বিএনপি আসুক না আসুক, নির্বাচন হবে। এখন কিন্তু সে কথা কেউ বলতে পারছেন না। জাতিসংঘের মহাসচিব বলেছেন, সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। মার্কিন রাষ্ট্রদূতও বলেছেন। এমনকি কয়েক দিন আগে একজন প্রখ্যাত সাংবাদিকও বলেছেন, একদলীয় নির্বাচন করতে গেলে জনগণই তা রুখে দেবে। এছাড়া সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবীসহ প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলো বলছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহালের দাবি জানাচ্ছে সিপিবি-গণফোরামের মত দলগুলোও। এটাই আমাদের অর্জন, আন্দোলনের সাফল্য। আর সরকারের ফ্যাসিবাদী আচরণের কারণে আন্দোলন জোরালো করা যাচ্ছে না। সরকার গুম-খুন করছে, মামলা দিচ্ছে। একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের পক্ষে যা মোকাবেলা করা কঠিন।
No comments