‘অভাবে নয় স্বভাবের কারণে চুরি করি’ -কোটিপতি চোর জয়নালের স্বীকারোক্তি
নূরুজ্জামান: ‘অভাবে নয়, স্বভাবের কারণেই চুরি করেছি। উচ্চশিক্ষিত ছেলের কথায় অনেক আগেই চুরি করা ছেড়েছিলাম। কিন্তু বিমানবন্দরে গেলেই মাথা ওলট-পালট হয়ে যায়। লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড শাখায় একটি টেলিভিশন দেখেই জেগে ওঠে চুরির নেশা। টিভি নিয়ে পালানোর সময়ই এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যাই।’ এভাবেই বিমানবন্দর থানা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে দীর্ঘ ২০ বছরের চৌর্যবৃত্তির কথা অকপটে স্বীকার করেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সাবেক কর্মচারী জয়নাল আবেদীন (৫৪)। তিন দিনের রিমান্ডের দ্বিতীয় দিনে গতকাল জয়নাল জানিয়েছে, তার দুই স্ত্রীর ঘরে ৫ জন ছেলে-মেয়ে রয়েছে। সবাই উচ্চশিক্ষিত। বড় ছেলে ইমন বর্তমানে লন্ডনে সিএ পড়ছে। দুই ছেলে ঘরে এনেছে উচ্চশিক্ষিত বউ। আগের স্ত্রী মারা যাওয়ায় নিজেও আরেকটি বিয়ে করেছে। তাকে নিয়েই বর্তমানে সে অবসর সময় কাটাচ্ছে। বিমানবন্দর থানার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আজম বলেন, কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তির তথ্য গোপন ও চুরির পেশা বজায় রাখতেই জয়নাল নিজের বাসায় থাকতো না। থাকতো তার সম্বন্ধী ও হত্যা মামলার আসামির বাড়িতে। তিনি আরও বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে জয়নাল চুরির কথা স্বীকার করে বলেছে, অবসরের কারণে মাঝে-মধ্যেই বেড়াতে যাই বিমানবন্দর এলাকায়। আর তখনই জেগে ওঠে আগের চুরির নেশা। বিদেশী ব্রান্ডের দামি জিনিসপত্রের লাগেজ চোখে পড়লেই চুরির স্বভাব জেগে ওঠে। তদন্ত সূত্র জানায়, বিমানের কর্মচারী থাকাকালে জয়নাল প্রায় ২০-২১ বছর ধরে বিমানবন্দর এলাকায় লাগেজসহ বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র চুরির সঙ্গে জড়িত ছিল। এ সময় তার সঙ্গে ছিল বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, সিভিল এভিয়েশন ও বিমানবন্দরের তিন চোর সিন্ডিকেটের বেশ কয়েকজন। বিভিন্ন কৌশলে তারা প্রতি মাসে প্রায় কোটি টাকার মালামাল চুরি করেছে। ইতিমধ্যে তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী বিমানবন্দরের আরেক চোর ও বিমানের চালক বারেককে গ্রেপ্তার করে দু’দিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এছাড়া তার আরেক সহযোগী মোস্তফাকে খোঁজা হচ্ছে। তদন্ত সূত্র জানায়, জয়নাল চুরির কথা স্বীকার করলেও বারেক ধূর্ত। নানা কৌশলে সে চুরির কথা গোপন রাখার চেষ্টা করছে। বিমানবন্দরে দায়িত্বরত আর্মড পুলিশ সূত্র জানায়, বিমানবন্দর কেন্দ্রিক সংঘবদ্ধ চোর দলের নেতা জয়নাল। তার অধীনে বিমানবন্দরে কর্মরত প্রায় ৫২ জন চোর কর্মচারীর তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের গোপন নজরদারিতে রাখা হয়েছে। এর আগে গত রোববার সন্ধ্যায় হজরত শাহজালাল (র.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চুরির মালামালসহ হাতেনাতে জয়নালকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগেও গত বছরের ৯ই জানুয়ারি চোরাই লাগেজসহ সে গ্রেপ্তার হয়েছিল। আর্মড সহকারী পুলিশ কমিশনার (এএসপি) আতিকুর রহমান বলেন, বিমানবন্দরের পার্কিং এলাকা, আমদানি এলাকা ও লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড শাখায় চোর সিন্ডিকেটের সদস্যরা ওত পেতে থাকে। সুযোগ বুঝে মালামাল নিয়ে সটকে পড়ে। তদন্ত সূত্র জানায়, লাগেজ চোর জয়নাল রাজধানীর দক্ষিণ খান থানা এলাকায় ইলেকট্রনিক্স পণ্য ও কসমেটিক্স সামগ্রীর পাইকারি সরবরাহকারী হিসেবে পরিচিত। তার স্ত্রীর বড় ভাইয়ের বাসায় ওইসব চোরাই পণ্যসামগ্রীর গোডাউন থেকে উদ্ধার করা হয়েছে বিপুল পরিমাণ কসমেটিকস, কম্বল, জামাকাপড় ও বিদেশী ব্রান্ডের ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জয়নাল জানিয়েছে, তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে। সেখানে নতুন স্ত্রীর নামে চার বিঘা জমি কিনেছে। তৈরি করেছে পাকা বাড়ি। নিজের এলাকায় বিমানের অফিসার হিসেবে পরিচিত। তদন্ত কর্মকর্তা আরও বলেন, জয়নাল প্রায় কয়েক কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তির মালিক। দক্ষিণ খানে নিজের নামে ৫ কাঠা জমি রয়েছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন রেন্ট-এ কারে তার কয়েকটি প্রাইভেটকার ভাড়ায় চলে। তবে এ বিষয়ে সে এখনও মুখ খোলেনি। তবে পুলিশের কাছে তার সহযোগী হিসেবে সিভিল এভিয়েশন ও বিমানবন্দরের বেশ কয়েকজন কর্মচারীর নাম ফাঁস করেছে। সে তথ্য অনুযায়ী বিমানবন্দর থানা পুলিশ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করছে। বিমানবন্দর থানার ওসি সামসুদ্দীন সালেহ আহমেদ বলেন, বিমানবন্দর এলাকার চোর সিন্ডিকেট সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। এসব সিন্ডিকেটের সঙ্গে সিভিল এভিয়েশন ও বিমানের কতিপয় অসাধু কর্মচারী জড়িত। তাদের সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়া হচ্ছে। এপিবিএন সূত্র মতে, এর আগে জয়নালের চোর দলের দুই সদস্য জিএমজি এয়ারলাইন্সের কর্মচারী সিরাজুল ইসলাম ও সিভিল এভিয়েশনের নিরাপত্তাকর্মী দুলালকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা আমদানি গোডাউন থেকে সাত ড্রাম কেমিক্যাল চুরির সময় ধরা পড়েছিল। সূত্র জানায়, ২০১০ সালে বিমানবন্দর এলাকায় ৩৫২টি চুরির ঘটনা ঘটে। এ সময়ে চুরি, প্রতারণা ও পাচারকাজে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৭৩ জনকে আটক করা হয়।
No comments