আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৫৭)-অসাম্প্রদায়িক ওয়াহিদ ভাই by আলী যাকের

মরা দিনভর কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম আর সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স এনেক্স বিল্ডিংয়ের নিচতলায় আমার ভাই এবং ঘনিষ্ঠতম বন্ধু মাহমুদুর রহমান বেনুর ঘরে আড্ডা দিতাম। সেখানে বলাইয়ের ক্যান্টিনের চা চলত কাপের পর কাপ। নিতান্ত বিস্বাদ এই চা, আমরা বলতাম বলাইয়ের পাচন। কিন্তু টেরই পেতাম না যে সন্ধ্যা থেকে আরম্ভ করে রাত ১০টার মধ্যে একেকজন প্রায় কাপ দশেক শেষ করে ফেলেছি। আরো একটি ব্যাপার ছিল, বেনুদের বাসায়


আমরা ব্যাডমিন্টন খেলতাম নিয়মিত। এ সময় আমাদের পুরনো বন্ধুরা সব আবার একসঙ্গে হলাম। বেনু, খোকন, লিটু, কামাল সিদ্দিকী, কমল দা প্রমুখ। তারা সবাই পরে নিজ নিজ ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি করেছে। তাদের অনেকের সঙ্গে রাজনৈতিক মতপার্থক্য ঘটেছে; কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যে সেই সময়ের যে বন্ধুত্ব তার স্মৃতি আমাকে যেমন, তেমনি তাদেরও মাঝেমধ্যে উদাস করে দেয়।
ছায়ানটের সঙ্গে আমার সম্পর্ক সেই ইউনিভার্সিটিতে পড়ার কাল থেকেই। আমি আজকে যে সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে মোটামুটি স্বীকৃত হয়েছি, তার পেছনে ছায়ানট এবং ছায়ানটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অবদান সবচেয়ে বেশি। বেনুই আমার হাত ধরে ছায়নটে নিয়ে যায়। আমাদের সংস্কৃতিবিষয়ক রুচির উন্নয়নে বেনু সর্বদাই সচেষ্ট ছিল। যদিও এ নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করি, এটা অনস্বীকার্য যে আজ সংগীত সম্বন্ধে আমার যদি সামান্য কোনো সুরুচির সৃষ্টি হয়, এর পেছনে প্রথমত বেনু, তারপর ছায়ানটের অবদান সবচেয়ে বেশি। শিল্পকলার প্রতি আমার আকর্ষণ ছিল ঠিকই; কিন্তু শিল্পকলার কোনো বিভাগেই আমি সরাসরি জড়িত ছিলাম না। আমার নাট্যকর্মের শুরু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর। ছায়ানটে গিয়ে গানের অথবা বাদ্যযন্ত্রের ক্লাসগুলো থেকে ভেসে আসা সুর ক্রমে আমার হৃদয়ে প্রবেশ করে। আমি রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি এবং ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীতের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ বোধ করতে থাকি। সেই যে একবার সুরের জাদু ঢুকল আমার অন্তরে, আজ অবধি তা অক্ষয় রয়ে গেছে। আজকের কোনো লঘু সংগীতই আমাকে আর উদ্বেলিত করে না। ছায়ানটের আরো একটি আকর্ষণ ছিল। একজন তরুণ হিসেবে নারীর প্রতি যে অদম্য আকর্ষণ, সেইটিও ছায়ানটের দিকে আমাদের টানত। তখন তো মনে হতো, বাংলাদেশের তাবত সুন্দরী ছায়ানটের অঙ্গনে মিলিত হয় সপ্তাহে দুবার, যেদিন ছায়ানটের ক্লাস থাকে।
ছায়ানটের সংস্পর্শে আসার পর বোধ করি আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া ওয়াহিদ ভাই-ওয়াহিদুল হকের সানি্নধ্য এবং সন্্জীদা খাতুনের স্নেহ। সন্্জীদা খাতুনকে আমরা মিনু আপা বলে ডাকতাম, এখনো ডাকি। ছায়ানট ঘরানার একটা বিশেষ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলো, সংস্কৃতির শুদ্ধ পথ থেকে কোনোক্রমেই বিচ্যুত না হওয়া। এই দর্শন আমাকে সংস্কৃতির জগতে অনেক পথ অতিক্রম করতে সাহায্য করেছে এবং আমার চিন্তা-চেতনা ঋদ্ধ করেছে। ঋদ্ধ করেছে সৎ এবং সুন্দরের পথে পথ চলায়।
পরে দেশ এবং দেশের রাজনীতি নিয়ে আমার যে ধ্যান-ধারণা, তারও উন্মেষ ঘটেছে ছায়ানটের সানি্নধ্যে আসার পর। ওয়াহিদ ভাই সর্বৈব অর্থে একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ ছিলেন এবং তাঁরই সানি্নধ্যে এসে মানুষকে, মানুষের চিরায়ত অধিকারকে সবচেয়ে বেশি দাম দিতে শিখেছি-এ কথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করা যায়। তাঁর প্রয়াণের পর তিনি তাঁর দেহ চিকিৎসাশাস্ত্রের উন্নয়নে গবেষণার জন্য ঢাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করে যান। যেকোনো প্রাণীর মৃত্যু অনিবার্য। আমাদের সবাইকেই যেতে হবে কোনো না কোনো দিন। তবে মৃত্যুর পর যখন আমাদের কিছুই আর করার থাকে না, তখনো আমরা আমাদের দেহ এমন অবলীলায় দান করে যেতে পারি কি না সে সম্বন্ধে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। মনে হয়, মৃত্যু অন্তে সব ধর্মীয় এবং সামাজিক আচার তো খুবই স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। তার পরই ঘর হবে সেই গহ্বরে, যাকে আমরা গোর বলে জানি। অর্থাৎ মানুষ মাত্রই নিজেকে চিরন্তন করে রাখতে চায়। এই মানসিকতা অতিক্রম করা খুব সহজ কথা নয়। সব আচার তুচ্ছজ্ঞান করে, মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করে নিজের শেষটুকুও দান করে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন এমন এক মানসিকতার, যা বেশির ভাগ মানুষের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। অধ্যাপক আহমদ শরীফ করেছিলেন। তারপর ওয়াহিদ ভাই এবং আমি যতদূর জানি, তাঁর পরিবারের সবারই সেই ইচ্ছা এবং তাঁরা এ বিষয়ে একটি আইনানুগ ইচ্ছাপত্রও লিখে রেখেছেন। অনেকেই মনে করেন যে এহেন আচরণ যাঁদের, তাঁরা নাস্তিকই বটে। একদিক দিয়ে দেখতে গেলে এটি সত্য। কেননা প্রয়াত আহমদ শরীফ নাস্তিক ছিলেন। আবার প্রয়াত অধ্যাপক সায়েদুর রহমান সম্পূর্ণ নাস্তিক হয়েও সামাজিক আচারের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন বৈকি। তাঁর গ্রামের বাড়িতে তিনি সমাহিত হয়েছিলেন। এ নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমার বিশেষ কোনো চিন্তা নেই। তবে ভাবনা আছে। ওয়াহিদ ভাইয়ের কোনো ধর্মে বিশ্বাস ছিল বলে আমার জানা নেই। তবে তিনি কিছু নন্দনতাত্তি্বক মূল্যবোধকে এবং সেই মূল্যবোধের সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষকে প্রায় ঈশ্বরের মর্যাদা দিতেন। তাঁদের মধ্যে সর্বাগ্রে রবীন্দ্রনাথের নাম উল্লেখ করতে হয়। ছায়ানটের সংস্পর্শে এসে রবীন্দ্রনাথকে জানার চেষ্টার মধ্য দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি আমার ভালোবাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। এবং এই ভালোবাসাই একদিকে যেমন বাঙালি জাতিসত্তার প্রতি, তার সার্বিক মুক্তির প্রতি আমাকে সচেতন করে তোলে, ঠিক তেমনভাবেই আজকের এই বাংলাদেশের অন্তর্গত সব জাতিসত্তার প্রতিও শ্রদ্ধাশীল করে তোলে। এই জাতিসত্তা, যাদের আমরা আদিবাসী বলি, তাদের কারো কারো সঙ্গে আমার পরিচয় নটর ডেম কলেজে পড়ার সময়। সেই সময় থেকেই এক ধরনের কৌতূহল কাজ করত আমার মধ্যে। এরও পেছনে রবীন্দ্রনাথের অনুপ্রেরণা নিরন্তর কাজ করেছে। পরবর্তী সময় যখন তাঁর সাহিত্যের সঙ্গে, চিত্রকলার সঙ্গে, সংগীতের সঙ্গে আরো নিবিড় পরিচয় ঘটে, তখন আবিষ্কার করি যে বাংলায় নিবাস যাদের তাদের সবার সম্বন্ধেই প্রচণ্ড কৌতূহল ছিল এই ব্যক্তির। যে কারণে তাঁর সাহিত্য এবং সংগীতে বাংলার প্রান্তিক জনগণের কথা ও বাংলার আদিবাসীদের শিল্পকলা বেশ লক্ষণীয় একটি স্থান করে নিয়েছে।
(চলবে...)

লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.