সংঘাত এড়াতে না পারলে গৃহযুদ্ধ হতে পারে
কাজল ঘোষ: নির্বাচনের দু’বছর থাকতেই বড় দু’দলে বিতর্ক চলছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু নিয়ে। আগামী দিনগুলোতে এ সঙ্কটের সুরাহা না হলে দেশে গৃহযুদ্ধ হতে পারে। এর ওপর রয়েছে তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কট। গুম আর গুপ্তহত্যা তো আছেই। সরকারের পৃষ্ঠা ৪ কলাম ৫
৩ বছরের মূল্যায়নে সাবেক সচিব ও বাংলাদেশ টুডে’র সাবেক সম্পাদক মোহাম্মদ আসাফ্উদ্দৌল্লাহ্ আরও বলেন, বিএনপির সংসদে না যাওয়ার ঘোষণা তাদের জন্য বড় রকমের রাজনৈতিক ব্যর্থতা। মানবজমিনকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সঙ্কট নিয়ে বলেছেন খোলামেলা নানা কথা-
তিন বছরের সাফল্য ও ব্যর্থতা কোথায়?
সফলতার চেয়ে ব্যর্থতার পাল্লাই ভারি। কৃষি ও শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারের বেশ কিছু দৃশ্যমান সফলতা রয়েছে। মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। গত তিন বছরে কাজের চেয়ে ফ্রন্ট বেশি খোলা হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই নতুন শত্রুপক্ষ তৈরি করা হয়েছে। তিন বছরে বড় সফলতা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারও শুরু হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন থাকে, এটি আওয়ামী লীগের প্রথম টার্মে কেন শুরু হয়নি? ছিয়ানব্বইতে জামায়াত তাদের মিত্র ছিল বলেই কি বিচার হয়নি? আর এখন তারা সঙ্গে নেই বলেই কি বিচার করতে হবে? যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে চারপাশে আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ঘরে ঘরে যুদ্ধাপরাধী খুঁজে বের করা হবে। এটা কোন আইনের ভাষা হতে পারে না। এটা ন্যায়বিচারের দৃষ্টান্ত হতে পারে না। নাগরিকমাত্রেই বিচার চায়, তবে তা হতে হবে স্বচ্ছ, রাজনৈতিক, পক্ষপাতদুষ্ট নয়। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। কাল কেটেছে গুম আর গুপ্ত হত্যায়। সবমিলিয়ে মানুষ আতঙ্কিত।
অর্থনীতি কেমন দেখলেন-
দেশের আর্থিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে ভয়াবহ মাত্রায়। চলতি বছরে যা আরও বাড়তে পারে। বছর শুরু হয়েছে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির ধাক্কায়। এতে পণ্য মূল্য বাড়বে। অভ্যন্তরীণ ব্যয় নির্বাহ করতে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে। এর কোনও সীমা নেই। অর্থবছরের শুরুতে বলা হয়েছিল, ১৮ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ নেয়া হবে, কিন্তু সেখানে প্রথম ছয় মাসেই নেয়া হয়েছে ২৪ হাজার কোটি টাকা।
দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ হয়ে গেছে। ঘাটতি ব্যয় নির্বাহে সরকার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে করের বোঝা বাড়াচ্ছে। জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়েছে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, বিদ্যুতের দাম আরও বাড়ানো হবে। এ ধরনের ভয় দেখানো কোন সরকারের সুনীতি হতে পারে না। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি এডিপি’র বাস্তবায়ন অর্থবছরের প্রথম ক’মাসে হয়েছে মাত্র ২৭ ভাগ। ঘাটতি পূরণ করতে গিয়ে সরকার সকল দায় চাপিয়ে দিচ্ছে জনগণের ওপর। অর্থনীতির অবস্থা যেন ঘরের বউকে পেটানোর মতো।
পুঁজিবাজার থেকে ৬০-৯০ হাজার কোটি টাকা লুট হয়েছে। এ নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে যাদের চিহ্নিত করা হলো তাদের নাম পর্যন্ত প্রকাশ করা হলো না। তাদের শাস্তি তো অনেক দূরের বিষয়। যে সরকারের এতটুকু সৎ সাহস নেই- সে সরকারের মুখদর্শন করাও উচিত নয়। বিনিয়োগ শূন্যের কোঠায়। বিনিয়োগ না থাকায় কোন কর্মসংস্থান নেই। দেশে ২ কোটির মতো মানুষ বেকার। অথচ সরকার ঘরে ঘরে চাকরি দেবে বলে একটি অবাস্তব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ভোটের লোভে। ইশতেহারের সিকি ভাগও বাস্তবায়ন হয়নি তিন বছরে। দুদককে করা হয়েছে নখদন্তহীন। সেখানে সরকার পক্ষের প্রায় ৮ হাজার মামলা তুলে নেয়া হয়েছে। অন্যদিকে বিরোধী পক্ষের নেতাকর্মীদের ওপর আরও মামলা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এটা ন্যায়বিচারের লক্ষণ নয়। এটা পক্ষপাতদুষ্ট, অবিচার।
কূটনৈতিক ক্ষেত্রে এক বিন্দুও সফলতা নেই। বিদেশ ভ্রমণে কাল কেটেছে মন্ত্রীর। প্রতিবেশী দেশের প্রতি নতজানু নয় অন্তত নির্ভয় হতে ভয় পাবো না- এটিই আমাদের এখানে ঘটেনি। একদিকে শুধু আশার ফুলঝুড়ি আর গালভরা বুলি। আর আমাদের উপহার কাঁটাতারে ঝুলছে ফেলানিদের লাশ। এটা মেনে নেয়া যায় না।
সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দল তো সরকারেরই অংশ-
এ দেশে বিরোধী দলকে কখনই ছায়া সরকার হিসেবে গণ্য করা হয়নি। এখানে যে যখনই সরকারে থাকুক বিরোধী দল হচ্ছে তখন শত্রুপক্ষ। গত তিন বছর বিশ্লেষণ করলে বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি’র ভূমিকা খুব ভাল ছিল- এটা বলা যাবে না। রাজপথ ও সংসদ দুই জায়গাতেই বিরোধী দলের সমান ভূমিকা থাকা দরকার। কখনও সংসদে যাবো না- বিএনপি’র এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত অব্যাহত রাখা গণতন্ত্রের জন্য শুভ হতে পারে না। সংসদে কার্যকর ভূমিকা না রাখা বিরোধী দলের বিদায়ী বছরে একটি বড় ধরনের রাজনৈতিক ব্যর্থতা।
নাগরিক সমাজের ভূমিকাকে কিভাবে দেখছেন-
রাজনৈতিক দলের বাইরে দেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে নাগরিক সমাজের উদ্বেগ আমাদের এখানে গত ১৫ বছরের ইতিহাস। রাজনৈতিক দলের মতোই নাগরিক সমাজ দ্বিধাবিভক্ত এমন অভিযোগ সত্ত্বেও টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ, তিস্তার পানি বণ্টন ইস্যুতে নাগরিক সমাজ দ্বিধাবিভক্ত ছিল না। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, এ দেশে যারাই সরকারের সমালোচনা করেন, তাদের ভাল চোখে দেখা হয় না। অন্যায়ভাবে প্রতিপক্ষ ভেবে অপদস্থ করা হয়। আমাদের এখানে নিরপেক্ষতা যেন চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কোন ইস্যুতে যৌক্তিক কারণেও বিরোধিতা করলে তা যদি বিএনপি’র পক্ষে যায় তাহলে আওয়ামী লীগ বলবে, ওই যে বিএনপি। আবার বিএনপি’র বিপক্ষে গেলে বলবে, ওই যে আওয়ামী লীগ। আমাদের গণমাধ্যমের চিত্রও যেন তাই। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার আচার-আচরণ ও উপস্থাপনার ধরন দেখলেই বোঝা যায়, তারা কোন পক্ষ বা মতের।
সংশোধিত সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করা হয়েছে। নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে বড় দু’দলই বাহাসে লিপ্ত-
এ দেশে যিনিই নির্বাচিত হন তিনিই স্বেচ্ছাচারী হয়ে পড়েন। ‘আমি নড়িব না’- এমন অবস্থা চলতে থাকলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল ও ইভিএম নিয়ে যে ধরনের বাহাস চলছে তাতে সামনের দিনে সংঘাত অনিবার্য। আর এ সমস্যা সমাধানে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। ইভিএম পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক চলছে। নারায়ণগঞ্জের পর কুমিল্লা, নরসিংদীতে এই পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণ হচ্ছে। উন্নত বিশ্ব, বিশেষত ইউরোপ-আমেরিকায় যখন ইভিএম পদ্ধতিতে ফল জালিয়াতির অভিযোগ পাওয়ায় এ পদ্ধতি বাতিল হচ্ছে- সেখানে আমরা এ পদ্ধতি প্রয়োগের চিন্তা করছি। ইভিএম পদ্ধতি বাতিল ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করলেই বর্তমান সংঘাতময় রাজনীতির অবসান হবে। শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।
ওয়ান ইলেভেনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে একটি ভিন্ন অভিজ্ঞতা রয়েছে। নানা আশঙ্কাও কাজ করছে-
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোন প্রয়োজন ছিল না। যদি আমরা একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন পেতাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের কমিশন তো সরকারের আজ্ঞাবহ। নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে প্রেসিডেন্ট সংলাপ শুরু করেছেন। সময় নষ্ট করা ছাড়া এতে কোন ফলাফল আসবে না। কারণ, যার কোন ক্ষমতা নেই তার সঙ্গে সংলাপ করে কি লাভ? তাছাড়া, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় এখনও প্রকাশিত হয়নি, তার আগেই তাড়াহুড়া করে সংসদে বিবদমান সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই এ বিল কেন বাতিল করা হলো সেটাই বড় প্রশ্ন।
দুই নেত্রীকে কেমন দেখলেন গত তিন বছরে-
রাষ্ট্রনায়কের সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে জাতিকে ঐকমত্য ও সংহত করা। যিনি এই দায়িত্ব পালন করেন তিনি রাষ্ট্রনায়ক। তাকে হতে হবে অনেক বেশি ক্ষমাশীল। আমাদের দুর্ভাগ্য তা কখনই পাইনি। ওয়ান ইলেভেনের পর রাজনীতিতে যে গুণগত পরিবর্তন হওয়ার কথা বলা হচ্ছিল তার কিছুই হয়নি। একে অপরের বিরুদ্ধে অসহিষ্ণু রাজনীতিই যেন আমাদের সংস্কৃতি। দু’জনের কর্মকাণ্ডেই সনু্তষ্টি প্রকাশের কিছু দেখি না। যে প্রজ্ঞা, নেতৃত্ব ও দূরদৃষ্টি আমরা দু’নেত্রীর কাছ থেকে আশা করেছি তা পাইনি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তীর্যকভাবে আঘাত না করে কথা বলতে পারেন না। তিনি আবেগ সংযত করতে পারেন না। বেশির ভাগ সময় কিছু না ভেবেই কথা বলেন। ক্ষমতায় থেকে জনপ্রিয়তা ধরে রাখা কঠিন কাজ। জনগণ সরকারের গৃহীত বিভিন্ন নীতি সমর্থন না করায় শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা কমেছে। অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রীর তুলনায় বিরোধী দলীয় নেত্রী অনেক বেশি সংযত। আবোল-তাবোল কথা কম বলেন। সরকারের কর্মকাণ্ডে বিমুখ মানুষ বিএনপি’র প্রতি ঝুঁকছে। ফলে বিদায়ী বছরগুলোতে খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা বেড়েছে। তবে, উনার সংসদে না যাওয়া কোন ভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।
সামনের দু’বছর কেমন যাবে বলে মনে করেন-
পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে তাতে, রাজনীতিতে সংঘাত অনিবার্য। কারও বক্তব্য-বিবৃতিতে বিনয় নেই, সহিষ্ণুতা নেই, সহনশীলতা নেই। দু’টো ট্রেন যখন প্রচণ্ড গতিতে একই লাইনে চলে তখন দুর্ঘটনায় যাত্রীরা মারা যাবে- এটা নিশ্চিত। কথা হচ্ছে, যারা জানে না যে দুর্ঘটনায় মরতে যাচ্ছে তাদের কথা ভিন্ন। কিন্তু যে যাত্রীরা জানে যে দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হলে প্রাণে বাঁচা যাবে না- তাদের কথা একবার ভাবুন। আমরা নাগরিকরা দুর্ঘটনাক্রান্ত ট্রেনের সেই অবরুদ্ধ যাত্রী। অনিবার্য সংঘাত থেকে বাঁচতে চলন্ত সেই ট্রেনের অন্তত একটিকে থামতে হবে। একটি সিগন্যালকে ডাউন হতে হবে। আর তা হতে হবে সরকারেরই। রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব সরকারের। সুতরাং সংঘাত এড়ানোর দায়িত্বও সরকারের। দ্বিধাবিভক্ত-সংঘাতময় রাজনীতির কারণে দেশে গৃহযুদ্ধ বেধে যেতে পারে। মানুষ সংঘাতময় রাজনীতির পরিবর্তে সমস্যার সমাধান দেখতে চায়। দুঃখজনক হলেও সত্য, সংসদের দিকে তাকালে মনে হয় সংঘাত যেন দু’টি পরিবারের। মুজিব পরিবার আর জিয়া পরিবার। একে অন্যের ছেলে কি মেয়ে বা বোন সম্পর্কে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অহোরাত্র গালমন্দ আর কুৎসা চর্চা করা হচ্ছে। আমাদের সংসদে যে ধরনের ভাষা ব্যবহার করা হয়, তা কোন শিক্ষিত বা সভ্য মানুষের ভাষা হতে পারে না।
৩ বছরের মূল্যায়নে সাবেক সচিব ও বাংলাদেশ টুডে’র সাবেক সম্পাদক মোহাম্মদ আসাফ্উদ্দৌল্লাহ্ আরও বলেন, বিএনপির সংসদে না যাওয়ার ঘোষণা তাদের জন্য বড় রকমের রাজনৈতিক ব্যর্থতা। মানবজমিনকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সঙ্কট নিয়ে বলেছেন খোলামেলা নানা কথা-
তিন বছরের সাফল্য ও ব্যর্থতা কোথায়?
সফলতার চেয়ে ব্যর্থতার পাল্লাই ভারি। কৃষি ও শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারের বেশ কিছু দৃশ্যমান সফলতা রয়েছে। মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। গত তিন বছরে কাজের চেয়ে ফ্রন্ট বেশি খোলা হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই নতুন শত্রুপক্ষ তৈরি করা হয়েছে। তিন বছরে বড় সফলতা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারও শুরু হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন থাকে, এটি আওয়ামী লীগের প্রথম টার্মে কেন শুরু হয়নি? ছিয়ানব্বইতে জামায়াত তাদের মিত্র ছিল বলেই কি বিচার হয়নি? আর এখন তারা সঙ্গে নেই বলেই কি বিচার করতে হবে? যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে চারপাশে আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ঘরে ঘরে যুদ্ধাপরাধী খুঁজে বের করা হবে। এটা কোন আইনের ভাষা হতে পারে না। এটা ন্যায়বিচারের দৃষ্টান্ত হতে পারে না। নাগরিকমাত্রেই বিচার চায়, তবে তা হতে হবে স্বচ্ছ, রাজনৈতিক, পক্ষপাতদুষ্ট নয়। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। কাল কেটেছে গুম আর গুপ্ত হত্যায়। সবমিলিয়ে মানুষ আতঙ্কিত।
অর্থনীতি কেমন দেখলেন-
দেশের আর্থিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে ভয়াবহ মাত্রায়। চলতি বছরে যা আরও বাড়তে পারে। বছর শুরু হয়েছে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির ধাক্কায়। এতে পণ্য মূল্য বাড়বে। অভ্যন্তরীণ ব্যয় নির্বাহ করতে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে। এর কোনও সীমা নেই। অর্থবছরের শুরুতে বলা হয়েছিল, ১৮ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ নেয়া হবে, কিন্তু সেখানে প্রথম ছয় মাসেই নেয়া হয়েছে ২৪ হাজার কোটি টাকা।
দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ হয়ে গেছে। ঘাটতি ব্যয় নির্বাহে সরকার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে করের বোঝা বাড়াচ্ছে। জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়েছে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, বিদ্যুতের দাম আরও বাড়ানো হবে। এ ধরনের ভয় দেখানো কোন সরকারের সুনীতি হতে পারে না। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি এডিপি’র বাস্তবায়ন অর্থবছরের প্রথম ক’মাসে হয়েছে মাত্র ২৭ ভাগ। ঘাটতি পূরণ করতে গিয়ে সরকার সকল দায় চাপিয়ে দিচ্ছে জনগণের ওপর। অর্থনীতির অবস্থা যেন ঘরের বউকে পেটানোর মতো।
পুঁজিবাজার থেকে ৬০-৯০ হাজার কোটি টাকা লুট হয়েছে। এ নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে যাদের চিহ্নিত করা হলো তাদের নাম পর্যন্ত প্রকাশ করা হলো না। তাদের শাস্তি তো অনেক দূরের বিষয়। যে সরকারের এতটুকু সৎ সাহস নেই- সে সরকারের মুখদর্শন করাও উচিত নয়। বিনিয়োগ শূন্যের কোঠায়। বিনিয়োগ না থাকায় কোন কর্মসংস্থান নেই। দেশে ২ কোটির মতো মানুষ বেকার। অথচ সরকার ঘরে ঘরে চাকরি দেবে বলে একটি অবাস্তব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ভোটের লোভে। ইশতেহারের সিকি ভাগও বাস্তবায়ন হয়নি তিন বছরে। দুদককে করা হয়েছে নখদন্তহীন। সেখানে সরকার পক্ষের প্রায় ৮ হাজার মামলা তুলে নেয়া হয়েছে। অন্যদিকে বিরোধী পক্ষের নেতাকর্মীদের ওপর আরও মামলা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এটা ন্যায়বিচারের লক্ষণ নয়। এটা পক্ষপাতদুষ্ট, অবিচার।
কূটনৈতিক ক্ষেত্রে এক বিন্দুও সফলতা নেই। বিদেশ ভ্রমণে কাল কেটেছে মন্ত্রীর। প্রতিবেশী দেশের প্রতি নতজানু নয় অন্তত নির্ভয় হতে ভয় পাবো না- এটিই আমাদের এখানে ঘটেনি। একদিকে শুধু আশার ফুলঝুড়ি আর গালভরা বুলি। আর আমাদের উপহার কাঁটাতারে ঝুলছে ফেলানিদের লাশ। এটা মেনে নেয়া যায় না।
সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দল তো সরকারেরই অংশ-
এ দেশে বিরোধী দলকে কখনই ছায়া সরকার হিসেবে গণ্য করা হয়নি। এখানে যে যখনই সরকারে থাকুক বিরোধী দল হচ্ছে তখন শত্রুপক্ষ। গত তিন বছর বিশ্লেষণ করলে বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি’র ভূমিকা খুব ভাল ছিল- এটা বলা যাবে না। রাজপথ ও সংসদ দুই জায়গাতেই বিরোধী দলের সমান ভূমিকা থাকা দরকার। কখনও সংসদে যাবো না- বিএনপি’র এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত অব্যাহত রাখা গণতন্ত্রের জন্য শুভ হতে পারে না। সংসদে কার্যকর ভূমিকা না রাখা বিরোধী দলের বিদায়ী বছরে একটি বড় ধরনের রাজনৈতিক ব্যর্থতা।
নাগরিক সমাজের ভূমিকাকে কিভাবে দেখছেন-
রাজনৈতিক দলের বাইরে দেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে নাগরিক সমাজের উদ্বেগ আমাদের এখানে গত ১৫ বছরের ইতিহাস। রাজনৈতিক দলের মতোই নাগরিক সমাজ দ্বিধাবিভক্ত এমন অভিযোগ সত্ত্বেও টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ, তিস্তার পানি বণ্টন ইস্যুতে নাগরিক সমাজ দ্বিধাবিভক্ত ছিল না। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, এ দেশে যারাই সরকারের সমালোচনা করেন, তাদের ভাল চোখে দেখা হয় না। অন্যায়ভাবে প্রতিপক্ষ ভেবে অপদস্থ করা হয়। আমাদের এখানে নিরপেক্ষতা যেন চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কোন ইস্যুতে যৌক্তিক কারণেও বিরোধিতা করলে তা যদি বিএনপি’র পক্ষে যায় তাহলে আওয়ামী লীগ বলবে, ওই যে বিএনপি। আবার বিএনপি’র বিপক্ষে গেলে বলবে, ওই যে আওয়ামী লীগ। আমাদের গণমাধ্যমের চিত্রও যেন তাই। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার আচার-আচরণ ও উপস্থাপনার ধরন দেখলেই বোঝা যায়, তারা কোন পক্ষ বা মতের।
সংশোধিত সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করা হয়েছে। নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে বড় দু’দলই বাহাসে লিপ্ত-
এ দেশে যিনিই নির্বাচিত হন তিনিই স্বেচ্ছাচারী হয়ে পড়েন। ‘আমি নড়িব না’- এমন অবস্থা চলতে থাকলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল ও ইভিএম নিয়ে যে ধরনের বাহাস চলছে তাতে সামনের দিনে সংঘাত অনিবার্য। আর এ সমস্যা সমাধানে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। ইভিএম পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক চলছে। নারায়ণগঞ্জের পর কুমিল্লা, নরসিংদীতে এই পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণ হচ্ছে। উন্নত বিশ্ব, বিশেষত ইউরোপ-আমেরিকায় যখন ইভিএম পদ্ধতিতে ফল জালিয়াতির অভিযোগ পাওয়ায় এ পদ্ধতি বাতিল হচ্ছে- সেখানে আমরা এ পদ্ধতি প্রয়োগের চিন্তা করছি। ইভিএম পদ্ধতি বাতিল ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করলেই বর্তমান সংঘাতময় রাজনীতির অবসান হবে। শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।
ওয়ান ইলেভেনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে একটি ভিন্ন অভিজ্ঞতা রয়েছে। নানা আশঙ্কাও কাজ করছে-
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোন প্রয়োজন ছিল না। যদি আমরা একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন পেতাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের কমিশন তো সরকারের আজ্ঞাবহ। নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে প্রেসিডেন্ট সংলাপ শুরু করেছেন। সময় নষ্ট করা ছাড়া এতে কোন ফলাফল আসবে না। কারণ, যার কোন ক্ষমতা নেই তার সঙ্গে সংলাপ করে কি লাভ? তাছাড়া, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় এখনও প্রকাশিত হয়নি, তার আগেই তাড়াহুড়া করে সংসদে বিবদমান সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই এ বিল কেন বাতিল করা হলো সেটাই বড় প্রশ্ন।
দুই নেত্রীকে কেমন দেখলেন গত তিন বছরে-
রাষ্ট্রনায়কের সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে জাতিকে ঐকমত্য ও সংহত করা। যিনি এই দায়িত্ব পালন করেন তিনি রাষ্ট্রনায়ক। তাকে হতে হবে অনেক বেশি ক্ষমাশীল। আমাদের দুর্ভাগ্য তা কখনই পাইনি। ওয়ান ইলেভেনের পর রাজনীতিতে যে গুণগত পরিবর্তন হওয়ার কথা বলা হচ্ছিল তার কিছুই হয়নি। একে অপরের বিরুদ্ধে অসহিষ্ণু রাজনীতিই যেন আমাদের সংস্কৃতি। দু’জনের কর্মকাণ্ডেই সনু্তষ্টি প্রকাশের কিছু দেখি না। যে প্রজ্ঞা, নেতৃত্ব ও দূরদৃষ্টি আমরা দু’নেত্রীর কাছ থেকে আশা করেছি তা পাইনি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তীর্যকভাবে আঘাত না করে কথা বলতে পারেন না। তিনি আবেগ সংযত করতে পারেন না। বেশির ভাগ সময় কিছু না ভেবেই কথা বলেন। ক্ষমতায় থেকে জনপ্রিয়তা ধরে রাখা কঠিন কাজ। জনগণ সরকারের গৃহীত বিভিন্ন নীতি সমর্থন না করায় শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা কমেছে। অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রীর তুলনায় বিরোধী দলীয় নেত্রী অনেক বেশি সংযত। আবোল-তাবোল কথা কম বলেন। সরকারের কর্মকাণ্ডে বিমুখ মানুষ বিএনপি’র প্রতি ঝুঁকছে। ফলে বিদায়ী বছরগুলোতে খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা বেড়েছে। তবে, উনার সংসদে না যাওয়া কোন ভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।
সামনের দু’বছর কেমন যাবে বলে মনে করেন-
পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে তাতে, রাজনীতিতে সংঘাত অনিবার্য। কারও বক্তব্য-বিবৃতিতে বিনয় নেই, সহিষ্ণুতা নেই, সহনশীলতা নেই। দু’টো ট্রেন যখন প্রচণ্ড গতিতে একই লাইনে চলে তখন দুর্ঘটনায় যাত্রীরা মারা যাবে- এটা নিশ্চিত। কথা হচ্ছে, যারা জানে না যে দুর্ঘটনায় মরতে যাচ্ছে তাদের কথা ভিন্ন। কিন্তু যে যাত্রীরা জানে যে দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হলে প্রাণে বাঁচা যাবে না- তাদের কথা একবার ভাবুন। আমরা নাগরিকরা দুর্ঘটনাক্রান্ত ট্রেনের সেই অবরুদ্ধ যাত্রী। অনিবার্য সংঘাত থেকে বাঁচতে চলন্ত সেই ট্রেনের অন্তত একটিকে থামতে হবে। একটি সিগন্যালকে ডাউন হতে হবে। আর তা হতে হবে সরকারেরই। রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব সরকারের। সুতরাং সংঘাত এড়ানোর দায়িত্বও সরকারের। দ্বিধাবিভক্ত-সংঘাতময় রাজনীতির কারণে দেশে গৃহযুদ্ধ বেধে যেতে পারে। মানুষ সংঘাতময় রাজনীতির পরিবর্তে সমস্যার সমাধান দেখতে চায়। দুঃখজনক হলেও সত্য, সংসদের দিকে তাকালে মনে হয় সংঘাত যেন দু’টি পরিবারের। মুজিব পরিবার আর জিয়া পরিবার। একে অন্যের ছেলে কি মেয়ে বা বোন সম্পর্কে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অহোরাত্র গালমন্দ আর কুৎসা চর্চা করা হচ্ছে। আমাদের সংসদে যে ধরনের ভাষা ব্যবহার করা হয়, তা কোন শিক্ষিত বা সভ্য মানুষের ভাষা হতে পারে না।
No comments