ধর নির্ভয় গান-নববর্ষে নবচেতনায় জাগ্রত হই সবে by আলী যাকের
বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে প্রায়ই পড়ে থাকি অধিকাংশ তরুণ আজ রাজনীতিবিমুখ। সেটিকে একেবারে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য, তরুণদের রাজনীতির প্রতি আগ্রহী করার জন্য প্রথম পদক্ষেপ আমাদের রাজনীতিবিদদেরই নিতে হবে। এ এক বিরাট দায়িত্ব আমাদের রাজনীতিবিদদের মাথার ওপরে। এই কথাটি বললাম এই প্রত্যয় নিয়ে, আমাদের ক্ষমতাসীন সরকার এবং তাদের দল আসলেই তাদের প্রতিষ্ঠাতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবের আদর্শ অনুসরণ করে আমাদের দারিদ্র্যপীড়িত দেশের রাজনীতিতে একটি গুণগত পরিবর্তন আনতে আগ্রহী অবশেষে চলে গেল ২০১১। ২০১২-এর সূর্যোদয়ের পরপরই আমার পড়ার ঘরের পুব দিকের জানালার ধারে লেখার টেবিলের সামনে বসে আলোয় উদ্ভাসিত পুবাকাশ দেখতে দেখতে নানা কথা মনে এলো। গত রাতের মধ্যযামে আমার বন্ধুবান্ধবরা একের পর এক টেলিফোন করে আমায় নববর্ষের অভিনন্দন জানিয়েছে। অনেকে এসএমএসের মাধ্যমেও জানিয়েছে শুভেচ্ছা। আমি আমার প্রিয় চেয়ারটিতে বসে হাসিমুখে সকলের সম্ভাষণকে আলিঙ্গন করে বলেছি_ 'শুভ নববর্ষ।' আমি যে পাড়ায় থাকি, এক অভিজাত পল্লীতে, তার চারপাশে বিভিন্ন স্থানে তরুণরা অবিরাম গান গেয়ে গেছে নববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে। ঠিক ১২টায় ঘড়ির কাঁটা এক হয়ে গেলে অজস্র পটকার মাধ্যমে তারা স্বাগত জানিয়েছে নববর্ষকে। আমি তাদের উদ্দেশেও মৃদু কণ্ঠে বলেছি_ 'শুভ নববর্ষ, বন্ধুরা।' আজ প্রভাতে 'নতুন দিনের সূর্য' যখন আমায় জিজ্ঞেস করল, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, কে তুমি? আমি মৃদু হেসে তাকে বললাম, 'আমি এই জগতের নগণ্য মানুষ এক। তোমার আলোয় উদ্ভাসিত হতে উন্মুখ। আর আমার নেই কোনো পরিচয়।'
শুরু করেছিলাম 'অবশেষে চলে গেল ২০১১' বলে। এই আপাত হতাশাব্যঞ্জক একটি বাক্যে হয়তো এ কথা পরিষ্কার হবে যে, ২০১১ আমার জন্য খুব সুখপ্রদ ছিল না। বস্তুতপক্ষে অনেকের জন্যই ছিল না। ওই বছর আমরা হারিয়েছি কণ্ঠশিল্পী আযম খান এবং বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী অজিত রায়কে, চিত্রনির্মাতা তারেক মাসুদ, চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীর, রাজনীতিবিদ এবং মুক্তিযুদ্ধের এক প্রধান সংগঠক আবদুর রাজ্জাককে, তিন প্রবীণ চিত্রশিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া, ইমদাদ হোসেন এবং আমিনুল ইসলামকে এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের অবিসংবাদিত, স্পষ্টবাদী এবং সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী, গণতন্ত্রের পক্ষে সোচ্চার যোদ্ধাপুরুষ জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে। এই মাপের মানুষদের প্রয়াণে একটি দেশ এবং জাতি নিঃসন্দেহে বড় নিষ্প্র্রভ হয়ে যায়। আর এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো ঘটেছে ২০১১তেই। সে জন্য ২০১২-এর রৌদ্রকরোজ্জ্বল প্রভাতে যতই মন উদ্ভাসিত হয়ে উঠুক না কেন, মনের কোণে কোথায় যেন রক্তক্ষরণ হয়েই চলেছে। তবুও তো মানুষকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হয়। কোমর বেঁধে প্রস্তুত হতে হয় নতুন সময়ের উপযোগী করে নিজেকে তৈরি করতে। একটি মানুষের জীবনে একটি করে দিনের হয় অবসান আর পরবর্তী দিনটি উপস্থিত হয় এক নতুন চাহিদার বাহন হিসেবে। ফলে গেল কাল কী করেছি, তা যতই গৌরবোজ্জ্বল হোক না কেন, আগামীকাল নতুন দাবি নিয়ে দাঁড়াবে আমার সামনে। যদি বলি কাল তো ভালোই ছিল, সময় বলবে গেছে যেই কাল সে কাল একেবারেই গেছে। আজকে আমার দাবি আরও অনেক অধিক। তখনই ভাবতে হয় অতীতের আলোকে কী করে সাজাব আমার বর্তমান।
২০১১ দুটি তাৎপর্য নিয়ে এসেছিল আমাদের জীবনে। প্রথমত, ওই বছরটি ছিল রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী এবং দ্বিতীয়ত, আমাদের বাংলাদেশের চলি্লশতম স্বাধীনতা ও বিজয়বার্ষিকী। রবীন্দ্রনাথ গত হয়েছেন বহুকাল আগে। তিনি ছিলেন মরণশীল মানুষ প্রজাতিরই প্রতিনিধি। অতএব তাঁর জীবদ্দশায় তিনি যা করে গেছেন, এরপর তাঁর আর কিছুই করার নেই। তবে তিনি যা করে গেছেন, তা আরও কয়েকশ' বছর, এমনকি হাজার বছরেও ম্লান হওয়ার নয়। এখানেই রবীন্দ্রনাথের বিশেষত্ব। আর একটি দেশ, এক জাতিসত্তার ওপরে নির্ভরশীল একটি রাজনৈতিক- ভৌগোলিক সত্তা। এর বিনাশ নেই বললেই চলে। অন্ততপক্ষে বর্তমান সময়ে। বাংলাদেশ থাকবে যতদিন না এই বিশ্ব ধ্বংস হয়ে যায়। এখানেই সবচেয়ে বৈধ প্রশ্নটি এসে যায়। থাকবে তো বটে তবে কেমন থাকবে? একটি দেশ কেমন থাকবে তা নিঃসন্দেহে নির্ভর করে সেই দেশের অধিবাসীদের ওপর। আমরা তো অদূর অতীতের ইতিহাস কিংবা বর্তমানের চিত্র দেখলেই বুঝতে পারি, এই আমাদের নিকট প্রতিবেশীদের চেহারা দেখে, যে তাদেরই কৃতকর্মের জন্য তাদের দেশগুলো কেমন চলছে! আমরা পাকিস্তানের দিকে তাকাই, কিংবা আফগানিস্তান অথবা মিয়ানমার। কিংবা কয়েক বছর আগের শ্রীলংকা। কেমন আছে, কেমন ছিল দেশগুলো? বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এক ধরনের অরাজকতাই সব সমাজ এবং সব রাষ্ট্রকে মাঝে মধ্যে একেবারে অকেজো করে দেয়। তখন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ওইসব দেশকে বলেন ব্যর্থ রাষ্ট্র কিংবা ভধরষবফ ংঃধঃবং. নানাবিধ কারণে একটি রাষ্ট্র ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে অভিহিত হতে পারে। তবে আমাদের এই উপমহাদেশের অভ্যন্তরে কিংবা এর নিকট প্রতিবেশীদের মধ্যে যেসব দেশ প্রায় ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে আজ চিহ্নিত, সেগুলোর ক্ষেত্রে অস্ত্রবাজদের আস্টম্ফালনই হচ্ছে ব্যর্থতার প্রধান কারণ। আশির দশকের শেষে আমাদের বাংলাদেশকেও অনেক বাংলাদেশি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইতেন। এতে তাদের কোনো দোষ নেই। তাদের বেশিরভাগই ছিলেন প্রবীণ, দেশহিতৈষী মানুষ। এই দেশের অনিয়মতান্ত্রিক স্বৈরাচারী রাষ্ট্রশাসনকে তারা কখনোই স্বাভাবিক বলে আখ্যায়িত করতে চাইতেন না। আমার কতিপয় ঘনিষ্ঠ বয়োজ্যেষ্ঠ আত্মীয়স্বজন আমাকে তো সরাসরি প্রশ্নই করতেন তখন, ' আমরা কি তবে ব্যর্থ রাষ্ট্র হয়ে যাব?'
এক দুর্মর আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেই অবস্থা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পেরেছি। যে গণতন্ত্রের মন্ত্র নিয়ে সেই '৭১-এ আমাদের পথচলা শুরু হয়েছিল, সেই গণতন্ত্রেরই ভগ্নপ্রায় হাল ধরে দাঁড়াবার চেষ্টা করেছি আমরা একটি জাতি হিসেবে ১৯৯১-এ। সেই যে শুরু, এখন পর্যন্ত ওই পথে পথ চলেছি আমরা। যদিও মাঝে মধ্যে হোঁচট খাই, তবুও পথভ্রষ্ট হইনি, এ আমাদের ভাগ্য। কিন্তু যে কোনো দেশ বা সমাজ দীর্ঘদিন ধরে যদি সামরিক শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট হতে থাকে, তবে সেই দেশের রাজনীতিবিদ, পেশাজীবী এবং সাধারণ মানুষ এক ধরনের অগণতান্ত্রিক মানসিকতার শিকার হয়, এটি অবিসংবাদিত সত্য। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় ঘটেনি।
এ রকম একটি পরিস্থিতিতে দেশকে গণতন্ত্রের মসৃণ পথে চলতে দিতে আগ্রহী যারা, তাদের উচিত সাধারণ মানুষকে বোঝানো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ কাকে বলে। এটিই বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতিবিদদের প্রধান কাজ হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। এজন্য প্রথমেই তাদের নিজেদের সব স্বৈরাচারী মনোভাব থেকে সরে আসতে হবে। গণতান্ত্রিক আচার-ব্যবহারের সব সংজ্ঞা ও বর্ণনা বিস্তৃতভাবে লেখা রয়েছে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সব পুস্তকে। সেখান থেকে জ্ঞানার্জন করে রাজনীতিবিদদের উচিত হবে যার যার নির্বাচনী অঞ্চলে গিয়ে গণমানুষকে সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক সহনশীলতা, সৎ জীবনযাত্রা এবং দেশের বর্তমান অবস্থা সম্বন্ধে আলোকিত করা।
আমরা বাল্যকাল থেকেই শুনে এসেছি যে, যখন দুঃসময় আসে, বিশেষ করে অর্থনৈতিক মন্দার সময়, তখন কৃচ্ছ্রসাধনই সবচেয়ে উত্তম পন্থা। আমরা শুনেও আসছি, প্রায় নিয়মিতভাবে, এই কৃচ্ছ্রসাধনের আহ্বান। কিন্তু যারা এই আহ্বানের সঙ্গে যুক্ত অর্থাৎ গণতন্ত্রের বরপুত্র যারা আমাদের নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত বিভিন্ন দলে, তাদের তো নেতৃত্ব দিতে হবে একেবারে সামনে থেকে! তারা মুখে বলবেন কৃচ্ছ্রসাধনের কথা, মুনষ্যত্বের কথা, ভব্যতার কথা, সভ্যতার কথা, অথচ নিজেরা একেকজন স্বৈরাচারীরও অধম অমার্জিত, অভব্য, অশিক্ষিত, অশোভনীয় মানুষের মতো কাজ করবেন, তাহলে দেশের কী দশা হবে? আমরা ভুলে যাই যে, সরকার এবং রাজনৈতিক দলের মধ্যে একটা বিভাজন থাকা প্রয়োজন। যখন কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্যরা মিলে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়ে সরকার নির্মাণ করবেন, তখন তাদের নিজস্ব দল 'দল' হিসেবেই ক্ষমতার বাইরে থেকে কাজ করে যাবে। সরকার পক্ষের দল হিসেবেই তাদের দায়িত্ব অনেকগুণ বেড়ে যাবে। বস্তুতপক্ষে সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করবে দলই। তাদেরই দেখার কথা যে, তাদের দলের যেসব সদস্য সরকারে আছেন, তারা নির্বাচনী অঙ্গীকার মতো কাজ করছেন কি-না। যদি না করেন, তাহলে দলীয় ফোরামে কিংবা সংসদের মাধ্যমে সাবধানবাণী উচ্চারণ করা তাদের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক দেশে এই প্রক্রিয়াতেই গণতন্ত্র কাজ করে এবং সাধারণ মানুষ এই আচরণ থেকে শৃঙ্খলাবোধ, দেশপ্রেম এবং জনগণতন্ত্র সম্বন্ধে সম্যক শিক্ষা লাভ করে। এর অন্যথা হলে পরে শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে এবং এক ধরনের নৈরাজ্যবাদের উদ্ভব হতে পারে।
একটি অতি স্বচ্ছ এবং সুচারু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমাদের সরকার গণতান্ত্রিকভাবে আজ ক্ষমতায় এসেছে। অতএব গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সমুন্নত রেখে সাধারণ মানুষকে সঠিক পথ প্রদর্শন করে সামনের দিকে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব তাদেরই ওপর বর্তায়। আমরা সবাই জানি যে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক নির্বাচনে তরুণদের মধ্যে অধিকাংশ ভোটার আজকের অধিষ্ঠিত সরকারের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। তারা বড় আশা করে ভোট দিয়েছিল। অতএব তাদের প্রতি একটি দায়িত্ব রয়েছে সরকারের এবং সরকারি দলের। যেমন, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে প্রায়ই পড়ে থাকি অধিকাংশ তরুণ আজ রাজনীতিবিমুখ। সেটিকে একেবারে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য, তরুণদের রাজনীতির প্রতি আগ্রহী করার জন্য প্রথম পদক্ষেপ আমাদের রাজনীতিবিদদেরই নিতে হবে। এ এক বিরাট দায়িত্ব আমাদের রাজনীতিবিদদের মাথার ওপরে। এই কথাটি বললাম এই প্রত্যয় নিয়ে, আমাদের ক্ষমতাসীন সরকার এবং তাদের দল আসলেই তাদের প্রতিষ্ঠাতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আদর্শ অনুসরণ করে আমাদের দারিদ্র্যপীড়িত দেশের রাজনীতিতে একটি গুণগত পরিবর্তন আনতে আগ্রহী। যারা সংসদীয় রাজনীতির শপথ গ্রহণ করে সংসদে অনুপস্থিত, যাদের জন্ম একনায়কত্বের ছত্রছায়ায়, তাদের আমি এই আবেদনের বাইরেই রাখছি। তারা কোনোদিন সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ধারক ছিলেন না, হবেনও না। বরং তারা সবসময় সুযোগের অপেক্ষায় থাকবেন যেনতেন প্রকারে ক্ষমতা অধিগ্রহণের।
অতএব, যদি গণতান্ত্রিক অবস্থাকে চিরায়ত করতে হয়, যদি আমাদের সাধারণ মানুষকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে দীক্ষিত করতে হয়, যদি আমাদের তরুণদের রাজনীতির প্রতি আকর্ষিত করতে হয় তাহলে এখনই সময় গণসংযোগের। সমাজের সর্বস্তরে, দেশের সব মানুষের সঙ্গে। ২০১২ হোক সেই অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের সূচনার বছর। সবাইকে গ্রেগরিয়ান নববর্ষের শুভেচ্ছা।
আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
শুরু করেছিলাম 'অবশেষে চলে গেল ২০১১' বলে। এই আপাত হতাশাব্যঞ্জক একটি বাক্যে হয়তো এ কথা পরিষ্কার হবে যে, ২০১১ আমার জন্য খুব সুখপ্রদ ছিল না। বস্তুতপক্ষে অনেকের জন্যই ছিল না। ওই বছর আমরা হারিয়েছি কণ্ঠশিল্পী আযম খান এবং বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী অজিত রায়কে, চিত্রনির্মাতা তারেক মাসুদ, চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীর, রাজনীতিবিদ এবং মুক্তিযুদ্ধের এক প্রধান সংগঠক আবদুর রাজ্জাককে, তিন প্রবীণ চিত্রশিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া, ইমদাদ হোসেন এবং আমিনুল ইসলামকে এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের অবিসংবাদিত, স্পষ্টবাদী এবং সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী, গণতন্ত্রের পক্ষে সোচ্চার যোদ্ধাপুরুষ জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে। এই মাপের মানুষদের প্রয়াণে একটি দেশ এবং জাতি নিঃসন্দেহে বড় নিষ্প্র্রভ হয়ে যায়। আর এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো ঘটেছে ২০১১তেই। সে জন্য ২০১২-এর রৌদ্রকরোজ্জ্বল প্রভাতে যতই মন উদ্ভাসিত হয়ে উঠুক না কেন, মনের কোণে কোথায় যেন রক্তক্ষরণ হয়েই চলেছে। তবুও তো মানুষকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হয়। কোমর বেঁধে প্রস্তুত হতে হয় নতুন সময়ের উপযোগী করে নিজেকে তৈরি করতে। একটি মানুষের জীবনে একটি করে দিনের হয় অবসান আর পরবর্তী দিনটি উপস্থিত হয় এক নতুন চাহিদার বাহন হিসেবে। ফলে গেল কাল কী করেছি, তা যতই গৌরবোজ্জ্বল হোক না কেন, আগামীকাল নতুন দাবি নিয়ে দাঁড়াবে আমার সামনে। যদি বলি কাল তো ভালোই ছিল, সময় বলবে গেছে যেই কাল সে কাল একেবারেই গেছে। আজকে আমার দাবি আরও অনেক অধিক। তখনই ভাবতে হয় অতীতের আলোকে কী করে সাজাব আমার বর্তমান।
২০১১ দুটি তাৎপর্য নিয়ে এসেছিল আমাদের জীবনে। প্রথমত, ওই বছরটি ছিল রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী এবং দ্বিতীয়ত, আমাদের বাংলাদেশের চলি্লশতম স্বাধীনতা ও বিজয়বার্ষিকী। রবীন্দ্রনাথ গত হয়েছেন বহুকাল আগে। তিনি ছিলেন মরণশীল মানুষ প্রজাতিরই প্রতিনিধি। অতএব তাঁর জীবদ্দশায় তিনি যা করে গেছেন, এরপর তাঁর আর কিছুই করার নেই। তবে তিনি যা করে গেছেন, তা আরও কয়েকশ' বছর, এমনকি হাজার বছরেও ম্লান হওয়ার নয়। এখানেই রবীন্দ্রনাথের বিশেষত্ব। আর একটি দেশ, এক জাতিসত্তার ওপরে নির্ভরশীল একটি রাজনৈতিক- ভৌগোলিক সত্তা। এর বিনাশ নেই বললেই চলে। অন্ততপক্ষে বর্তমান সময়ে। বাংলাদেশ থাকবে যতদিন না এই বিশ্ব ধ্বংস হয়ে যায়। এখানেই সবচেয়ে বৈধ প্রশ্নটি এসে যায়। থাকবে তো বটে তবে কেমন থাকবে? একটি দেশ কেমন থাকবে তা নিঃসন্দেহে নির্ভর করে সেই দেশের অধিবাসীদের ওপর। আমরা তো অদূর অতীতের ইতিহাস কিংবা বর্তমানের চিত্র দেখলেই বুঝতে পারি, এই আমাদের নিকট প্রতিবেশীদের চেহারা দেখে, যে তাদেরই কৃতকর্মের জন্য তাদের দেশগুলো কেমন চলছে! আমরা পাকিস্তানের দিকে তাকাই, কিংবা আফগানিস্তান অথবা মিয়ানমার। কিংবা কয়েক বছর আগের শ্রীলংকা। কেমন আছে, কেমন ছিল দেশগুলো? বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এক ধরনের অরাজকতাই সব সমাজ এবং সব রাষ্ট্রকে মাঝে মধ্যে একেবারে অকেজো করে দেয়। তখন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ওইসব দেশকে বলেন ব্যর্থ রাষ্ট্র কিংবা ভধরষবফ ংঃধঃবং. নানাবিধ কারণে একটি রাষ্ট্র ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে অভিহিত হতে পারে। তবে আমাদের এই উপমহাদেশের অভ্যন্তরে কিংবা এর নিকট প্রতিবেশীদের মধ্যে যেসব দেশ প্রায় ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে আজ চিহ্নিত, সেগুলোর ক্ষেত্রে অস্ত্রবাজদের আস্টম্ফালনই হচ্ছে ব্যর্থতার প্রধান কারণ। আশির দশকের শেষে আমাদের বাংলাদেশকেও অনেক বাংলাদেশি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইতেন। এতে তাদের কোনো দোষ নেই। তাদের বেশিরভাগই ছিলেন প্রবীণ, দেশহিতৈষী মানুষ। এই দেশের অনিয়মতান্ত্রিক স্বৈরাচারী রাষ্ট্রশাসনকে তারা কখনোই স্বাভাবিক বলে আখ্যায়িত করতে চাইতেন না। আমার কতিপয় ঘনিষ্ঠ বয়োজ্যেষ্ঠ আত্মীয়স্বজন আমাকে তো সরাসরি প্রশ্নই করতেন তখন, ' আমরা কি তবে ব্যর্থ রাষ্ট্র হয়ে যাব?'
এক দুর্মর আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেই অবস্থা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পেরেছি। যে গণতন্ত্রের মন্ত্র নিয়ে সেই '৭১-এ আমাদের পথচলা শুরু হয়েছিল, সেই গণতন্ত্রেরই ভগ্নপ্রায় হাল ধরে দাঁড়াবার চেষ্টা করেছি আমরা একটি জাতি হিসেবে ১৯৯১-এ। সেই যে শুরু, এখন পর্যন্ত ওই পথে পথ চলেছি আমরা। যদিও মাঝে মধ্যে হোঁচট খাই, তবুও পথভ্রষ্ট হইনি, এ আমাদের ভাগ্য। কিন্তু যে কোনো দেশ বা সমাজ দীর্ঘদিন ধরে যদি সামরিক শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট হতে থাকে, তবে সেই দেশের রাজনীতিবিদ, পেশাজীবী এবং সাধারণ মানুষ এক ধরনের অগণতান্ত্রিক মানসিকতার শিকার হয়, এটি অবিসংবাদিত সত্য। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় ঘটেনি।
এ রকম একটি পরিস্থিতিতে দেশকে গণতন্ত্রের মসৃণ পথে চলতে দিতে আগ্রহী যারা, তাদের উচিত সাধারণ মানুষকে বোঝানো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ কাকে বলে। এটিই বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতিবিদদের প্রধান কাজ হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। এজন্য প্রথমেই তাদের নিজেদের সব স্বৈরাচারী মনোভাব থেকে সরে আসতে হবে। গণতান্ত্রিক আচার-ব্যবহারের সব সংজ্ঞা ও বর্ণনা বিস্তৃতভাবে লেখা রয়েছে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সব পুস্তকে। সেখান থেকে জ্ঞানার্জন করে রাজনীতিবিদদের উচিত হবে যার যার নির্বাচনী অঞ্চলে গিয়ে গণমানুষকে সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক সহনশীলতা, সৎ জীবনযাত্রা এবং দেশের বর্তমান অবস্থা সম্বন্ধে আলোকিত করা।
আমরা বাল্যকাল থেকেই শুনে এসেছি যে, যখন দুঃসময় আসে, বিশেষ করে অর্থনৈতিক মন্দার সময়, তখন কৃচ্ছ্রসাধনই সবচেয়ে উত্তম পন্থা। আমরা শুনেও আসছি, প্রায় নিয়মিতভাবে, এই কৃচ্ছ্রসাধনের আহ্বান। কিন্তু যারা এই আহ্বানের সঙ্গে যুক্ত অর্থাৎ গণতন্ত্রের বরপুত্র যারা আমাদের নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত বিভিন্ন দলে, তাদের তো নেতৃত্ব দিতে হবে একেবারে সামনে থেকে! তারা মুখে বলবেন কৃচ্ছ্রসাধনের কথা, মুনষ্যত্বের কথা, ভব্যতার কথা, সভ্যতার কথা, অথচ নিজেরা একেকজন স্বৈরাচারীরও অধম অমার্জিত, অভব্য, অশিক্ষিত, অশোভনীয় মানুষের মতো কাজ করবেন, তাহলে দেশের কী দশা হবে? আমরা ভুলে যাই যে, সরকার এবং রাজনৈতিক দলের মধ্যে একটা বিভাজন থাকা প্রয়োজন। যখন কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্যরা মিলে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়ে সরকার নির্মাণ করবেন, তখন তাদের নিজস্ব দল 'দল' হিসেবেই ক্ষমতার বাইরে থেকে কাজ করে যাবে। সরকার পক্ষের দল হিসেবেই তাদের দায়িত্ব অনেকগুণ বেড়ে যাবে। বস্তুতপক্ষে সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করবে দলই। তাদেরই দেখার কথা যে, তাদের দলের যেসব সদস্য সরকারে আছেন, তারা নির্বাচনী অঙ্গীকার মতো কাজ করছেন কি-না। যদি না করেন, তাহলে দলীয় ফোরামে কিংবা সংসদের মাধ্যমে সাবধানবাণী উচ্চারণ করা তাদের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক দেশে এই প্রক্রিয়াতেই গণতন্ত্র কাজ করে এবং সাধারণ মানুষ এই আচরণ থেকে শৃঙ্খলাবোধ, দেশপ্রেম এবং জনগণতন্ত্র সম্বন্ধে সম্যক শিক্ষা লাভ করে। এর অন্যথা হলে পরে শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে এবং এক ধরনের নৈরাজ্যবাদের উদ্ভব হতে পারে।
একটি অতি স্বচ্ছ এবং সুচারু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমাদের সরকার গণতান্ত্রিকভাবে আজ ক্ষমতায় এসেছে। অতএব গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সমুন্নত রেখে সাধারণ মানুষকে সঠিক পথ প্রদর্শন করে সামনের দিকে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব তাদেরই ওপর বর্তায়। আমরা সবাই জানি যে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক নির্বাচনে তরুণদের মধ্যে অধিকাংশ ভোটার আজকের অধিষ্ঠিত সরকারের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। তারা বড় আশা করে ভোট দিয়েছিল। অতএব তাদের প্রতি একটি দায়িত্ব রয়েছে সরকারের এবং সরকারি দলের। যেমন, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে প্রায়ই পড়ে থাকি অধিকাংশ তরুণ আজ রাজনীতিবিমুখ। সেটিকে একেবারে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য, তরুণদের রাজনীতির প্রতি আগ্রহী করার জন্য প্রথম পদক্ষেপ আমাদের রাজনীতিবিদদেরই নিতে হবে। এ এক বিরাট দায়িত্ব আমাদের রাজনীতিবিদদের মাথার ওপরে। এই কথাটি বললাম এই প্রত্যয় নিয়ে, আমাদের ক্ষমতাসীন সরকার এবং তাদের দল আসলেই তাদের প্রতিষ্ঠাতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আদর্শ অনুসরণ করে আমাদের দারিদ্র্যপীড়িত দেশের রাজনীতিতে একটি গুণগত পরিবর্তন আনতে আগ্রহী। যারা সংসদীয় রাজনীতির শপথ গ্রহণ করে সংসদে অনুপস্থিত, যাদের জন্ম একনায়কত্বের ছত্রছায়ায়, তাদের আমি এই আবেদনের বাইরেই রাখছি। তারা কোনোদিন সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ধারক ছিলেন না, হবেনও না। বরং তারা সবসময় সুযোগের অপেক্ষায় থাকবেন যেনতেন প্রকারে ক্ষমতা অধিগ্রহণের।
অতএব, যদি গণতান্ত্রিক অবস্থাকে চিরায়ত করতে হয়, যদি আমাদের সাধারণ মানুষকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে দীক্ষিত করতে হয়, যদি আমাদের তরুণদের রাজনীতির প্রতি আকর্ষিত করতে হয় তাহলে এখনই সময় গণসংযোগের। সমাজের সর্বস্তরে, দেশের সব মানুষের সঙ্গে। ২০১২ হোক সেই অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের সূচনার বছর। সবাইকে গ্রেগরিয়ান নববর্ষের শুভেচ্ছা।
আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments