সাফল্য ব্যর্থতার ৩ বছর
স্টাফ রিপোর্টার: দিন বদল ও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসা মহাজোট সরকারের পাঁচ অগ্রাধিকার প্রতিশ্রুতির অগ্রগতি হয়েছে কম। অনেক ক্ষেত্রে তা হতাশাজনক। সরকারের তিন বছর পূর্তিতে এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। সরকারের পাঁচ অগ্রাধিকারের মধ্যে ছিল- দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ
, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, দারিদ্র্য ঘোচা ও বৈষম্য রুখো এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা। তিন বছরের মাথায় সমালোচক ও বিরোধী দলের পক্ষ থেকে এই অগ্রাধিকার প্রতিশ্রুতির বিষয়ে সমালোচনা হচ্ছে বেশি।
গত তিন বছরে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও মূল্যস্ফীতি পুরো নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি সরকার। দফায় দফায় বেড়েছে নিত্য পণ্যের দাম। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও মানবাধিকারের বিষয় সমালোচিত হচ্ছে সরকারের শুরু থেকে। ক্রসফায়ারের সমালোচনা থেকে অনেকটা বেরিয়ে আসতে পারলেও এখন নতুন আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে গুমহত্যা। দুর্নীতির সূচকে কিছুটা উন্নতি হলেও দেশের প্রধান প্রধান সেবাখাত এখনও আছে সেই তিমিরেই। তিন বছরে প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে এমনটা সরকার বললেও উৎপাদন বাড়াতে করা রেন্টাল এবং কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ফাঁদে বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছে পুরো অর্থনীতি। দ্রব্যমূল্য ও মূল্যস্ফীতির কারণে ভেস্তে যাওয়ার অবস্থা সরকারের দারিদ্র্য ঘোচানোর প্রতিশ্রুতি।
দ্রব্যমূল্যে পরিস্থিতি: সরকারের বিগত তিন বছরে দ্রব্যমূল্য নিয়ে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। অথচ সরকারের প্রথম অগ্রাধিকারের মধ্যে ছিল এই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের বিষয়। বাংলাদেশে ভোক্তা অধিকার রক্ষার বিষয়ে কাজ করে এমন একটি সংস্থা কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা ক্যাব তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলেছে বাংলাদেশে গত এক বছরে পণ্য এবং সেবার মূল্য গড়ে প্রায় ১২.৫ শতাংশ বেড়েছে। ২০১১ সালে বাজারে দ্রব্যমূল্য এবং বাড়িভাড়াসহ বেশ কিছু সেবাখাতের মূল্যের হিসাব করে ক্যাব তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে এ মূল্যবৃদ্ধির তথ্য দিয়েছে। ক্যাবের তথ্য অনুযায়ী গত এক বছরে এসব খাতে গড়ে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে ১২ দশমিক ৭.৭ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে খাদ্যপণ্যে। এর মধ্যে ভোজ্যতেলে প্রায় ২৬ শতাংশ এবং শাকসবজিতে বেড়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ। ২০১১ সালে প্রায় বছর জুড়েই দ্রব্যমূল্যসহ জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। এর আগের বছরও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি ছিল আলোচনায়। সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশ অব বাংলাদেশ টিসিবি’র হিসাবেই ২০১০ সালে নিত্যপ্রয়োজনীয় ৪২টি পণ্যের দাম বাড়ে আর কমে মাত্র পাঁচ থেকে ছয়টি পণ্যের। সরকারের প্রথম দুই বছরে অনেক পণ্যের দাম বাড়ে ৫০ থেকে ১০০ ভাগ পর্যন্ত। সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে টিসিবি’র মাধ্যমে কম দামে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রির ঘোষণা দিলেও তিন বছরে এই প্রতিষ্ঠান তেমন সফলতা দেখাতে পারেনি।
আইনশৃঙ্খলা ও মানবাধিকার: সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী গত তিন বছরে আইনশৃঙ্খলা ও মানবাধিকার বিষয়ে অগ্রগতি হয়নি খুব একটা। এই সময়ে বরং অনেক ক্ষেত্রে সমালোচনার বোঝা বেড়েছে। ক্রসফায়ার, গুপ্তহত্যা, খুন ও গুমসহ সহিংস ঘটনায় উদ্বেগ ও আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছে সুশীল সমাজ। সমালোচিত হয়েছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়। সরকারের প্রথম সময়ে র্যাব ও পুলিশের ক্রসফায়ার ও এনকাউন্টার নিয়ে আলোচনা ছিল সর্বত্র। এতে স্থানীয় গণমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোতেও ছিল সমালোচনা। সমপ্রতি আর ক্রসফায়ারের খবর তেমন শোনা যায় না। কিন্তু আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে গুপ্তহত্যা ও গুম। এ রকম অনেক ঘটনায় সরাসরি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর প্রতি অভিযোগ তুলছেন ভুক্তভোগীরা। সামপ্রতিক সময়ে রাজধানী ঢাকাতেই চলতি বছর গুম হয়েছেন ৩০ জন। এ পর্যন্ত ১৬ জনের লাশ নদী, হাওর ও জঙ্গল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। বিএনপি নেতা ও ৫৬ নং ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলমের কোন হদিস নেই দু’বছরেও। গত বছরের ২৩শে মার্চ ঝালকাঠির রাজাপুরে তালিকাভুক্ত এক সন্ত্রাসীকে ধরতে গিয়ে র্যাবের গুলিতে নিরীহ কলেজছাত্র লিমন হোসেনকে পা হারাতে হয়। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দেয়া তথ্য অনুযায়ী ২০০৯, ২০১০ ও ২০১১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ৩৫৯ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে মারা যান।
গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল কাদেরকে ধরে নিয়ে খিলগাঁও থানায় আটক রেখে অপরাধী বলে নির্যাতন করে পুলিশ। এ ঘটনায় বিচারবিভাগীয় ও পুলিশি তদন্তে খিলগাঁও থানার ওসিসহ তিনজনকে দোষী সাব্যস্ত এবং আদালতের নির্দেশে তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে সাসপেন্ড করা হয়। অপরদিকে গত শবেবরাতে সাভারের আমিনবাজারে ৬ ছাত্রকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনায় বিচারবিভাগীয় তদন্তে সাভার থানার ওসি মাহবুবুর রহমানকে প্রত্যাহার ও এসআই হারেস শিকদার এবং আনোয়ারকে সাসপেন্ড করা হয়। এছাড়া বিদায়ী বছরে নোয়াখালীতে এক কিশোরকে আটক করে পুলিশ বিক্ষুব্ধ জনতার মাঝে ছেড়ে দেয়ার পর সেখানে তার মৃত্যু হয়। এদিকে নরসিংদীর নির্বাচিত জনপ্রিয় মেয়র লোকমান হোসেনকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যার অভিযোগ ওঠে খোদ সরকারেরই ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদের প্রতি। যদিও নিহতের পরিবারের করা মামলায় তার বিরুদ্ধে অবিযোগ করা হয়নি।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে এ পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ৫৯২ জন এবং আহত হয়েছেন ৪০ হাজার ১৯০ জন। চলতি বছর ইউপি নির্বাচনী সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ৮৩ জন। তবে পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ১০ হাজার ৬ শ’ উল্লেখ করা হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা অধিকার-এর তথ্য অনুযায়ী সরকারের ২ বছর ১১ মাসে ৪ সাংবাদিক নিহত, ২৮০ সাংবাদিক আহত ও ৮৮ জন লাঞ্ছিত হয়েছেন। এছাড়া বিরোধী দলের চিফ হুইপের ওপর পুলিশের হামলার ঘটনা সমালোচিত হয়েছে দেশে-বিদেশে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি: মহাজোট সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির মধ্যে ক্ষমতার দুই বছরের মধ্যে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছিল। দুই বছরে পরিস্থিতি কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে না এলেও তৃতীয় বছর শেষে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রে ভর করে প্রায় ৩০০০ মেগাওয়াট উৎপাদন বেড়েছে। তবে নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় এই সময়ে চাহিদাকে চেপে রাখে সরকার। ভাড়া করা কেন্দ্রের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে পুরো জ্বালানি খাতে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে বিগত সময়ে। উৎপাদন বাড়লেও বাড়তি দামে বিদ্যুৎ কিনতে গিয়ে বেড়েছে সরকারের ভর্তুকি। এই চাপ সামলাতে সরকার একের পর বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়িয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে পুরো অর্থনীতিতে। অন্যদিকে গ্যাস উৎপাদন বাড়াতে খুব একটা অগ্রগতি হয়নি। একদিকে যেমন নতুন সংযোগ বন্ধ, অন্যদিকে গ্যাস স্বল্পতার কারণে শিল্পখাতে উৎপাদন কমে যাচ্ছে। আবাসিক সংযোগের ক্ষেত্রে মানুষকে পোহাতে হচ্ছে দুর্ভোগ।
দুর্নীতির রোধ: দুর্নীতি রোধ ও দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করা ছিল সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের দ্বিতীয় অগ্রাধিকার। ইশতেহারে বলা ছিল- দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে শক্তিশালী করা হবে। ক্ষমতাধরদের বার্ষিক সম্পদ বিবরণ দিতে হবে। রাষ্ট্র ও সমাজের সব স্তরের ঘুষ, দুর্নীতি উচ্ছেদ, অনুপার্জিত আয়, ঋণখেলাপি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কালো টাকা, পেশীশক্তি প্রতিরোধ ও নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে ইশতেহারে দেয়া এসব প্রতিশ্রুতির অনেকটাই বাস্তবায়ন হয়নি বিগত সময়ে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে দুদকের দায়ের করা বেশির ভাগ মামলা রাজনৈতিক বিবেচনায় বাতিল করতে সরকারের গঠন করা কমিটি সুপারিশ করেছে। এদিকে সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির বিষয়টি আলোচনায় এসেছে পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্ব ব্যাংক এ প্রকল্পে ঋণ দেয়া স্থগিত করায়। বিশ্ব ব্যাংক সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলে। পরে বিশ্বব্যাংকের পথ ধরে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও জাইকা ঋণ সহায়তা বন্ধ রেখেছে। দুর্নীতির অভিযোগ আর সমালোচনার মুখে আবুল হোসেনকে ওই মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে অন্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
দারিদ্র্য ঘোচাও বৈষম্য রুখো: এ খাতে সরকারের ব্যাপক সাফল্যের কথা বলা হলেও অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, গ্যাস-বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধান এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এখানে যথেষ্ট অগ্রগতি হবে না। তবে বিগত সময়ে সরকার ন্যাশনাল সার্ভিস কার্যক্রমের আওতায় কর্মসংস্থান কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। বয়স্ক ও বিধবা ভাতা বাড়িয়েছে। ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ আশ্রয়ন, গৃহায়ণ, আদর্শ গ্রাম কর্মসূচি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। এসব দিকে অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে।
অন্যান্য প্রতিশ্রুতি: সরকারের দ্বিতীয় বছরে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসির রায় কার্যকরের মাধ্যমে অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ করে সরকার। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা সীমান্ত-সংক্রান্ত কয়েকটি অমীমাংসিত বিষয়ের সমাধান হয়েছে। অবরুদ্ধ জীবনের অবসান হয়েছে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতাবাসীর। তারপরও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে সরকার খুব বেশি সফল তা মনে করেন না সংশ্লিষ্টরা। তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি না হওয়ায় সমালোচনা আছে খোদ সরকারি দলেই। পদ্মা সেতু নির্মাণ, প্রশাসনকে দলীয়করণমুক্ত, প্রতিবেশী দেশের কাছ থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়সহ অন্য অনেক প্রতিশ্রুতি পূরণেও খুব একটা সাফল্য নেই সরকারের। ঢাকার যানজট নিরসনে বেশ কিছু প্রকল্পের প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও একটিরও বাস্তবায়ন হয়নি এ পর্যন্ত। ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ চলছে। পাতাল রেল বা মনোরেল, সার্কুলার রেলপথ এবং এলিভেটেড (উড়াল সড়ক) রাস্তা নির্মাণ করে গণপরিবহন সমস্যার সমাধান, ঢাকার চারদিকে বৃত্তাকার (অরবিটাল) জলপথ, বেড়িবাঁধ, সড়ক ও রেলপথ নির্মাণ করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
জাতীয় সংসদকে কার্যকর করার কথা বলা হলেও মহাজোট সরকার এ প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। বিরোধী দল টানা সংসদ বর্জন করে চলেছে। তবে কৃষি ও শিক্ষা খাতে মোটা দাগের সাফল্য রয়েছে বলে মনে করছেন সরকারের সমালোচকরাও।
, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, দারিদ্র্য ঘোচা ও বৈষম্য রুখো এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা। তিন বছরের মাথায় সমালোচক ও বিরোধী দলের পক্ষ থেকে এই অগ্রাধিকার প্রতিশ্রুতির বিষয়ে সমালোচনা হচ্ছে বেশি।
গত তিন বছরে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও মূল্যস্ফীতি পুরো নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি সরকার। দফায় দফায় বেড়েছে নিত্য পণ্যের দাম। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও মানবাধিকারের বিষয় সমালোচিত হচ্ছে সরকারের শুরু থেকে। ক্রসফায়ারের সমালোচনা থেকে অনেকটা বেরিয়ে আসতে পারলেও এখন নতুন আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে গুমহত্যা। দুর্নীতির সূচকে কিছুটা উন্নতি হলেও দেশের প্রধান প্রধান সেবাখাত এখনও আছে সেই তিমিরেই। তিন বছরে প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে এমনটা সরকার বললেও উৎপাদন বাড়াতে করা রেন্টাল এবং কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ফাঁদে বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছে পুরো অর্থনীতি। দ্রব্যমূল্য ও মূল্যস্ফীতির কারণে ভেস্তে যাওয়ার অবস্থা সরকারের দারিদ্র্য ঘোচানোর প্রতিশ্রুতি।
দ্রব্যমূল্যে পরিস্থিতি: সরকারের বিগত তিন বছরে দ্রব্যমূল্য নিয়ে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। অথচ সরকারের প্রথম অগ্রাধিকারের মধ্যে ছিল এই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের বিষয়। বাংলাদেশে ভোক্তা অধিকার রক্ষার বিষয়ে কাজ করে এমন একটি সংস্থা কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা ক্যাব তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলেছে বাংলাদেশে গত এক বছরে পণ্য এবং সেবার মূল্য গড়ে প্রায় ১২.৫ শতাংশ বেড়েছে। ২০১১ সালে বাজারে দ্রব্যমূল্য এবং বাড়িভাড়াসহ বেশ কিছু সেবাখাতের মূল্যের হিসাব করে ক্যাব তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে এ মূল্যবৃদ্ধির তথ্য দিয়েছে। ক্যাবের তথ্য অনুযায়ী গত এক বছরে এসব খাতে গড়ে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে ১২ দশমিক ৭.৭ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে খাদ্যপণ্যে। এর মধ্যে ভোজ্যতেলে প্রায় ২৬ শতাংশ এবং শাকসবজিতে বেড়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ। ২০১১ সালে প্রায় বছর জুড়েই দ্রব্যমূল্যসহ জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। এর আগের বছরও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি ছিল আলোচনায়। সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশ অব বাংলাদেশ টিসিবি’র হিসাবেই ২০১০ সালে নিত্যপ্রয়োজনীয় ৪২টি পণ্যের দাম বাড়ে আর কমে মাত্র পাঁচ থেকে ছয়টি পণ্যের। সরকারের প্রথম দুই বছরে অনেক পণ্যের দাম বাড়ে ৫০ থেকে ১০০ ভাগ পর্যন্ত। সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে টিসিবি’র মাধ্যমে কম দামে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রির ঘোষণা দিলেও তিন বছরে এই প্রতিষ্ঠান তেমন সফলতা দেখাতে পারেনি।
আইনশৃঙ্খলা ও মানবাধিকার: সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী গত তিন বছরে আইনশৃঙ্খলা ও মানবাধিকার বিষয়ে অগ্রগতি হয়নি খুব একটা। এই সময়ে বরং অনেক ক্ষেত্রে সমালোচনার বোঝা বেড়েছে। ক্রসফায়ার, গুপ্তহত্যা, খুন ও গুমসহ সহিংস ঘটনায় উদ্বেগ ও আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছে সুশীল সমাজ। সমালোচিত হয়েছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়। সরকারের প্রথম সময়ে র্যাব ও পুলিশের ক্রসফায়ার ও এনকাউন্টার নিয়ে আলোচনা ছিল সর্বত্র। এতে স্থানীয় গণমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোতেও ছিল সমালোচনা। সমপ্রতি আর ক্রসফায়ারের খবর তেমন শোনা যায় না। কিন্তু আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে গুপ্তহত্যা ও গুম। এ রকম অনেক ঘটনায় সরাসরি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর প্রতি অভিযোগ তুলছেন ভুক্তভোগীরা। সামপ্রতিক সময়ে রাজধানী ঢাকাতেই চলতি বছর গুম হয়েছেন ৩০ জন। এ পর্যন্ত ১৬ জনের লাশ নদী, হাওর ও জঙ্গল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। বিএনপি নেতা ও ৫৬ নং ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলমের কোন হদিস নেই দু’বছরেও। গত বছরের ২৩শে মার্চ ঝালকাঠির রাজাপুরে তালিকাভুক্ত এক সন্ত্রাসীকে ধরতে গিয়ে র্যাবের গুলিতে নিরীহ কলেজছাত্র লিমন হোসেনকে পা হারাতে হয়। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দেয়া তথ্য অনুযায়ী ২০০৯, ২০১০ ও ২০১১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ৩৫৯ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে মারা যান।
গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল কাদেরকে ধরে নিয়ে খিলগাঁও থানায় আটক রেখে অপরাধী বলে নির্যাতন করে পুলিশ। এ ঘটনায় বিচারবিভাগীয় ও পুলিশি তদন্তে খিলগাঁও থানার ওসিসহ তিনজনকে দোষী সাব্যস্ত এবং আদালতের নির্দেশে তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে সাসপেন্ড করা হয়। অপরদিকে গত শবেবরাতে সাভারের আমিনবাজারে ৬ ছাত্রকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনায় বিচারবিভাগীয় তদন্তে সাভার থানার ওসি মাহবুবুর রহমানকে প্রত্যাহার ও এসআই হারেস শিকদার এবং আনোয়ারকে সাসপেন্ড করা হয়। এছাড়া বিদায়ী বছরে নোয়াখালীতে এক কিশোরকে আটক করে পুলিশ বিক্ষুব্ধ জনতার মাঝে ছেড়ে দেয়ার পর সেখানে তার মৃত্যু হয়। এদিকে নরসিংদীর নির্বাচিত জনপ্রিয় মেয়র লোকমান হোসেনকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যার অভিযোগ ওঠে খোদ সরকারেরই ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদের প্রতি। যদিও নিহতের পরিবারের করা মামলায় তার বিরুদ্ধে অবিযোগ করা হয়নি।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে এ পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ৫৯২ জন এবং আহত হয়েছেন ৪০ হাজার ১৯০ জন। চলতি বছর ইউপি নির্বাচনী সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ৮৩ জন। তবে পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ১০ হাজার ৬ শ’ উল্লেখ করা হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা অধিকার-এর তথ্য অনুযায়ী সরকারের ২ বছর ১১ মাসে ৪ সাংবাদিক নিহত, ২৮০ সাংবাদিক আহত ও ৮৮ জন লাঞ্ছিত হয়েছেন। এছাড়া বিরোধী দলের চিফ হুইপের ওপর পুলিশের হামলার ঘটনা সমালোচিত হয়েছে দেশে-বিদেশে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি: মহাজোট সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির মধ্যে ক্ষমতার দুই বছরের মধ্যে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছিল। দুই বছরে পরিস্থিতি কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে না এলেও তৃতীয় বছর শেষে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রে ভর করে প্রায় ৩০০০ মেগাওয়াট উৎপাদন বেড়েছে। তবে নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় এই সময়ে চাহিদাকে চেপে রাখে সরকার। ভাড়া করা কেন্দ্রের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে পুরো জ্বালানি খাতে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে বিগত সময়ে। উৎপাদন বাড়লেও বাড়তি দামে বিদ্যুৎ কিনতে গিয়ে বেড়েছে সরকারের ভর্তুকি। এই চাপ সামলাতে সরকার একের পর বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়িয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে পুরো অর্থনীতিতে। অন্যদিকে গ্যাস উৎপাদন বাড়াতে খুব একটা অগ্রগতি হয়নি। একদিকে যেমন নতুন সংযোগ বন্ধ, অন্যদিকে গ্যাস স্বল্পতার কারণে শিল্পখাতে উৎপাদন কমে যাচ্ছে। আবাসিক সংযোগের ক্ষেত্রে মানুষকে পোহাতে হচ্ছে দুর্ভোগ।
দুর্নীতির রোধ: দুর্নীতি রোধ ও দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করা ছিল সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের দ্বিতীয় অগ্রাধিকার। ইশতেহারে বলা ছিল- দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে শক্তিশালী করা হবে। ক্ষমতাধরদের বার্ষিক সম্পদ বিবরণ দিতে হবে। রাষ্ট্র ও সমাজের সব স্তরের ঘুষ, দুর্নীতি উচ্ছেদ, অনুপার্জিত আয়, ঋণখেলাপি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কালো টাকা, পেশীশক্তি প্রতিরোধ ও নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে ইশতেহারে দেয়া এসব প্রতিশ্রুতির অনেকটাই বাস্তবায়ন হয়নি বিগত সময়ে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে দুদকের দায়ের করা বেশির ভাগ মামলা রাজনৈতিক বিবেচনায় বাতিল করতে সরকারের গঠন করা কমিটি সুপারিশ করেছে। এদিকে সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির বিষয়টি আলোচনায় এসেছে পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্ব ব্যাংক এ প্রকল্পে ঋণ দেয়া স্থগিত করায়। বিশ্ব ব্যাংক সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলে। পরে বিশ্বব্যাংকের পথ ধরে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও জাইকা ঋণ সহায়তা বন্ধ রেখেছে। দুর্নীতির অভিযোগ আর সমালোচনার মুখে আবুল হোসেনকে ওই মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে অন্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
দারিদ্র্য ঘোচাও বৈষম্য রুখো: এ খাতে সরকারের ব্যাপক সাফল্যের কথা বলা হলেও অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, গ্যাস-বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধান এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এখানে যথেষ্ট অগ্রগতি হবে না। তবে বিগত সময়ে সরকার ন্যাশনাল সার্ভিস কার্যক্রমের আওতায় কর্মসংস্থান কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। বয়স্ক ও বিধবা ভাতা বাড়িয়েছে। ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ আশ্রয়ন, গৃহায়ণ, আদর্শ গ্রাম কর্মসূচি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। এসব দিকে অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে।
অন্যান্য প্রতিশ্রুতি: সরকারের দ্বিতীয় বছরে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসির রায় কার্যকরের মাধ্যমে অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ করে সরকার। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা সীমান্ত-সংক্রান্ত কয়েকটি অমীমাংসিত বিষয়ের সমাধান হয়েছে। অবরুদ্ধ জীবনের অবসান হয়েছে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতাবাসীর। তারপরও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে সরকার খুব বেশি সফল তা মনে করেন না সংশ্লিষ্টরা। তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি না হওয়ায় সমালোচনা আছে খোদ সরকারি দলেই। পদ্মা সেতু নির্মাণ, প্রশাসনকে দলীয়করণমুক্ত, প্রতিবেশী দেশের কাছ থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়সহ অন্য অনেক প্রতিশ্রুতি পূরণেও খুব একটা সাফল্য নেই সরকারের। ঢাকার যানজট নিরসনে বেশ কিছু প্রকল্পের প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও একটিরও বাস্তবায়ন হয়নি এ পর্যন্ত। ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ চলছে। পাতাল রেল বা মনোরেল, সার্কুলার রেলপথ এবং এলিভেটেড (উড়াল সড়ক) রাস্তা নির্মাণ করে গণপরিবহন সমস্যার সমাধান, ঢাকার চারদিকে বৃত্তাকার (অরবিটাল) জলপথ, বেড়িবাঁধ, সড়ক ও রেলপথ নির্মাণ করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
জাতীয় সংসদকে কার্যকর করার কথা বলা হলেও মহাজোট সরকার এ প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। বিরোধী দল টানা সংসদ বর্জন করে চলেছে। তবে কৃষি ও শিক্ষা খাতে মোটা দাগের সাফল্য রয়েছে বলে মনে করছেন সরকারের সমালোচকরাও।
No comments