সরকারের তিন বছর-সামনে অগি্নপরীক্ষা
সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন নিয়ে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি যাত্রা শুরু হয়েছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের। সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রয়োগের মধ্য দিয়ে জনগণ আওয়ামী লীগের প্রতি যে সমর্থন ব্যক্ত করেছিল ২০০৮ সালের নির্বাচনে তার পেছনে ছিল বিপুল প্রত্যাশা। নির্বাচনী ইশতেহারে দলটি জনপ্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটাতে পেরেছিল আর তাতে সন্তুষ্ট হয়েছিল ভোটাররা। ইশতেহারে দিনবদলের প্রতিশ্রুতি ছিল, তথ্যপ্রযুক্তিতে অগ্রসর ডিজিটাল
বাংলাদেশ গঠনের অঙ্গীকার ছিল। দুর্নীতিমুক্ত দেশ গঠন, সংসদকেন্দ্রিক গণতান্ত্রিক রাজনীতি, ন্যায্য বাজার প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক গতিশীলতাসহ নানা ইতিবাচক প্রত্যাশাও সঞ্চার করতে পেরেছিল দলটি। তরুণদের একটি বড় অংশ মুখ্যত ডিজিটাল বাংলাদেশ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আওয়ামী লীগের প্রতি আস্থা ব্যক্ত করেছিল। বস্তুত বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের ৫ বছর এবং পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরের অভিজ্ঞতা থেকে অনেকেই আশা করেছিলেন, এবার নতুনভাবে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সূচনা হবে আওয়ামী লীগের মাধ্যমে। রাজনীতির পুরনো ক্লেদ অপসারিত হবে। জনপ্রত্যাশার তালিকা দীর্ঘ হলেও বিগত তিন বছরে সে প্রত্যাশার কতটা পূরণ হয়েছে তা নিয়ে জনমনে যথেষ্ট সংশয় আছে। সরকারের তিন বছর উপলক্ষে সমকাল একটি জরিপের আয়োজন করেছে। তাতে স্পষ্ট যে, সরকারের তিন বছরের অভিজ্ঞতায় জনগণ সন্তুষ্ট হতে পারেনি। প্রথমত, একটি অনির্বাচিত ব্যবস্থা থেকে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তনের পর সংসদনির্ভর যে গণতান্ত্রিক চর্চা চালু হওয়ার কথা ছিল, কার্যক্ষেত্রে তা ঘটেনি। বিগত তিন বছরের অধিকাংশ সময় সংসদে বিরোধী দল অংশ নেয়নি। সংসদ কার্যকর করার জন্য সরকার ও বিরোধী দলের আন্তরিকতা এবং আগ্রহ নিয়ে সংশয় থেকে গেছে। অনেকে মনে করেন, সংসদে জনগণের সমস্যা ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে প্রত্যাশিত আলোচনা ও তর্ক-বিতর্ক হয়নি। এমনকি সরকার পরিচালনায় সংসদের নির্দেশক ভূমিকাও অনুভূত হয়নি। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোতে গণতন্ত্র চর্চা অবাধ হয়নি। রাজনৈতিক দল পরিচালনায় যে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও গণতান্ত্রিক রীতি মানার প্রত্যাশা ছিল তাতে অগ্রগতি হতাশাব্যঞ্জক। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে সমাজে মূল আলোচ্য প্রসঙ্গ ছিল দুর্নীতি। সে সময় দুর্নীতির অভিযোগে রাজনীতিকরা নানা ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। সঙ্গে এ কথাও সত্য, দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানের কারণে সে সময়ের কিছু উদ্যোগ প্রশংসিতও হয়েছিল। বর্তমান সরকারের সময়ে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানগুলো স্তিমিত, দুর্নীতি দমন কমিশন কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে জনমত জরিপে বিপুলসংখ্যক মানুষ মনে করেন, এ সরকারের আমলে দুর্নীতি বেড়েছে। এটি সতর্ক হওয়ার মতো তথ্য। বাজার, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়েও বিপুল প্রত্যাশা ছিল জনমনে। বাজারের ক্ষেত্রে খুব একটা সুখবর মেলেনি, বরং মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। কয়েক দফা জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির চাপ বাজারে পড়েছে। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির বিহিত করতে না পারা এবং বাজার সামাল দিতে না পারা সরকারের ব্যর্থতার তালিকায় বড় দাগ কেটে রেখেছে। গ্যাস, বিদ্যুৎসহ জ্বালানি ক্ষেত্রের সমস্যার কারণে বিনিয়োগও প্রত্যাশিত মাত্রায় হতে পারেনি। অবশ্য বিদ্যুৎ খাতে কিছুটা উন্নতির লক্ষণ দেখা দিয়েছে। সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয় বলেই বিশেষজ্ঞদের অভিমত। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিষয়ে 'মোটামুটি' অভিমত পাওয়া গেছে। একে খুব সন্তোষজনক বলা যাবে না। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বিশেষ আলোচিত বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়েও জনমনে সংশয় ক্রিয়াশীল। অধিকাংশ মানুষ মনে করে, টিপাইমুখ ও ট্রানজিট বিষয়ে সরকারের অবস্থান গ্রহণযোগ্য নয়। তবে কয়েকটি ক্ষেত্রে সরকার বিশেষ সফলতা দেখিয়েছে। শিক্ষা খাতে বিশেষ সাফল্য এসেছে, তথ্যপ্রযুক্তিতেও ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে, যুদ্ধাপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে, আগামীতে বিদ্যুৎ খাতেও ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। সার্বিক পরিস্থিতি বলছে, আগামী দু'বছর সরকারের জন্য অগি্নপরীক্ষার সময়। এ সময় রাজনৈতিক সংঘাত এড়িয়ে গঠনমূলক রাজনীতির ধারা অব্যাহত রাখার স্বার্থে জনমত বিবেচনায় নিয়ে গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচনের উপায় বেছে নেওয়া সরকারের অন্যতম কর্তব্য হবে। এ ক্ষেত্রে বিরোধী দলকেও গঠনমূলক ভূমিকা নিতে হবে। পাশাপাশি, বিতর্কিত ও অগ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্তের বদলে গঠনমূলক কর্মসূচির দিকে অগ্রসর হতে হবে। দ্রব্যমূল্যের ন্যায্যতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি অর্থনীতি, বিনিয়োগ ও বাণিজ্যে গতিশীলতা আনা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগামী দু'বছরে সরকার এসব দিকে মনোযোগ দিলে সেটি শুধু আওয়ামী লীগের জন্যই নয়, দেশের জন্যও ভালো ফল বয়ে আনবে।
No comments