ধর্ম-মানব চরিত্র গঠনে ইসলাম by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান
‘আশরাফুল মাখলুকাত’ সৃষ্টির সেরা মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে একে অন্যের সঙ্গে মিলেমিশে শান্তিপূর্ণভাবে সহ-অবস্থান করতে হয়। পিতা-মাতা, আত্মীয়স্বজন ও অন্যান্য লোকের সঙ্গে পারস্পরিক লেনদেন, ওঠা-বসা ও আচার-আচরণ বিভিন্নভাবে করতে হয়। আর এসব জীবনাচরণ কখনো প্রশংসনীয় হয় আবার কখনো নিন্দনীয় হয়। মানুষের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার দৈনন্দিন কাজকর্ম, লেনদেন, আচার-আচরণ ও সৌজন্যমূলক ব্যবহারের মধ্য দিয়ে যে
স্বভাবচরিত্র প্রকাশ পায় তা-ই আখলাক। যে কতগুলো মৌলিক গুণ মানুষকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছে, অপরাপর সৃষ্ট জীব থেকে তাকে পৃথক করেছে তার মধ্যে আখলাক অন্যতম। ইসলামের আলোকে মানুষের স্বভাবচরিত্র যখন সামগ্রিকভাবে সুন্দর, নির্মল, মার্জিত ও কল্যাণকর হয় তখন তাকে ‘আখলাকে হামিদা’ বা সচ্চরিত্র বলে। আর সচ্চরিত্রবান বলতে উত্তম ও ভালো চরিত্রের অধিকারীকেই বোঝায়। উত্তম চরিত্র বলতে নৈতিকতার অনুশীলন ও পরিচর্চাকে বোঝায়; যা মানুষকে সঠিক কল্যাণের পথ দেখায়। সব সমাজে আখলাকে হামিদা অত্যন্ত সমাদৃত ও প্রশংসনীয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কাছেও প্রিয়। মানব চরিত্রে যেসব উত্তম গুণাবলির বহিঃপ্রকাশ ঘটে তা হচ্ছে তাকওয়া, সত্যবাদিতা, সততা, বিশ্বস্ততা, ধৈর্য-সহিষ্ণুতা, মায়া-মমতা, ক্ষমা, উদারতা প্রভৃতি। এগুলো মানুষের মৌলিক মানবীয় গুণ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সুন্দর নৈতিক চরিত্র ও শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়ার চাইতে উত্তম কিছুই পিতামাতা সন্তানদের দান করতে পারে না।’ (তিরমিযি)
যেসব আচার-আচরণ ও স্বভাব-চরিত্র মানুষকে হীন, নীচ ও নিন্দনীয় করে তোলে তাকে ‘আখলাকে যামিমা’ বা নিন্দনীয় আচরণ বলে। মানব চরিত্রে মিথ্যাচার, অহংকার, নিষ্ঠুরতা, প্রতারণা, ঘুষ, দুর্নীতি, অশ্লীলতা প্রভৃতি নিন্দনীয় আচরণ সব সমাজেই অত্যন্ত ঘৃণ্য ও বর্জনীয়। এসব অনৈতিক আচরণ সমাজজীবনে যেমন নিন্দনীয়, আল্লাহ ও রাসুলের কাছেও তা অত্যন্ত অপছন্দনীয় এবং কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যার সচ্চরিত্র কলুষিত হয়, সে মানুষের মর্যাদা হারিয়ে পশুত্বের পর্যায়ে নেমে আসে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘ভালো ও মন্দ কখনো সমান হতে পারে না, মন্দ প্রতিহত করো ভালো দ্বারা, ফলে তোমার সঙ্গে যার শত্রুতা আছে সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো।’ ( সূরা হা-মীম আস সাজদা, আয়াত-৩৪)
মানুষের উত্তম স্বভাবচরিত্র ও আচার-আচরণ তথা আখলাকে হামিদা মৌলিক মানবীয় এবং জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। মানবচরিত্র ভালো ও গঠনমূলক না হলে অন্য সব সহায়সম্পদ অর্থহীন হয়ে যায়। মানব চরিত্রই উন্নত ও সমৃদ্ধ জাতির প্রধান জীবনীশক্তি। যে জাতির চরিত্র যত উন্নত সে বেশি উন্নত। যে জাতির চরিত্র যত দৃঢ় সে জাতি তত বেশি শক্তিশালী। যে জাতির চরিত্র নেই, সে জাতি যথাযথ সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারে না। পৃথিবীতে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে না। পার্থিব জগতের সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি যেমন উন্নত চরিত্রের ওপর নির্ভরশীল, তেমনি পারলৌকিক কল্যাণ এর ওপর নির্ভর করে। প্রশংসনীয় আচরণ মানুষে মানুষে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে এবং মানবসমাজে সমপ্রীতি বজায় রাখে।
মানবজাতির হিদায়াত তথা সৎপথ প্রদর্শনের জন্য পৃথিবীতে যুগে যুগে যত নবী-রাসূল আগমন করেছেন, তাঁরা সবাই স্ব স্ব জাতিকে উত্তম চরিত্রের আদর্শ শিক্ষা দিয়েছেন। ইসলামের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে উত্তম চরিত্রের পরিপূর্ণতা প্রদানের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘উত্তম চরিত্রকে পরিপূর্ণতা দানের জন্য আমি প্রেরিত হয়েছি।’ (ইবনে মাজা)
আখলাকে হামিদা মানুষকে নীতি-নৈতিকতা ও সৎকাজের দিকে পরিচালিত করে। এ ধরনের মানব চরিত্রের অত্যাবশ্যকীয় বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে সত্যবাদিতা, পবিত্রতা, সচ্চরিত্রতা, উন্নত মূল্যবোধ তথা সত্য, ন্যায়, ইনসাফ ও সৌন্দর্যপ্রিয়। আর আখলাকে যামিমা মানুষকে যাবতীয় দুর্নীতি, অন্যায়, অসৎকর্ম ও পাপের পথে পরিচালিত করে থাকে। এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সচ্চরিত্রের গুণাবলি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া ও উন্নত মূল্যবোধ থেকে দূরে চলে যাওয়া। ফলে সমাজে চরিত্রহীন ব্যক্তি নিজের ব্যক্তিগত জীবনের সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করে। কুপ্রবৃত্তির বিভিন্ন চাহিদা মানুষকে ঘিরে ফেলে এবং সব কাজে অনৈতিকতা ও দুর্নীতি প্রকট আকারে দেখা দেয়। পক্ষান্তরে সুন্দর স্বভাব-চরিত্রই হচ্ছে সৎকর্মের চালিকাশক্তি। মহানবী (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘উত্তম চরিত্রই হলো সব সৎকর্মের মূল।’ (মুসলিম)
মানুষের স্বভাবচরিত্রের ওপর আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ভালোবাসা ও সন্তুষ্টি নির্ভর করে। চরিত্রবান ব্যক্তি সবারই প্রিয়। সুন্দর চরিত্রের অধিকারীকে সবাই ভালো জানে, ভালোবাসে। সচ্চরিত্রবান আল্লাহর প্রিয়, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রিয়। চরিত্রবানকে যেমন পৃথিবীর সব মানুষ ভালোবাসেন, তেমনি ফেরেশতারাও ভালোবাসেন। এমনকি আল্লাহর সমগ্র সৃষ্টি জীব ও জড় পদার্থ সব সৃষ্টিই চরিত্রবানকে ভালোবাসে। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আমার নিকট অধিক প্রিয় যার চরিত্র সর্বোত্তম।’ (বুখারি ও মুসলিম)
মানবজীবনের ভালো-মন্দের মানদণ্ড হচ্ছে চরিত্র। সচ্চরিত্র মানুষের ঈমানের পরিপূর্ণতা প্রদান করে। যার চরিত্র ভালো তিনি সর্বোত্তম ব্যক্তিত্ব, আর যার চরিত্র খারাপ তিনি অধম। উত্তম চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তি তাঁর চরিত্রের গুণে জাহান্নামের শাস্তি থেকে রেহাই পাবেন। আর আখিরাতের সুবিশাল জীবনের সব নিয়ামত সুন্দর চরিত্রের অধিকারীর জন্যই অপেক্ষা করছে। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ যার গঠন ও স্বভাব সুন্দর করেছেন, দোযখের আগুন তাঁকে ভক্ষণ করবে না।’ (বায়হাকি ও তাবারানি)
তাই মানুষকে উত্তম চারিত্রিক গুণাবলি অর্জন করতে হবে এবং ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সমাজজীবনে তার বাস্তবায়ন করতে হবে। সব ধরনের নিন্দনীয় স্বভাব-আচরণ পরিহার করতে হবে। তাহলে মানবজীবনে ইহলৌকিক শান্তি ও পারলৌকিক মুক্তির পথ সুগম হবে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com
যেসব আচার-আচরণ ও স্বভাব-চরিত্র মানুষকে হীন, নীচ ও নিন্দনীয় করে তোলে তাকে ‘আখলাকে যামিমা’ বা নিন্দনীয় আচরণ বলে। মানব চরিত্রে মিথ্যাচার, অহংকার, নিষ্ঠুরতা, প্রতারণা, ঘুষ, দুর্নীতি, অশ্লীলতা প্রভৃতি নিন্দনীয় আচরণ সব সমাজেই অত্যন্ত ঘৃণ্য ও বর্জনীয়। এসব অনৈতিক আচরণ সমাজজীবনে যেমন নিন্দনীয়, আল্লাহ ও রাসুলের কাছেও তা অত্যন্ত অপছন্দনীয় এবং কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যার সচ্চরিত্র কলুষিত হয়, সে মানুষের মর্যাদা হারিয়ে পশুত্বের পর্যায়ে নেমে আসে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘ভালো ও মন্দ কখনো সমান হতে পারে না, মন্দ প্রতিহত করো ভালো দ্বারা, ফলে তোমার সঙ্গে যার শত্রুতা আছে সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো।’ ( সূরা হা-মীম আস সাজদা, আয়াত-৩৪)
মানুষের উত্তম স্বভাবচরিত্র ও আচার-আচরণ তথা আখলাকে হামিদা মৌলিক মানবীয় এবং জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। মানবচরিত্র ভালো ও গঠনমূলক না হলে অন্য সব সহায়সম্পদ অর্থহীন হয়ে যায়। মানব চরিত্রই উন্নত ও সমৃদ্ধ জাতির প্রধান জীবনীশক্তি। যে জাতির চরিত্র যত উন্নত সে বেশি উন্নত। যে জাতির চরিত্র যত দৃঢ় সে জাতি তত বেশি শক্তিশালী। যে জাতির চরিত্র নেই, সে জাতি যথাযথ সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারে না। পৃথিবীতে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে না। পার্থিব জগতের সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি যেমন উন্নত চরিত্রের ওপর নির্ভরশীল, তেমনি পারলৌকিক কল্যাণ এর ওপর নির্ভর করে। প্রশংসনীয় আচরণ মানুষে মানুষে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে এবং মানবসমাজে সমপ্রীতি বজায় রাখে।
মানবজাতির হিদায়াত তথা সৎপথ প্রদর্শনের জন্য পৃথিবীতে যুগে যুগে যত নবী-রাসূল আগমন করেছেন, তাঁরা সবাই স্ব স্ব জাতিকে উত্তম চরিত্রের আদর্শ শিক্ষা দিয়েছেন। ইসলামের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে উত্তম চরিত্রের পরিপূর্ণতা প্রদানের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘উত্তম চরিত্রকে পরিপূর্ণতা দানের জন্য আমি প্রেরিত হয়েছি।’ (ইবনে মাজা)
আখলাকে হামিদা মানুষকে নীতি-নৈতিকতা ও সৎকাজের দিকে পরিচালিত করে। এ ধরনের মানব চরিত্রের অত্যাবশ্যকীয় বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে সত্যবাদিতা, পবিত্রতা, সচ্চরিত্রতা, উন্নত মূল্যবোধ তথা সত্য, ন্যায়, ইনসাফ ও সৌন্দর্যপ্রিয়। আর আখলাকে যামিমা মানুষকে যাবতীয় দুর্নীতি, অন্যায়, অসৎকর্ম ও পাপের পথে পরিচালিত করে থাকে। এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সচ্চরিত্রের গুণাবলি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া ও উন্নত মূল্যবোধ থেকে দূরে চলে যাওয়া। ফলে সমাজে চরিত্রহীন ব্যক্তি নিজের ব্যক্তিগত জীবনের সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করে। কুপ্রবৃত্তির বিভিন্ন চাহিদা মানুষকে ঘিরে ফেলে এবং সব কাজে অনৈতিকতা ও দুর্নীতি প্রকট আকারে দেখা দেয়। পক্ষান্তরে সুন্দর স্বভাব-চরিত্রই হচ্ছে সৎকর্মের চালিকাশক্তি। মহানবী (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘উত্তম চরিত্রই হলো সব সৎকর্মের মূল।’ (মুসলিম)
মানুষের স্বভাবচরিত্রের ওপর আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ভালোবাসা ও সন্তুষ্টি নির্ভর করে। চরিত্রবান ব্যক্তি সবারই প্রিয়। সুন্দর চরিত্রের অধিকারীকে সবাই ভালো জানে, ভালোবাসে। সচ্চরিত্রবান আল্লাহর প্রিয়, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রিয়। চরিত্রবানকে যেমন পৃথিবীর সব মানুষ ভালোবাসেন, তেমনি ফেরেশতারাও ভালোবাসেন। এমনকি আল্লাহর সমগ্র সৃষ্টি জীব ও জড় পদার্থ সব সৃষ্টিই চরিত্রবানকে ভালোবাসে। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আমার নিকট অধিক প্রিয় যার চরিত্র সর্বোত্তম।’ (বুখারি ও মুসলিম)
মানবজীবনের ভালো-মন্দের মানদণ্ড হচ্ছে চরিত্র। সচ্চরিত্র মানুষের ঈমানের পরিপূর্ণতা প্রদান করে। যার চরিত্র ভালো তিনি সর্বোত্তম ব্যক্তিত্ব, আর যার চরিত্র খারাপ তিনি অধম। উত্তম চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তি তাঁর চরিত্রের গুণে জাহান্নামের শাস্তি থেকে রেহাই পাবেন। আর আখিরাতের সুবিশাল জীবনের সব নিয়ামত সুন্দর চরিত্রের অধিকারীর জন্যই অপেক্ষা করছে। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ যার গঠন ও স্বভাব সুন্দর করেছেন, দোযখের আগুন তাঁকে ভক্ষণ করবে না।’ (বায়হাকি ও তাবারানি)
তাই মানুষকে উত্তম চারিত্রিক গুণাবলি অর্জন করতে হবে এবং ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সমাজজীবনে তার বাস্তবায়ন করতে হবে। সব ধরনের নিন্দনীয় স্বভাব-আচরণ পরিহার করতে হবে। তাহলে মানবজীবনে ইহলৌকিক শান্তি ও পারলৌকিক মুক্তির পথ সুগম হবে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com
No comments