গতকাল সমকাল-ইমরান খান—পাকিস্তানের রাজনীতিতে ‘সুনামি’? by ফারুক চৌধুরী
সু‘নামি’ শব্দটি ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের অর্থবাহী। কিন্তু এক কালের জাঁদরেল পাকিস্তানি ক্রিকেটার, যিনি ১৯৯২ সালে ক্রিকেটে পাকিস্তানের বিশ্বকাপ বিজয়ী দলের অধিনায়ক ছিলেন, আর পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে দেড় দশক ধরে বহুলাংশে যাঁর ছিল নিঃসঙ্গ পদচারণ, তিনি তাঁর হালের নাটকীয় রাজনৈতিক অভ্যুদয়কে ‘ইতিবাচক সুনামি’ (গুড সুনামি) বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর বিশ্বাস, দেশ পরিচালনার দায়িত্বে নির্বাচিত হলে এই অভ্যুদয় তাঁর দেশে ‘অবিচার
আর দুর্নীতি’কে দূর করার ক্ষমতা রাখে। গত শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষার্ধে পাকিস্তানে (তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে) আরও একজন রাজনীতিবিদের অভ্যুদয় ঘটেছিল। তাঁর নাম ছিল জুলফিকার আলী ভুট্টো। তাঁর রাজনীতির স্লোগান ছিল, ‘রুটি, কাপড় আর বাসগৃহ’ (রোটি, কাপড়া আওর মকান)। বহু বছর হলো তিনি পাকিস্তানের সেনা-পরিচালিত পঙ্কিল রাজনীতির শিকার হয়ে ফাঁসির কাষ্ঠে প্রাণ দিয়েছেন। তাঁর চার সন্তানের তিনজনই হয়েছেন রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার। কিন্তু আজও পাকিস্তান তাঁর তিন দফা স্লোগানের কোনোটাই অর্জন করতে পারেনি; বরঞ্চ সেই লক্ষ্য থেকে দূরে বহুদূরে সরে আছে। তার প্রায় পাঁচ দশক পর অভ্যুদয় ঘটল ক্রিকেটার রাজনীতিবিদ ইমরান খানের, যাঁর সঙ্গে ভুট্টোর তুলনামূলক বিচার একাধিক কারণে ইমরানের প্রতি অবিচারই হবে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে ভুট্টো এসেছিলেন ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের তল্পিবাহক হয়ে। আর ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ মনোভাব নিয়ে ইমরান খান তাঁর রাজনৈতিক পথে ‘একলা’ চলেছেন দেড় যুগ ধরে। সত্যিকার অর্থেই একলা, কারণ পাকিস্তান পার্লামেন্টে তিনি তাঁর দল ‘তাহরিকে ইনসাফ’-এর একমাত্র প্রতিনিধি। বর্তমান যুগের পাকিস্তানের ভিন্নতর প্রেক্ষাপটে ইমরান খানের স্লোগান: সুবিচার, মনুষ্যত্ব আর আত্মসম্মানবোধ। (জাস্টিস, হিউম্যানিটি অ্যান্ড সেলফ এস্টিম)। এর মানে এই নয় যে, ইমরান খান যদি দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তাঁকে ‘রুটি কাপড় আর বাসগৃহ’ সম্বন্ধে ভাবতে হবে না। অর্থনৈতিকভাবে বিধ্বস্ত আর রাজনৈতিক অবস্থানে ভঙ্গুর (বেলুচিস্তান আর সীমান্তের পাখতুন খোয়া প্রদেশ) আজকের পাকিস্তানের হাল ধরা কোনো বিচারেই সহজসাধ্য নয়। কিন্তু গত দুই মাসে এই একলা চলা মানুষটির পেছনে জনসমর্থন এতই ব্যাপক হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, অনেক দেশি-বিদেশি রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের ধারণা, সুদর্শন ও পাশ্চাত্য-শিক্ষিত, ষাটের কোঠা ছুঁই ছুঁই ইমরান খানই হতে যাচ্ছেন আগামীর রাষ্ট্রনায়ক। অবশ্য এটাও সত্য, নানা ধরনের অঘটনের দেশ পাকিস্তানে নিশ্চয়তা নিয়ে যেকোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষকের অবস্থান নেওয়া দুরূহ। তবে ইদানীং ইমরান খানের রাজনৈতিক আচার-আচরণে একজন ভাবী রাষ্ট্র অথবা সরকারপ্রধানের পরিপক্বতা এসেছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর পৈশাচিক আক্রমণের শুরুতেই ভুট্টো তাঁর সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান রক্ষা পেল’। আর তার সম্পূর্ণ বিপরীত মনোভাব নিয়ে আমাদের স্বাধীনতার চার দশকের পূর্তিতে ইমরান খান একাধিকবারই উল্লেখ করেছেন, ১৯৭১ সালের নৃশংস ঘটনাবলির জন্য পাকিস্তানের উচিত বাংলাদেশের মানুষের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা।
পাকিস্তানে সাংবাদিকের দায়িত্বে আমার শেষ সফর ছিল আড়াই বছর আগে ২০০৯ সালের মে মাসে। সেই সময় প্রথম আলোতে আমার দেখা পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের সম্বন্ধে লিখেছিলাম, ‘উষ্ণহূদয়, অতিথিপরায়ণ, উদার, মনখোলা এই মানুষগুলো ছয়টি দশক ধরে ধারাবাহিক স্বৈরাচারী সামরিক আর সামরিক বাহিনী-প্রভাবিত শাসনে পরাভূত ও হতাশাগ্রস্ত। এ দেশের মানবসম্পদের বিকাশকে পদে পদে ব্যাহত করছে কুসংস্কারাচ্ছন্ন, সামন্তবাদী, স্বার্থান্বেষী নির্মম একটি সমাজ। তবে মুগ্ধ হতে হয় তাদের স্কুল-কলেজ আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর উচ্চশিক্ষার মান, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, সাহিত্য আর শিল্পকলার বিকাশ আর মুক্তচিন্তার প্রতি অনুরাগ দেখে। একজন শিক্ষিত পাকিস্তানি বিনয়ী, আপাতস্নিগ্ধ মার্জিত ও সামাজিক মনা, কিন্তু আর্থ-রাজনৈতিক দুরবস্থার মুখে কখনো বা হতাশাবাদী, অনিশ্চিত সন্দেহপ্রবণ ও বিভ্রান্ত।’ একই লেখনীতে আমার একদার সহকর্মী, পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব, কলাম লেখক নাজিমুদ্দিন শেখের কথা উল্লেখ করে বলেছিলাম, পাকিস্তানের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক দুরবস্থা সত্ত্বেও তার দেশ সম্বন্ধে সে আশাবাদী ছিল। সে বলেছিল, তার আশাবাদের কারণ হচ্ছে এই যে, পাকিস্তানের বর্তমান সংকট একটি নির্বাচিত সরকার মোকাবিলা করছে। সে বলেছিল, পাকিস্তানের বর্তমান গণতন্ত্র যতই ত্রুটিপূর্ণ হোক না কেন, তাতে মানুষের সম্পৃক্ততা তো রয়েছে এবং তার দেশের আপামর জনসাধারণ তালেবানকে সেই দেশ থেকে নির্মূল করার পক্ষে। (‘মনখোলা মানুষগুলো হতাশ ও পরাভূত’, প্রথম আলো, ১৪ মে, ২০০৯)
হয়তোবা তার কথাটি যথার্থ, কারণ দেশে অনিশ্চিত হলেও একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া রয়েছে, যা ইমরান খানের মতো একজন জনপ্রিয় নেতাকে সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। ইমরান খান জনপ্রিয়, কারণ তিনি মানুষের মনের কথা বলছেন, তিনি দুর্নীতি ও সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীন রইবেন বলে বলছেন, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন না হতে দেওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, দেশের বিভিন্ন অংশের সাধারণ মানুষ তাঁর কথার ওপর আস্থা রাখছে। ইমরান খান আরও বলছেন, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক নেতাদের নৈতিক অবস্থান নেই বলেই পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী থেকে থেকে অসাংবিধানিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এ বিষয়েও দেশের সিংহভাগ মানুষ তাঁর সঙ্গে একমত।
৬ মে ২০০৯ সালে আমি ইসলামাবাদে তাহরিকে ইনসাফের অফিসে গিয়েছিলাম। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে সেদিন ইমরান খান তাঁর অফিসে আসতে পারলেন না। সেখানে আমার দেখা হলো ইমরান খানের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ডা. শিরিন মাজারির সঙ্গে। সেই সময় তাহরিকে ইনসাফের দপ্তর চালানোর ভার তাঁর ওপর ন্যস্ত ছিল। শিরিন মাজারি একজন স্বল্পভাষী মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা, যিনি পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার একজন কঠোর সমালোচক। আমার সেই সাক্ষাৎকারের পর গত আড়াই বছরে যুক্তরাষ্ট্র আর পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের নাটকীয় অবনতি ঘটেছে। ওসামা বিন লাদেন হত্যা, অসংখ্য ড্রোন বিমান আক্রমণ আর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত পাকিস্তানের মাটিতে ২৪ জন পাকিস্তানি সেনা হত্যা পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মনোভাবকে আরও বিরূপ করে তুলেছে। পাকিস্তানিরা যুক্তিযুক্তভাবে মনে করে, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বারবার পাকিস্তানের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত হানছে। আমেরিকার পক্ষ নিয়ে যুদ্ধে এ পর্যন্ত প্রাণ দিয়েছে ৪০ হাজার পাকিস্তানি আর দেশের অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে ৭০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। কথাগুলো ইমরান খানের। ছেলেবেলার পড়া বাংলা কবিতার একটি পঙিক্ততেই ইমরান খানের মনোভাব প্রকাশ করা যায়। পঙিক্তটি হলো: ‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়, দাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে কে পরিবে পায়?’ ইমরান খান সেদিন ভারতীয় টেলিভিশনের সাংবাদিক সাগরিকা ঘোষকে বলেছেন, জারদারি আর গিলানি দুজনই যুক্তরাষ্ট্রের সৃষ্টি আর তাঁদের অধীনে পুরো দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্রের ‘ভাড়া করা আগ্নেয়াস্ত্র’।
তবে এটাও সত্য, যুক্তরাষ্ট্র এখন স্পষ্টভাবেই বিরাট জনপ্রিয়তার মাঝের ইমরান খানের রাজনৈতিক মূল্য অনুধাবন করছে। তাই পাকিস্তানে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান রাষ্ট্রদূত ক্যামেরন মুনস্টার সাধু সেজেই সেদিন বলেছেন, ইমরান খান যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী নন। তিনি গণতন্ত্র, স্বচ্ছ ও দুর্নীতিবিহীন সরকার এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পক্ষে কাজ করছেন। সন্দেহ নেই, যুক্তরাষ্ট্রের অন্য রাষ্ট্রদূতদের মতো তিনি আদিষ্ট হয়েই কথাগুলো বলেছেন, কিছুটা ভূতের মুখে রাম নামের মতো! অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র ইমরান খানের সঙ্গে সহযোগিতার মূল্য বুঝতে পারছে—আর ইমরান খানও যে এই বিষয়ে উদাসীন নন, তা তাঁর হালের কিছু উক্তিতে পরিলক্ষিত হচ্ছে। ইমরান খানের ‘ব্যান্ড ওয়াগনে’ এখন দল-মত নির্বিশেষে অনেকেই যোগ দিচ্ছেন। পারভেজ মোশাররফও (অর্থাৎ মোহাজের প্রতিনিধি) ইমরান খানের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি হাসছেন। শুনেছি যে, এতে শিরিন মাজারির মতো ইমরান খানের আদি নির্মল মনা (পিওরিস্ট) সমর্থকেরা প্রীত নন মোটেও। এমনকি এও গুজব রয়েছে, যেখানে কোটি কোটি মানুষের ঢল একপথে চলেছে, শিরিন মাজারি আর মুষ্টিমেয় কিছু ইমরান-সমর্থক ইমরান খানের এই রাজনৈতিক ‘সুবিধাবাদিতা’ (মতান্তরে বাস্তবধর্মিতা) সমর্থন করছেন না। ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক সম্বন্ধে ইমরান খান সজাগ দৃষ্টি রাখছেন বলে মনে হয়। তিনি কাশ্মীরে ছয়-সাত লাখ ভারতীয় সেনার অবস্থান ও মানবাধিকারের প্রশ্ন সম্বন্ধে সরব রয়েছেন, কিন্তু এও আশঙ্কা প্রকাশ করছেন যে, দুই দেশে ক্ষমতাবান সরকার অধিষ্ঠিত থাকলে কাশ্মীর সমস্যার একটি সমাধান সম্ভব। এদিকে পাশতুন ইমরান খান পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্ত অঞ্চল ও তালেবানদের সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখেন এবং তালেবানদের হিংস্র থাবাকে তাঁর বশ বানাতে বিশেষ অসুবিধা হবে না বলেই মনে করছেন।
ক্রিকেটের এককালের সার্থক ‘ফাস্ট বোলার’ ইমরান খান জানেন, ক্রিকেটের মতোই কেবল বাউন্সারে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা যায় না, লাইন ও লেনথ বজায় রেখে উইকেটের একটু এপাশে-ওপাশে দু-চারটা লোভনীয় বল নিক্ষেপ ফলপ্রসূই হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র আর ভারতের সঙ্গে তাই করতে হবে। কিন্তু ‘রানআপ’ বজায় রাখতে হবে। ‘নো বল’ করার অবকাশ নেই। মনে হচ্ছে ক্যাপ্টেন ইমরান খান এখন তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইনিংসটি খেলতে নেমেছেন। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, দেশে-বিদেশে তাঁর প্রতিপক্ষ ক্রিকেটের নিয়মাবলি মেনে চলতে প্রস্তুত আছেন তো?
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্র সচিব। কলাম লেখক।
zaaf@bdmail.net
পাকিস্তানে সাংবাদিকের দায়িত্বে আমার শেষ সফর ছিল আড়াই বছর আগে ২০০৯ সালের মে মাসে। সেই সময় প্রথম আলোতে আমার দেখা পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের সম্বন্ধে লিখেছিলাম, ‘উষ্ণহূদয়, অতিথিপরায়ণ, উদার, মনখোলা এই মানুষগুলো ছয়টি দশক ধরে ধারাবাহিক স্বৈরাচারী সামরিক আর সামরিক বাহিনী-প্রভাবিত শাসনে পরাভূত ও হতাশাগ্রস্ত। এ দেশের মানবসম্পদের বিকাশকে পদে পদে ব্যাহত করছে কুসংস্কারাচ্ছন্ন, সামন্তবাদী, স্বার্থান্বেষী নির্মম একটি সমাজ। তবে মুগ্ধ হতে হয় তাদের স্কুল-কলেজ আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর উচ্চশিক্ষার মান, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, সাহিত্য আর শিল্পকলার বিকাশ আর মুক্তচিন্তার প্রতি অনুরাগ দেখে। একজন শিক্ষিত পাকিস্তানি বিনয়ী, আপাতস্নিগ্ধ মার্জিত ও সামাজিক মনা, কিন্তু আর্থ-রাজনৈতিক দুরবস্থার মুখে কখনো বা হতাশাবাদী, অনিশ্চিত সন্দেহপ্রবণ ও বিভ্রান্ত।’ একই লেখনীতে আমার একদার সহকর্মী, পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব, কলাম লেখক নাজিমুদ্দিন শেখের কথা উল্লেখ করে বলেছিলাম, পাকিস্তানের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক দুরবস্থা সত্ত্বেও তার দেশ সম্বন্ধে সে আশাবাদী ছিল। সে বলেছিল, তার আশাবাদের কারণ হচ্ছে এই যে, পাকিস্তানের বর্তমান সংকট একটি নির্বাচিত সরকার মোকাবিলা করছে। সে বলেছিল, পাকিস্তানের বর্তমান গণতন্ত্র যতই ত্রুটিপূর্ণ হোক না কেন, তাতে মানুষের সম্পৃক্ততা তো রয়েছে এবং তার দেশের আপামর জনসাধারণ তালেবানকে সেই দেশ থেকে নির্মূল করার পক্ষে। (‘মনখোলা মানুষগুলো হতাশ ও পরাভূত’, প্রথম আলো, ১৪ মে, ২০০৯)
হয়তোবা তার কথাটি যথার্থ, কারণ দেশে অনিশ্চিত হলেও একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া রয়েছে, যা ইমরান খানের মতো একজন জনপ্রিয় নেতাকে সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। ইমরান খান জনপ্রিয়, কারণ তিনি মানুষের মনের কথা বলছেন, তিনি দুর্নীতি ও সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীন রইবেন বলে বলছেন, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন না হতে দেওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, দেশের বিভিন্ন অংশের সাধারণ মানুষ তাঁর কথার ওপর আস্থা রাখছে। ইমরান খান আরও বলছেন, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক নেতাদের নৈতিক অবস্থান নেই বলেই পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী থেকে থেকে অসাংবিধানিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এ বিষয়েও দেশের সিংহভাগ মানুষ তাঁর সঙ্গে একমত।
৬ মে ২০০৯ সালে আমি ইসলামাবাদে তাহরিকে ইনসাফের অফিসে গিয়েছিলাম। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে সেদিন ইমরান খান তাঁর অফিসে আসতে পারলেন না। সেখানে আমার দেখা হলো ইমরান খানের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ডা. শিরিন মাজারির সঙ্গে। সেই সময় তাহরিকে ইনসাফের দপ্তর চালানোর ভার তাঁর ওপর ন্যস্ত ছিল। শিরিন মাজারি একজন স্বল্পভাষী মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা, যিনি পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার একজন কঠোর সমালোচক। আমার সেই সাক্ষাৎকারের পর গত আড়াই বছরে যুক্তরাষ্ট্র আর পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের নাটকীয় অবনতি ঘটেছে। ওসামা বিন লাদেন হত্যা, অসংখ্য ড্রোন বিমান আক্রমণ আর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত পাকিস্তানের মাটিতে ২৪ জন পাকিস্তানি সেনা হত্যা পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মনোভাবকে আরও বিরূপ করে তুলেছে। পাকিস্তানিরা যুক্তিযুক্তভাবে মনে করে, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বারবার পাকিস্তানের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত হানছে। আমেরিকার পক্ষ নিয়ে যুদ্ধে এ পর্যন্ত প্রাণ দিয়েছে ৪০ হাজার পাকিস্তানি আর দেশের অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে ৭০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। কথাগুলো ইমরান খানের। ছেলেবেলার পড়া বাংলা কবিতার একটি পঙিক্ততেই ইমরান খানের মনোভাব প্রকাশ করা যায়। পঙিক্তটি হলো: ‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়, দাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে কে পরিবে পায়?’ ইমরান খান সেদিন ভারতীয় টেলিভিশনের সাংবাদিক সাগরিকা ঘোষকে বলেছেন, জারদারি আর গিলানি দুজনই যুক্তরাষ্ট্রের সৃষ্টি আর তাঁদের অধীনে পুরো দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্রের ‘ভাড়া করা আগ্নেয়াস্ত্র’।
তবে এটাও সত্য, যুক্তরাষ্ট্র এখন স্পষ্টভাবেই বিরাট জনপ্রিয়তার মাঝের ইমরান খানের রাজনৈতিক মূল্য অনুধাবন করছে। তাই পাকিস্তানে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান রাষ্ট্রদূত ক্যামেরন মুনস্টার সাধু সেজেই সেদিন বলেছেন, ইমরান খান যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী নন। তিনি গণতন্ত্র, স্বচ্ছ ও দুর্নীতিবিহীন সরকার এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পক্ষে কাজ করছেন। সন্দেহ নেই, যুক্তরাষ্ট্রের অন্য রাষ্ট্রদূতদের মতো তিনি আদিষ্ট হয়েই কথাগুলো বলেছেন, কিছুটা ভূতের মুখে রাম নামের মতো! অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র ইমরান খানের সঙ্গে সহযোগিতার মূল্য বুঝতে পারছে—আর ইমরান খানও যে এই বিষয়ে উদাসীন নন, তা তাঁর হালের কিছু উক্তিতে পরিলক্ষিত হচ্ছে। ইমরান খানের ‘ব্যান্ড ওয়াগনে’ এখন দল-মত নির্বিশেষে অনেকেই যোগ দিচ্ছেন। পারভেজ মোশাররফও (অর্থাৎ মোহাজের প্রতিনিধি) ইমরান খানের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি হাসছেন। শুনেছি যে, এতে শিরিন মাজারির মতো ইমরান খানের আদি নির্মল মনা (পিওরিস্ট) সমর্থকেরা প্রীত নন মোটেও। এমনকি এও গুজব রয়েছে, যেখানে কোটি কোটি মানুষের ঢল একপথে চলেছে, শিরিন মাজারি আর মুষ্টিমেয় কিছু ইমরান-সমর্থক ইমরান খানের এই রাজনৈতিক ‘সুবিধাবাদিতা’ (মতান্তরে বাস্তবধর্মিতা) সমর্থন করছেন না। ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক সম্বন্ধে ইমরান খান সজাগ দৃষ্টি রাখছেন বলে মনে হয়। তিনি কাশ্মীরে ছয়-সাত লাখ ভারতীয় সেনার অবস্থান ও মানবাধিকারের প্রশ্ন সম্বন্ধে সরব রয়েছেন, কিন্তু এও আশঙ্কা প্রকাশ করছেন যে, দুই দেশে ক্ষমতাবান সরকার অধিষ্ঠিত থাকলে কাশ্মীর সমস্যার একটি সমাধান সম্ভব। এদিকে পাশতুন ইমরান খান পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্ত অঞ্চল ও তালেবানদের সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখেন এবং তালেবানদের হিংস্র থাবাকে তাঁর বশ বানাতে বিশেষ অসুবিধা হবে না বলেই মনে করছেন।
ক্রিকেটের এককালের সার্থক ‘ফাস্ট বোলার’ ইমরান খান জানেন, ক্রিকেটের মতোই কেবল বাউন্সারে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা যায় না, লাইন ও লেনথ বজায় রেখে উইকেটের একটু এপাশে-ওপাশে দু-চারটা লোভনীয় বল নিক্ষেপ ফলপ্রসূই হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র আর ভারতের সঙ্গে তাই করতে হবে। কিন্তু ‘রানআপ’ বজায় রাখতে হবে। ‘নো বল’ করার অবকাশ নেই। মনে হচ্ছে ক্যাপ্টেন ইমরান খান এখন তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইনিংসটি খেলতে নেমেছেন। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, দেশে-বিদেশে তাঁর প্রতিপক্ষ ক্রিকেটের নিয়মাবলি মেনে চলতে প্রস্তুত আছেন তো?
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্র সচিব। কলাম লেখক।
zaaf@bdmail.net
No comments