চালচিত্র-বিশ্ব গণতন্ত্রে যুগান্তকারী নতুন অধ্যায় by শুভ রহমান
সৌদি আরবে ভোট ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার অধিকার পেলেন নারীরা। ভোটাধিকার হচ্ছে নারীর ক্ষমতায়নের নূ্যনতম ও প্রথম ধাপ। এক রকম নীরবেই ঘটে গেল একটা দুনিয়া-কাঁপানো ঘটনা। সভ্যতার ইতিহাসে, আমার মতে, একবিংশ শতাব্দীতে ঘটে যাওয়া এত বড় ঘটনা শুধু সৌদি সমাজকেই নয়, উন্নত ও আধুনিক অনেক সমাজকেও গণতন্ত্র ও উন্নয়নের অনেক বাধা চূর্ণ করার বিরাট শক্তি জোগাবে।
বস্তুত বিশ্বে প্রাপ্তবয়স্ক ও সর্বজনীন ভোটাধিকারের সংগ্রাম সুপ্রাচীন। ১৮৭১ সালে প্যারি কমিউন নারীর ভোটাধিকারকে স্বীকৃতি দিলেও প্যারি কমিউনের পতন ঘটলে নারীরা আবার ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হন। এরপর মাত্র ১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে চার্লস দ্য গল-ই নারীর ভোটাধিকারকে স্বীকৃতি দেন। সে সময় প্যারিসসহ ফ্রান্সের বেশির ভাগ অঞ্চল নাৎসিদের দখলে ছিল। এর পরের মাসে প্যারিস নাৎসি দখলমুক্ত হয়।
পৃথিবীর ইতিহাসে নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার অর্জন সুদীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সম্ভব হয়েছে। আজকের উন্নত ও সভ্যতাগর্বী পাশ্চাত্য বহু দেশেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নিগড়ে আবদ্ধ থেকে নারীরা দীর্ঘকাল মনুষ্য পদবাচ্য হওয়ার, একটি স্বতন্ত্র ও রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে স্বীকৃত হওয়ার নূ্যনতম অধিকারটুকু থেকেই বঞ্চিত থেকেছেন। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে অভিজাত শ্রেণীর ও সম্পত্তির অধিকারী নারীরা পুরুষতন্ত্রের কৃপায় ও কল্যাণে অনেকটা 'শোপিস' হিসেবে, অলংকার হিসেবে রাষ্ট্র ও সমাজে ভোটাধিকারসহ কোনো কোনো নাগরিক অধিকার ভোগ করতে পারলেও শ্রমজীবী শ্রেণীর নারীসহ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নারীই ভোটাধিকার তো দূরের কথা, বাঁচার নূ্যনতম অধিকার থেকেও যুগ যুগ বঞ্চিত থেকেছেন। অন্য উন্নত দেশের কথা বাদ দিয়ে বয়স্ক ভোটাধিকার ও গণতন্ত্রের সূতিকাগার ব্রিটেনেই পার্লামেন্টে নারীদের ভোটাধিকারসহ নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই এক দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই এগিয়েছে। আক্ষরিক অর্থেই একপর্যায়ে এ জন্য লর্ডসভার পুরুষ সদস্যদের ধাওয়া পর্যন্ত করতে হয়েছে নারীদের। নারী আন্দোলনের অনেক নেত্রীকে এ জন্য জেলও খাটতে হয়েছে। জওহরলাল নেহরুর গি্লম্পসেস অব ওয়ার্ল্ড হিস্টরিতে এ প্রসঙ্গে চিত্তাকর্ষক আলোচনা রয়েছে।
বস্তুত সমাজ উন্নয়ন ও সমাজ মুক্তির ক্ষেত্রে ভোটাধিকারের ভূমিকা ও গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের দেশে স্বাধীনতাপূর্বকালে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকরা দীর্ঘকাল জনগণকে বয়স্ক ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত রেখেছিল। একনায়ক ও স্বঘোষিত ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের দীর্ঘ সামরিক শাসনামলে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে প্রত্যক্ষ নির্বাচন ও বয়স্ক ভোটাধিকার আদায় এবং 'এক লোক এক ভোট'-এর দাবি প্রতিষ্ঠা করতে জনগণকে রাজপথে বুকের রক্ত ঢালতে হয়।
প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, সৌদি নারীরাও বহু যুগের শোষণ-বঞ্চনা-অবহেলার বাধাবন্ধ চূর্ণ করে একাধারে রাষ্ট্রীয় পরামর্শক সভায় (শুরা কাউন্সিল) প্রবেশাধিকার এবং ভোটাধিকার লাভসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতারও সুযোগ পাবেন। রবিবার সৌদি বাদশাহ আবদুল্লাহ বিন আবদুল আজিজ আল সউদ এ ঘোষণা দিয়েছেন। এই বৃহস্পতিবারের পৌর নির্বাচনে সৌদি নারীরা অংশ নিতে না পারলেও আগামী নির্বাচন থেকে এ সুযোগ পাবেন। শুরা কাউন্সিলের পরবর্তী মেয়াদে নারীদের নিয়োগ করার ঘোষণা কার্যকর করা হবে। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, কঠোর সুনি্ন আইনে পরিচালিত দেশটিতে এ ধরনের ঘোষণা যুগান্তকারী ঘটনা। খবরে আরো বলা হয়েছে, গত এপ্রিলে সৌদি নারীদের ভোটাধিকার আদায়ের দাবিতে অনুষ্ঠিত আন্দোলনেরই এটা ফল। সৌদি লেখিকা নিমাহ ইসমাইল নওয়াব জানিয়েছেন, ২০ বছর ধরে নারীদের গাড়িচালনা ও একা বিদেশ ভ্রমণের অধিকার, সন্তানের অভিভাবকত্বের অধিকার এবং ভোটাধিকার আদায়ে মানবাধিকারকর্মীরা দাবি জানিয়ে আসছেন।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সাম্প্রতিককালে মিসর, তিউনিসিয়া, ইয়েমেন ও লিবিয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ আরব মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সুদীর্ঘকালের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে যে বিশাল গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়ে গেল এবং যার ফলে হোসনি মুবারক ও গাদ্দাফির তিন-চার দশকের দুঃশাসনের অবসান সূচিত হলো, তারই প্রচণ্ড অভিঘাতে আজ সৌদি রাজতান্ত্রিক অচলায়তনও টলটলায়মান। নারীদের অধিকার আদায়ের জন্য মানবাধিকারকর্মীদের আন্দোলনকে তা অকল্পনীয় শক্তি জুগিয়েছে, যার ফলে বাস্তবতার স্বীকৃতি দিয়ে সৌদি বাদশাহ সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত অংশ সৌদি নারীদের গণতান্ত্রিক অধিকার দিয়ে সমাজে একটা আধুনিক যুক্তিনির্ভর ও সভ্য পরিবেশ কায়েম করতে চাইছেন। উল্লেখ্য, আফগানিস্তানে বাদশাহ আমানুল্লাহর ক্ষণস্থায়ী শাসনকালেও আধুনিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে নারীদের চিকিৎসাবিজ্ঞান অধ্যয়নে বিদেশে গমন, স্কার্ট পরিধান_এসবের স্বাধীনতা দিয়ে সমাজে আধুনিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল। বছর কয়েক আগে কুয়েতেও নারীদের সীমিত ভোটাধিকারসহ কিছু কিছু নাগরিক স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। পাশ্চাত্য ধনতান্ত্রিক দেশগুলোর কল্যাণে উন্নত ও আধুনিক সভ্যতা, অফুরন্ত তেলসম্পদ ও ধনৈশ্বর্যের অধিকারী হয়েও অভ্যন্তরীণ সৌদি সমাজ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে লজ্জাজনকভাবেই পিছিয়ে রয়েছে।
আজকের দিনে বিশ্বসভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশের সার্বিক উন্নয়ন অবাধ ও নিশ্চিত করতে চাইলে নারীদের পশ্চাৎপদতা ও রক্ষণশীলতার মধ্যে নিমজ্জিত রাখলে চলবে না। সৌদি শাসকগোষ্ঠী ও সমাজ সে বাস্তবতা মেনে নিলে বিশ্বের গণতান্ত্রিক সমাজ তাকে অকুণ্ঠচিত্তে স্বাগত জানাবে।
২৭.৯.২০১১
পৃথিবীর ইতিহাসে নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার অর্জন সুদীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সম্ভব হয়েছে। আজকের উন্নত ও সভ্যতাগর্বী পাশ্চাত্য বহু দেশেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নিগড়ে আবদ্ধ থেকে নারীরা দীর্ঘকাল মনুষ্য পদবাচ্য হওয়ার, একটি স্বতন্ত্র ও রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে স্বীকৃত হওয়ার নূ্যনতম অধিকারটুকু থেকেই বঞ্চিত থেকেছেন। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে অভিজাত শ্রেণীর ও সম্পত্তির অধিকারী নারীরা পুরুষতন্ত্রের কৃপায় ও কল্যাণে অনেকটা 'শোপিস' হিসেবে, অলংকার হিসেবে রাষ্ট্র ও সমাজে ভোটাধিকারসহ কোনো কোনো নাগরিক অধিকার ভোগ করতে পারলেও শ্রমজীবী শ্রেণীর নারীসহ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নারীই ভোটাধিকার তো দূরের কথা, বাঁচার নূ্যনতম অধিকার থেকেও যুগ যুগ বঞ্চিত থেকেছেন। অন্য উন্নত দেশের কথা বাদ দিয়ে বয়স্ক ভোটাধিকার ও গণতন্ত্রের সূতিকাগার ব্রিটেনেই পার্লামেন্টে নারীদের ভোটাধিকারসহ নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই এক দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই এগিয়েছে। আক্ষরিক অর্থেই একপর্যায়ে এ জন্য লর্ডসভার পুরুষ সদস্যদের ধাওয়া পর্যন্ত করতে হয়েছে নারীদের। নারী আন্দোলনের অনেক নেত্রীকে এ জন্য জেলও খাটতে হয়েছে। জওহরলাল নেহরুর গি্লম্পসেস অব ওয়ার্ল্ড হিস্টরিতে এ প্রসঙ্গে চিত্তাকর্ষক আলোচনা রয়েছে।
বস্তুত সমাজ উন্নয়ন ও সমাজ মুক্তির ক্ষেত্রে ভোটাধিকারের ভূমিকা ও গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের দেশে স্বাধীনতাপূর্বকালে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকরা দীর্ঘকাল জনগণকে বয়স্ক ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত রেখেছিল। একনায়ক ও স্বঘোষিত ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের দীর্ঘ সামরিক শাসনামলে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে প্রত্যক্ষ নির্বাচন ও বয়স্ক ভোটাধিকার আদায় এবং 'এক লোক এক ভোট'-এর দাবি প্রতিষ্ঠা করতে জনগণকে রাজপথে বুকের রক্ত ঢালতে হয়।
প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, সৌদি নারীরাও বহু যুগের শোষণ-বঞ্চনা-অবহেলার বাধাবন্ধ চূর্ণ করে একাধারে রাষ্ট্রীয় পরামর্শক সভায় (শুরা কাউন্সিল) প্রবেশাধিকার এবং ভোটাধিকার লাভসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতারও সুযোগ পাবেন। রবিবার সৌদি বাদশাহ আবদুল্লাহ বিন আবদুল আজিজ আল সউদ এ ঘোষণা দিয়েছেন। এই বৃহস্পতিবারের পৌর নির্বাচনে সৌদি নারীরা অংশ নিতে না পারলেও আগামী নির্বাচন থেকে এ সুযোগ পাবেন। শুরা কাউন্সিলের পরবর্তী মেয়াদে নারীদের নিয়োগ করার ঘোষণা কার্যকর করা হবে। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, কঠোর সুনি্ন আইনে পরিচালিত দেশটিতে এ ধরনের ঘোষণা যুগান্তকারী ঘটনা। খবরে আরো বলা হয়েছে, গত এপ্রিলে সৌদি নারীদের ভোটাধিকার আদায়ের দাবিতে অনুষ্ঠিত আন্দোলনেরই এটা ফল। সৌদি লেখিকা নিমাহ ইসমাইল নওয়াব জানিয়েছেন, ২০ বছর ধরে নারীদের গাড়িচালনা ও একা বিদেশ ভ্রমণের অধিকার, সন্তানের অভিভাবকত্বের অধিকার এবং ভোটাধিকার আদায়ে মানবাধিকারকর্মীরা দাবি জানিয়ে আসছেন।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সাম্প্রতিককালে মিসর, তিউনিসিয়া, ইয়েমেন ও লিবিয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ আরব মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সুদীর্ঘকালের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে যে বিশাল গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়ে গেল এবং যার ফলে হোসনি মুবারক ও গাদ্দাফির তিন-চার দশকের দুঃশাসনের অবসান সূচিত হলো, তারই প্রচণ্ড অভিঘাতে আজ সৌদি রাজতান্ত্রিক অচলায়তনও টলটলায়মান। নারীদের অধিকার আদায়ের জন্য মানবাধিকারকর্মীদের আন্দোলনকে তা অকল্পনীয় শক্তি জুগিয়েছে, যার ফলে বাস্তবতার স্বীকৃতি দিয়ে সৌদি বাদশাহ সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত অংশ সৌদি নারীদের গণতান্ত্রিক অধিকার দিয়ে সমাজে একটা আধুনিক যুক্তিনির্ভর ও সভ্য পরিবেশ কায়েম করতে চাইছেন। উল্লেখ্য, আফগানিস্তানে বাদশাহ আমানুল্লাহর ক্ষণস্থায়ী শাসনকালেও আধুনিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে নারীদের চিকিৎসাবিজ্ঞান অধ্যয়নে বিদেশে গমন, স্কার্ট পরিধান_এসবের স্বাধীনতা দিয়ে সমাজে আধুনিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল। বছর কয়েক আগে কুয়েতেও নারীদের সীমিত ভোটাধিকারসহ কিছু কিছু নাগরিক স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। পাশ্চাত্য ধনতান্ত্রিক দেশগুলোর কল্যাণে উন্নত ও আধুনিক সভ্যতা, অফুরন্ত তেলসম্পদ ও ধনৈশ্বর্যের অধিকারী হয়েও অভ্যন্তরীণ সৌদি সমাজ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে লজ্জাজনকভাবেই পিছিয়ে রয়েছে।
আজকের দিনে বিশ্বসভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশের সার্বিক উন্নয়ন অবাধ ও নিশ্চিত করতে চাইলে নারীদের পশ্চাৎপদতা ও রক্ষণশীলতার মধ্যে নিমজ্জিত রাখলে চলবে না। সৌদি শাসকগোষ্ঠী ও সমাজ সে বাস্তবতা মেনে নিলে বিশ্বের গণতান্ত্রিক সমাজ তাকে অকুণ্ঠচিত্তে স্বাগত জানাবে।
২৭.৯.২০১১
No comments