ট্রাফিকের ব্যবহার এবং একজন সম্পাদকের ভীতি by জাহিদ হায়দার
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি' (কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়)। কবিরা সত্যদ্রষ্টা হন। বিখ্যাত কবিতার বিভিন্ন রকম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হতে পারে। কবির বিখ্যাত কবিতাটির মূল বক্তব্য মাতৃভূমির সৌন্দর্য বর্ণনা এবং তার প্রতি ভালোবাসা। প্রশ্ন উঠতে পারে, ট্রাফিকদের কথা বলতে গিয়ে ওই গানের লাইনটি এল কেন?
সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু সড়ক দুর্ঘটনার কারণে নিরাপদ সড়ক, ট্রাফিক এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তাদের বিষয়ে অনেক যৌক্তিক কথা ও দাবি বলাবলি হচ্ছে। আগেও হয়েছে, তবে এতটা হৈচৈ করে হয়নি। মিরসরাইয়ে ৩৮ জন শিশুর মৃত্যুর পর প্রচারমাধ্যমে যত কথা হয়নি, তার চেয়ে বেশি কথা হচ্ছে দুজন বিখ্যাত ব্যক্তি (তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর) মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার পর; এবং আরো হবে। লক্ষ করার ব্যাপার, ওই দুজনের সঙ্গে আর যে তিনজন মানুষ মারা গেলেন, তাঁদের ব্যাপারে কেউ খুব একটা খোঁজখবর নিচ্ছে না (তাঁরা অতি সাধারণ বলেই যেন তাঁদের মৃত্যু মূল্যবান মৃত্যু নয়, ক্ষতিকর মৃত্যু নয়!)। বিখ্যাত মানুষদের অকাল অপমৃত্যু থেকে সাধারণ শিশুদের অকাল অপমৃত্যু যেন অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সম্প্রতি যে বিবেক-সমাজ শহীদ মিনারে ঈদের দিন অনেক দাবি তুলল, দাবিগুলো যৌক্তিক। কিন্তু এই বিবেক-সমাজ মিরসরাইয়ে শিশুদের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর কেন শহীদ মিনারে গিয়ে এভাবে প্রচারমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণকারী সভা করল না? কিংবা কেন তারাই এত দিন অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চনের সঙ্গে নিরাপদ সড়কের জন্য আরো জোর আন্দোলন গড়ে তুলল না?
'এমন দেশটি'র বিশেষ বিশেষ বিবেকবান মানুষের আচার-ব্যবহারবিধির মাত্রা নির্ধারিত হয় 'সাধারণ মানুষ' এবং 'বিখ্যাত মানুষ'দের মৃত্যুবিষয়ক গ্রহণ-বর্জনের ওপর।
ঘটনাটি ঈদের কয়েক দিন আগের। আমি একজন ট্রাফিক ভাইকে একটি পথের দূরত্ব কত জিজ্ঞেস করেছিলাম। যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম, তখন তিনি ব্যস্ত ছিলেন একটি গাড়ির কাগজপত্র দেখা নিয়ে। ঈদের আগে কেন যে চলমান গাড়িগুলোর কাগজপত্র বেশি বেশি দেখা হয়, তার কারণ আমার অজানা। তো, ওই ট্রাফিক ভাই বেশ বিরক্ত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন কী আমার জিজ্ঞাসা। পথের দূরত্ব কত? আমার প্রশ্নে ট্রাফিক ভাই, তিন রকম সংখ্যা বললেন। আমি বললাম, মৌচাক থেকে এ পর্যন্ত দূরত্ব তিন রকম হতে পারে না_আপনার তো সঠিক দূরত্ব জানার কথা। তিনি আমার কথায় খুব রেগে গেলেন। তিনি ইংরেজিতে কথা বললেন, যার মূল বক্তব্য, আমি নাকি তাঁকে 'টিজ' করেছি। আমি বললাম, 'আচ্ছা, আমার চেহারা দেখে আপনার কেন মনে হলো, আমি বাংলা ভাষা না বুঝে ইংরেজি ভালো বুঝব? আর আপনাকে টিজ করলাম কোথায়?' তিনি আরো রেগে গিয়ে আবার ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন, 'আমি কী করি? তাঁকে জানালাম, আমি একজন নাগরিক। মাঝেমধ্যে সংবাদপত্রে লেখালেখি করি, ফ্রিল্যান্স কলাম লিখি।' তিনি যৌক্তিকভাবে সংবাদপত্রের কার্ড দেখতে চাইলেন। কিন্তু আমি তাঁকে তা দেখাতে পারলাম না। এরপর তিনি বললেন, 'আপনি মিথ্যা কথা বলছেন। আপনি কিসের সাংবাদিক? আপনাকে এখন গ্রেপ্তার করব।' তাঁর কথায় যুক্তি আছে। আমি তাঁকে কোনো সাংবাদিক পরিচয়পত্র দেখাতে পারিনি। তিনি অদূরে একটি ঘরে বসে থাকা তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বললেন আমার ব্যাপারে। তিনি সব কিছু শুনে চুপ করে রইলেন। আমি অবস্থা বেগতিক দেখে বারবার সরি বললাম। ঊর্ধ্বতন ট্রাফিক ভাই আমাকে বললেন, 'এ রকম আর করবেন না, এখন যান।' আমি শুনলাম, প্রথম ট্রাফিক ভাই বলছেন, 'দেশে দুই নম্বর সাংবাদিক বেশি হয়ে গেছে।'
আমি মৌচাক মোড়ে এসে আরেকজন ট্রাফিক ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, 'মৌচাক থেকে বাংলামোটরের দূরত্ব কত?' তিনি সুন্দরভাবে হেসে জানালেন, 'পৌনে দুই কিলোমিটার।' আমি তাঁকে ওপরে বর্ণিত ঘটনাটি বললাম। তিনি একটি দার্শনিক উত্তর দিলেন, এবারও হেসে_'ভাই, জগতের সব মানুষ তো এক না।' বলেই একটি শিশু আর তার মাকে নিরাপদে রাস্তা পার হওয়ার জন্য হাত তুলে রাস্তাটা তাদের জন্য নিরাপদ করে দিলেন।
ওপরের দুটি ঘটনা আমি কালের কণ্ঠের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলনকে জানিয়ে বললাম, ফ্রিল্যান্স কলাম লেখকদের কোনো ধরনের সাংবাদিক পরিচয়পত্র দেওয়ার নিয়ম আছে কি না। তিনি জানালেন, নিয়ম নেই, তবে এ বিষয়ে তাঁরা সভা করবেন। তিনি আরো বললেন, ট্রাফিকের বিষয় দুটি আমি লিখতে পারি তো। আমি তাঁকে বললাম, 'হ্যাঁ লিখতে পারি। আমি ওই দুই ট্রাফিক ভাইয়ের নামও জানি। নাম দিয়ে লিখলে প্রথম ট্রাফিক ভাই চাকরিগত কোনো অসুবিধায় পড়লে আমাকে পুলিশ দিয়ে গ্রেপ্তার করাতে পারেন। তিনি পথের সঠিক দূরত্ব আমাকে বলতে পারেননি_এটা আর কেউ দেখবে না। তখন কী হবে?' মিলন একটু ভেবে বললেন, 'হতে পারে, লেখার দরকার নেই।'
আমি পরে ভাবলাম, একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকও পুলিশের ইদানীংকার কাজকর্মে ভীত। আমরা জেনেছি, পুলিশ জনতার কাছে তরুণকে তুলে দিচ্ছে মারার জন্য। কাদের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তরুণকে খামাখাই তুলে নিয়ে, দোষী বানিয়ে পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠাচ্ছে। আমরা আইনি ব্যবস্থার ধারক-বাহকদের কাছ থেকে মানবিক সহযোগিতা পাচ্ছি না। এ বিষয়গুলো আমার সম্পাদক বন্ধুর মাথায় ছিল বলেই হয়তো তিনি আমাকে ট্রাফিক পুলিশ সম্পর্কে লিখতে বারণ করেছিলেন।
পুনশ্চ : পাঠক, খেয়াল করুন, আমি ট্রাফিক ভাইদের নাম ভয় থেকেই লিখিনি।
লেখক : কবি
'এমন দেশটি'র বিশেষ বিশেষ বিবেকবান মানুষের আচার-ব্যবহারবিধির মাত্রা নির্ধারিত হয় 'সাধারণ মানুষ' এবং 'বিখ্যাত মানুষ'দের মৃত্যুবিষয়ক গ্রহণ-বর্জনের ওপর।
ঘটনাটি ঈদের কয়েক দিন আগের। আমি একজন ট্রাফিক ভাইকে একটি পথের দূরত্ব কত জিজ্ঞেস করেছিলাম। যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম, তখন তিনি ব্যস্ত ছিলেন একটি গাড়ির কাগজপত্র দেখা নিয়ে। ঈদের আগে কেন যে চলমান গাড়িগুলোর কাগজপত্র বেশি বেশি দেখা হয়, তার কারণ আমার অজানা। তো, ওই ট্রাফিক ভাই বেশ বিরক্ত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন কী আমার জিজ্ঞাসা। পথের দূরত্ব কত? আমার প্রশ্নে ট্রাফিক ভাই, তিন রকম সংখ্যা বললেন। আমি বললাম, মৌচাক থেকে এ পর্যন্ত দূরত্ব তিন রকম হতে পারে না_আপনার তো সঠিক দূরত্ব জানার কথা। তিনি আমার কথায় খুব রেগে গেলেন। তিনি ইংরেজিতে কথা বললেন, যার মূল বক্তব্য, আমি নাকি তাঁকে 'টিজ' করেছি। আমি বললাম, 'আচ্ছা, আমার চেহারা দেখে আপনার কেন মনে হলো, আমি বাংলা ভাষা না বুঝে ইংরেজি ভালো বুঝব? আর আপনাকে টিজ করলাম কোথায়?' তিনি আরো রেগে গিয়ে আবার ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন, 'আমি কী করি? তাঁকে জানালাম, আমি একজন নাগরিক। মাঝেমধ্যে সংবাদপত্রে লেখালেখি করি, ফ্রিল্যান্স কলাম লিখি।' তিনি যৌক্তিকভাবে সংবাদপত্রের কার্ড দেখতে চাইলেন। কিন্তু আমি তাঁকে তা দেখাতে পারলাম না। এরপর তিনি বললেন, 'আপনি মিথ্যা কথা বলছেন। আপনি কিসের সাংবাদিক? আপনাকে এখন গ্রেপ্তার করব।' তাঁর কথায় যুক্তি আছে। আমি তাঁকে কোনো সাংবাদিক পরিচয়পত্র দেখাতে পারিনি। তিনি অদূরে একটি ঘরে বসে থাকা তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বললেন আমার ব্যাপারে। তিনি সব কিছু শুনে চুপ করে রইলেন। আমি অবস্থা বেগতিক দেখে বারবার সরি বললাম। ঊর্ধ্বতন ট্রাফিক ভাই আমাকে বললেন, 'এ রকম আর করবেন না, এখন যান।' আমি শুনলাম, প্রথম ট্রাফিক ভাই বলছেন, 'দেশে দুই নম্বর সাংবাদিক বেশি হয়ে গেছে।'
আমি মৌচাক মোড়ে এসে আরেকজন ট্রাফিক ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, 'মৌচাক থেকে বাংলামোটরের দূরত্ব কত?' তিনি সুন্দরভাবে হেসে জানালেন, 'পৌনে দুই কিলোমিটার।' আমি তাঁকে ওপরে বর্ণিত ঘটনাটি বললাম। তিনি একটি দার্শনিক উত্তর দিলেন, এবারও হেসে_'ভাই, জগতের সব মানুষ তো এক না।' বলেই একটি শিশু আর তার মাকে নিরাপদে রাস্তা পার হওয়ার জন্য হাত তুলে রাস্তাটা তাদের জন্য নিরাপদ করে দিলেন।
ওপরের দুটি ঘটনা আমি কালের কণ্ঠের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলনকে জানিয়ে বললাম, ফ্রিল্যান্স কলাম লেখকদের কোনো ধরনের সাংবাদিক পরিচয়পত্র দেওয়ার নিয়ম আছে কি না। তিনি জানালেন, নিয়ম নেই, তবে এ বিষয়ে তাঁরা সভা করবেন। তিনি আরো বললেন, ট্রাফিকের বিষয় দুটি আমি লিখতে পারি তো। আমি তাঁকে বললাম, 'হ্যাঁ লিখতে পারি। আমি ওই দুই ট্রাফিক ভাইয়ের নামও জানি। নাম দিয়ে লিখলে প্রথম ট্রাফিক ভাই চাকরিগত কোনো অসুবিধায় পড়লে আমাকে পুলিশ দিয়ে গ্রেপ্তার করাতে পারেন। তিনি পথের সঠিক দূরত্ব আমাকে বলতে পারেননি_এটা আর কেউ দেখবে না। তখন কী হবে?' মিলন একটু ভেবে বললেন, 'হতে পারে, লেখার দরকার নেই।'
আমি পরে ভাবলাম, একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকও পুলিশের ইদানীংকার কাজকর্মে ভীত। আমরা জেনেছি, পুলিশ জনতার কাছে তরুণকে তুলে দিচ্ছে মারার জন্য। কাদের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তরুণকে খামাখাই তুলে নিয়ে, দোষী বানিয়ে পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠাচ্ছে। আমরা আইনি ব্যবস্থার ধারক-বাহকদের কাছ থেকে মানবিক সহযোগিতা পাচ্ছি না। এ বিষয়গুলো আমার সম্পাদক বন্ধুর মাথায় ছিল বলেই হয়তো তিনি আমাকে ট্রাফিক পুলিশ সম্পর্কে লিখতে বারণ করেছিলেন।
পুনশ্চ : পাঠক, খেয়াল করুন, আমি ট্রাফিক ভাইদের নাম ভয় থেকেই লিখিনি।
লেখক : কবি
No comments