সাদাকালো-ওয়াশিংটন ও তার বেয়াড়া সহযাত্রী by আহমদ রফিক
দীর্ঘ ঘুমের পর জেগে উঠেছেন পিএলও নেতা মাহমুদ আব্বাস। হঠাৎ করেই বারাক ওবামা ও নেতানিয়াহুকে চমকে দিয়ে তিনি ঘোষণা করেছেন, স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের দাবিতে জাতিসংঘে আবেদন জানাবেন। যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের 'নীলমণি সন্তান' ইসরায়েলের মাথায় বাজ পড়ার উপক্রম। প্রথমে অনুরোধ, পরে হুমকি এবং তা দুই তরফ থেকেই। কিন্তু নিজ সিদ্ধান্তে অটল মাহমুদ আব্বাস। নম্র মেরুদণ্ড মাহমুদ আব্বাসের এমন ভূমিকায় সবাই চমকিত।
ইয়াসির আরাফাতের রহস্যময় মৃত্যুর পর থেকে দীর্ঘদিন এ মানুষটিকে ফিলিস্তিনের জাতীয় স্বার্থের পক্ষে জোর গলায় কথা বলতে শোনা যায়নি। বরং হামাসের সঙ্গে সংঘাতে গিয়ে জাতিকে বিভাজিত করার অনাকাঙ্ক্ষিত পথই ছিল তাঁর রাজনীতির মূলকথা। উদ্দেশ্য উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনিদের আশা-আকাঙ্ক্ষার একক প্রতিনিধি হিসেবে শক্তি সংহত করা এবং আপসবাদিতায় হাত পাকানো। এমনটাই ছিল তাবৎ মাহমুদ আব্বাসের রাজনীতির ধারা।
গোটা বিষয়টা অর্থাৎ মাহমুদ আব্বাসের স্বভাববিরুদ্ধ ভূমিকা আমার কাছে রহস্যময়ই মনে হচ্ছে। কারণ মাহমুদ আব্বাস ইয়াসির আরাফাত নন। তবু ভালো, শেষ পর্যন্ত তাঁর ঘুম ভেঙেছে এবং তাঁর বর্তমান ভূমিকায় দলীয় বিরোধিতার মধ্যেও হামাসের সমর্থন থাকবে বলাই বাহুল্য। কারণ সেখানে থাকবে ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর একাট্টা সমর্থন। যদিও সবাই জানি, ওয়াশিংটন-তেল আবিব এ প্রস্তাব পাস হতে দেবে না, এমনকি প্রস্তাব উপস্থাপন করাতেই বাগড়া দেবে। ওবামা তো প্রকাশ্যেই বলেছেন এ প্রস্তাবে ভেটো দেওয়ার কথা।
বারাক ওবামা। কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট ওবামার নির্বাচনপূর্ব বক্তৃতা ও নির্বাচনী ইশতেহার ঘিরে বিশ্বের সাধারণ মানুষের কী প্রত্যাশাই না ছিল! একমাত্র সংশয়বাদী ও প্রগতিবাদীদের একাংশের ভবিষ্যদ্বাণী ছিল তিনি হোয়াইট হাউসের ইসরায়েলি বিষচক্রের বিরুদ্ধে ফলপ্রসূ কিছু করতে পারবেন না, ফিলিস্তিনি প্রশ্নে তো নয়ই। অসলো চুক্তি, রোডম্যাপ ইত্যাদি নিয়ে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের হাতেই অগ্রগতি ঘটল না, আর বারাক ওবামা। তবু কিছুসংখ্যক মানুষের প্রত্যাশা ছিল তাঁর কাছে, বিশ্বাস ছিল তাঁর প্রতি। কিন্তু তাঁর বড় সমস্যা তাঁর দেহরং, তাঁর বংশগত অবস্থান। তবু তাঁর প্রাথমিক বলিষ্ঠতা অনেকের মধ্যে আশাবাদ তৈরি করেছিল। ভেবেছিল, তিনি হবেন ব্যতিক্রমী মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তাঁর কথিত নৈতিক গুরু লিংকনের মতো। না, তিনি পারেননি। হার মেনেছেন নৈতিকতা এবং সম্ভবত দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার আকাঙ্ক্ষার কাছে। আত্মসমর্পণ করেছেন ইহুদিবাদী লবির কাছে, ইসরায়েলের কাছে। যে ইসরায়েল রাজনৈতিক তৎপরতায় ফিলিস্তিনিদের আজরাইল বটে। এবং আজরাইল মধ্যপ্রাচ্যসহ জাতীয়তাবাদী আরববিশ্বের জন্য।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষে নাৎসি বর্বরতার কারণে ইহুদিদের প্রতি মানুষের সহানুভূতি ছিল ব্যাপকভাবে। ছিল আমাদেরও। তবু ইঙ্গ-মার্কিন চাপের মুখে ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে এককভাবে শুধু ইসরায়েলি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, তাও আবার ফিলিস্তিনিদেরই ভূখণ্ডে এবং তাতে স্তালিনের সম্মতি অনেককে অবাক ও হতাশ করেছিল। তখন থেকেই ইসরায়েলি একগুঁয়েমি ও ইহুদি-শোভিনিজমের সূচনা ক্রমে বেড়ে নিষ্ঠুর নৃশংসতায় পেঁৗছেছে_ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে আচরণে তারা নাৎসিদের কাছাকাছি পেঁৗছে গেছে। বৃথাই শেঙ্পিয়ার অঙ্কিত শাইলক চরিত্রের সমালোচনা।
ইসরায়েলি একগুঁয়েমি ও যুক্তিহীন স্বার্থপরতার মূল কারণ তাদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অন্ধ সমর্থন_এদিক থেকে ডেমোক্রেটিক, রিপাবলিকান মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। ব্যক্তিবিশেষের আচরণে কখনো সামান্য কিছু ব্যতিক্রম। তা ছাড়া রয়েছে ইসরায়েলের সামরিক শক্তি (হয়তো আণবিকও), হোক না অতি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আরব-অনৈক্য এবং ফিলিস্তিনি দাবির প্রতি তাদের একাট্টা সমর্থনের অভাব। ভাবতে অবাক লাগে, নাসেরের দেশ মিসরও এদিক থেকে ব্যতিক্রম নয়। সম্প্রতি ইসরায়েলের কাছে ভালো ধাক্কা খেয়েছে ত্রাণ সহায়তা দিতে গিয়ে মিসর ও তুরস্ক। তুরস্কের দৃঢ় প্রতিক্রিয়া অভিনন্দনযোগ্য, তেমনি মিসরে ইসরায়েলি দূতাবাস আক্রমণ। সম্ভবত তরুণ বিদ্রোহীদের হাতে।
তবে এ প্রসঙ্গে অস্বীকার করা যাবে না, ফিলিস্তিনি নেতাদের ভুলভ্রান্তিও তাদের দুর্দশার জন্য কিছুটা হলেও দায়ী। ফিলিস্তিনি গ্র্যান্ড মুফতির পক্ষে সম্ভব ছিল না ব্রিটিশ চাতুরী ও রাজনৈতিক খেলার মুখে সমঝোতায় আসা। কিন্তু ইসরায়েলি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পর্বে কিছুটা নমনীয় ইসরায়েলের সঙ্গে কিছুটা ছাড় দিয়ে হলেও সমঝোতা চুক্তির পথ ধরা উচিত ছিল ফিলিস্তিনি নেতাদের। তখন তাঁদেরও ছিল যুক্তিহীন একগুঁয়েমি। বিশ্বমোড়লদের ইচ্ছায় গড়া ইহুদি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতিদানে মহাভারত অশুদ্ধ হতো না।
তাঁদের ধারণা ছিল, ছোট্ট ইসরায়েল রাষ্ট্রকে জর্দান নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া অসম্ভব হবে না। এটা ছিল আসলে রাজনৈতিক বিচক্ষণতার অভাব এবং বাস্তবতাকে অস্বীকার। যেমন ১৯৪৭-পরবর্তী বেশ কিছুকাল ভারতীয় ডানপন্থী নেতাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, পাকিস্তান টিকবে না। যে জন্য সে সময় কথায় কথায় পাকিস্তানি নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে বলতে শুনেছি, 'পাকিস্তান টিকে থাকতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।' (পাকিস্তান হ্যাজ কাম টু স্টে)। এ মন্ত্র উচ্চারণ ছিল আত্মবিশ্বাসে শান দেওয়া। সব কিছু দেখেশুনে যুক্তরাষ্ট্র হাল ধরেছিল দুর্বল পাকিস্তানের_অর্থ, অস্ত্র, প্রশিক্ষণ, সামরিক সমর্থন এবং সব শেষে দেশটির লাগাম হাতে নেওয়ার।
পরাশক্তি যেখানে অন্ধ সহায়ক, সেখানে তাকে ভাসিয়ে দেওয়া যে খুবই কঠিন কাজ, এ সত্যটা ফিলিস্তিনি নেতাদের কেউ বুঝতে পারেননি। এমনকি পারেননি ইয়াসির আরাফাত থেকে জর্জ হাবাস। অবশ্য আরাফাত শেষ মুহূর্তে বুঝেশুনেই অসলো শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। কিন্তু তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ইসরায়েল তখন ফুলেফেঁপে অনেক মোটা হয়ে গেছে, তাদের আত্মবিশ্বাসও অনেক অনেক বেড়ে গেছে। তাদের দাবিও যুক্তি অতিক্রম করে গেছে।
কেন জানি ফিলিস্তিন সমস্যাটা জেরুজালেমের গ্র্যান্ড মুফতির সংগ্রামী কাহিনী পড়ার পর ছাত্রজীবন থেকেই আমাকে পেয়ে বসেছিল। অনেক লেখা এ বিষয়টা নিয়ে। জানি, এসব লেখায় কিছু হয় না। তবু নৈতিক দায়মোচন বলে একটা কথা আছে না? এ যে এখন লিখছি, সেটাও ওই বুদ্ধিবৃত্তির দায়মোচনের অংশ। যেমন দেখি 'ইনডিপেনডেন্ট'-এ সাংবাদিক রবার্ট ফিস্ক ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর দুর্দশা ও ইসরায়েলি বর্বরতা নিয়ে যুক্তিসংগতভাবে ফিলিস্তিনের পক্ষ নিয়ে লিখতে দ্বিধা করেন না।
কিন্তু কোনো যুক্তিতেই ইসরায়েলের মন গলছে না। তা যুক্তিগ্রাহ্য সমাধানের পক্ষে শ্বেতাঙ্গ ফিস্ক বা বাংলাদেশের কলামিস্টরা যতই লিখুন না কেন। গলছে না হোয়াইট হাউসের কৃষ্ণাঙ্গ হৃদয় কিংবা সংখ্যাগরিষ্ঠ সিনেটরদের। ফিলিস্তিনি আরবদের মর্মন্তুদ দুর্দশার কাহিনীর চেয়ে স্বদেশে জনপ্রিয়তা ধরে রাখা বারাক ওবামার জন্য অনেক বেশি জরুরি। মনে হচ্ছে, তাঁর আদর্শবাদী কর্থাবার্তার পেছনে সততা ও আন্তরিকতার অভাব ছিল।
তাই গাজায় অন্যায় ও অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপন, অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনি জনতার জন্য বিদেশি ত্রাণবাহী জাহাজে ইসরায়েলি গোলাবর্ষণ এবং তার ফলে মৃত্যুর ঘটনা একদা-নির্যাতিত কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর বংশধর ওবামার হৃদয় স্পর্শ করছে না। রাজনীতিবিদদের নাকি হৃদয় বলতে কিছু নেই। অথচ একদা শুনেছি হৃদয়বৃত্তির তাড়নায় মানুষের জন্য ভালো কিছু করার জন্যই নাকি রাজনীতি। কিন্তু সব কিছু ওলটপালট হয়ে গেছে। কিছু ব্যতিক্রম বাদে স্বার্থবাদিতার নামই এখন রাজনীতি।
রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি ও কিছুটা ভাষা ধার করে বলি, লোভ ও স্বার্থপরতার সঙ্গে রাজনীতির গান্ধর্ব বিয়ে ঘটে গেছে। শক্তির সঙ্গে শক্তির মোকাবিলা ছাড়া রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। বর্তমান ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানে তাই দরকার আরববিশ্বের পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনিদের দাবিতে একাট্টা সমর্থন। কিন্তু সেটা যে হওয়ার নয়। এ কে তো আরববিশ্ব কথিত জনবিদ্রোহে নাজেহাল, তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন। এমন কোনো বিচক্ষণ, আকর্ষণীয় ভাবমূর্তিসম্পন্ন আরব নেতা তথা রাজনীতিবিদ নেই, যিনি সবাইকে আরব স্বার্থে একমঞ্চে গভীর আন্তরিকতায় দাঁড় করাতে পারেন।
পারেননি গণতন্ত্রী মিসরের প্রতিষ্ঠাতা নাসের। সে পথে হাঁটেননি রাজতন্ত্রী লিবিয়ার মুক্তিদাতা গাদ্দাফি। সম্ভাবনা ছিল আলজেরীয় বিপ্লবীদের। কিন্তু আত্মকলহে তাদের সব কিছু শেষ হয়ে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যের বেশির ভাগ দেশই তো অনাচারী রাজন্য বা স্বৈরতন্ত্রশাসিত। ব্যক্তিস্বার্থের বাইরে অন্য কোনো হিসাব তাদের নেই। তেলভাণ্ডার তাদের সর্বনাশ করে ছেড়েছে। ডেকে এনেছে মাংসাশী নেকড়েদের, তাদের সঙ্গে হয়ে গেছে স্বার্থের বোঝাপড়া। সেই কবে তিউনিসিয়া নিয়ে প্রগতিবাদীদের কাব্য পঙ্ক্তি রচনা_সব বিফলে গেছে।
এবার ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের দাবি জাতিসংঘে উপস্থাপনের আব্বাসীয় ঘটনা নিয়ে কথা। যে উদ্দীপনায়ই হোক, আমার ধারণা এ পদক্ষেপের ইতিবাচক দিকটাই বড় কথা। আর দুর্দান্ত দুই রাষ্ট্রীয় শক্তির উন্মাতাল বিরোধিতায় মনে হতে পারে, এ পদক্ষেপ কিছুটা হলেও সঠিক, অন্তত চাপ সৃষ্টির জন্য তো বটেই। তাতে কিছুটা যে কাজ হতে পারে, তার ইঙ্গিত মিলছে জঙ্গিবাদী ইহুদি প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে আলোচনার আহ্বানে।
প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর প্রস্তাব জাতিসংঘের অধিবেশন উপলক্ষে নিউ ইয়র্কে বা অন্যত্র বসে বিষয়টির আলোচনা। মাহমুদ আব্বাসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে শর্ত সাপেক্ষে আলোচনার কথা। শর্ত যত্রতত্র এমনকি জেরুজালেমেও ইহুদি বসতি স্থাপন বন্ধ করা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অঙ্গীকারনির্ভর আলোচনা, যাতে আলোচনা-উত্তর সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে কার্যকর করা সম্ভব হয়। কিন্তু এ আলোচনা নিয়ে আমি খুব একটা আশাবাদী নই।
কারণ এর আগে অনেক আলোচনা হয়েছে, এমনকি মার্কিন প্রতিনিধি সঙ্গে রেখেও হয়েছে। কিন্তু ইসরায়েলের একগুঁয়েমির জন্য কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই আলোচনা শেষ হয়েছে। অর্থাৎ আলোচনা ভেঙে গেছে মূলত জেরুজালেম প্রসঙ্গ নিয়ে বিতর্কে। জেরুজালেম ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলমান_এই তিন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্যই পবিত্র তথা গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এখানে ইহুদিদের একক আধিপত্যের পেছনে কোনো যুক্তি নেই। কিন্তু জেরুজালেম নিয়েই যত গোঁ ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের। তা ছাড়া সীমান্ত নিয়েও রয়েছে মতভেদ, বিতর্ক। ফিলিস্তিনিদের দাবি ১৯৬৭-র যুদ্ধপূর্ব সীমানার স্বীকৃতি। এ দাবি যুক্তিসংগত এ জন্য যে সাম্প্রতিক যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে জবরদখল করা ভূমি তো ন্যায্য অধিকারের নয়।
সে জন্যই বলতে হয়, কোনো আলোচনাই ইতিবাচক ফল তৈরি করে না, যখন যুক্তি ও সদিচ্ছা সে আলোচনায় প্রাধান্য না পায়। শুধু ইহুদি-আরবই নয়, বহু আলোচনাই নানা দেশে সদিচ্ছার অভাবে ভেঙে যেতে দেখা গেছে। ভারত-বাংলাদেশের রাজনৈতিক সাম্প্রতিক আলোচনাও তেমন একটা উদাহরণ। বছরের পর বছর কেটে গেছে এবং কেটে যায় শুধু আলোচনা আর আলোচনার টেবিলে; সমাধান মেলে না।
সে জন্যই মাহমুদ আব্বাসকে আজ দুই ফ্রন্ট খোলা রেখে তাত্তি্বক লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। এক. জাতিসংঘে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রস্তাব উত্থাপন; দুই. ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনা। সে আলোচনা ত্রিপক্ষীয় বা চতুষ্পক্ষীয়। তবে মুশকিল হলো, চতুর ও মেধাবী ইহুদিপক্ষের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনায় ফিলিস্তিনি আরব পক্ষ কতটা দড় তার ওপর নির্ভর করবে আলোচনার ফলাফল। অর্থাৎ ঝোল কার পাতে বেশি যাবে।
আলোচনা ছাড়া বিকল্প পন্থাও নেই। অস্ত্রশক্তিতে সমস্যার সমাধান বর্তমান অবস্থায় সম্ভব নয়। আগেও বলেছি, আবারও বলি, সমাধানের পথে বড় সম্ভাবনা হলো তেলসমৃদ্ধ আরব রাষ্ট্র ও আরব লীগের যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপ সৃষ্টি, যাতে ওয়াশিংটন তার বেয়াড়া সহযোগী শক্তিকে পথে আনতে পারে। তা না হলে কোনো শান্তিচুক্তি বা আলোচনাই উভয় পক্ষে গ্রহণযোগ্য সমাধান এনে দিতে পারবে না। সে ক্ষেত্রে আফ্রো-এশীয় দেশগুলোর ফিলিস্তিনিদের নৈতিক সমর্থনও জরুরি_দরকার একটা বৈশ্বিক চাপ চীন-রাশিয়াসহ। ফিলিস্তিনি কূটনীতি এদিক থেকে আরো ব্যাপক ও দূরদর্শী হতে না পারলে সমর্থনের পাল্লা জোরদার হবে না। এ লেখা যখন ছাপা হবে, তার আগেই হয়তো ফিলিস্তিনি প্রস্তাব প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
লেখক : রবীন্দ্র গবেষক, কবি, প্রাবন্ধিক ও ভাষাসংগ্রামী
গোটা বিষয়টা অর্থাৎ মাহমুদ আব্বাসের স্বভাববিরুদ্ধ ভূমিকা আমার কাছে রহস্যময়ই মনে হচ্ছে। কারণ মাহমুদ আব্বাস ইয়াসির আরাফাত নন। তবু ভালো, শেষ পর্যন্ত তাঁর ঘুম ভেঙেছে এবং তাঁর বর্তমান ভূমিকায় দলীয় বিরোধিতার মধ্যেও হামাসের সমর্থন থাকবে বলাই বাহুল্য। কারণ সেখানে থাকবে ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর একাট্টা সমর্থন। যদিও সবাই জানি, ওয়াশিংটন-তেল আবিব এ প্রস্তাব পাস হতে দেবে না, এমনকি প্রস্তাব উপস্থাপন করাতেই বাগড়া দেবে। ওবামা তো প্রকাশ্যেই বলেছেন এ প্রস্তাবে ভেটো দেওয়ার কথা।
বারাক ওবামা। কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট ওবামার নির্বাচনপূর্ব বক্তৃতা ও নির্বাচনী ইশতেহার ঘিরে বিশ্বের সাধারণ মানুষের কী প্রত্যাশাই না ছিল! একমাত্র সংশয়বাদী ও প্রগতিবাদীদের একাংশের ভবিষ্যদ্বাণী ছিল তিনি হোয়াইট হাউসের ইসরায়েলি বিষচক্রের বিরুদ্ধে ফলপ্রসূ কিছু করতে পারবেন না, ফিলিস্তিনি প্রশ্নে তো নয়ই। অসলো চুক্তি, রোডম্যাপ ইত্যাদি নিয়ে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের হাতেই অগ্রগতি ঘটল না, আর বারাক ওবামা। তবু কিছুসংখ্যক মানুষের প্রত্যাশা ছিল তাঁর কাছে, বিশ্বাস ছিল তাঁর প্রতি। কিন্তু তাঁর বড় সমস্যা তাঁর দেহরং, তাঁর বংশগত অবস্থান। তবু তাঁর প্রাথমিক বলিষ্ঠতা অনেকের মধ্যে আশাবাদ তৈরি করেছিল। ভেবেছিল, তিনি হবেন ব্যতিক্রমী মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তাঁর কথিত নৈতিক গুরু লিংকনের মতো। না, তিনি পারেননি। হার মেনেছেন নৈতিকতা এবং সম্ভবত দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার আকাঙ্ক্ষার কাছে। আত্মসমর্পণ করেছেন ইহুদিবাদী লবির কাছে, ইসরায়েলের কাছে। যে ইসরায়েল রাজনৈতিক তৎপরতায় ফিলিস্তিনিদের আজরাইল বটে। এবং আজরাইল মধ্যপ্রাচ্যসহ জাতীয়তাবাদী আরববিশ্বের জন্য।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষে নাৎসি বর্বরতার কারণে ইহুদিদের প্রতি মানুষের সহানুভূতি ছিল ব্যাপকভাবে। ছিল আমাদেরও। তবু ইঙ্গ-মার্কিন চাপের মুখে ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে এককভাবে শুধু ইসরায়েলি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, তাও আবার ফিলিস্তিনিদেরই ভূখণ্ডে এবং তাতে স্তালিনের সম্মতি অনেককে অবাক ও হতাশ করেছিল। তখন থেকেই ইসরায়েলি একগুঁয়েমি ও ইহুদি-শোভিনিজমের সূচনা ক্রমে বেড়ে নিষ্ঠুর নৃশংসতায় পেঁৗছেছে_ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে আচরণে তারা নাৎসিদের কাছাকাছি পেঁৗছে গেছে। বৃথাই শেঙ্পিয়ার অঙ্কিত শাইলক চরিত্রের সমালোচনা।
ইসরায়েলি একগুঁয়েমি ও যুক্তিহীন স্বার্থপরতার মূল কারণ তাদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অন্ধ সমর্থন_এদিক থেকে ডেমোক্রেটিক, রিপাবলিকান মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। ব্যক্তিবিশেষের আচরণে কখনো সামান্য কিছু ব্যতিক্রম। তা ছাড়া রয়েছে ইসরায়েলের সামরিক শক্তি (হয়তো আণবিকও), হোক না অতি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আরব-অনৈক্য এবং ফিলিস্তিনি দাবির প্রতি তাদের একাট্টা সমর্থনের অভাব। ভাবতে অবাক লাগে, নাসেরের দেশ মিসরও এদিক থেকে ব্যতিক্রম নয়। সম্প্রতি ইসরায়েলের কাছে ভালো ধাক্কা খেয়েছে ত্রাণ সহায়তা দিতে গিয়ে মিসর ও তুরস্ক। তুরস্কের দৃঢ় প্রতিক্রিয়া অভিনন্দনযোগ্য, তেমনি মিসরে ইসরায়েলি দূতাবাস আক্রমণ। সম্ভবত তরুণ বিদ্রোহীদের হাতে।
তবে এ প্রসঙ্গে অস্বীকার করা যাবে না, ফিলিস্তিনি নেতাদের ভুলভ্রান্তিও তাদের দুর্দশার জন্য কিছুটা হলেও দায়ী। ফিলিস্তিনি গ্র্যান্ড মুফতির পক্ষে সম্ভব ছিল না ব্রিটিশ চাতুরী ও রাজনৈতিক খেলার মুখে সমঝোতায় আসা। কিন্তু ইসরায়েলি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পর্বে কিছুটা নমনীয় ইসরায়েলের সঙ্গে কিছুটা ছাড় দিয়ে হলেও সমঝোতা চুক্তির পথ ধরা উচিত ছিল ফিলিস্তিনি নেতাদের। তখন তাঁদেরও ছিল যুক্তিহীন একগুঁয়েমি। বিশ্বমোড়লদের ইচ্ছায় গড়া ইহুদি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতিদানে মহাভারত অশুদ্ধ হতো না।
তাঁদের ধারণা ছিল, ছোট্ট ইসরায়েল রাষ্ট্রকে জর্দান নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া অসম্ভব হবে না। এটা ছিল আসলে রাজনৈতিক বিচক্ষণতার অভাব এবং বাস্তবতাকে অস্বীকার। যেমন ১৯৪৭-পরবর্তী বেশ কিছুকাল ভারতীয় ডানপন্থী নেতাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, পাকিস্তান টিকবে না। যে জন্য সে সময় কথায় কথায় পাকিস্তানি নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে বলতে শুনেছি, 'পাকিস্তান টিকে থাকতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।' (পাকিস্তান হ্যাজ কাম টু স্টে)। এ মন্ত্র উচ্চারণ ছিল আত্মবিশ্বাসে শান দেওয়া। সব কিছু দেখেশুনে যুক্তরাষ্ট্র হাল ধরেছিল দুর্বল পাকিস্তানের_অর্থ, অস্ত্র, প্রশিক্ষণ, সামরিক সমর্থন এবং সব শেষে দেশটির লাগাম হাতে নেওয়ার।
পরাশক্তি যেখানে অন্ধ সহায়ক, সেখানে তাকে ভাসিয়ে দেওয়া যে খুবই কঠিন কাজ, এ সত্যটা ফিলিস্তিনি নেতাদের কেউ বুঝতে পারেননি। এমনকি পারেননি ইয়াসির আরাফাত থেকে জর্জ হাবাস। অবশ্য আরাফাত শেষ মুহূর্তে বুঝেশুনেই অসলো শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। কিন্তু তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ইসরায়েল তখন ফুলেফেঁপে অনেক মোটা হয়ে গেছে, তাদের আত্মবিশ্বাসও অনেক অনেক বেড়ে গেছে। তাদের দাবিও যুক্তি অতিক্রম করে গেছে।
কেন জানি ফিলিস্তিন সমস্যাটা জেরুজালেমের গ্র্যান্ড মুফতির সংগ্রামী কাহিনী পড়ার পর ছাত্রজীবন থেকেই আমাকে পেয়ে বসেছিল। অনেক লেখা এ বিষয়টা নিয়ে। জানি, এসব লেখায় কিছু হয় না। তবু নৈতিক দায়মোচন বলে একটা কথা আছে না? এ যে এখন লিখছি, সেটাও ওই বুদ্ধিবৃত্তির দায়মোচনের অংশ। যেমন দেখি 'ইনডিপেনডেন্ট'-এ সাংবাদিক রবার্ট ফিস্ক ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর দুর্দশা ও ইসরায়েলি বর্বরতা নিয়ে যুক্তিসংগতভাবে ফিলিস্তিনের পক্ষ নিয়ে লিখতে দ্বিধা করেন না।
কিন্তু কোনো যুক্তিতেই ইসরায়েলের মন গলছে না। তা যুক্তিগ্রাহ্য সমাধানের পক্ষে শ্বেতাঙ্গ ফিস্ক বা বাংলাদেশের কলামিস্টরা যতই লিখুন না কেন। গলছে না হোয়াইট হাউসের কৃষ্ণাঙ্গ হৃদয় কিংবা সংখ্যাগরিষ্ঠ সিনেটরদের। ফিলিস্তিনি আরবদের মর্মন্তুদ দুর্দশার কাহিনীর চেয়ে স্বদেশে জনপ্রিয়তা ধরে রাখা বারাক ওবামার জন্য অনেক বেশি জরুরি। মনে হচ্ছে, তাঁর আদর্শবাদী কর্থাবার্তার পেছনে সততা ও আন্তরিকতার অভাব ছিল।
তাই গাজায় অন্যায় ও অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপন, অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনি জনতার জন্য বিদেশি ত্রাণবাহী জাহাজে ইসরায়েলি গোলাবর্ষণ এবং তার ফলে মৃত্যুর ঘটনা একদা-নির্যাতিত কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর বংশধর ওবামার হৃদয় স্পর্শ করছে না। রাজনীতিবিদদের নাকি হৃদয় বলতে কিছু নেই। অথচ একদা শুনেছি হৃদয়বৃত্তির তাড়নায় মানুষের জন্য ভালো কিছু করার জন্যই নাকি রাজনীতি। কিন্তু সব কিছু ওলটপালট হয়ে গেছে। কিছু ব্যতিক্রম বাদে স্বার্থবাদিতার নামই এখন রাজনীতি।
রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি ও কিছুটা ভাষা ধার করে বলি, লোভ ও স্বার্থপরতার সঙ্গে রাজনীতির গান্ধর্ব বিয়ে ঘটে গেছে। শক্তির সঙ্গে শক্তির মোকাবিলা ছাড়া রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। বর্তমান ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানে তাই দরকার আরববিশ্বের পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনিদের দাবিতে একাট্টা সমর্থন। কিন্তু সেটা যে হওয়ার নয়। এ কে তো আরববিশ্ব কথিত জনবিদ্রোহে নাজেহাল, তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন। এমন কোনো বিচক্ষণ, আকর্ষণীয় ভাবমূর্তিসম্পন্ন আরব নেতা তথা রাজনীতিবিদ নেই, যিনি সবাইকে আরব স্বার্থে একমঞ্চে গভীর আন্তরিকতায় দাঁড় করাতে পারেন।
পারেননি গণতন্ত্রী মিসরের প্রতিষ্ঠাতা নাসের। সে পথে হাঁটেননি রাজতন্ত্রী লিবিয়ার মুক্তিদাতা গাদ্দাফি। সম্ভাবনা ছিল আলজেরীয় বিপ্লবীদের। কিন্তু আত্মকলহে তাদের সব কিছু শেষ হয়ে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যের বেশির ভাগ দেশই তো অনাচারী রাজন্য বা স্বৈরতন্ত্রশাসিত। ব্যক্তিস্বার্থের বাইরে অন্য কোনো হিসাব তাদের নেই। তেলভাণ্ডার তাদের সর্বনাশ করে ছেড়েছে। ডেকে এনেছে মাংসাশী নেকড়েদের, তাদের সঙ্গে হয়ে গেছে স্বার্থের বোঝাপড়া। সেই কবে তিউনিসিয়া নিয়ে প্রগতিবাদীদের কাব্য পঙ্ক্তি রচনা_সব বিফলে গেছে।
এবার ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের দাবি জাতিসংঘে উপস্থাপনের আব্বাসীয় ঘটনা নিয়ে কথা। যে উদ্দীপনায়ই হোক, আমার ধারণা এ পদক্ষেপের ইতিবাচক দিকটাই বড় কথা। আর দুর্দান্ত দুই রাষ্ট্রীয় শক্তির উন্মাতাল বিরোধিতায় মনে হতে পারে, এ পদক্ষেপ কিছুটা হলেও সঠিক, অন্তত চাপ সৃষ্টির জন্য তো বটেই। তাতে কিছুটা যে কাজ হতে পারে, তার ইঙ্গিত মিলছে জঙ্গিবাদী ইহুদি প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে আলোচনার আহ্বানে।
প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর প্রস্তাব জাতিসংঘের অধিবেশন উপলক্ষে নিউ ইয়র্কে বা অন্যত্র বসে বিষয়টির আলোচনা। মাহমুদ আব্বাসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে শর্ত সাপেক্ষে আলোচনার কথা। শর্ত যত্রতত্র এমনকি জেরুজালেমেও ইহুদি বসতি স্থাপন বন্ধ করা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অঙ্গীকারনির্ভর আলোচনা, যাতে আলোচনা-উত্তর সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে কার্যকর করা সম্ভব হয়। কিন্তু এ আলোচনা নিয়ে আমি খুব একটা আশাবাদী নই।
কারণ এর আগে অনেক আলোচনা হয়েছে, এমনকি মার্কিন প্রতিনিধি সঙ্গে রেখেও হয়েছে। কিন্তু ইসরায়েলের একগুঁয়েমির জন্য কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই আলোচনা শেষ হয়েছে। অর্থাৎ আলোচনা ভেঙে গেছে মূলত জেরুজালেম প্রসঙ্গ নিয়ে বিতর্কে। জেরুজালেম ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলমান_এই তিন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্যই পবিত্র তথা গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এখানে ইহুদিদের একক আধিপত্যের পেছনে কোনো যুক্তি নেই। কিন্তু জেরুজালেম নিয়েই যত গোঁ ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের। তা ছাড়া সীমান্ত নিয়েও রয়েছে মতভেদ, বিতর্ক। ফিলিস্তিনিদের দাবি ১৯৬৭-র যুদ্ধপূর্ব সীমানার স্বীকৃতি। এ দাবি যুক্তিসংগত এ জন্য যে সাম্প্রতিক যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে জবরদখল করা ভূমি তো ন্যায্য অধিকারের নয়।
সে জন্যই বলতে হয়, কোনো আলোচনাই ইতিবাচক ফল তৈরি করে না, যখন যুক্তি ও সদিচ্ছা সে আলোচনায় প্রাধান্য না পায়। শুধু ইহুদি-আরবই নয়, বহু আলোচনাই নানা দেশে সদিচ্ছার অভাবে ভেঙে যেতে দেখা গেছে। ভারত-বাংলাদেশের রাজনৈতিক সাম্প্রতিক আলোচনাও তেমন একটা উদাহরণ। বছরের পর বছর কেটে গেছে এবং কেটে যায় শুধু আলোচনা আর আলোচনার টেবিলে; সমাধান মেলে না।
সে জন্যই মাহমুদ আব্বাসকে আজ দুই ফ্রন্ট খোলা রেখে তাত্তি্বক লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। এক. জাতিসংঘে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রস্তাব উত্থাপন; দুই. ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনা। সে আলোচনা ত্রিপক্ষীয় বা চতুষ্পক্ষীয়। তবে মুশকিল হলো, চতুর ও মেধাবী ইহুদিপক্ষের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনায় ফিলিস্তিনি আরব পক্ষ কতটা দড় তার ওপর নির্ভর করবে আলোচনার ফলাফল। অর্থাৎ ঝোল কার পাতে বেশি যাবে।
আলোচনা ছাড়া বিকল্প পন্থাও নেই। অস্ত্রশক্তিতে সমস্যার সমাধান বর্তমান অবস্থায় সম্ভব নয়। আগেও বলেছি, আবারও বলি, সমাধানের পথে বড় সম্ভাবনা হলো তেলসমৃদ্ধ আরব রাষ্ট্র ও আরব লীগের যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপ সৃষ্টি, যাতে ওয়াশিংটন তার বেয়াড়া সহযোগী শক্তিকে পথে আনতে পারে। তা না হলে কোনো শান্তিচুক্তি বা আলোচনাই উভয় পক্ষে গ্রহণযোগ্য সমাধান এনে দিতে পারবে না। সে ক্ষেত্রে আফ্রো-এশীয় দেশগুলোর ফিলিস্তিনিদের নৈতিক সমর্থনও জরুরি_দরকার একটা বৈশ্বিক চাপ চীন-রাশিয়াসহ। ফিলিস্তিনি কূটনীতি এদিক থেকে আরো ব্যাপক ও দূরদর্শী হতে না পারলে সমর্থনের পাল্লা জোরদার হবে না। এ লেখা যখন ছাপা হবে, তার আগেই হয়তো ফিলিস্তিনি প্রস্তাব প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
লেখক : রবীন্দ্র গবেষক, কবি, প্রাবন্ধিক ও ভাষাসংগ্রামী
No comments