সপ্তাহের হালচাল-ভালোর ভালো সর্বকালে মন্দের ভালো আগে by আব্দুল কাইয়ুম

বাংলা প্রবাদে বলে ভালো সরকারের শুরু বা শেষ, সব সময়ই ভালো, কিন্তু মন্দ সরকারের শুরুতে ভালো দেখা গেলেও শেষের দিকে মন্দ দিকগুলোই প্রকট হয়ে ওঠে। এটা যে কত সত্য, আমাদের দেশে একের পর এক সরকারগুলোর কাজকর্ম দেখলেই বোঝা যায়। নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমানকে সরকার যেভাবে মাথায় তুলছে, এরপর খারাপের আর বাকি থাকে কী? অথচ শুরুতে বেশ কিছু ভালো পদক্ষেপ নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার সুনাম পেয়েছিল।


বিগত আমলের পচা মালগুলো সব বাদ পড়লেন। জয়নাল হাজারি থেকে শুরু করে হাসনাত আবদুল্লাহ, সব আউট! অথচ এখন শামীম ওসমান ইন।
আওয়ামী লীগের বিগত সরকারের সময় যে কয়জন নেতার অপকর্মের জন্য ২০০১ সালের নির্বাচনে তাদের শোচনীয় পরাজয় ঘটেছিল, নারায়ণগঞ্জের এই শামীম ওসমান তাদের অন্যতম ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনি নিজেও সেটা বুঝতেন। তাই ২০০১ সালের নির্বাচনের ফলাফল পুরোপুরি প্রকাশের আগেই তিনি গা ঢাকা দেন। একেবারে দেশ ছেড়ে বাইরে চলে যান। আবার সুযোগ বুঝে এখন দেশে। তাঁকে কাছে টেনে নেওয়ার পদক্ষেপকেই আসলে প্রবাদের সেই মন্দের মন্দ দিকের সূচনা বলে ধরে নেওয়া যায়।
এবার কোরবানির হাট গরুশূন্য হয়ে পড়ে। এ রকম ঘটনা এই প্রথম। অকল্পনীয়। কেন এ রকম হলো তার কোনো ব্যাখ্যা সরকার দেয়নি বা দিতে পারেনি। ফলে যে যার মতো করে ব্যাখ্যা খুঁজে নিয়েছে। সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যাখ্যাটি হলো সিন্ডিকেট! সবাই বলে এবং বিশ্বাস করে যে গরুর দাম বাড়ানোর জন্য ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে পথে পথে গরু আটকে রেখেছে, ঢাকার বাজারে আসতে দেয়নি। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, সরকার কী করেছে? সিন্ডিকেটওয়ালারা কি গরু ধামাচাপা দিয়ে রাখতে পারে? যদি শত শত গরু পথে আটকে রাখে তাহলে তো খালি চোখেই তা দেখা যাবে। তাহলে সরকারের আইনশৃঙ্খলাওয়ালারা কোথায় ছিল? আর যদি সিন্ডিকেট না হয়, তাহলে কেন হলো? একটা ব্যাখ্যা তো লাগবে?
তারপর আসুন চামড়ায়। হঠাৎ ব্যবসায়ীরা বলে বসলেন, চামড়া যে যা দামে পারে বিক্রি করুক। আগে এমনটি চামড়ার বর্গইঞ্চির দামও ঠিক করে দিয়েছে। আর এবার নাকি আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দাম পড়ে গেছে, তাই দাম ঠিক করা যাবে না। ফলে কোরবানির চামড়া নিয়ে বিরাট ঠগবাজি হয়ে গেছে। কোরবানির চামড়ার দামটা গরিবদের দেওয়া হয়। তাই আসলে গরিবদেরকেই ঠকানো হয়েছে। আবার ঈদের পরদিন একটি টিভি চ্যানেলের খবরে শুনলাম, চামড়া সংরক্ষণের জন্য যে লবণ দরকার তার প্রতি বস্তার দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। লবণের অভাবে চামড়া নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এবার ঈদের বাজারে এমন অরাজকতা হয়েছে, বলে শেষ করা যায় না।
পচন শুরু হয় মাথা থেকে। কিন্তু সরকারের সর্ব অঙ্গে শুরু হয়ে গেছে। নরসিংদীর মেয়রকে নৃশংসভাবে খুন করা হলো। আজও কেউ গ্রেপ্তার হলো না। যাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেই খায়রুল কবির খোকন বিএনপির নেতা, যার নামে তেমন কোনো অভিযোগ নেই।
সরকার ডিজিটালের কথা বলে অ্যানালগ চালে খেলছে। অ্যানালগ, মানে পুরোনো পদ্ধতির রাজনীতি। বিগত বিএনপি সরকারের সময় ময়মনসিংহে জঙ্গিরা বোমা হামলা করলে তার দায়ে মুনতাসীর মামুনসহ দেশের সেরা বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক দল ও নাগরিকসমাজের নেতাদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতন চালিয়েছিল। এর আগে আওয়ামী লীগের সরকারের সময় ঝড়ে বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে পড়লে ষড়যন্ত্রের দায়ে বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকাসহ কয়েকজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার ও হয়রানি করেছিল। একটা কিছু ঘটলেই বিরোধী দলকে ফাঁসানোর এই খেলা সেই পুরোনো কাল থেকে চলে আসছে। আজকের ডিজিটাল সরকারও সেই গড়পড়তা চাল দিয়ে চলেছে।
ঈদের দুই দিন আগে থেকে মিল্কভিটা দুধের প্রতি লিটার প্যাকেট বিক্রি হয়েছে ৮৫ টাকা থেকে ৯০ টাকায়। সরকারি দাম ৫৫ টাকা। কদিন আগে ছিল ৫২ টাকা। তারও আগে ছিল ৪৮ টাকা। যা হোক, ৫৫ টাকার দুধের প্যাকেট মানুষকে কিনতে হয়েছে ৯০ টাকায়। কেন? কারণ চাহিদা বেশি, সরবরাহ কম। মিল্কভিটা তো সরকারি প্রতিষ্ঠান। সরকার কি দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে? চাহিদা বাড়ার কারণে কি মিল্কভিটার উৎপাদন ব্যয় এক পয়সাও বেড়েছিল? তাহলে কেন দাম বাড়ল। চোখের ওপর দাম বাড়ল, প্রতি ঈদেই বাড়ে, সরকার কী করে? একবারও কি তদন্ত করেছে? এই যে প্রতি লিটারে ৩৫ টাকা করে বেশি নেওয়া হলো, সেই টাকা কার পকেটে গেল? সরকার যদি মানুষের ভালো চায়, তাহলে তাদের তদন্ত করে দেখা দরকার এই জালিয়াতি ও দুর্নীতির সঙ্গে কারা জড়িত।
জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে অকল্পনীয় হারে। চাল, ডাল, তেল, তরিতরকারি, কোনোটাই বাদ নেই। বাজারে আগুন, যানবাহনে আগুন। ওদিকে সরকার জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বাড়িয়েই চলেছে। ঘুষের বাজারেও আগুন। আগে যে কাজ দু-চার শ টাকায় সারত, এখন সেখানে দু-চার হাজার গুনতে হয়। প্রতিকারের উপায় নেই বলে সবাই নীরবে ঘুষ দিয়ে কাজ আদায় করে নিচ্ছে।
যাতায়াতে যাত্রীরা প্রতিনিয়ত হয়রানি হচ্ছে। ঢাকার বেশির ভাগ রাস্তায় রিকশা বন্ধ। ট্যাক্সি রাস্তায় দুর্লভ। সিএনজি স্বল্প দূরত্বে যায় না। যদি বা রাজি হয়, বলে ১০০ টাকা লাগবে, দূরত্ব যত কমই হোক। মিটারের কথা বললে সদর্পে জানিয়ে দেয়, ওটা নষ্ট। যে কয়টা বাস চলে সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন। নগরে কোনো পরিষ্কার ওয়াশরুম নেই। দুই বা পাঁচ টাকা দিয়ে আপনি সিটি করপোরেশনের যে টয়লেটে যাবেন, তার চেয়ে রাস্তার ড্রেন অনেক পরিষ্কার মনে হবে। মানুষ যাবে কোথায়?
আরেকটা নিকৃষ্ট উদাহরণ হলো শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি। সরকারি দলেরই নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত শুঁটকির হাটে বেড়ালকে চৌকিদার বানানোর কারসাজি ফাঁস করে দিয়েছেন। অনেক সময় বলা হয়, শেয়ারবাজারে উত্থান-পতন থাকবেই। কিন্তু সরকার জেলায় জেলায় ঢোল পিটিয়ে (রোড শো) মধ্যবিত্তদের কেন শেয়ারবাজারে আনার জন্য এত লোভ দেখাতে গিয়েছিল? কার ইন্ধনে ওই পদক্ষেপ নেওয়া হয়? এটা তদন্ত করে দেখা দরকার। যদি ওভাবে ডেকে আনা না হতো, তাহলে তো তাদের আজ ঠকতে হতো না।
যেখানে নতুন বিনিয়োগ তেমন নেই, পুরোনো বিনিয়োগের সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেই, সেখানে সেকেন্ডারি মার্কেটে ধুম তুলে শেয়ারবাজারে মধ্যবিত্ত বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার অর্থ কী? এর পেছনে বড় চক্রান্ত কাজ করেছে। সরকারের তদন্ত কমিটি কিছু চক্রান্তকারীকে চিহ্নিত করেছে। সরকার তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে বরং সর্বসাধারণ্যে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আবার ডেকে এনে শেয়ারবাজার তদারকির দায়িত্বে নিয়োগ দিয়েছে। মধ্যবিত্ত তার সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসেছে। শেয়ারবাজারে অসন্তোষ এখনো চলছে। শেষ কোপটা হয়তো তারাই দেবে।
সরকারের আরেকটা হাস্যকর কারবার দেখলে অবাক হতে হয়। কোনো কিছু ঘটলেই সরকার বলে বিএনপির আমলে এর চেয়ে খারাপ অবস্থা ছিল! ক্রসফায়ার? ওটা তো বিএনপিই শুরু করেছিল! সংসদে বিরোধী দলকে কথা বলতে না দেওয়ার অভিযোগ? বিএনপি তো আরও কম সময় দিত! দলীয় কোন্দল, খুন খারাবি? বিএনপির আমলে কি কম হয়েছে? লোডশেডিং? আরে বিএনপি তো এক ছটাক বিদ্যুতও তৈরি করেনি, শুধু খুঁটি পুতেছে!
এ রকম ব্যখ্যা শুনলে একটা গল্প মনে পড়ে। গ্রামের দুই নাক কাটা তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। কার নাক কাটা বেশি গৌরবের, সেটাই প্রতিপাদ্য বিষয়। দুজনেরই নাক কাটা গেছে চৌর্যবৃত্তির দায়ে। একজন বলছে, ‘তোর নাক কাটা আর মোর নাক কাটা কি সমান? তোর নাক কাটা গেছে বিচারকের রায়ে, কোতোয়ালের তলোয়ারের কোপে। আর আমারটা? রাজার আদেশে, ঢাকে ঢোলে, বাদ্য বাজনা বাজিয়ে, সেপাইয়ের কোপে’!
নাক কাটাদের রাজত্বে মানুষ বড় বিপদে আছে।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.