চরাচর-সেই অন্নছত্র ট্রাস্ট by আলম শাইন
প্রয়াত কণ্ঠশিল্পী ভূপেন হাজারিকার কণ্ঠে গাওয়া 'মানুষ মানুষের জন্যে...' কালজয়ী গানটি শুনলে যে কারো মধ্যে থাকা মানবতাবোধ যেন জেগে ওঠে। পারিপার্শ্বিক চিত্র অবলোকন করে মানুষের মধ্যে হুঁশ ফিরিয়ে আনতে তিনি গানটি বেঁধেছেন। কণ্ঠসেধে সংগ্রাম করেছেন মানুষের মধ্যে মানবতার শিখা প্রজ্বলিত করতে। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে আরো অনেক গান বেঁধেছেন তিনি। সে প্রচেষ্টায় তিনি সফল না ব্যর্থ সেটা বড় কথা নয়-বড় কথা হচ্ছে, তিনি সংগীতপ্রেমীদের হৃদয়ে
স্থায়ীভাবে আসন গেড়ে নিতে সক্ষম হয়েছেন। বিশেষ করে বাংলা ভাষাভাষীদের হৃদয়ে স্থায়ী আসন গেড়েছেন নিঃসন্দেহে। তাই তাঁকেও জানাই সশ্রদ্ধ সালাম।
অপরদিকে এপার বাংলার প্রয়াত জমিদার মদনমোহন পালকে তদ্রূপ সম্মান জানাচ্ছি এ লেখাটার মাধ্যমে। কারণ দুজনই মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখার চেষ্টা করেছেন। যার প্রমাণও রেখেছেন ভূরি ভূরি। মদনমোহন পাল শুধু মানবতার জন্যই আহাজারি করেননি, সৃষ্টি করেছেন এক যুগান্তকারী ইতিহাসও। তিনি ১৯২৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেছেন 'মদনমোহন অন্নছত্র ট্রাস্ট এস্টেট'। এ ট্রাস্টের মাধ্যমে তিনি প্রতিদিন ১০১ জন মানুষকে পেট ভরে খাওয়ানোর রেওয়াজ চালু করেছেন। প্রচলিত রাজনীতিবিদদের মতো তিনি লোকদেখাতে কাজটি করেননি। যদি তাই-ই করতেন, তাহলে তাঁর মৃত্যুর পরও অদ্যাবধি এ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতেন না বোধ করি। অন্য সব জমিদারের মতো তিনি ছিলেন না অহংকারী এবং স্বৈরাচারী মনোভাবের। বরং ছিলেন উল্টোটা। প্রজাদের হিতের কথা চিন্তা করেই শুধু ক্ষান্ত হননি। কর্মের মাধ্যমে তা বাস্তবায়নও করে গেছেন। ফলে তিনি আজও হয়ে আছেন অমর। জীবিত অবস্থায়ই মদনমোহন পাল প্রমাণ করেছেন, তিনি একজন মানুষ।
জন্মেছেন মানুষের সেবার জন্য। শুরুর দিকে মদনমোহন পাল প্রতিদিন ২০ জন ক্ষুধার্ত মানুষকে খাইয়ে নিজে খেতে বসতেন। ভুখাদের ভরপেট দেখে তিনি বেশ আনন্দিত হতেন। বিশেষ করে ভুখা মানুষের অন্নগ্রাসের চিত্র তাঁকে একেবারে কাতর করে দিত। দৃশ্যটি দেখে তিনি গঠন করেন ওই ট্রাস্ট। ট্রাস্টটিকে পাকাপোক্ত করতে তিনি দ্বারস্থ হন আইনের। একেবারে উইল করে দেন আদালতের মাধ্যমে। উইলে উল্লেখ থাকে, তাঁর মৃত্যুর পরও অন্নছত্র ট্রাস্টের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। (ট্রাস্টের প্রধান থাকবেন তাঁর বংশের কেউ। যদি বংশের কাউকে না পাওয়া যায়, তাহলে যেন পাল বংশের কাউকে ওই ট্রাস্টের প্রধান করা হয়) এর জন্য তিনি বেশ কিছু সম্পত্তিও দান করে যান। অন্নছত্র ট্রাস্টের আরেকটি পদক্ষেপ হলো, ওয়াইজঘাটে নিজস্ব অর্থায়নে বিশাল 'অন্নছত্র কাটরা' প্রতিষ্ঠা করা।
মদনমোহন পাল দুস্থ ও অনাহারীদের মুখে আহার দেওয়ার পাশাপাশি তাদের থাকার জন্য বাংলা ১৩৩৪ সালে অন্নছত্র কাটরা নির্মাণ করেন। এ ছাড়াও দুই নম্বর ওয়াইজঘাটের (৫৯/১ নম্বর লয়ার স্ট্রিট, পাটুয়াটুলী) তিনটি বাড়ি ওই ট্রাস্টের নামে দান করেন। ঢাকা সিটি করপোরেশন তাঁর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ নবাবপুরের তাঁর বাড়ির পাশের রাস্তার নামকরণ করেছে 'মদনমোহন লেন'। অপরদিকে দুঃখজনক চিত্রটি হচ্ছে, যেখানে বসিয়ে বর্তমানে অভুক্তদের খাওয়ানো হয়, সে বাড়িতে জনৈক ব্যক্তি নির্মাণ করেছেন একটি বাতির কারখানা। যা শুধু দৃষ্টিকটুই নয়, খেতে আসা মানুষের পায়ে কাচভাঙাও বসিয়ে দেয়।
এ ছাড়া আরেকটি বিষয় যা না বললেই নয়, আর তা হচ্ছে ট্রাস্টটি এখন ধুঁকে ধুঁকে চললেও দোকানের ভাড়াটিয়ারা সেই পুরনো ভাড়া কোর্টের মাধ্যমে পরিশোধ করছেন। যা সত্যিই দুঃখজনক।
আলম শাইন
No comments