মুক্তিযুদ্ধ- বাংলাদেশ ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন by ইত্তেফাকের সম্পাদকীয়

খন বিজয়ের মাস চলছে। ১৯৭১-এর পর থেকে ডিসেম্বর বাংলাদেশের মানুষের কাছে আসে মিশ্র অনুভূতির রেশ ছড়াতে। এ অনুভূতি যুগপৎ আনন্দের ও মহা বেদনার। ১৯৭১-সেতো খুব বেশী দূরের কথা নয়। বছরের হিসেবে মাত্র ৩৯ বছর যা কিনা একটি জাতির বয়সের কাছে নস্যি! আমাদের সেই পাঁচ/ছয় দশক পূর্বের বিক্ষিপ্ত ঘটনা প্রবাহের দিকে দৃষ্টিক্ষেপ করলে কতই না স্মৃতি ভেসে ওঠে মনের পর্দায়!
মানবদরদী, নিষ্ঠাবান ও কর্তব্যপরায়ণ কত মানুষের কথা এক নিমিষে স্মরণপথে এসে ভিড় জমায়। এঁদের অনেকেই আজ বিস্মৃতির অতলান্তে হারিয়ে গেছেন তাদেরই সতীর্থদের অবিমৃষ্যকারিতার দরুন। অথচ, এইসব নিবেদিতপ্রাণ, নীতি ও আদর্শের প্রতি একনিষ্ঠ মানুষগুলির কথা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বার বার জানানো কর্তব্য ছিল। ক'দিন আগে চ্যানেল-আই'র তৃতীয় মাত্রায় শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর উপর আয়োজিত এক টক শো'তে আমি আমন্ত্রিত হয়ে গভীরভাবে উপলব্ধি করেছি দেশের সেইসব কৃতবিদ্য এবং নীতিনিষ্ঠ মানুষের প্রতি আমাদের ক্ষমাহীন উপেক্ষা ও অবজ্ঞার বিষয়টি। অনুষ্ঠানের এ্যাংকর জিলস্নুর রহমান প্রশ্ন করেছিলেন দৈনিক ইত্তেফাক ছাড়া অন্য কোন পত্রিকায় শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর প্রতি কোন বিশেষ শ্রদ্ধা-ভক্তি নিবেদন করা হয় না; রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলির মধ্যেও এ নিয়ে এখন কোন আগ্রহ দেখা যায় না;- তাহলে কি আগামীতে শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী বা এম্নি আরও বরেণ্য ব্যক্তি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে কোন আগ্রহের সঞ্চার করতে পারবেন? সময়ের স্বল্পতার কারণে এ প্রশ্নের উত্তরটি সে রাতে ঠিকমত দেয়া হয়নি। অনুষ্ঠান শেষে বাসায় ফেরার পথে এবং ঘুমুতে যাবার আগ পর্যন্ত প্রশ্নটি মনের মাঝে বার বার উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল।
চন্দ্রগুপ্ত নাটকে দ্বিজেন্দ্র লাল রায় বীর সেকান্দারের কণ্ঠে কতগুলি অসাধারণ সংলাপ পুরে দিয়েছিলেন। তিনি তার সেনাপতি সেলু্যকসকে বলছেন 'সত্যিই সেলু্যকস, -কি বিচিত্র এই দেশ!' এই দেশ মানে ভূ-ভারত। কিন্তু ডি এল রায় নিজে বাঙালী ছিলেন বিধায় সেকেন্দার উচ্চারিত পরবর্তী সংলাপগুলিতে বাঙলার রূপ-বিভা ইত্যাদিই ফুটে উঠতে দেখা যায়। এখানে 'কি বিচিত্র এই দেশ' কথাটির প্রাকৃতিক তাৎপর্যের পরিবর্তে জাতিগত ও সামাজিক দিকটির উপর অধিক গুরুত্বারোপ করে বিচার-বিশেস্নষণ করলে আসলেই এ দেশ ও জাতির এক আশ্চর্য্য স্ববিরোধী রূপই জাজ্বল্যমান হয়ে ওঠে। অর্থাৎ, এ দেশের মানুষের আচার-ব্যবহার, ভাবনা-চিন্তা ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই কেমন যেন এক ধরনের স্থূলতা, অগভীরতা এবং বিস্মৃতিপ্রবণতা লক্ষ্যনীয় হয়ে ওঠে। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমি সৃষ্টির জন্য অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যে শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী বাঙলার গ্রামে-গঞ্জে, নগরে-প্রান্তরে তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে উল্কার মতো ছুটে বেড়িয়ে পাকিস্তান অর্জনকে অবধারিত করে তুলেছিলেন সেই সোহ্রাওয়ার্দীকেই বিভাগোত্তর পর্বে পূর্ব-পাকিস্তানে কুচক্রীরা যখন প্রবেশ করতে দেয়নি তখন জনতাসাগর যেন মৌন-মূক রূপ ধারণ করেছিল। অথচ, জনতা সাগরেরতো তখন ঊর্মিমুখর হবার কথা ছিল,- কিন্তু হোল না। মাত্র দু'তিন বছর আগে শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর পক্ষে যারা শতকরা ৯৮ ভাগ ভোট দিয়েছিল তারা কি করে সে সময় এমন নিশ্চুপ থাকতে পারল? আবার চুয়ান্নর নির্বাচনের পর পরই বাঙলার মুকুটহীন সম্রাট শেরে বাংলা ফজলুল হককে যখন পাকিস্তানী গণবিরোধী শাসকরা 'ট্রেইটর' বলে আখ্যা দিল তখনও আমরা জনতাকে নিরব থাকতে দেখলাম! ফজলুল হক তখন অশীতিপর বৃদ্ধ। এই চক্র-চক্রান্ত বা ষড়যন্ত্রের মোকাবেলার মতো মনের ও শরীরের শক্তি তার তেমন আর অবশেষ নেই!  সেদিন যারা (প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মোহাম্মদ আলী) হক সাহেবকে 'বিশ্বাসঘাতক' বলে অভিহিত করেছিল তারা তার 'ৎবঃরৎবসবহঃ্থএর ঘোষণায় এমনই উৎফুল্ল-চিত্ত তখন যে, মতলব হাসিলের মওকা হাতের মুঠোয় এসে যাওয়ায় হক সাহেবকে এবার 'প্রিন্স অব প্যাট্রিওট' হিসেবে বরণ করে নিতে এতটুকুও বাঁধল না তাদের মনে। উভয় ক্ষেত্রেই আমরা এ দেশের মানুষদের আশ্চর্য নীরবতা লক্ষ্য করেছি। ৬ দফা ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধুকে যখন বার বার গ্রেফতার করা হচ্ছিল এবং জেল থেকে জামিন লাভের পর আবারও কোন না কোন ছুঁতায় তাকে আটক করা হচ্ছিল তখনও এ দেশের বৃহদংশ মানুষই এতে বিচলিত বোধ করেনি। বরং তখনকার দিনে মুসলিম লীগ, পিডিপি, জামায়াতে ইসলামী প্রভৃতি দলের নেতা-কর্মীরা এতে উৎফুলস্নই হয়েছে।
কথাটি এই যে, আমাদের রাজনৈতিক সংগ্রামের সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমণের বাঁকে বাঁকে যখন দেশপ্রেমিক নেতা বা কর্মী বা বুদ্ধিজীবীদের উপর জেল-জুলুম নেমে এসেছে তখন জনগণের মাঝে এ নিয়ে প্রথম দিকে কোন প্রকার উত্তাপ-উত্তেজনা দেখা যায়নি।
যাহোক, বলছিলাম ডিসেম্বর তথা বিজয়ের মাসের কথা। এ মাসে দেশের অসংখ্য গৃহে স্বজন হারানোর বেদনায় থাকে মুহ্যমান। হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর-আল শামসের নির্মমতায় কত সোনার সংসার ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেছে একাত্তরে। আজও স্বজন হারাদের মর্মন্তুদ দীর্ঘশ্বাসে ডিসেম্বরের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। আবার এই ডিসেম্বরেই হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বাঙালীদের যে জয়ভেরী বেজে উঠেছিল, রবীন্দ্রনাথের 'দেশ দেশ নন্দিত করি মন্দ্রিত তব ভেরী/ আসিল যত বীর বৃন্দ আসন তব ঘেরি'র বাস্তব রূপটিই যেন জাতি প্রত্যক্ষ করেছিল একাত্তরের ষোলই ডিসেম্বর। ডিসেম্বরে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী নিধন যজ্ঞ চালানো হয়। দেশের বরেণ্য অনেক বুদ্ধিজীবী আল্বদর, আল্শামস ঘাতকদের অবর্ণনীয় নির্মমতার শিকার হন। বাংলাদেশ দশ মাসব্যাপী যুদ্ধ-বিগ্রহে লন্ডভন্ড তখন। চারিদিকে হানাদার ও তাদের দোসরদের নির্মমতা ও নৃশংসতার স্বাক্ষর! বিপুল আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে জাতি। তাই আনন্দ ও বেদনার যুগলবন্দী ধ্বনিত হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের ঊধর্্বাকাশে ছোঁড়া এল এম জি বা রাইফেলের গুলি আর স্বজন হারানো মানুষের বেদনার্ত হূদয়ের আর্তনাদের সংমিশ্রণে!
বলতে গেলে ১৯৪৭-এর অব্যবহিত পর থেকেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামের সূচনা ঘটে এতদঞ্চলে। পাকিস্তান অর্জনের সময় গণমানুষকে যে সকল স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল তা অল্প দিনের মধ্যেই বাতাসে মিলিয়ে যেতে থাকে। এক ধরনের ঔপনিবেশিক মানসিকতায় আচ্ছন্ন তদানিন্তন সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র শোষণ ও বঞ্চনার নাগপাশে বন্দী করে ফেলতে থাকে পাকিস্তানের হতদরিদ্র মানুষদেরকে। তন্মধ্যে, আমাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য, ভাষাগত বৈশিষ্ট্য আর রাজনৈতিক চেতনার প্রতি কুঠারাঘাত হেনে শাসকেরা সকল প্রকার অন্যায়ও চাপিয়ে দেয় আমাদের উপর। জগদ্দল পাথরের মতো সে অন্যায় শাসন আর নির্যাতন-লাঞ্ছনা চেপে বসে বাঙালীর বুকের উপর। এই অবস্থার অবসানকল্পে এ দেশের শেরে বাংলা, সোহ্রাওয়ার্দী, ভাসানী, মুজিবের নেতৃত্বে বার বার গর্জে উঠেছে মানুষ। এ কারণে ঐ নেতৃবৃন্দের কপালে জুটেছে 'ভারতের চর' এর মিথ্যা ইলজাম আর নিগ্রহ-নির্যাতন। হাসিমুখে তারা সেদিন এসব অত্যাচার সহ্য করেছেন গণমানুষের মুখে হাসি ফোটাবার অভিপ্রায়ে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষায়। জনসাগরে জেগে ওঠা ঊর্মির আঘাতে স্বৈরাচারের তখতে-তাউস বার বার কেঁপে উঠেছে আর দেশে গণতন্ত্র কায়েমের সম্ভাবনা উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়েছে। কিন্তু আবারও দেশী-বিদেশী এজেন্টদের সহায়তায় শাসকবর্গ অঙ্কুরেই সে সম্ভাবনাকে বিনাশ করে দিতে উদ্যত হয়েছে। এমনিভাবেই চলেছে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ। একাত্তরের আগ পর্যন্ত অবৈধ শাসক আর জনগণের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে চলেছে এই দ্বৈরথ। একাত্তরে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ঘটে এর একটি পটের পরিসমাপ্তি। কে মনে রাখে শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর গণতন্ত্রের প্রতি নিষ্ঠার এবং জনগণের কাতারে দাঁড়িয়ে সেই প্রাণপণ সংগ্রামের কথা? কোথায় হারিয়ে গেলেন শেরে বাংলার মতো 'জেন্টেল কলোসাস!' মওলানা ভাসানীইবা কোথায় আজ?
একটি বিষয় অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বোঝা দরকার, তা এই যে, স্বাধীন বাংলাদেশ-জনগণের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আকুলতা থেকে উৎসারিত দীর্ঘ ধারাবাহিক রাজনৈতিক সংগ্রামের চূড়ান্ত অর্জন। এই সদীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামে যারা জনগণের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে কিংবা দীর্ঘ আত্মগোপনে কাল কাটিয়ে সর্বস্ব উজাড় করে দিয়ে গেছেন তারা আমাদের নমস্য। শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আজীবন সংগ্রাম করেছেন আর তাকে ঘিরে সেদিনের ইত্তেফাক, বঙ্গবন্ধু বা আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব আবর্তিত হয়েছে।
================================
ক্ষুদ্রঋণ ও বাংলাদেশের দারিদ্র্য  শেয়ারবাজারে লঙ্কাকাণ্ড  মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার  শক্ত ভিত ছাড়া উঁচু ভবন হয় না  ট্রেন টু বেনাপোল  বনের নাম দুধপুকুরিয়া  নথি প্রকাশ অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার অ্যাসাঞ্জের  ছিটমহলবাসীর নাগরিক অধিকার  শিক্ষা আসলে কোনটা  জীবন ব্যাকরণঃ হিরালি  ন্যাটো ও রাশিয়ার সমঝোতা ইরানের ওপর কি প্রভাব ফেলবে  জার্নি বাই ট্রেন  পারিষদদলে বলেঃ  চরাঞ্চলের ভূমি ব্যবস্থাপনা  সচেতন হলে শিশু প্রতিবন্ধী হয় না  স্মৃতির জানালায় বিজয়ের মাস  বিচারপতিদের সামনে যখন ‘ঘুষ’  কয়লানীতিঃ প্রথম থেকে দশম খসড়ার পূর্বাপর  শ্বাপদসংকুল পথ  মুক্তিযুদ্ধে গ্রাম  ১২ বছর আগে বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়েছে  চট্টগ্রাম ইপিজেডে সংঘর্ষে নিহত ৪  ড. ইউনূস : প্রতিটি বাংলাদেশির গৌরব  জলাভূমিবাসীদের দুনিয়ায় আবার..  আসুন, আমরা গর্বিত নাগরিক হই  স্মৃতির শহীদ মির্জা লেন  ইয়াংওয়ান গ্রুপের পোশাক কারখানা বন্ধ  ট্রানজিটে ১১ খাতের লাভ-ক্ষতির হিসাব শুরু  চট্টগ্রামের বনাঞ্চল ছাড়ছে হাতি  ট্রেন  স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি  মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধের বিচার  মানবাধিকার লঙ্ঘন দেশে দেশে  ক্ষমতা যেভাবে মানবাধিকার আর ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ করে  চাক্কু মারা 'মশা' কাহিনী  উল্কির ভেলকি  এইচআইভি/এইডস্  উইকিলিকসঃ জুলিয়ান চে গুয়েভারা!  তিন কালের সাক্ষী  বাবর আলীর ইশকুল


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্যে
লেখখাঃ ইত্তেফাকের সম্পাদকীয় থেকে


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.