অসময়ের হানিমুন! by আসিফ নজরুল
হানিমুনের
বাংলা প্রতিশব্দ মধুচন্দ্রিমা। একান্তে সময় কাটানোর জন্য নবদম্পতির কাছে
হানিমুন পরম প্রত্যাশিত কিছু। হানিমুনের ধারণা এসেছে পশ্চিমা সভ্যতা থেকে। এ
দেশে উচ্চবিত্ত তো বটেই, মধ্যবিত্তের মধ্যেও হানিমুনের প্রসার বাড়ছে
এখন। বেড়েছে বিভিন্ন পরিস্থিতি বোঝাতে হানিমুন শব্দের ব্যবহারও। যেমন:
কোনো নবনির্বাচিত সরকারের প্রথম কয়েক মাসকে অভিহিত করা হয় হানিমুন পিরিয়ড
হিসেবে। এ সময় সরকারকে সমালোচনার তির থেকে শান্তিতে থাকতে দেওয়া হয়,
কিছুটা সময় দেওয়া হয় সব গুছিয়ে নেওয়ার জন্য। সরকারের ভুলত্রুটি নিয়ে কথা
বলা থেকে বিরত থাকে সবাই, এমনকি নির্বাচনে পরাজিত বিরোধী দলও।
হানিমুন পিরিয়ড ভোগ করার সুযোগ তাই বলে সব সরকারের হয় না। বিশেষ করে অতিবিতর্কিত নির্বাচনে বিজয়ী দলের তো নয়ই। ১৯৯৬ সালে এমন একটি নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভের পরদিন থেকে দেশ অচল করে দেওয়ার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী। ১৯৮৮ সালে একতরফা নির্বাচনে জাতীয় পার্টির বিজয়ের কিছুদিন পর একই অবস্থার সৃষ্টি করে অন্য তিনটি বড় রাজনৈতিক দল। সেদিক থেকে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগ ছিল অনেক ভাগ্যবান। এই নির্বাচন আরও একতরফা এবং আরও বেশি বিতর্কিত হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগকে ছয় মাস হানিমুন পিরিয়ড দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে বসে বিএনপি।
রাজনৈতিকভাবে হানিমুন পিরিয়ডের মানে হতে পারে জবাবদিহিহীন থাকা। সেই অর্থে ২০১৫ সালের মধ্যভাগে এসে আওয়ামী লীগ সরকার আবারও এক হানিমুন পিরিয়ড ভোগ করার সুযোগ পেয়েছে। তবে এবারের হানিমুন একটু ভিন্ন। এই হানিমুন এসেছে অসময়ে, এটি হাসিমুখে বা সন্তুষ্টচিত্তে সরকারকে দেওয়া হয়নি। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক মহলগুলোকে শক্তিমত্তা দেখিয়ে দমন করে, ঝামেলা সৃষ্টি করতে পারে এমন মহলগুলোকে নানান সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বশীভূত করে এবং আমজনতাকে বিভিন্ন প্রচারণা-অপপ্রচারণা চালিয়ে হতোদ্যম করে সরকার এই হানিমুন পিরিয়ড সৃষ্টি করে নিয়েছে।
এমনই নিরুপদ্রব এই হানিমুন যে আওয়ামী লীগকে এখন তো বটেই, অদূর ভবিষ্যতে কোনো জবাবদিহির যন্ত্রণায় আর পড়তে হবে বলে মনে হচ্ছে না। এমন যন্ত্রণায় ফেলতে পারার মতো কোনো প্রকৃত বিরোধী দল এখন আর সংসদে নেই। যারা আছে, তারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল দেশি-বিদেশি শক্তির ধমক খেয়ে। তারা এখন সরকারকে যতটা ধমক দিতে পারে, তারচেয়ে বেশি ধমক দেয় সরকারের প্রতিপক্ষদের, কখনো নিজেরা নিজেদের।
আসল ‘বিরোধী দল’ যারা, তাদের বিশ্বাস ছিল, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তারা জিতবে তাতে। নির্বাচন না ঠেকাতে পেরে, নির্বাচনে না অংশ নিয়ে আম-ছালা দুটোই আপাতত হারিয়ে তারা আজ সংসদ থেকেই নির্বাসিত। রাজপথে আন্দোলন করার অনুমতি নেই তাদের, পেট্রলবোমার কালিমা গায়ে লাগার পর সরকারকে এই অনুমতি দিতে বাধ্য করার মতো তেমন শক্তিও নেই তাদের। তাদের নেতা-সংগঠক-কর্মী-মিত্রদের একাংশ জর্জরিত মৃত্যুদণ্ড বা কারাদণ্ডের আশঙ্কায়, আরেক অংশ সন্ত্রস্ত ক্রসফায়ার বা গুমের ভয়ে। এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তাদের মধ্যে যারা স্থানীয় নির্বাচনে জয়ী হয়ে মেয়র বা কাউন্সিলর হয়েছিলেন, আইনি মারপ্যাঁচে তাঁদের অনেকের পদ কেড়ে নিয়ে নিক্ষেপ করা হয়েছে কারাগারে। তাঁদের কর্মী বা ছোট নেতাদের বিরাট একটি অংশও কারাগারে বা আত্মগোপনে বা অগণিত মামলার বেড়াজালে। আগামী শীতে তো দূরের কথা, আগামী আরও অনেক শীতে রাজপথ গরম করার যথেষ্ট সামর্থ্য তাদের আছে কি না সন্দেহ!
বাকি থাকে জবাবদিহির জন্য জনগণের অর্থে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন সাংবিধানিক ও আইনসৃষ্ট প্রতিষ্ঠান। সরকার বাড়াবাড়ি করলে, নাগরিক অধিকার হরণ করলে, গণতন্ত্র আর আইনের শাসনের টুঁটি চেপে ধরলে সরকারকে লাগামের মধ্যে রাখার দায়িত্ব সংসদীয় কমিটি, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, তথ্য কমিশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের। কিন্তু রাষ্ট্রের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান এখন বরং নিবেদিত সরকারের শক্তিমত্তা রক্ষা ও বৃদ্ধিতে কিংবা বিরোধী দলগুলোকে নানাভাবে হয়রানি করার কাজে। রাষ্ট্রের পুলিশ-র্যা ব ব্যস্ত সরকারের ক্যাডারের ভূমিকা নিয়ে জনগণকে চোখ রাঙানোর কাজে। যে বিজিবির কাজ সীমান্তের সম্মান আর মর্যাদা রক্ষা করা, সেখানে নতকণ্ঠ থেকে তারা বরং গর্জে ওঠে রাজধানী আর দেশের ভেতরের বড় শহরের আন্দোলনের বিরুদ্ধে।
সুষ্ঠু নির্বাচন আর সুশাসন দিতে ব্যর্থ হলে সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নাগরিক সমাজেরও। এদের একাংশ ব্যস্ত সরকারের সব কর্মকাণ্ডের গুণকীর্তনে, সরকারের অনুগ্রহ ও সুবিধা লাভের আশায় বা তা ভোগের আনন্দে। এদের কেউ কেউ ৫ জানুয়ারি নির্বাচনকে সহনীয় করার লক্ষ্যে সুষ্ঠু নির্বাচন, প্রকৃত জনপ্রতিনিধিত্ব এবং নিরন্তর জবাবদিহি ছাড়াই উন্নয়ন, এমনকি গণতন্ত্র পর্যন্ত সম্ভব—এমন মহা আবিষ্কার দেশের মানুষকে শোনাতে মগ্ন। কেউ কেউ কম গণতন্ত্রই দেশের জন্য মঙ্গলজনক—এমন বাণী প্রচারে নিবেদিত। নাগরিক সমাজের আরেক অংশ ব্যস্ত বিরোধী দলের টিমটিমে বাতি বহনে। এই বাতি যত টিমটিমে হচ্ছে, ততই তারা দলছুট বা মৃদুকণ্ঠ হচ্ছে, হচ্ছে দলকানা তর্কে অপাঙ্ক্তেয়। সরকারের কাছে কোনো কিছুর জবাব চাওয়ার নৈতিক সাহস ও জোরালো কণ্ঠস্বর—দুটোই তারা হারাচ্ছে দিনকে দিন।
নাগরিক সমাজের অবশিষ্ট অংশ হতবুদ্ধ নানান ভোগান্তি ও হয়রানির আশঙ্কায়। এঁদের কেউ কেউ এক-এগারো সরকারের গন্ধ গায়ে মেখে ম্রিয়মাণ, কেউ কেউ সরকার পরিবর্তন হলে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের সম্ভাবনায় সন্দিহান, কেউ কেউ সরকারের কড়া চাবুকের ভয়ে কম্পমান। আমেরিকা আর ইউরোপকেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক উন্নয়ন-সহযোগীদের প্রিয়পাত্র হিসেবে পরিচিত এই ‘নাগরিক সমাজের’ দুর্বলতার কারণে উন্নয়ন-সহযোগীদের ভূমিকাও এখন মৃদু, অনুল্লেখ্য এবং অকার্যকর। এই ‘সহযোগীরা’ নামকাওয়াস্তে কিছু বিবৃতি-বক্তব্য প্রদান করে সরকারকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার-বিষয়ক কিছু দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। আবার ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য বিরোধী দলের ততোধিক সমালোচনা করে সরকারকে নিঃশঙ্ক রাখছেন। বাংলাদেশের রাজনীতির ওপর সরকারের ঘনিষ্ঠ একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের একচেটিয়া অভিভাবকত্বও এঁরা সম্ভবত মেনে নিয়েছেন।
সরকারের তাই জয়জয়কার সর্বত্র। কোথাও কেউ নেই জবাব চাওয়ার, প্রশ্নবিদ্ধ করার, জনরায়ের সামনে ফেলার। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আদৌ বৈধতা আছে কি না, এই সরকার আদৌ জনগণের সম্মতির সরকার কি না, সেই প্রশ্ন তোলার মতো কোনো জোরালো শক্তি আর নেই দেশে। দলীয়করণ, দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস হলে প্রতিকার পাওয়ার শক্তিশালী কোনো সম্ভাবনা নেই কোথাও। ক্ষমতায় থাকার স্বার্থে একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে বহু কিছু উজাড় করে দেওয়ার অভিযোগ থাকলে এর জবাব চাওয়ার জায়গা নেই কোথাও। কিছুটা সমালোচনা করার অধিকার হয়তো আছে এখনো কোথাও কোথাও। কিন্তু সমালোচনা একটু এদিক-সেদিক হলে আছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী বা রাষ্ট্রদ্রোহী বা মান হননকারী বা অবমাননাকারী হিসেবে হেনস্তা হওয়ার ভয়। আছে সরকারের রোষানলে জীবন-জীবিকা বা সুখ-শান্তি বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা।
এমন হানিমুন পিরিয়ড বহু বছর অভাবনীয় ছিল নব্বই-পরবর্তী সময়ে। এখন এটাই বাস্তবতা। এই হানিমুন সরকারের লোকদের জন্য অপার আনন্দ আর উপভোগের কারণ হতে পারে। কিন্তু জবাবদিহিহীন এবং চ্যালেঞ্জহীন একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রয়োগের বর্তমান সময় দীর্ঘায়িত হলে সর্বনাশ হতে পারে সাধারণ মানুষের আর দেশের।
সরকার যখন এমন জবাবদিহিহীন থাকে, তখন প্রহসনমূলক নির্বাচন আবারও অনুষ্ঠানের দম্ভ দেখানো যায়, খুন-খারাবি-দুর্নীতি করেও ক্ষমতার দাপট দেখানো যায়, ইয়াবা-মাদক-মানব পাচারকারী হয়েও আইন-আদালতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো যায়, শেয়ারবাজার আর ব্যাংকের সাধারণ মানুষের টাকা লুট করে তাদের ভাগ্যবিধাতা হওয়া যায়, সরকারি চাকরি আর ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ থেকে মেধাবী তরুণদের হটিয়ে দিয়ে দলের ক্যাডারদের অভিষিক্ত করা যায়, ক্ষমতায় নিরাপদে থাকার জন্য দেশের বন-জলাভূমি আর সম্পদ দেশি-বিদেশি লুটেরাদের হাতে তুলে দেওয়া যায়। সরকার এমন জবাবদিহিহীন থাকলে তরুণদের স্বপ্ন চুরি হয়, সাধারণ মানুষের দুঃস্বপ্ন দীর্ঘায়িত হয়, দেশে অরাজকতা, অশান্তি আর অস্বস্তি বৃদ্ধি পায়, উন্নয়নের ফসল অল্প কিছু মানুষের করায়ত্ত হয়।
জনগণের প্রকৃত সম্মতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত না হলে সরকারের জবাবদিহি থাকে না। জবাবদিহি না থাকলে বা সুশাসনে ব্যর্থ হলে জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয় না থাকলে, সরকার গণতন্ত্র, সম্পদের সুষম বণ্টন, ন্যায়বিচার আর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্তরিক হয় না।
আমরা রক্তস্নাত একটি মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম এসব লক্ষ্য অর্জন করার জন্যই। আরব, লাতিন আমেরিকা বা আফ্রিকার কোনো দেশের মতো বাংলাদেশে দীর্ঘস্থায়ী স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য নয়।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
হানিমুন পিরিয়ড ভোগ করার সুযোগ তাই বলে সব সরকারের হয় না। বিশেষ করে অতিবিতর্কিত নির্বাচনে বিজয়ী দলের তো নয়ই। ১৯৯৬ সালে এমন একটি নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভের পরদিন থেকে দেশ অচল করে দেওয়ার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী। ১৯৮৮ সালে একতরফা নির্বাচনে জাতীয় পার্টির বিজয়ের কিছুদিন পর একই অবস্থার সৃষ্টি করে অন্য তিনটি বড় রাজনৈতিক দল। সেদিক থেকে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগ ছিল অনেক ভাগ্যবান। এই নির্বাচন আরও একতরফা এবং আরও বেশি বিতর্কিত হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগকে ছয় মাস হানিমুন পিরিয়ড দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে বসে বিএনপি।
রাজনৈতিকভাবে হানিমুন পিরিয়ডের মানে হতে পারে জবাবদিহিহীন থাকা। সেই অর্থে ২০১৫ সালের মধ্যভাগে এসে আওয়ামী লীগ সরকার আবারও এক হানিমুন পিরিয়ড ভোগ করার সুযোগ পেয়েছে। তবে এবারের হানিমুন একটু ভিন্ন। এই হানিমুন এসেছে অসময়ে, এটি হাসিমুখে বা সন্তুষ্টচিত্তে সরকারকে দেওয়া হয়নি। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক মহলগুলোকে শক্তিমত্তা দেখিয়ে দমন করে, ঝামেলা সৃষ্টি করতে পারে এমন মহলগুলোকে নানান সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বশীভূত করে এবং আমজনতাকে বিভিন্ন প্রচারণা-অপপ্রচারণা চালিয়ে হতোদ্যম করে সরকার এই হানিমুন পিরিয়ড সৃষ্টি করে নিয়েছে।
এমনই নিরুপদ্রব এই হানিমুন যে আওয়ামী লীগকে এখন তো বটেই, অদূর ভবিষ্যতে কোনো জবাবদিহির যন্ত্রণায় আর পড়তে হবে বলে মনে হচ্ছে না। এমন যন্ত্রণায় ফেলতে পারার মতো কোনো প্রকৃত বিরোধী দল এখন আর সংসদে নেই। যারা আছে, তারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল দেশি-বিদেশি শক্তির ধমক খেয়ে। তারা এখন সরকারকে যতটা ধমক দিতে পারে, তারচেয়ে বেশি ধমক দেয় সরকারের প্রতিপক্ষদের, কখনো নিজেরা নিজেদের।
আসল ‘বিরোধী দল’ যারা, তাদের বিশ্বাস ছিল, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তারা জিতবে তাতে। নির্বাচন না ঠেকাতে পেরে, নির্বাচনে না অংশ নিয়ে আম-ছালা দুটোই আপাতত হারিয়ে তারা আজ সংসদ থেকেই নির্বাসিত। রাজপথে আন্দোলন করার অনুমতি নেই তাদের, পেট্রলবোমার কালিমা গায়ে লাগার পর সরকারকে এই অনুমতি দিতে বাধ্য করার মতো তেমন শক্তিও নেই তাদের। তাদের নেতা-সংগঠক-কর্মী-মিত্রদের একাংশ জর্জরিত মৃত্যুদণ্ড বা কারাদণ্ডের আশঙ্কায়, আরেক অংশ সন্ত্রস্ত ক্রসফায়ার বা গুমের ভয়ে। এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তাদের মধ্যে যারা স্থানীয় নির্বাচনে জয়ী হয়ে মেয়র বা কাউন্সিলর হয়েছিলেন, আইনি মারপ্যাঁচে তাঁদের অনেকের পদ কেড়ে নিয়ে নিক্ষেপ করা হয়েছে কারাগারে। তাঁদের কর্মী বা ছোট নেতাদের বিরাট একটি অংশও কারাগারে বা আত্মগোপনে বা অগণিত মামলার বেড়াজালে। আগামী শীতে তো দূরের কথা, আগামী আরও অনেক শীতে রাজপথ গরম করার যথেষ্ট সামর্থ্য তাদের আছে কি না সন্দেহ!
বাকি থাকে জবাবদিহির জন্য জনগণের অর্থে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন সাংবিধানিক ও আইনসৃষ্ট প্রতিষ্ঠান। সরকার বাড়াবাড়ি করলে, নাগরিক অধিকার হরণ করলে, গণতন্ত্র আর আইনের শাসনের টুঁটি চেপে ধরলে সরকারকে লাগামের মধ্যে রাখার দায়িত্ব সংসদীয় কমিটি, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, তথ্য কমিশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের। কিন্তু রাষ্ট্রের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান এখন বরং নিবেদিত সরকারের শক্তিমত্তা রক্ষা ও বৃদ্ধিতে কিংবা বিরোধী দলগুলোকে নানাভাবে হয়রানি করার কাজে। রাষ্ট্রের পুলিশ-র্যা ব ব্যস্ত সরকারের ক্যাডারের ভূমিকা নিয়ে জনগণকে চোখ রাঙানোর কাজে। যে বিজিবির কাজ সীমান্তের সম্মান আর মর্যাদা রক্ষা করা, সেখানে নতকণ্ঠ থেকে তারা বরং গর্জে ওঠে রাজধানী আর দেশের ভেতরের বড় শহরের আন্দোলনের বিরুদ্ধে।
সুষ্ঠু নির্বাচন আর সুশাসন দিতে ব্যর্থ হলে সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নাগরিক সমাজেরও। এদের একাংশ ব্যস্ত সরকারের সব কর্মকাণ্ডের গুণকীর্তনে, সরকারের অনুগ্রহ ও সুবিধা লাভের আশায় বা তা ভোগের আনন্দে। এদের কেউ কেউ ৫ জানুয়ারি নির্বাচনকে সহনীয় করার লক্ষ্যে সুষ্ঠু নির্বাচন, প্রকৃত জনপ্রতিনিধিত্ব এবং নিরন্তর জবাবদিহি ছাড়াই উন্নয়ন, এমনকি গণতন্ত্র পর্যন্ত সম্ভব—এমন মহা আবিষ্কার দেশের মানুষকে শোনাতে মগ্ন। কেউ কেউ কম গণতন্ত্রই দেশের জন্য মঙ্গলজনক—এমন বাণী প্রচারে নিবেদিত। নাগরিক সমাজের আরেক অংশ ব্যস্ত বিরোধী দলের টিমটিমে বাতি বহনে। এই বাতি যত টিমটিমে হচ্ছে, ততই তারা দলছুট বা মৃদুকণ্ঠ হচ্ছে, হচ্ছে দলকানা তর্কে অপাঙ্ক্তেয়। সরকারের কাছে কোনো কিছুর জবাব চাওয়ার নৈতিক সাহস ও জোরালো কণ্ঠস্বর—দুটোই তারা হারাচ্ছে দিনকে দিন।
নাগরিক সমাজের অবশিষ্ট অংশ হতবুদ্ধ নানান ভোগান্তি ও হয়রানির আশঙ্কায়। এঁদের কেউ কেউ এক-এগারো সরকারের গন্ধ গায়ে মেখে ম্রিয়মাণ, কেউ কেউ সরকার পরিবর্তন হলে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের সম্ভাবনায় সন্দিহান, কেউ কেউ সরকারের কড়া চাবুকের ভয়ে কম্পমান। আমেরিকা আর ইউরোপকেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক উন্নয়ন-সহযোগীদের প্রিয়পাত্র হিসেবে পরিচিত এই ‘নাগরিক সমাজের’ দুর্বলতার কারণে উন্নয়ন-সহযোগীদের ভূমিকাও এখন মৃদু, অনুল্লেখ্য এবং অকার্যকর। এই ‘সহযোগীরা’ নামকাওয়াস্তে কিছু বিবৃতি-বক্তব্য প্রদান করে সরকারকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার-বিষয়ক কিছু দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। আবার ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য বিরোধী দলের ততোধিক সমালোচনা করে সরকারকে নিঃশঙ্ক রাখছেন। বাংলাদেশের রাজনীতির ওপর সরকারের ঘনিষ্ঠ একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের একচেটিয়া অভিভাবকত্বও এঁরা সম্ভবত মেনে নিয়েছেন।
সরকারের তাই জয়জয়কার সর্বত্র। কোথাও কেউ নেই জবাব চাওয়ার, প্রশ্নবিদ্ধ করার, জনরায়ের সামনে ফেলার। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আদৌ বৈধতা আছে কি না, এই সরকার আদৌ জনগণের সম্মতির সরকার কি না, সেই প্রশ্ন তোলার মতো কোনো জোরালো শক্তি আর নেই দেশে। দলীয়করণ, দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস হলে প্রতিকার পাওয়ার শক্তিশালী কোনো সম্ভাবনা নেই কোথাও। ক্ষমতায় থাকার স্বার্থে একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে বহু কিছু উজাড় করে দেওয়ার অভিযোগ থাকলে এর জবাব চাওয়ার জায়গা নেই কোথাও। কিছুটা সমালোচনা করার অধিকার হয়তো আছে এখনো কোথাও কোথাও। কিন্তু সমালোচনা একটু এদিক-সেদিক হলে আছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী বা রাষ্ট্রদ্রোহী বা মান হননকারী বা অবমাননাকারী হিসেবে হেনস্তা হওয়ার ভয়। আছে সরকারের রোষানলে জীবন-জীবিকা বা সুখ-শান্তি বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা।
এমন হানিমুন পিরিয়ড বহু বছর অভাবনীয় ছিল নব্বই-পরবর্তী সময়ে। এখন এটাই বাস্তবতা। এই হানিমুন সরকারের লোকদের জন্য অপার আনন্দ আর উপভোগের কারণ হতে পারে। কিন্তু জবাবদিহিহীন এবং চ্যালেঞ্জহীন একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রয়োগের বর্তমান সময় দীর্ঘায়িত হলে সর্বনাশ হতে পারে সাধারণ মানুষের আর দেশের।
সরকার যখন এমন জবাবদিহিহীন থাকে, তখন প্রহসনমূলক নির্বাচন আবারও অনুষ্ঠানের দম্ভ দেখানো যায়, খুন-খারাবি-দুর্নীতি করেও ক্ষমতার দাপট দেখানো যায়, ইয়াবা-মাদক-মানব পাচারকারী হয়েও আইন-আদালতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো যায়, শেয়ারবাজার আর ব্যাংকের সাধারণ মানুষের টাকা লুট করে তাদের ভাগ্যবিধাতা হওয়া যায়, সরকারি চাকরি আর ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ থেকে মেধাবী তরুণদের হটিয়ে দিয়ে দলের ক্যাডারদের অভিষিক্ত করা যায়, ক্ষমতায় নিরাপদে থাকার জন্য দেশের বন-জলাভূমি আর সম্পদ দেশি-বিদেশি লুটেরাদের হাতে তুলে দেওয়া যায়। সরকার এমন জবাবদিহিহীন থাকলে তরুণদের স্বপ্ন চুরি হয়, সাধারণ মানুষের দুঃস্বপ্ন দীর্ঘায়িত হয়, দেশে অরাজকতা, অশান্তি আর অস্বস্তি বৃদ্ধি পায়, উন্নয়নের ফসল অল্প কিছু মানুষের করায়ত্ত হয়।
জনগণের প্রকৃত সম্মতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত না হলে সরকারের জবাবদিহি থাকে না। জবাবদিহি না থাকলে বা সুশাসনে ব্যর্থ হলে জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয় না থাকলে, সরকার গণতন্ত্র, সম্পদের সুষম বণ্টন, ন্যায়বিচার আর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্তরিক হয় না।
আমরা রক্তস্নাত একটি মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম এসব লক্ষ্য অর্জন করার জন্যই। আরব, লাতিন আমেরিকা বা আফ্রিকার কোনো দেশের মতো বাংলাদেশে দীর্ঘস্থায়ী স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য নয়।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments