'অনেক পরিকল্পনা শুধু কল্পনাই রয়ে গেছে, পরীটা উড়ে গেছে' by খুজিস্তা নূর-ই-নাহরিন
খুজিস্তা নূর-ই-নাহরিন |
সময়টা
২০০৫। আমার স্বামী আমাকে হজ করার জন্য চাপ দিচ্ছে। আমি হজে যেতে নারাজ।
যুক্তিটা হচ্ছে হজ করতে হয় বুড়ো বয়সে যখন সমস্ত পাপ বিলীন হয়ে যাবে।
আমিতো বুড়ি নই। জীবনের অনেকটা পথই তখন বাকি। চাপাচাপির এক পর্যায়ে রাজী
না হয়ে পারলাম না। অতএব তৈরি হওয়ার জন্য বাচ্চা দুটোকে ওদের নানীর কাছে
রেখে আসতে জামালপুর গেলাম। আসার পথে বিরাট অ্যাকসিডেন্ট। বাঁচার কথা ছিল না
কিন্তু অলৌকিকভাবে বেঁচে গেলাম। অলক্ষ্য থেকে কেও যেন আমাকে বুঝিয়ে দিলেন
সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না। আজকের দিনই হতে পারে আমার জন্য শেষ দিন।
অতঃপর হুইল চেয়ারে করে হজ্ব যাত্রা। মদিনাতে যেয়ে প্রথম যখন আয়নার সামনে
দাঁড়ালাম, আমার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো। এতো কুৎসিত, এতো বীভৎস চেহারা!
পুরো মুখে কালো কালো দাগ, এর চেয়ে বুঝি আমার মৃত্যুও ভালো ছিল। কিন্তু
মদিনা এবং মক্কায় সবাই আমাকে বলতে লাগলো, "মহান আল্লাহ্পাক তোমাকে পছন্দ
করে, এই জন্য এতো কিছুর পরও তুমি হজ্বে আসতে বাধ্য হয়েছো, তিনি তোমায়
নিষ্পাপ করে এখানে এনেছেন।" আমি নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলাম। ২০১০ সাল, বৃদ্ধ
বাবার সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য বাড়ি গেছি। সারাদিনের জার্নি ক্লান্ত শরীর
ঘুমিয়ে কাটালাম সারাটিদিন। আমার বাবা ভীষণ রাগ; আমি সময় দিচ্ছি না বলে।
ভাবলাম কাল সারাটাদিন আব্বার সঙ্গে কাটাবো। সন্ধ্যায় খবর এলো আমার মেঝো
ভাইয়ের হার্ট অ্যাটাক করেছে, ঢাকায়। মেঝো ভাবী অসুস্থ, বাসায় ওদের ছোট
মেয়েটা শুধু। ছেলেটাকেও আমি সঙ্গে করে ঈদ করতে নিয়ে এসেছি। কোন কিছু না
ভেবে ছোট ভাইকে নিয়ে ঢাকায় ফিরে এলাম। ভাবলাম এর পরের ঈদটা আব্বার সঙ্গে
কাটাবো। কিন্তু পরের ঈদ আর এলো না। কারণ এর ঠিক এক মাস পর আমার আব্বা না
ফেরার দেশে চলে গেলো। আব্বার সঙ্গে আমার সময় কাটানো শুধু কল্পনাই থেকে
গেলো। আব্বার গায়ের গন্ধ, সিগারেটের ধোঁয়া এখনো আমায় টানে। কানে বাজে
আব্বা বলছে, "মেয়েটা আমার কাছে এলো না।"
আম্মাকে সময় দেওয়া দরকার, কারণ আম্মার একাকীত্বের সঙ্গী কেবল আমিই হতে পারি। ভাবলাম ঈদে তো যাচ্ছিই জামালপুর তখন মাকে নিয়ে আসবো। ঈদের মাত্র কয়েকটি দিন বাকী, ২০১০ এর ১০ ই নভেম্বর। ধরা পড়ল আমার স্বামী টিংকুর ব্রেইন ক্যান্সার। দিনটি ছিল ওর জন্মদিন। শত শত ফুলের পাপড়ি আর কেকের মাঝে ও' শুনল ওর মৃত্যুর আগমনী বার্তা। সেই ঈদ করতে হল সিঙ্গাপুরের গ্লেনিগালস হসপিটালে। টিংকুর ব্রেইন অপারেশান হয়েছে ঈদের একদিন আগে। ঈদের দিন সবাই বাইরে খেতে গেছে। আমি টিংকুর হাত ধরে নির্বাক বসে রইলাম। পরের ঈদ আমরা রাওজানে করলাম, কারণ ডাক্তার বলেছিল ওর হাতে সময় নেই। সময় খুব দ্রুত চলে যাচ্ছে। প্রতিটি মুহূর্ত ভীষণ দামী, প্রতিটি সময়কে কাজে লাগাতে হবে। হয়তোবা এটাই ওর জীবনের শেষ ঈদ, মহা ধুমধামে ঈদ করা। কিন্তু ফেরার পথে গাড়ি অ্যাকসিডেন্টে ওর বোনের আকস্মিক মৃত্যু আমাদের স্থবির করে দিল। যথারীতি ডাক্তারের দেওয়া সময় ধরে ঠিক ১৫ মাস পরে টিংকুও চলে গেলো। এর দু বছর পর সবাই জামালপুর গেছে ঈদ করতে। আমি রয়ে গেছি ঢাকায়। কারণ আমার মেঝো ভাবী মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। কয়েকদিন পর মেঝো ভাবীও না ফেরার দেশে চলে গেলো। এইতো কয়েকদিন আগে আম্মা আমার কাছে এসেছে চিকিৎসা করানোর জন্য। আম্মার ফোনে আমাদের বাড়ির এক সময়ের বুয়া রওসনার কান্না। ওর খুব অভাব। টাকার অভাবে খাওয়া জুটছে না। রওসনার ইউটেরাস ক্যান্সার, এর আগেও আমি ওকে অনেকবার টাকা দিয়েছি। বললাম ঈদে যখন বাড়ী যাবো ওকে টাকা দিবো। এ ছাড়া প্রতি মাসে আম্মার কাছে ওর জন্য টাকা পাঠাব। দিন পনেরো পরে আম্মা যখন ফিরে গেছে, শুনলো মাত্র ৪ দিন আগে রওসনা মারা গেছে। টাকাপয়সা, ধনদৌলত সবকিছুই এখন ওর কাছে তুচ্ছ। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। জীবনের অনেক পরিকল্পনা শুধু কল্পনাই রয়ে গেছে, পরীটা উড়ে গেছে। এখন কোন কিছু ভাবতেই ভয় হয়, কখন পরীরা উড়ে যায়। জীবন থেকে শিখেছি, কাল কি হবে জানা নেই; শুধু আজকের জন্য বাঁচো। কাল আমরা এই পৃথিবীতে থাকতেও পারি নাও পারি। অতএব আজকের দিনটা প্রাণ ভরে বাঁচতে শিখি। ভোরবেলা প্রতিদিন চোখ মেলে বলি সুবহানআল্লাহ্ ঘুমোতে যাওয়ার সময় চোখ বন্ধ করার আগে বলি আলহামদুলিল্লাহ। আজকের দিনের জন্য ধন্যবাদ তোমায়!
আম্মাকে সময় দেওয়া দরকার, কারণ আম্মার একাকীত্বের সঙ্গী কেবল আমিই হতে পারি। ভাবলাম ঈদে তো যাচ্ছিই জামালপুর তখন মাকে নিয়ে আসবো। ঈদের মাত্র কয়েকটি দিন বাকী, ২০১০ এর ১০ ই নভেম্বর। ধরা পড়ল আমার স্বামী টিংকুর ব্রেইন ক্যান্সার। দিনটি ছিল ওর জন্মদিন। শত শত ফুলের পাপড়ি আর কেকের মাঝে ও' শুনল ওর মৃত্যুর আগমনী বার্তা। সেই ঈদ করতে হল সিঙ্গাপুরের গ্লেনিগালস হসপিটালে। টিংকুর ব্রেইন অপারেশান হয়েছে ঈদের একদিন আগে। ঈদের দিন সবাই বাইরে খেতে গেছে। আমি টিংকুর হাত ধরে নির্বাক বসে রইলাম। পরের ঈদ আমরা রাওজানে করলাম, কারণ ডাক্তার বলেছিল ওর হাতে সময় নেই। সময় খুব দ্রুত চলে যাচ্ছে। প্রতিটি মুহূর্ত ভীষণ দামী, প্রতিটি সময়কে কাজে লাগাতে হবে। হয়তোবা এটাই ওর জীবনের শেষ ঈদ, মহা ধুমধামে ঈদ করা। কিন্তু ফেরার পথে গাড়ি অ্যাকসিডেন্টে ওর বোনের আকস্মিক মৃত্যু আমাদের স্থবির করে দিল। যথারীতি ডাক্তারের দেওয়া সময় ধরে ঠিক ১৫ মাস পরে টিংকুও চলে গেলো। এর দু বছর পর সবাই জামালপুর গেছে ঈদ করতে। আমি রয়ে গেছি ঢাকায়। কারণ আমার মেঝো ভাবী মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। কয়েকদিন পর মেঝো ভাবীও না ফেরার দেশে চলে গেলো। এইতো কয়েকদিন আগে আম্মা আমার কাছে এসেছে চিকিৎসা করানোর জন্য। আম্মার ফোনে আমাদের বাড়ির এক সময়ের বুয়া রওসনার কান্না। ওর খুব অভাব। টাকার অভাবে খাওয়া জুটছে না। রওসনার ইউটেরাস ক্যান্সার, এর আগেও আমি ওকে অনেকবার টাকা দিয়েছি। বললাম ঈদে যখন বাড়ী যাবো ওকে টাকা দিবো। এ ছাড়া প্রতি মাসে আম্মার কাছে ওর জন্য টাকা পাঠাব। দিন পনেরো পরে আম্মা যখন ফিরে গেছে, শুনলো মাত্র ৪ দিন আগে রওসনা মারা গেছে। টাকাপয়সা, ধনদৌলত সবকিছুই এখন ওর কাছে তুচ্ছ। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। জীবনের অনেক পরিকল্পনা শুধু কল্পনাই রয়ে গেছে, পরীটা উড়ে গেছে। এখন কোন কিছু ভাবতেই ভয় হয়, কখন পরীরা উড়ে যায়। জীবন থেকে শিখেছি, কাল কি হবে জানা নেই; শুধু আজকের জন্য বাঁচো। কাল আমরা এই পৃথিবীতে থাকতেও পারি নাও পারি। অতএব আজকের দিনটা প্রাণ ভরে বাঁচতে শিখি। ভোরবেলা প্রতিদিন চোখ মেলে বলি সুবহানআল্লাহ্ ঘুমোতে যাওয়ার সময় চোখ বন্ধ করার আগে বলি আলহামদুলিল্লাহ। আজকের দিনের জন্য ধন্যবাদ তোমায়!
No comments