বাংলাদেশের রাজনীতি- হাফিংটন পোস্টের মূল্যায়ন
বাংলাদেশে
‘দুই নেত্রী’ ও তাদের দলের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব চলছে তা দৃশ্যত শেষ হওয়ার
নয়। ২০০৮ সালে তারা গণতন্ত্রের বার্তা নিয়ে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক
সরকারের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন, যে সরকার তাদের রাজনীতি থেকে
সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল। গণতন্ত্রের সেই বার্তা আবারও হয়তো একবার সামনে
তুলে ধরার সময় এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত অনলাইন হাফিংটন পোস্টে এক
দীর্ঘ প্রতিবেদনে এসব কথা লিখেছেন ডমিনিক মোসবার্গেন। ‘উই নিড টু টক এবাউট
বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রের বিভিন্ন
দিক তুলে ধরেন। এতে তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশের রাজনীতি হয়ে পড়েছে দুই শিবিরে
বিভক্ত। এক শিবির প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন। আরেক শিবির
বিরোধীদলীয় নেত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন। ১৯৯১ সাল
থেকে তারা দুজনেই পর্যায়ক্রমে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। দুজনেরই আছে কিছু
সফলতা। দুজনের বিরুদ্ধেই আছে নির্বাচনে জালিয়াতি, দুর্নীতি ও সরকার চালাতে
অক্ষমতার অভিযোগ। দুই নারীই যখন বিরোধী দলে থেকেছেন তখনই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল
করতে হরতাল-অবরোধসহ সহিংস কর্মকাণ্ডের আশ্রয় নিয়েছেন। এর ফলে দেশ বারবার
আপাদমস্তক বিশৃঙ্খলায় ডুবছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বয়স ৬৭ বছর। খালেদা
জিয়ার ৬৯ বছর। তারা দলীয় কর্তৃত্বপরায়ণতা চালিয়েছেন। এতে দেশ যুদ্ধমুখী
দুটি শিবিরে বিভক্ত। বাংলাদেশের অলাভজনক সংস্থা সুজনের সম্মাদক বদিউল আলম
মজুমদার এ বছরের শুরুতে দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে বলেছেন, আমাদের
প্রতিষ্ঠানগুলোকে হেয় করা হয়েছে এবং সুশীলসমাজ বিভক্ত হয়ে গেছে। ওই
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশ
জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নেত্রী খালেদা জিয়ার মধ্যে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব
আরও গভীর হচ্ছে। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, শেখ হাসিনার পিতা, আওয়ামী লীগ নেতা ও
বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার সঙ্গে যারা জড়িত
তার সঙ্গে যোগসূত্র ছিল খালেদা জিয়ার স্বামী ও বাংলাদেশের সাবেক
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের। কয়েক বছর পরে জিয়াউর রহমানকেও হত্যা করা
হয়েছে। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মধ্যে আরও দ্বন্দ্ব তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী
দুই দলের জাতীয় পরিচয় নিয়ে। শেখ হাসিনা ধর্মনিরপেক্ষ। অন্যদিকে খালেদা
জিয়ার সমর্থকদের মধ্যে রয়েছে ইসলামপন্থি ও এর সঙ্গে সম্পর্ক আছে এমন দলের।
দুই পক্ষের মধ্যে সম্প্রতি যে সংঘাত হয়ে গেছে তা ভয়াবহ। ২০১৪ সালের জাতীয়
নির্বাচনের প্রথম বার্ষিকী উপলক্ষে এ বছরের ৫ই জানুয়ারি ওই ভয়াবহ সংঘর্ষ
শুরু হয়। বিরোধী দল বিএনপি ও তার মিত্ররা বর্জন করায় ওই নির্বাচনে বিজয়ী হন
শেখ হাসিনা ও তার আওয়ামী লীগ। কিন্তু তখন ওই নির্বাচনকে খালেদা জিয়া
কলঙ্কিত, প্রহসনের নির্বাচন আখ্যা দেন। এ বছর জানুয়ারিতে বিএনপি নেত্রী
খালেদা জিয়া তার সমর্থকদের অনির্দিষ্টকালের হরতাল ও সারা দেশে পরিবহন
ধর্মঘট পালনের নির্দেশ দেন। খালেদা জিয়া বলেন, শেখ হাসিনাকে নতুন নির্বাচন
দেয়ার জন্য বাধ্য করার জন্য ওই হরতাল ও অবরোধ ছিল। তবে তিনি সফল হন নি। সে
সময় থেকে টানা তিন মাস চলতে থাকে রাজপথের সহিংসতা। রাস্তায় বোমা হামলা করা
হয়। গুলি চালানো হয়। ভয়াবহ সেই সহিংসতায় কমপক্ষে ১০০ মানুষ নিহত হন।
মারাত্মক আহত হন অনেকে। আটক করা হয় বিরোধী দলের ১০ হাজারের বেশি
নেতাকর্মীকে। রাজনৈতিক এ অস্থিরতায় কমপক্ষে ২২০ কোটি ডলারের অর্থনীতির
ক্ষতি হয় বাংলাদেশে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে যা জাতীয় প্রবৃদ্ধির শতকরা প্রায়
এক ভাগ। কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের জীবনের সঙ্গে মিশে আছে হরতাল ও অবরোধ।
সামপ্রতিক সময়ে তা গণতান্ত্রিক চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের স্থান দখল করেছে
তা। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের পর ২০১৩ সালে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি
রাজনৈতিক সহিংসতা হয়। এতে কমপক্ষে ৫০০ মানুষ নিহত হন। রাজনৈতিক এ সহিংসতা
বাংলাদেশে এতটাই প্রভাব বিস্তার করে আছে, অনেককে বলেছেন, তারা রাজনীতি থেকে
দূরে সরে এসেছেন। বেছে নিয়েছেন যতটা সম্ভব সাধারণ জীবন। গত ফেব্রুয়ারিতে
বাংলাদেশে ছিলেন কানাডাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘লেফট অব দ্য ডট’-এর প্রতিষ্ঠাতা
জন লিওটিয়ের। তখন বাংলাদেশে দীর্ঘায়িত হরতাল চলছে। তিনি বলেছেন, তখন মনে
হয়েছে সাধারণ মানুষ রাজনীতি থেকে অবসরে গেছেন। তারা হরতালে বিরক্ত।
প্রতিদিন তাদের জীবনে এর যে প্রভাব পড়ছে তাতে তারা আর এটা মেনে নিতে পারছেন
না। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মধ্যে এই যে রাজনৈতিক লড়ই তা এ অঞ্চলের
অনেক মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে পর্যবেক্ষণ করছেন। ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব
হালের সাউথ এশিয়া প্রজেক্টের পরিচালক প্রফেসর ভূমিকা চাকমা বলেন, দুই
উত্তরাধিকার সূত্রের রাজনীতিতে যে সংঘাত তাতে এরই মধ্যে বাংলাদেশকে চরম
মূল্য দিতে হয়েছে। এতে গণতন্ত্রায়ণের ধারা পাল্টে গেছে। বাংলাদেশে ব্যক্তি
রাজনীতিতে সৃষ্টি হয়েছে সহিংসতা। অব্যাহতভাবে রাজনৈতিক যে অস্থিতিশীলতা তা
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলেছে। এর সুবাদে কট্টরপন্থি ও অপরাধীদের
নেটওয়ার্ক বৃদ্ধি পাবে- এ নিয়ে জোরালো উদ্বেগ জানানো হয়েছে। এরই মধ্যে দেশে
ইসলামপন্থি উগ্র জঙ্গিরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এ বছরের শুরুর দিকে
ইসলামপন্থি জঙ্গিদের হাতে নিহত হয়েছে তিন ব্লগার। বঙ্গোপসাগর দিয়ে নতুন করে
অভিবাসী সংকট দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ভাগ্যবিড়ম্বিত বহু হাজার
মানুষকে পাচার করে নৌপথে বিদেশে পাঠানোর চেষ্টা ধরা পড়েছে। এতে দেশ ও
সমাজের ভঙ্গুর অবস্থার আরেকটি চিত্র ফুটে উঠেছে। তা হলো দলে দলে মানুষের
দেশত্যাগ। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৬
কোটি। বিশ্বের মধ্যে এটি সবচেয়ে ঘনবসতির অন্যতম দেশ। যদিও এর অর্থনীতি
দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, তথাপি এ দেশের শতকরা ৭০ ভাগের বেশি মানুষের বসবাস
গ্রামে। এক-তৃতীয়াংশ মানুষের বেশি রয়েছেন দারিদ্র্যে। এখানে জমি বিরল।
জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এ পরিস্থিতিকে আরও
সঙ্গিন করে তুলছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে শ্রমিকদের ভীতিকর পরিস্থিতি, নারী,
সংখ্যালঘু ও সমাজে বিপর্যয়ের মুখ থাকা মানুষগুলোর বিরুদ্ধে উদ্বেগজনকভাবে
বৃদ্ধি পাওয়া সহিংসতা, বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি। বাংলাদেশ থেকে
বিদেশে পাড়ি জমানো মানুষের হার সব সময়ই উচ্চ। বছরে প্রায় ৫ লাখ মানুষ
বৈধভাবে ভাল বেতন ও উন্নত জীবনের প্রত্যাশায় দেশ ছাড়েন। বাংলাদেশ থেকে যেসব
মানুষ বিদেশে যান কাজের জন্য তার বেশির ভাগই কম দক্ষ ও মোটামুটি দক্ষ।
বিশেষ করে তারা মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশে যান অস্থায়ী
চুক্তিতে। বিশ্বের মধ্যে অষ্টম সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স পায় বাংলাদেশ। সরকারি
হিসাবে যে পরিমাণ মানুষের কথা বলা হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ আছে দেশের
বাইরে। অবৈধভাবে তারা আছে বিভিন্ন দেশে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে অবশ্যই
তাদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। তার চেয়ে বড় কথা দক্ষিণ এশিয়ার
এ দেশটিতে এমন অবস্থা তখনই সৃষ্টি হবে যখন এখানে শান্তি ফিরবে। বাংলাদেশের
দুই নেত্রী ও তাদের রাজনৈতিক দলের মধ্যকার বিরোধ কোন দিন মিটবে বলে মনে হয়
না। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের প্রফেসর ডেভিড লুইসের মতে, দলের ভেতর যদি
গণতন্ত্র কায়েম না হয় তাহলে এর কোন পরিসমাপ্তি ঘটবে না। তা সত্ত্বেও
দুপক্ষকেই হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করতে হবে, তারা একে অন্যের সহযোগিতায় দেশে
গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনে সহায়তা করেছে। ২০০৮ সালে দুই নেত্রী সেনাসমর্থিত
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে একত্রিত হয়েছিলেন, যে সরকার তাদের দুজনকেই
রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল। আবারও হয়তো সেই পরিস্থিতি আসতে
পারে।
No comments