রাতজাগা মানুষের বুদ্ধি অন্যদের তুলনায় বেশি কেন!
রাতের
এক অদ্ভুত মাদকতা আছে। রাত হলো সেই ক্ষণ, যখন মানুষের আকাঙ্ক্ষাগুলির আসল
চেহারা প্রকাশ পায়। দিনের আলোয় লুকিয়ে থাকা তাৎক্ষণিক অপূর্ণতা আর
অতৃপ্তিগুলি প্রকাশিত হয়ে পড়ে। রাতে মানুষ দিনের সব ব্যর্থতা খতিয়ে দেখতে
পারে, আক্ষেপ করতে পারে সেসবের জন্য। ঘৃণা করতে পারে, যারা কষ্ট দিয়েছে
তাদের। বুকভাঙা কান্নায় বালিশ ভেজাতে পারে। রাত হলো আবেগের। কল্পনার,
রোমান্সের এবং সংকটের। যখন তারাদের উদার প্রশ্রয়ে নির্দ্বিধায় বেরিয়ে পড়ে
মানুষের সমস্ত অকৃত্রিম, সুপ্ত এবং অবদমিত দিকগুলি। রাত সেই সবকিছুর জন্য
দুয়ার খুলে দেয়, যা দিনের বেলায় সূর্যের কঠোর পর্যবেক্ষণের আওতায় করার কথা
কল্পনাও করা যায় না। খুব স্বাভাবিকভাবেই যারা রাত জাগে না, তারা রাতের
আঁধারে মানুষের মানসিক এবং আবেগিক বিচিত্র পরিবর্তনগুলি সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে
যায়। ‘সাইকোলজি টুডে’ ম্যাগাজিনের মতে, বুদ্ধিমান মানুষ নিম্ন আইকিউধারী
মানুষের তুলনায় বেশি রাত জাগে। আমেরিকান তরুণদের ওপর করা এক গবেষণায় দেখা
গিয়েছে, দলের মধ্যে তুলনামূলকভাবে যারা বেশি বুদ্ধিমান, তারা অন্যদের চেয়ে
দেরিতে ঘুমাতে যায়। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স অ্যান্ড পলিটিকাল সায়েন্সের
একজন মনোরোগ-বিশেষজ্ঞ সাতশি কানাজাওয়া ‘স্টাডি ম্যাগাজিন’কে বলেছেন,
মানুষের গড় আইকিউ এবং ঘুমের প্যাটার্নের মধ্যে এমন সুনির্দিষ্ট সম্পর্ক
রয়েছে৷ যা প্রমাণ করে যে যারা রাতে কাজ করে তারা অধিক বুদ্ধিমত্তার
অধিকারী। তার গবেষণা থেকে জানা গিয়েছে, প্রাগৈতিহাসিককাল থেকেই আদিম
মানুষেরা সূর্যের উদয় এবং প্রস্থানের সঙ্গে নিজেদের জীবন বিন্যস্ত করে
নিয়েছিল। গড়পড়তা মস্তিষ্কগুলি এই প্যাটার্নকে নির্দ্বিধায় মেনে নেয়, কিন্তু
কৌতূহলি এবং বুদ্ধিদীপ্তরা অন্ধ আনুগত্যের পরিবর্তে নিজেদের মতো করে নিয়ম
তৈরি করে নেয়। এ হল অধিকাংশ মানুষের থেকে নিজেকে পৃথক করার, স্বকীয়তা
সৃষ্টির এক অবচেতন উদ্যোগ। ‘স্টাডি ম্যাগাজিন’-এ প্রকাশিত তথ্যগুলো এই রকম:
বিশ বছর বয়সী আমেরিকানদের আইকিউ অনুসারে ঘুমাতে যাবার এবং জেগে ওঠার সময়-
অতি স্বল্পবুদ্ধিসম্পন্ন (আইকিউ < ৭৫) কর্ম দিবস: রাত ১১:৪১ – সকাল
০৭:২০ ছুটির দিন: রাত ১২:৩৫ – সকাল ১০:০৯ স্বাভাবিক বুদ্ধিসম্পন্ন (৯০ <
আইকিউ < ১১০) কর্ম দিবস: রাত ১২:১০ – সকাল ০৭:৩২ ছুটির দিন: রাত ০১:১৩ –
সকাল ১০:১৪ অতি বুদ্ধিমান (আইকিউ > ১২৫) কর্ম দিবস: রাত ১২:২৯ – সকাল
০৭:৫২ ছুটির দিন: রাত ০১:৪৪ – সকাল ১১:০৭ বয়ঃপ্রাপ্তির শুরুর দিকে ৭৫-এর কম
আইকিউধারী ব্যক্তিরা রাত ১১:৩০ এর দিকে ঘুমাতে যায়, যেখানে ১২৫ এর বেশি
আইকিউধারীরা ঘুমাতে যায় ১২:৩০ এর দিকে। এটি কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। এই
উপাত্ত নিশাচরদের বক্তব্যকেই সমর্থন করে: জীবনকে উপভোগের সত্যিকারের সময়
আসে যখন অন্য সবাই ঘুমাতে যায়। রাত নামার পরেই কেবল দিনের প্রভাবগুলি
বিশ্লেষণ, মূল্যায়ন এবং উপলব্ধি করা যায়। কিছু মানুষের এই জরুরি আত্মচেতনা
তৈরি হতে সময় লাগে। ঘুমের সহজ অভ্যাসের বিপরীতে গিয়ে যারা রাতের অচেনা
মুহূর্তগুলি আবিষ্কার করে তারা এমন কিছুর স্বাদ পায় যা চোখ বন্ধ করে পাওয়া
যায় না। তারা সুখস্বপ্ন দেখার সুযোগ পায় যে স্বপ্নগুলো দিনের বেলায় বন্ধু,
পরিবার এবং কাজের চাপে কাছে আসার সুযোগ না পেয়ে একসময় চিরতরে হারিয়ে যায়।
তাই রাত হল সবচেয়ে বেশি সৃষ্টিশীল সময়, সেইসঙ্গে সর্বাধিক স্বাধীনতার। রাত
গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের অকৃত্রিম আবেগগুলি প্রাকৃতিক সাবলীলতায়
উন্মোচিত হয়। প্রখর সূর্যালোকে মুখোশ পড়ে থাকা মনের একান্ত ইচ্ছাগুলিকে
লাগামহীন স্বাধীনতা দেওয়ার এখনই সময়। নিজের সামর্থ্য এবং সীমাবদ্ধতা যাচাই
করার উপযুক্ত সময় হল রাত। দিনের আলোয় দমন করা অনুভূতিগুলিকে মুক্তি দেওয়ার
এবং অভিভাবকদের আরোপ করা হাজারো বিধিনিষেধ ভেঙে ফেলার সময়। নিজের মনের
অজানা গহীন কোণ খুঁড়ে দেখার আর অবচেতনের অচেনা অলিগলি অনুসন্ধানের সময়।
নিজের কাছে এমন অবাধ আত্মপ্রকাশ কেবল রাতেই করা যায়, দিনে করা যায়
আত্ম-মূল্যায়ন। তারা প্রতিষ্ঠানবিরোধী রাত জাগা একধরনের বিদ্রোহ।
নয়টা-পাঁচটার প্রতিষ্ঠিত নিয়মকে অস্বীকার করে গভীর রাত অব্দি জেগে থাকার
অভ্যাস অবশ্যই বিপ্লবাত্মক। প্রামাণ্য অতীত থেকে আজও পর্যন্ত রাতজাগা
মানুষেরা সমাজের মূল স্রোতের বাইরে। ‘সাইকোলজি এন্ড ইনডিভিজুয়াল ডিফারেন্স’
জার্নালে ‘কেন রাতজাগা মানুষ অধিক বুদ্ধিমান’ শিরোনামে একটি অ্যাকাডেমিক
পেপার প্রকাশিত হয়৷ যেখানে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে কীভাবে শত শত
বছর ধরে মানুষ দিনে কাজ করা এবং রাতে ঘুমানোর ব্যাপারে অভ্যাস তৈরি করেছে।
যখন কেউ এই প্রতিষ্ঠিত ধারাকে অস্বীকার করে, স্বাভাবিকভাবেই তারা
বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রে অন্যান্য মানুষের চেয়ে বেশি প্রগতিশীল ঔপন্যাসিক
মূল্যবোধ ধারণ করে এবং চিন্তার দিক থেকে অগ্রগামী হয়। এই ঔপন্যাসিক
মূল্যবোধ নেতৃত্ব তৈরির ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। রাতজাগা মানুষেরা হয়
বিপ্লবী, আবিষ্কারক এবং উদ্ভাবক। নিজেকে উৎসর্গ করে এরা বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে
অনুসরণ করার সামাজিক চাপের বিরুদ্ধাচরণ করে। যারা গভীর রাত পর্যন্ত জেগে
থেকে রাতের অচেনা প্রহরগুলি আবিষ্কার করার চেষ্টা করে তারা অতি কৌতূহলী হয়
এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। তারা আবিষ্কারের নেশায় মেতে থাকে এবং
কর্তৃপক্ষকে চ্যালেঞ্জ করতে ভালোবাসে। তারা তাদের মনকে বিকশিত করতে চায়,
ঘুমানোর সময় হয়েছে এই অজুহাতে তারা মনের জানালা বন্ধ করে দিতে পারে না।
তারা মুক্তমনা রাতে যা সম্ভব, দিনে তা করার কথা কল্পনাও করা যায় না। রাত
শিথিল নৈতিকতার, অবৈধ লেনদেন এবং অপ্রচলিত পেশার সময়। এ হল মদের দোকান খুলে
যাবার এবং কবির কবিতা লিখবার সময়। সুরসাধকের বাদ্যযন্ত্র নিয়ে মগ্ন হবার
সময়, প্রতিভাবানদের আয়েশ করার এবং শিল্পীদের প্রাণ পাওয়ার সময়। এবং সবচেয়ে
বেশি যৌন মিলনের সময়। সুস্থ যৌন জীবনের সঙ্গে রাতজাগার ইতিবাচক সম্পর্ক
আছে। রাতজাগা দাম্পত্যজীবনের জন্য সুখকর। বুদ্ধিমত্তা নির্ভর করে
মুক্তচিন্তার ওপর, আর যৌনজীবনের ব্যাপারে মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি মুক্তচিন্তাকে
উৎসাহিত করে। যারা জেগে থেকে রাত্রির অনন্ত রহস্য সমাধানের চেষ্টায় ব্যগ্র
তারা এমন এক আবিষ্কারের জগতে প্রবেশ করে যার খোঁজ ঘুমিয়ে থেকে পাওয়া সম্ভব
নয়। যারা নিজেদের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে এবং আঁধারকে উন্মোচন করতে চায়
তারাই দিনের জন্য অধিক আলো বয়ে আনে। তারা করিৎকর্মা যদিও বলা হয় প্রথম যে
পাখি ঘুম থেকে ওঠে সে বেশি পোকা ধরতে পারে, আসলে রাতজাগা পাখি ঝাঁকে ঝাঁকে
শিকার পায়। কেননা ভোরের পাখি শিকার ধরে যখন পোকারা রাতের বিচরণ শেষে গর্তে
ফিরে যাচ্ছে। সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠা অবশ্যই কর্মক্ষমতার উৎস, কিন্তু রাত
জাগা একইরকম ফলপ্রসূ। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে সে বড়জোর এক কিংবা দুই ঘণ্টা
সময় সাশ্রয় হয়, অথচ রাত জাগলে সবগুলি প্রহরই দখলে থাকে। রাতে এমন কিছু
আবিষ্কার করার থাকে যা ভোরে উঠে কখনোই খুঁজে পাওয়া যাবে না; তা সে যত ভোরেই
ওঠা হোক না কেন। রাত এমন কিছু অভিজ্ঞতার জন্ম দেয়, এমন কিছু কাজ সম্পন্ন
করতে দেয় যা দিনের অন্য কোন সময়েই সম্ভব নয়। কারণ রাতে, আপনার সামনে থাকে
একটি নতুন ভোর এবং একটি সম্পূর্ণ দিন। সকালে, আপনার সম্মুখে শুধুই রাতের
অস্পষ্টতা এবং আরেকটি দিনের ভীতিকর পরিসমাপ্তির অপেক্ষা।– ওয়েবসাইট
No comments