রাজনের গায়ে ৬৪ আঘাত: মুহিত রিমান্ডে, সৌদিতে আটক কামরুল by ওয়েছ খছরু
সিলেটে
নির্মম নির্যাতনে খুন হওয়া শিশু রাজনের শরীরে রয়েছে ৬৪টি আঘাতের চিহ্ন।
আঙুল, কবজি, কনুই, হাঁটুতে আঘাতের পর আঘাত। এমনকি মাথায়ও আঘাত করা হয়। এ
কারণে মস্তিষ্কে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই মারা গেছে শিশু সামিউল ইসলাম রাজন।
রাজনের মৃত্যুর পর ময়না তদন্তের রিপোর্টে ডাক্তাররা জানিয়েছেন এসব তথ্য।
গতকাল সিলেটের জালালাবাদ থানার ওসি আক্তার হোসেন এ তথ্য জানিয়ে বলেন,
ডাক্তারি রিপোর্টে উঠে এসেছে শিশু রাজনকে নির্যাতনের ভয়াবহতা। রাজনের
শরীরের সবখানেই ছিল আঘাতের চিহ্ন। আর গোটা শরীর থেকে রক্ত ঝড়ে পড়ে। তিনি
বলেন, রাজনের উপর নির্যাতন সকল বর্বরতাকে হার মানিয়েছে। পুলিশের সুরতহাল
রিপোর্টেও উঠে আসে নির্যাতনের ভয়াবহতা। এদিকে, রাজনের ঘটনায় ভিডিও প্রকাশ
হওয়ার পর পুলিশ অভিযান শুরু করেছে। রোববার রাতভর পুলিশ বিভিন্ন স্থানে
অভিযান চালায়। ভোরে পুলিশ গ্রেপ্তার করে মামলার প্রধান আসামি মুহিতের তালতো
ভাই ইসমাইলকে। বিশ্বনাথের লামাকাজি এলাকা থেকে পুলিশ তাকে আটক করে। পুলিশ
জানিয়েছে, আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশের কয়েকটি টিম এক যোগে অভিযান
চালাচ্ছে। অমানুষিক নির্যাতন করে শিশু রাজনকে হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তারকৃত
শেখপাড়া গ্রামের আবদুল মানিকের ছেলে মুহিত আলমের ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর
করেছেন আদালত। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় সিলেটের মুখ্য মহানগর হাকিম ২য়
আদালতের বিচারক ফারহানা ইয়াসমিন এ রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেন। ৮ই জুলাই
বুধবার সকালে বাদেআলী গ্রামের মো. আজিজুর রহমান আলমের ছেলে সামিউল আলম রাজন
বাড়ি থেকে সবজি নিয়ে বিক্রির উদ্দেশ্যে টুকের বাজারে যায়। সকাল ৮টায়
তেমুখি বাইপাস সেতুর ওপর পৌঁছলে অজ্ঞাত কারণে মুহিত আলম, আলী, কামরুল, ময়না
মিয়া চৌকিদারসহ ৫-৬ জন মিলে রাজনকে অমানবিক নির্যাতন করে হত্যা করে।
রাজনের মৃতদেহ গুম করার লক্ষ্যে সাদা রঙের মাইক্রোবাস (ঢাকা
মেট্রো-চ-৫৪-০৫১৬) যোগে কুমারগাঁও আবাসিক এলাকার হায়দর মিয়ার বাসার পশ্চিমে
গাড়ি হতে লাশ ফেলার চেষ্টাকালে স্থানীয় লোকজন মুহিত আলমকে হাতেনাতে আটক
করেন। এসময় অন্য আসামি পালিয়ে যায়। খবর পেয়ে জালালাবাদ থানা পুলিশ
ঘটনাস্থলে গিয়ে মুহিত আলমকে গ্রেপ্তার করে এবং মৃতদেহটি থানায় নিয়ে এসে
ময়না তদন্তের জন্য সিওমেক হাসপাতালে প্রেরণ করেন। ওদিকে ঘটনার দুদিন পর
মুহিতের ভাই কামরুল সৌদি আরব চলে যায়। গতকাল কামরুলকে আটক করে পুলিশে
দিয়েছে সৌদি প্রবাসী বাংলাদেশীরা। ওদিকে এ ঘটনায় পুলিশের এসআই আমিনুল ইসলাম
বাদী হয়ে মুহিত ও ময়নাকে আসামি করে মামলা করেন। পরে রাত ১১টায় নিহতের পিতা
বাদী হয়ে ৪ জনের নাম উল্লেখ করে ও ৬ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে এজাহার
দায়ের করেন। এদিকে, নিহতের পিতা আজিজুর রহমান বলেন, বর্তমানে তার ছেলে রাজন
হত্যাকারীদের রক্ষা করার জন্য একটি মহল উঠেপড়ে লেগেছে এবং পুলিশের সঙ্গেও
সমঝোতার চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। রাজনের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ওয়াহিদুর রহমান জানান,
রাজনকে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। নিহতের পিতা
আজিজুর রহমানের আইনজীবী আতিকুর রহমান তাপাদার জানান, এমন নৃশংস ঘটনা তিনি
পূর্বে আর কখনও দেখেননি। ইতিপূর্বে একজন ঘাতককে আটক করা হয়েছে এবং তার ৫
দিনের রিমান্ডও মঞ্জুর করেছেন আদালত। এ ঘটনায় জড়িত অন্যদেরও দ্রুত আটক করে
আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত। চাঞ্চল্যকর ভিডিওতে দেখা
গেছে, রাজনকে নির্যাতনের সময় ঘাতকরা সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় তাকে বলে তোকে
কিভাবে মারব বল, আমাদের সব পদ্ধতি জানা আছে। এই বলে তারা রোল দিয়ে তার পায়ে
নির্মমভাবে পেটাতে থাকে। শিশুটির স্পর্শকাতর অঙ্গে বারবার খোঁচানো হয়েছে।
রোলার দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। বন্ধ মার্কেটের একটি পিলারের সঙ্গে তাকে
পিছমোড়া বেঁধে রাখা হয়। বাঁধন খুলে মাটিতে ফেলেও তাকে নানাভাবে নির্যাতন
করা হয়। টানা ২৮ মিনিটের ভিডিওটিতে দেখা গেছে নির্যাতন সইতে না পেরে
শিশুটির আর্তচিৎকার। এ সময় সিনেমার দৃশ্যের মতো অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে
ঘাতকরা। শিশুটি পানি খাওয়ার জন্য বারবার অনুরোধ করে। তারপরও
নির্যাতনকারীদের এতটুকু দয়া হয়নি। তারা তাকে শরীরের ঘাম খেতে বলে। এর পর
রাজনকে হাতের বাঁধন খুলে রশি লাগিয়ে হাঁটতে দেয়া হয়। ঘাতকরা ভেবেছিল রাজন
বুঝি হাঁটার শক্তি হারিয়ে ফেলছে। কিন্তু ভয়ে ভয়ে হাঁটতে থাকা শিশুটিকে
উদ্দেশ্য করে তারা বলে হাড়গোড় দেখি এখনও ঠিক আছে। আরও মারো এরপর রাজনের বাঁ
হাত খুঁটির সঙ্গে বেঁধে আরেক দফা পেটানো হয়। এভাবে দফায় দফায় শিশুটির নখে,
মাথা, পেট ও উরুসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে রোল দিয়ে আঘাত করা হয়। এক সময়
বাঁ হাত ও ডান পা ধরে মোচড়াতেও দেখা যায়। এদিকে, রাজনের মৃত্যুর ঘটনায়
রোববার তার বাইয়ারপাড়ে তার বাড়িতেই রোববার হাজারো মানুষের সমাগম ঘটে।
স্থানীয়ার এ ঘটনার জন্য খুনিদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি
করেন। রাজনের চাচারা জানিয়েছে, খুনিদের গ্রেপ্তার দাবিতে দুদিনের আলটিমেটাম
দেয়া হয়েছে। তবে, একটি পক্ষ এই আন্দোলন বানচালের চেষ্টা চালাচ্ছে বলে দাবি
করেন তারা।
ওদিকে রাজন হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিশ্ব মিডিয়াও সোচ্চার। লন্ডনের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট লিখেছে, ১৩ বছর বয়সী সামিউল আলম রাজনকে যখন একটি রিকশা চুরির অভিযোগে প্রহার করা হচ্ছিল তখন হামলাকারীরাই হাসিতে ফেটে পড়ছিল। তাকে হত্যা করে ফেসবুকে সে দৃশ্যের ভিডিও-ও প্রকাশ করে দিয়েছে তারা। এখন ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের খুঁজছে পুলিশ। এরই মধ্যে একজনকে সন্দেহজনকভাবে আটক করা হয়েছে বুধবার। আটক করা হয়েছে আরও একজনকে। শিশুটিকে হত্যার ফুটেজ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশে। তাতে দেখা যায়, সিলেটের কুমারগাঁও বাসস্টেশনে প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে একদল মানুষ ওই শিশুটিকে প্রহার করছে। ইন্ডিপেন্ডেন্ট তার নোটে লিখেছে, দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট পূর্ণাঙ্গ ভিডিওটি প্রচার করছে না। কারণ, তা দেখে অনেক মানুষই বিমর্ষ হয়ে পড়তে পারেন। ওই ভিডিওতে দেখা গেছে, রাজনকে একটি খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। তার হাত পেছনে নিয়ে বাঁধা। এ অবস্থায় তাকে ধাতব দণ্ড দিয়ে প্রহার করা হচ্ছে। তার চুল ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এক হামলাকারী। কিন্তু ব্যথায় গড়িয়ে পড়ে রাজন। এ হত্যায় অভিযুক্ত করা হয়েছে কামরুল ইসলাম (২৪), আলী হায়দার (৩৪), ময়না মিয়া (৪৫)কে। ভারতের অনলাইন রেডিফ লিখেছে, নৃশংসভাবে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে বাংলাদেশে এক শিশুকে প্রহার করা হয়েছে ৩০ মিনিট। এতে সে মারা গেছে। এই নির্যাতনের দৃশ্য ভিডিওতে ধারণ করে পোস্ট করা হয়েছে ফেসবুকে। তাতে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। ফলে অভিযুক্তদের ধরার পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ। সিলেটে নারী, শিশু সহ হাজার হাজার মানুষ এর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসেছেন। তারা রাজনের পোস্টার উঁচু করে ঘাতকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। অভিযুক্তদের মধ্যে মূল দু’জন। একজন হলো ২২ বছর বয়সী মুহিত আলম। তাকে এলাকাবাসী ধরে পুলিশে দিয়েছে। সে এখন হাজতে। অনলাইন গ্লোবাল ভয়েস লিখেছে, বাংলাদেশীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে ফেসবুকের একটি কভার। তাতে লেখা ‘আমরা ১৩ বছর বয়সী রাজন হত্যার বিচার চাই’।
No comments