বিভক্তির কবলে বিশ্বাস by উৎপল রায় ও সিরাজুস সালেকিন
বিভক্ত
বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটি। রাজনৈতিক বিশ্বাস আর দেনা-পাওনার ভিত্তিতেই এ
বিভাজন। সুশীল সমাজের বিভক্তিকে দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেন সমাজবিজ্ঞানী ও
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মীজানুর রহমান শেলী। তিনি বলেন, রাজনৈতিক বিভক্তি
জিনিসটা জীবনের প্রত্যক্ষ অংশ হিসাবে দাঁড়িয়েছে। আমাদের জাতীয় জীবনের
অন্যান্য অংশে যেমন রাজনীতি জড়িত; তেমনি এখানেও রাজনীতি তার প্রচণ্ড
স্বাক্ষর রেখেছে। রাজনৈতিক বিভক্তি এখন পেশাজীবী সমাজকে, বিভিন্ন অংশকে
যেমন চাকরিজীবী যারা জনপ্রশাসনে সম্পৃক্ত আমলাদের বিভক্ত করেছে। এ অবস্থায়
উচিত পেশাজীবীদের একমত থাকা। যদি সুশীল সমাজ, নাগরিক সমাজ, বুদ্ধিজীবী সবাই
যদি নিরপেক্ষভাবে কোন বিশেষ মত বা দলের সমর্থক না হয়ে কাজ করতে পারেন যেমন
আগে করেছেন তবে তা মঙ্গলজনক। আগে অনেক জাতীয় প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্তি ছিল
না, আমাদের ভাষা আন্দোলনে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বুদ্ধিজীবীরা, সুশীল সমাজের
নেতৃস্থানীয়রা একভাবে চিন্তা করেছেন। কিন্তু গণতন্ত্রের ব্যাপারে সেই
চিন্তাটা সাম্প্রতিক সময়ে আর দেখা যাচ্ছে না। এখানে গণতন্ত্র কতখানি
গণতন্ত্র, গণতন্ত্র না উন্নয়ন এই সমস্ত ব্যাপারে তর্কবিতর্ক চালাতে গিয়ে
তারা বিভক্ত হয়েছেন এবং দেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়েছে। সুশীল
সমাজের বিভক্তি রোধে মূল্যবোধ চর্চার প্রতি গুরুত্ব দেন এ সমাজবিজ্ঞানী।
তিনি বলেন, এখান থেকে বের হয়ে আসতে হলে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে বোধের উন্মেষ
উপলব্ধি, চেতনা জাগ্রত করতে হবে। তাদের বুঝতে হবে এরকম করে বিশেষ দলের
মুখপাত্র হয়ে তারা শুধু নিজেদের অসম্মান করছেন না নিজেদের ক্ষতি করছেন।
একজন বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজের লোক তিনি তো সরকারি চাকরি করেন না। তার কোন
সরকারের পক্ষ থেকে বিপক্ষে থেকে তার এমন কি লাভ ক্ষতি হয়। তবে বলা যেতে
পারে সরকারের রোষানলে পড়লে ব্যবসা বাণিজ্য করাও অসম্ভব হয়ে দাড়ায়। এভাবে তো
গণতন্ত্র চলতে পারে না।
ইতিহাসবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন মনে করেন বাংলাদেশে সিভিল সোসাইটি বা সুশীল সমাজ তেমনভাবে গড়ে উঠেনি। তিনি বলেন, সুশীল সমাজের মধ্যে যদি বিভাজন, মতপার্থক্য ও বিভক্তি থাকে তাহলে তাকে সুশীল সমাজ বলা যায় না। একে ‘বিশেষ গোষ্ঠী’ বলা যায়। যারা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে। আশা করবো বাংলাদেশের সুশীল সমাজ মতপার্থক্য ও বিভক্তি দূর করে দেশ ও জনগণের স্বার্থে কাজ করবে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গবেষক আফসান চৌধুরী বলেন, সিভিল সোসাইটি বলতে বুঝায় যারা কোন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত নয়, যারা নীতিগতভাবে স্বাধীন। তারা কোন দলের নয়। ক্ষমতায় যাবে বা যাওয়ার চেষ্টা করবে তারা এরকমও নয়। তাদের পরিসরটা এমন যে, তারা ক্ষমতার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বলা যায়, আমাদের দেশে সিভিল সোসাইটি বা সুশীল সমাজ কিংবা বুদ্ধিজীবী সমপ্রদায় যা-ই বলিনা যেভাবে গড়ে ওঠার কথা ছিল সেভাবে গড়ে উঠেনি। এটা অত্যন্ত দুখঃজনক। তিনি বলেন, আমাদের দেশে এখন রাজনৈতিক সোসাইটি গড়ে উঠেছে। উদাহরণ দিয়ে যদি বলি, ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে দেশের সুশীল সমাজ দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। এক দল আওয়ামী লীগ, আরেক দল বিএনপি। কিন্তু সিভিল সোসাইটিতো আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে ভাগাভাগি হতে পারে না। আফসান চৌধুরী বলেন, রাষ্ট্রের দুটি অংশ আছে। একটি সরকার ও আরেকটি সমাজ। সুশীল সমাজ সরকারের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ হতে চায়। সমাজের সঙ্গে নয়। কেননা সরকারের তরফে তার স্বার্থসিদ্ধির বিষয় জড়িত থাকে। এ কারণে সুশীল সমাজ বা বুদ্ধিজীবী সমপ্রদায় সমাজ থেকে ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। বিষয়টা এমন দাঁড়িয়েছে যে, আমরা সবাই সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে চাই। সমাজের সঙ্গে নয়। বর্তমান পরিস্থিতি দেখে এমনটাই মনে হয়। আর আমাদের সুশীল সমাজের মূল সংকটটা এখানেই। আফসান চৌধুরী আরও বলেন, বিভাজন যেটা হয়েছে সেটা স্বার্থের বিভাজন। প্রাপ্তির প্রতি সুশীল সমাজের একাংশের এত বেশি আগ্রহ বেড়েছে যে, তারা মনে করে সরকারের মন্ত্রী না হলেও বিশেষ সুবিধা পাওয়া যাবে। এখানে সুবিধা প্রাপ্তির বিষয়টা খুব বেশি হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে অনেকেই বিক্রি হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের সিভিল সোসাইটিরতো খাওয়া, পরার কোন অভাব দেখি না। গরিব কোন সুশীল সমাজও দেখি না। কিন্তু তারা কেন এ সংকটের পথে যাবে? সংকট তৈরি করবে? তবে, অনেকেই এখনও নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি। কিন্তু এ সংখ্যা খুবই নগণ্য।
সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোজাম্মেল বাবু বলেন, এখন পর্যন্ত দেশের বড় বড় অর্জনে সিভিল সোসাইটির বিশাল ভূমিকা রয়েছে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সময় অর্থনৈতিক মুক্তি ও স্বাধিকার আন্দোলনের জন্য সিভিল সোসাইটি অভিন্ন লক্ষ্যে কাজ করেছে। এত কিছু করার পরেও তারা কেউ ক্ষমতার অংশীদার হতে চায়নি। তাদের কোন রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাও ছিল না। কিন্তু এখন যাদের সিভিল সোসাইটি বলা হয় তাদের অনেকেই বিরাজনীতিকরণের মাধ্যমে এক এগারোর মতো পরিস্থিতি কায়েম করতে চায়। অরাজনৈতিক শক্তিকে ক্ষমতায় আনতে চায়। তিনি বলেন, সুশীল সমাজের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন যারা আওয়ামী লীগের দাসে পরিণত হয়েছে। আবার কেউ আছেন যারা বিএনপির দাসত্ব করছে। এরা দলদাসে পরিণত হয়েছে। দেশে আরও এক ধরনের সিভিল সোসাইটি আছে, যারা বিভিন্ন অ্যাম্বেসির মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করছে। সুশীল সমাজের নামে এরা আসলে আওয়ামী লীগ, বিএনপি কিংবা বিভিন্ন অ্যাম্বেসির দাসে পরিণত হয়েছে। দলীয় দাসত্ব থেকে না বেরুলে সিভিল সোসাইটি দেশ ও জনগণের স্বার্থে তাদের কাজ করতে পারবে না।
সুশীল সমাজের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার ঘটনাকে রাজনীতির জন্যই ক্ষতিকর বলে মনে করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, এটা সুশীল সমাজ বা নাগরিক সমাজের জন্য যেমন ক্ষতিকর একইভাবে আমি মনে করি রাজনীতির জন্যও ক্ষতিকর। নাগরিক সমাজকে দলনিরপেক্ষ থাকতে হবে। বলছি না যে রাজনীতি নিরপেক্ষ। কারণ আমরা যে কথাগুলো বলি, কাজগুলো করি সুশাসনের জন্য কাজ করি, দুর্নীতিবিরোধী কাজ করি এগুলো হচ্ছে রাজনৈতিক ইস্যু। এগুলো নাগরিক সমাজের কাজের মধ্যে থাকবে কিন্তু দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে থাকবে। এগুলো হচ্ছে মৌলিক জিনিস। এ থেকে বিচ্যুত হওয়াটা রাজনীতির জন্য ক্ষতিকারক এবং নাগরিক সমাজের জন্য ক্ষতিকারক। সুশীল সমাজের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, যারা দলীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন তারা তো এটা থেকে বিভিন্নভাবে মুনাফা বা সুবিধা অর্জনের উপায় হিসাবে দেখেন। অন্যদিক থেকে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে চাহিদা এবং সরবরাহ দুটোই কাজ করে। তাদের ব্যবহার করে রাজনৈতিক দল বা সরকার নাগরিক সমাজকে ব্যবহার করে। নাগরিক সমাজের একাংশ সুবিধা পায় এবং রাজনৈতিক দলগুলো সুবিধা পায়। এক ধরনের টানাপড়েন কাজ করে। মূল দায়িত্ব নাগরিক সমাজকে নিতে হবে। যদি তারা রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে চান তবে সরাসরি যোগ দিতে পারেন। দলীয় আদর্শের মধ্যে আংশিক বিলিয়ে দিয়ে নিজেকে নাগরিক সমাজ দাবি করা ঠিক না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সুশীল সমাজের সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, নাগরিক সমাজকে একটা প্রতিষ্ঠান হিসাবে ধরে নিতে চাই। আমরা যখন রাজনৈতিক সংস্কারের কথা বলি, গণতন্ত্রের চর্চা বৃদ্ধির কথা বলি। একইভাবে নাগরিক সমাজকে বলবো এই মূল্যবোধকে ধারণ করা। আমাদের কার্যক্রম আন্দোলন, বক্তব্য, অবস্থান দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে থাকবে এই ধারণাটাকে আত্তীকরণকরণ এবং এটাকে চর্চা করার চেষ্টা করা। এটা থেকে বিচ্যুত না হওয়ার জন্য ভারসাম্য রক্ষা করে চলা সেগুলো নিশ্চিত করা দরকার।
এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, সত্যিকারের সুশীল সমাজকে অরাজনৈতিক বলবো না, তবে নির্দলীয় হওয়া উচিত। কোন দলভিত্তিক হলে তারা সুশীল সমাজের সংজ্ঞার মধ্যে পড়ার কথা না। সুশীল সমাজের সংজ্ঞা হচ্ছে নন-গভর্নমেন্ট, নন-পার্টি, নন-মিলিটারি। কিন্তু আমরা সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের দলীয় রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার প্রবণতাটা লক্ষ্য করছি বেশ কয়েকবছর ধরে। তিনি আরও বলেন, আমি যদি কোথাও কোন জায়গায় অবস্থান নেই সুশীল সমাজের নামে সেই অবস্থান যদি কোন দলের পক্ষে যায় তখনই তাকে চিহ্নিত করে ফেলা হয় যে ওই দলের ওই। এই অন্যায়টাও করা হয়। আমরা তো দেখি একজন মানবাধিকার কর্মী একজন অবস্থান নিলেন যেটা ন্যায্য। যখন দেখা গেল রাজনৈতিক দলের বিপক্ষে যাচ্ছে, অথবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপক্ষে যাচ্ছে। তারা তাকে দলীয় কালার দেয়ার চেষ্টা করছে। দুদিকেই সমস্যা। একটা হচ্ছে দলীয় আনুগত্যের বিষয় থাকতে পারে। তার চেয়েও বেশি হচ্ছে যখনই কোন জায়গায় সুশীল সমাজ অবস্থান নেয়ার চেষ্টা করছে তখনই তাকে দলীয় রাজনীতির পরিচয় দিয়ে আখ্যায়িত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, বিভিন্ন সংগঠন যারা আছেন পেশাজীবীদের মধ্যে সর্বত্র দলীয়ভাবে বিভাজনটা প্রকট। তারা কিন্তু সুশীল সমাজের অংশ।
ইতিহাসবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন মনে করেন বাংলাদেশে সিভিল সোসাইটি বা সুশীল সমাজ তেমনভাবে গড়ে উঠেনি। তিনি বলেন, সুশীল সমাজের মধ্যে যদি বিভাজন, মতপার্থক্য ও বিভক্তি থাকে তাহলে তাকে সুশীল সমাজ বলা যায় না। একে ‘বিশেষ গোষ্ঠী’ বলা যায়। যারা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে। আশা করবো বাংলাদেশের সুশীল সমাজ মতপার্থক্য ও বিভক্তি দূর করে দেশ ও জনগণের স্বার্থে কাজ করবে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গবেষক আফসান চৌধুরী বলেন, সিভিল সোসাইটি বলতে বুঝায় যারা কোন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত নয়, যারা নীতিগতভাবে স্বাধীন। তারা কোন দলের নয়। ক্ষমতায় যাবে বা যাওয়ার চেষ্টা করবে তারা এরকমও নয়। তাদের পরিসরটা এমন যে, তারা ক্ষমতার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বলা যায়, আমাদের দেশে সিভিল সোসাইটি বা সুশীল সমাজ কিংবা বুদ্ধিজীবী সমপ্রদায় যা-ই বলিনা যেভাবে গড়ে ওঠার কথা ছিল সেভাবে গড়ে উঠেনি। এটা অত্যন্ত দুখঃজনক। তিনি বলেন, আমাদের দেশে এখন রাজনৈতিক সোসাইটি গড়ে উঠেছে। উদাহরণ দিয়ে যদি বলি, ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে দেশের সুশীল সমাজ দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। এক দল আওয়ামী লীগ, আরেক দল বিএনপি। কিন্তু সিভিল সোসাইটিতো আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে ভাগাভাগি হতে পারে না। আফসান চৌধুরী বলেন, রাষ্ট্রের দুটি অংশ আছে। একটি সরকার ও আরেকটি সমাজ। সুশীল সমাজ সরকারের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ হতে চায়। সমাজের সঙ্গে নয়। কেননা সরকারের তরফে তার স্বার্থসিদ্ধির বিষয় জড়িত থাকে। এ কারণে সুশীল সমাজ বা বুদ্ধিজীবী সমপ্রদায় সমাজ থেকে ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। বিষয়টা এমন দাঁড়িয়েছে যে, আমরা সবাই সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে চাই। সমাজের সঙ্গে নয়। বর্তমান পরিস্থিতি দেখে এমনটাই মনে হয়। আর আমাদের সুশীল সমাজের মূল সংকটটা এখানেই। আফসান চৌধুরী আরও বলেন, বিভাজন যেটা হয়েছে সেটা স্বার্থের বিভাজন। প্রাপ্তির প্রতি সুশীল সমাজের একাংশের এত বেশি আগ্রহ বেড়েছে যে, তারা মনে করে সরকারের মন্ত্রী না হলেও বিশেষ সুবিধা পাওয়া যাবে। এখানে সুবিধা প্রাপ্তির বিষয়টা খুব বেশি হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে অনেকেই বিক্রি হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের সিভিল সোসাইটিরতো খাওয়া, পরার কোন অভাব দেখি না। গরিব কোন সুশীল সমাজও দেখি না। কিন্তু তারা কেন এ সংকটের পথে যাবে? সংকট তৈরি করবে? তবে, অনেকেই এখনও নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি। কিন্তু এ সংখ্যা খুবই নগণ্য।
সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোজাম্মেল বাবু বলেন, এখন পর্যন্ত দেশের বড় বড় অর্জনে সিভিল সোসাইটির বিশাল ভূমিকা রয়েছে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সময় অর্থনৈতিক মুক্তি ও স্বাধিকার আন্দোলনের জন্য সিভিল সোসাইটি অভিন্ন লক্ষ্যে কাজ করেছে। এত কিছু করার পরেও তারা কেউ ক্ষমতার অংশীদার হতে চায়নি। তাদের কোন রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাও ছিল না। কিন্তু এখন যাদের সিভিল সোসাইটি বলা হয় তাদের অনেকেই বিরাজনীতিকরণের মাধ্যমে এক এগারোর মতো পরিস্থিতি কায়েম করতে চায়। অরাজনৈতিক শক্তিকে ক্ষমতায় আনতে চায়। তিনি বলেন, সুশীল সমাজের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন যারা আওয়ামী লীগের দাসে পরিণত হয়েছে। আবার কেউ আছেন যারা বিএনপির দাসত্ব করছে। এরা দলদাসে পরিণত হয়েছে। দেশে আরও এক ধরনের সিভিল সোসাইটি আছে, যারা বিভিন্ন অ্যাম্বেসির মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করছে। সুশীল সমাজের নামে এরা আসলে আওয়ামী লীগ, বিএনপি কিংবা বিভিন্ন অ্যাম্বেসির দাসে পরিণত হয়েছে। দলীয় দাসত্ব থেকে না বেরুলে সিভিল সোসাইটি দেশ ও জনগণের স্বার্থে তাদের কাজ করতে পারবে না।
সুশীল সমাজের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার ঘটনাকে রাজনীতির জন্যই ক্ষতিকর বলে মনে করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, এটা সুশীল সমাজ বা নাগরিক সমাজের জন্য যেমন ক্ষতিকর একইভাবে আমি মনে করি রাজনীতির জন্যও ক্ষতিকর। নাগরিক সমাজকে দলনিরপেক্ষ থাকতে হবে। বলছি না যে রাজনীতি নিরপেক্ষ। কারণ আমরা যে কথাগুলো বলি, কাজগুলো করি সুশাসনের জন্য কাজ করি, দুর্নীতিবিরোধী কাজ করি এগুলো হচ্ছে রাজনৈতিক ইস্যু। এগুলো নাগরিক সমাজের কাজের মধ্যে থাকবে কিন্তু দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে থাকবে। এগুলো হচ্ছে মৌলিক জিনিস। এ থেকে বিচ্যুত হওয়াটা রাজনীতির জন্য ক্ষতিকারক এবং নাগরিক সমাজের জন্য ক্ষতিকারক। সুশীল সমাজের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, যারা দলীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন তারা তো এটা থেকে বিভিন্নভাবে মুনাফা বা সুবিধা অর্জনের উপায় হিসাবে দেখেন। অন্যদিক থেকে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে চাহিদা এবং সরবরাহ দুটোই কাজ করে। তাদের ব্যবহার করে রাজনৈতিক দল বা সরকার নাগরিক সমাজকে ব্যবহার করে। নাগরিক সমাজের একাংশ সুবিধা পায় এবং রাজনৈতিক দলগুলো সুবিধা পায়। এক ধরনের টানাপড়েন কাজ করে। মূল দায়িত্ব নাগরিক সমাজকে নিতে হবে। যদি তারা রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে চান তবে সরাসরি যোগ দিতে পারেন। দলীয় আদর্শের মধ্যে আংশিক বিলিয়ে দিয়ে নিজেকে নাগরিক সমাজ দাবি করা ঠিক না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সুশীল সমাজের সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, নাগরিক সমাজকে একটা প্রতিষ্ঠান হিসাবে ধরে নিতে চাই। আমরা যখন রাজনৈতিক সংস্কারের কথা বলি, গণতন্ত্রের চর্চা বৃদ্ধির কথা বলি। একইভাবে নাগরিক সমাজকে বলবো এই মূল্যবোধকে ধারণ করা। আমাদের কার্যক্রম আন্দোলন, বক্তব্য, অবস্থান দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে থাকবে এই ধারণাটাকে আত্তীকরণকরণ এবং এটাকে চর্চা করার চেষ্টা করা। এটা থেকে বিচ্যুত না হওয়ার জন্য ভারসাম্য রক্ষা করে চলা সেগুলো নিশ্চিত করা দরকার।
এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, সত্যিকারের সুশীল সমাজকে অরাজনৈতিক বলবো না, তবে নির্দলীয় হওয়া উচিত। কোন দলভিত্তিক হলে তারা সুশীল সমাজের সংজ্ঞার মধ্যে পড়ার কথা না। সুশীল সমাজের সংজ্ঞা হচ্ছে নন-গভর্নমেন্ট, নন-পার্টি, নন-মিলিটারি। কিন্তু আমরা সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের দলীয় রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার প্রবণতাটা লক্ষ্য করছি বেশ কয়েকবছর ধরে। তিনি আরও বলেন, আমি যদি কোথাও কোন জায়গায় অবস্থান নেই সুশীল সমাজের নামে সেই অবস্থান যদি কোন দলের পক্ষে যায় তখনই তাকে চিহ্নিত করে ফেলা হয় যে ওই দলের ওই। এই অন্যায়টাও করা হয়। আমরা তো দেখি একজন মানবাধিকার কর্মী একজন অবস্থান নিলেন যেটা ন্যায্য। যখন দেখা গেল রাজনৈতিক দলের বিপক্ষে যাচ্ছে, অথবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপক্ষে যাচ্ছে। তারা তাকে দলীয় কালার দেয়ার চেষ্টা করছে। দুদিকেই সমস্যা। একটা হচ্ছে দলীয় আনুগত্যের বিষয় থাকতে পারে। তার চেয়েও বেশি হচ্ছে যখনই কোন জায়গায় সুশীল সমাজ অবস্থান নেয়ার চেষ্টা করছে তখনই তাকে দলীয় রাজনীতির পরিচয় দিয়ে আখ্যায়িত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, বিভিন্ন সংগঠন যারা আছেন পেশাজীবীদের মধ্যে সর্বত্র দলীয়ভাবে বিভাজনটা প্রকট। তারা কিন্তু সুশীল সমাজের অংশ।
No comments