দুরন্ত রাজনের স্বপ্ন ছিল বড় হবে
সুরমা
তীরের গ্রাম বাইয়ারপাড়। এ গ্রামেরই দরিদ্র পরিবারের সন্তান রাজন। দরিদ্র
হলে কি হবে শিশু রাজনেরও ছিল বড় হওয়ার স্বপ্ন। লেখাপড়া করার স্বপ্ন। কিন্তু
দরিদ্র্যতাই প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায় তার লেখাপড়ায়। আর জীবনে বাধা হয়ে
দাঁড়ায় পাশ গ্রামের কিছু পাষণ্ড। যাদের নির্মম অত্যাচার তার জীবন প্রদীপ
নিভে যায়। অথচ ওই দিন সকালে ঘর থেকে বের হওয়ার সময়ও কি রাজন জানতো পাশ
গ্রামে তার জন্য অপেক্ষা করছে যমদূত। প্রতিদিন ভোরে রাজনতো এ পথ ধরেই যেতো
সবজী বেচতে। শিশু রাজন জীবন কি বুঝার আগেই চলে যেতে হলো পৃথিবী ছেড়ে। অথচ
সুন্দর এ প্রথিবীতে রাজন খেলায় মেতে থাকতো সুরমার তীরে। খেলার সঙ্গী ছিলো
ছোটভাই সাজনসহ পাড়ার ছেলেরাও। মায়ের বকুনিও খেলা থেকে বিরত রাখা যেত না
তাকে। বন্ধুদের নিয়ে সুরমায় সাঁতার কাটা, মাছ ধরা ছিলো তার নেশা। এখন এ সবই
স্মৃতি। রাজন চলে গেছে না ফেরার দেশে। আর এই রাজনের শেষ ঠাঁই হয়েছে সুরমার
তীরেই। বাইয়ারপাড় গ্রামের নিজ বাড়ির আঙ্গিনার কাছাকাছি সুরমা নদীর তীরেই
চির নিদ্রায় শায়িত রাজন। মায়ের চোখের সামনেই রাজনের কবর। দরোজা খুললেই
রাজনের কবর চোখে পড়ে মা লুবনা বেগমের। রাজনের পুরো নাম সামিউল ইসলাম রাজন।
বয়স ১২ কিংবা ১৩ বছর। বাইয়ারপাড়ের আজিজুর রহমানের প্রথম সন্তান। পিতা
মাইক্রোবাস চালক। নিতান্তই গরিব ঘরের সন্তান সে। মা লুবনা বেগম গৃহিণী। বড়
ছেলে হিসেবে সে ছিলো সবার আদরের। পরিবারের স্নেহ ও ভালোবাসায় বড় হয়েছে সে।
বড়ই চঞ্চল ছিলো সে। চঞ্চলতার কারণে মায়ের বকুনি ছিলো তার নিত্য সঙ্গী।
রাজনের ছোটো ভাইয়ের নাম সাজন। সাজনের বয়স ৭ বছর। সেও স্কুলে পড়ালেখা করে।
দুই ভাই এক সঙ্গে মাতিয়ে রাখতো গোটা ঘর। তাদের অবিরাম দুষ্টুমি মাতিয়ে
রাখতো আজিজ-লুবনার সংসার। ছয় বছর বয়স যখন তখন গ্রামের পার্শ্ববর্তী
অনন্তপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয় রাজনকে। ওই স্কুলেই
কেটেছে তার চারটি বছর। এই চার বছরের মধ্যে সে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত
পড়ালেখা করেছে। স্কুলেও বেশ দুরন্ত ছিলো রাজন। বন্ধুদের নিয়ে দুষ্টুমির
অন্ত ছিলো। গতকাল তার স্কুলের সহপাঠীরা মানবজমিনের কাছে জানিয়েছে, সে ছিলো
সবার প্রিয়। পড়ালেখায় তেমন ভালো না হলেও ছেলেকে উচ্চ শিক্ষিত করবেন এমনটি
মনে মনে ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন মা লুবনা বেগম। কিন্তু পারিবারিক দুর্দিনের
বেড়াজালে বন্দি হয়ে পড়ে শিশু রাজনের জীবন। এ বছরের শুরু থেকে আর বিদ্যালয়ে
পা মাড়ায়নি সে। অভাব-অনটনের সংসারে সে হাল ধরার চেষ্টায় মেতে উঠে। কিছু দিন
ধরে সবজি ব্যবসায় পা বাড়ায় সাজন। সেই ভোর হলেই সবজি ব্যবসার জন্য বের হয়।
দুপুরের পরপরই সে ফিরতো বাড়িতে। এরপর বন্ধুদের নিয়ে চষে বেড়াতো গোটা গ্রাম।
রাজনের সহপাঠীরা জানিয়েছে, রাজন টুকেরবাজার, মদিনা মার্কেট সহ সিলেট শহরের
বিভিন্ন স্থানে সবজি ব্যবসা করতো। যা উপার্জন হতো তা তুলে দিতো মা লুবনা
বেগমের হাতে। পিতা আজিজুর রহমান প্রায় সময় যেতো না কাজে। এ জন্য পরিবারে
অভাব লেগেই থাকতো। অভাবের তাগিদে সে সবজি ব্যবসায় পা বাড়ায়। রাজনের পিতা
জানিয়েছেন, রাজনের মৃত্যু সবার মনে দাগ কেটেছে। গোটা দেশের মানুষ এ ঘটনায়
ধিক্কার দিয়েছে। তিনি বলেন, রাজনের মৃত্যুর পর ঘাতকদের ছেড়ে দেয়া ভিডিও
দেখে অসুস্থ হয়ে পড়েছে তারা। তিনি জানান, রাজনের কবর হয়েছে তাদের বাড়ির
পাশেই। তার কবর দেখতে আসছেন দূর দূরান্ত থেকে মানুষ। সুরমার তীর ঘেঁষা
বাইয়ারপাড়ের এই রাজনকে যেভাবে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়েছে সেই ভিডিও
যারা দেখছেন তারা চোখের জল ধরে রাখতে পারছেন না। গতকাল রাজনের মা লুবনা
বেগমকে সিলেটের আদালতে আনা হয়েছিলো। সেখানে সাংবাদিকদের দেখেই অঝোরে কেঁদে
উঠেন তিনি। আমার বাছাধন কই গেলো... বলেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এরপর গাড়িতে
তুলে তাকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। একই অবস্থা বাবা আজিজুর রহমানেরও।
চোখের জল ছেড়ে বললেন, আমার অবুঝ শিশুটি মৃত্যুর আগে পানির জন্য হাহাকার
করেছে। একটু পানি দেয়নি ওরা। অথচ পানিতে দেশ ভেসে যাচ্ছে। আমার ছেলে একটু
পানি পেলো না...। কত নির্মমভাবে ওরা রাজনকে মেরেছে। ওদের কী একটু দয়া-মায়া
হলো না।
No comments