কাজের বুয়া এবং... by সাজেদুল হক
এটা
আপনি নিশ্চিতই থাকতে পারেন। ১৬ কোটি মানুষের দেশ- বাংলাদেশের বহু মানুষের
নামই মর্জিনা। আমরা, আমাদের মা-বোন অনেকে এ নামেই পরিচিত। পরাক্রমশালী
মন্ত্রী মহোদয় হয়তোবা সব মর্জিনাকে বোঝাননি। তার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু
মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা। এ আক্রমণে তিনি টেনে এনেছেন কাজের
মেয়ে মর্জিনাকে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বেফাঁস মন্তব্যে মন্ত্রী শুধু মার্কিন
রাষ্ট্রদূতকেই অপমান করেননি, তিনি অবমাননা করেছেন বাংলাদেশের সব
গৃহকর্মীকেই। যাদের শ্রম আর ঘাম এ রাষ্ট্রের অর্থনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে
জড়িত, সংবিধান যাদেরকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মালিকানা দিয়েছে। যদিও ক্ষমতার
কারবারিরা এ মালিকানা স্বীকার করেন না। তারা মনে করেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের
তারাই মালিক। বাকিরা সবাই প্রজা। সংবিধান রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের
সমমর্যাদা ঘোষণা করেছে। তাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল
ইসলামের বক্তব্য ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত আর দুই লাখের বেশি মা-বোনের
সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত সংবিধানের প্রতিও এক ধরনের অস্বীকৃতি। অথচ এ
সংবিধান সংরক্ষণের শপথ তিনি নিয়েছেন।
সৈয়দ আশরাফ ইস্যুতে বাংলাদেশ-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে বড় ধরনের ফাটল তৈরির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম দূরত্ব তৈরি হয় ২০১১ সালে। যখন গ্রামীণ ব্যাংক থেকে নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অপসারণ করা হয়। মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকে বারবার ড. ইউনূসের মর্যাদা রক্ষার ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করা হলেও আওয়ামী লীগ সরকার তা আমলে নেয়নি। যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রশ্নেও কিছু কিছু ব্যাপারে বাংলাদেশের সঙ্গে মার্কিন মনোভাবের পার্থক্য রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক বিশেষ দূত স্টিফেন জে র্যাপ বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস আইনে বেশ কিছু সংশোধনীর পরামর্শ দিয়েছিলেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তার পরামর্শ উপেক্ষিত হয়েছে। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় মতবিরোধ তৈরি হয় বাংলাদেশে নির্বাচন প্রশ্নে। যুক্তরাষ্ট্র সবসময়ই বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণমূলক অবাধ নির্বাচন চেয়ে আসছে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশই যুক্তরাষ্ট্রের এ অবস্থানে সমর্থন জানায়। যদিও ভারতের অবস্থান ছিল ভিন্ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত এ ব্যাপারে একে অন্যের ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালায়। আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বাধা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত ৫ই জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরেকটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পক্ষে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে। এমনকি ছয় মাসের মধ্যে একটি নতুন নির্বাচনের কথাও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়। এসব কারণে সরকার যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ক্ষুদ্ধ হয়। এর আগে অন্তত চার জন মন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। তবে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিরোধ দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের জন্য কোন সুফল বয়ে আনবে না। কারণ এখনও দুনিয়ার বেশিরভাগ দেশের ওপরই যুক্তরাষ্ট্রের এক ধরনের প্রভাব রয়েছে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশ মার্কিন নীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়।
যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ক টানাপড়নের মধ্যে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম গত ২৯শে নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাইকে ‘দুই আনার মন্ত্রী’ বলে বিদ্রূপ করেন। খুলনা সার্কিট হাউসে মহানগর আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই আনা মন্ত্রী, চার আনাও না, এক মন্ত্রী আছে নিশা দেশাই’। ড্যান মজিনাকে ‘কাজের মেয়ে মর্জিনা’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ কিন্তু ওই অবস্থায় নাই যে কাজের মেয়ে মর্জিনা বাংলাদেশের ক্ষমতার রদবদল করতে পারে।’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনায় মুখর হলেও আওয়ামী লীগের প্রতি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সমর্থনের কথা সদর্পেই ঘোষণা করেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তিন দিনের সফর শেষে ওই দিনই ঢাকা ত্যাগ করেন নিশা দেশাই। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, প্রভাবশালী মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ মজিনার সমালোচনা করতে গিয়ে কাজের মেয়ে মর্জিনাদের বিদ্রূপ করেছেন। সংবিধান যে অধিকার তাকে দেয়নি। সংবিধানের বেশ কিছু অনুচ্ছেদে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নাগরিকদের সমতার বাণী উচ্চারিত হয়েছে। সংবিধানের প্রস্তাবনায় ঘোষণা করা হয়েছে, ‘আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ বলছে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কতৃত্বে কার্যকর হইবে।’ সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ বলছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ ২৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।’ তবে কেউ কেউ বলছেন, কাজের মেয়েদের কথা টেনে সৈয়দ আশরাফ হয়তো বাংলাদেশের মানুষের ক্ষমতাহীনতার প্রতিও ইঙ্গিত করে থাকতে পারেন। জনগণ যা-ই চাক না কেন ক্ষমতার মঞ্চে কোন পরিবর্তন আসবে না- এ বার্তাই হয়তো তিনি স্পষ্ট করেছেন। নিশা দেশাই কয় আনার মন্ত্রী সে বিতর্ক আলাদা। তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, অতিথিবৎসল হিসেবে এ অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘ পরিচিতি রয়েছে। অতিথিদের মর্যাদা সব ধর্মেই নিশ্চিত করা হয়েছে। এমনকি অতিথি পাখি খাওয়ার পক্ষে বক্তব্য দিয়েও আমাদের এক প্রয়াত মন্ত্রীকে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। সেই দেশে অতিথি হয়ে এসেছিলেন নিশা দেশাই বিশোয়াল। সরকার আর বিরোধী সব দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গেই কথা বলেছেন তিনি। অথচ বাংলাদেশের মন্ত্রীর কাছ থেকে বিদ্রূপের শিকার হতে হয়েছে তাকে। নিশা দেশাই এবং ড্যান মজিনার প্রতি সৈয়দ আশরাফারে আচরণ জেনেভা কনভেনশনেরও সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এটা সত্য যে, প্রায়ই বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশী কূটনীতিকরা তাদের সীমারেখার বাইরে গিয়ে নানা কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়েন। এ ক্ষেত্রে তাদের সতর্ক করার অথবা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার প্রচলিত বিধান রয়েছে। কিন্তু সে পথে না হেঁটে বাগাড়ম্বরপূর্ণ মন্তব্যের গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন সর্ব মহলেই উঠেছে।
ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছেন। ঢাকার একটি দৈনিকের কাছে তিনি আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য সম্পর্কে নিজের বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন। মাইলাম বলেন, নির্বাচনের ব্যাপারে যে কোন মন্তব্যকেই বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব সুনজরে দেখবে না। মধ্যবর্তী নির্বাচন দেয়ার কোন পরিকল্পনা এই সরকারের নেই। ফলে নির্বাচন বিষয়ক যে কোন ইঙ্গিত তাদের গাত্রদাহের কারণ হতে পারে। সম্ভবত আওয়ামী লীগ মনে করে, তাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রয়োজন নেই। তিনি বলেন, আমি মঙ্গলবার পড়ছিলাম, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন বাংলাদেশের তৈরী পোশাক আমদানি না করে আমেরিকার কোন উপায় নেই। কারণ, বাংলাদেশ থেকে আমদানি বন্ধ করলে আমেরিকা তৈরী পোশাকের সঙ্কটে পড়বে। তার এ কথার অর্থ সম্ভবত এই যে আমেরিকাকে বাংলাদেশের যতটা প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি আমেরিকার প্রয়োজন বাংলাদেশকেই। বলাই বাহুল্য, এ রকম ধারণা হাস্যকর। তিনি বলেন, দীর্ঘমেয়াদি হিসেবে এই নীতি অনুসরণের ফল ভয়াবহ হবে। তবে চলতি সরকার দীর্ঘ মেয়াদের কথা ভাবছে বলে মনে হয় না। তিনি তাঁর আগের আশঙ্কা পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, বাংলাদেশ ক্রমশ কার্যত একদলীয় সরকার ব্যবস্থার দিকে এগোচ্ছে। ওবামা প্রশাসন যে বাংলাদেশের চলতি ‘একতান্ত্রিক লক্ষণে’র বিরুদ্ধে কোন অবস্থান নেয়নি, তাতে মাইলাম তার অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
শেষ কথা: এ সত্য অস্বীকার করার যো নেই যে, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ এখন এক অবমাননার উপত্যকা। এখানে কে কখন অবমাননার শিকার হবেন তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। নিশা দেশাই আর মজিনার বিরুদ্ধে মন্তব্যে শুধু একটি নতুন বিষয়ই সংযুক্ত হয়েছে। অবমাননাকে এখন আমরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছি। এ সাফল্য অস্বীকার করার উপায় নেই।
সৈয়দ আশরাফ ইস্যুতে বাংলাদেশ-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে বড় ধরনের ফাটল তৈরির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম দূরত্ব তৈরি হয় ২০১১ সালে। যখন গ্রামীণ ব্যাংক থেকে নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অপসারণ করা হয়। মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকে বারবার ড. ইউনূসের মর্যাদা রক্ষার ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করা হলেও আওয়ামী লীগ সরকার তা আমলে নেয়নি। যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রশ্নেও কিছু কিছু ব্যাপারে বাংলাদেশের সঙ্গে মার্কিন মনোভাবের পার্থক্য রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক বিশেষ দূত স্টিফেন জে র্যাপ বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস আইনে বেশ কিছু সংশোধনীর পরামর্শ দিয়েছিলেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তার পরামর্শ উপেক্ষিত হয়েছে। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় মতবিরোধ তৈরি হয় বাংলাদেশে নির্বাচন প্রশ্নে। যুক্তরাষ্ট্র সবসময়ই বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণমূলক অবাধ নির্বাচন চেয়ে আসছে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশই যুক্তরাষ্ট্রের এ অবস্থানে সমর্থন জানায়। যদিও ভারতের অবস্থান ছিল ভিন্ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত এ ব্যাপারে একে অন্যের ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালায়। আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বাধা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত ৫ই জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরেকটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পক্ষে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে। এমনকি ছয় মাসের মধ্যে একটি নতুন নির্বাচনের কথাও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়। এসব কারণে সরকার যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ক্ষুদ্ধ হয়। এর আগে অন্তত চার জন মন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। তবে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিরোধ দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের জন্য কোন সুফল বয়ে আনবে না। কারণ এখনও দুনিয়ার বেশিরভাগ দেশের ওপরই যুক্তরাষ্ট্রের এক ধরনের প্রভাব রয়েছে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশ মার্কিন নীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়।
যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ক টানাপড়নের মধ্যে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম গত ২৯শে নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাইকে ‘দুই আনার মন্ত্রী’ বলে বিদ্রূপ করেন। খুলনা সার্কিট হাউসে মহানগর আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই আনা মন্ত্রী, চার আনাও না, এক মন্ত্রী আছে নিশা দেশাই’। ড্যান মজিনাকে ‘কাজের মেয়ে মর্জিনা’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ কিন্তু ওই অবস্থায় নাই যে কাজের মেয়ে মর্জিনা বাংলাদেশের ক্ষমতার রদবদল করতে পারে।’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনায় মুখর হলেও আওয়ামী লীগের প্রতি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সমর্থনের কথা সদর্পেই ঘোষণা করেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তিন দিনের সফর শেষে ওই দিনই ঢাকা ত্যাগ করেন নিশা দেশাই। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, প্রভাবশালী মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ মজিনার সমালোচনা করতে গিয়ে কাজের মেয়ে মর্জিনাদের বিদ্রূপ করেছেন। সংবিধান যে অধিকার তাকে দেয়নি। সংবিধানের বেশ কিছু অনুচ্ছেদে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নাগরিকদের সমতার বাণী উচ্চারিত হয়েছে। সংবিধানের প্রস্তাবনায় ঘোষণা করা হয়েছে, ‘আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ বলছে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কতৃত্বে কার্যকর হইবে।’ সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ বলছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ ২৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।’ তবে কেউ কেউ বলছেন, কাজের মেয়েদের কথা টেনে সৈয়দ আশরাফ হয়তো বাংলাদেশের মানুষের ক্ষমতাহীনতার প্রতিও ইঙ্গিত করে থাকতে পারেন। জনগণ যা-ই চাক না কেন ক্ষমতার মঞ্চে কোন পরিবর্তন আসবে না- এ বার্তাই হয়তো তিনি স্পষ্ট করেছেন। নিশা দেশাই কয় আনার মন্ত্রী সে বিতর্ক আলাদা। তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, অতিথিবৎসল হিসেবে এ অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘ পরিচিতি রয়েছে। অতিথিদের মর্যাদা সব ধর্মেই নিশ্চিত করা হয়েছে। এমনকি অতিথি পাখি খাওয়ার পক্ষে বক্তব্য দিয়েও আমাদের এক প্রয়াত মন্ত্রীকে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। সেই দেশে অতিথি হয়ে এসেছিলেন নিশা দেশাই বিশোয়াল। সরকার আর বিরোধী সব দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গেই কথা বলেছেন তিনি। অথচ বাংলাদেশের মন্ত্রীর কাছ থেকে বিদ্রূপের শিকার হতে হয়েছে তাকে। নিশা দেশাই এবং ড্যান মজিনার প্রতি সৈয়দ আশরাফারে আচরণ জেনেভা কনভেনশনেরও সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এটা সত্য যে, প্রায়ই বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশী কূটনীতিকরা তাদের সীমারেখার বাইরে গিয়ে নানা কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়েন। এ ক্ষেত্রে তাদের সতর্ক করার অথবা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার প্রচলিত বিধান রয়েছে। কিন্তু সে পথে না হেঁটে বাগাড়ম্বরপূর্ণ মন্তব্যের গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন সর্ব মহলেই উঠেছে।
ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছেন। ঢাকার একটি দৈনিকের কাছে তিনি আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য সম্পর্কে নিজের বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন। মাইলাম বলেন, নির্বাচনের ব্যাপারে যে কোন মন্তব্যকেই বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব সুনজরে দেখবে না। মধ্যবর্তী নির্বাচন দেয়ার কোন পরিকল্পনা এই সরকারের নেই। ফলে নির্বাচন বিষয়ক যে কোন ইঙ্গিত তাদের গাত্রদাহের কারণ হতে পারে। সম্ভবত আওয়ামী লীগ মনে করে, তাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রয়োজন নেই। তিনি বলেন, আমি মঙ্গলবার পড়ছিলাম, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন বাংলাদেশের তৈরী পোশাক আমদানি না করে আমেরিকার কোন উপায় নেই। কারণ, বাংলাদেশ থেকে আমদানি বন্ধ করলে আমেরিকা তৈরী পোশাকের সঙ্কটে পড়বে। তার এ কথার অর্থ সম্ভবত এই যে আমেরিকাকে বাংলাদেশের যতটা প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি আমেরিকার প্রয়োজন বাংলাদেশকেই। বলাই বাহুল্য, এ রকম ধারণা হাস্যকর। তিনি বলেন, দীর্ঘমেয়াদি হিসেবে এই নীতি অনুসরণের ফল ভয়াবহ হবে। তবে চলতি সরকার দীর্ঘ মেয়াদের কথা ভাবছে বলে মনে হয় না। তিনি তাঁর আগের আশঙ্কা পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, বাংলাদেশ ক্রমশ কার্যত একদলীয় সরকার ব্যবস্থার দিকে এগোচ্ছে। ওবামা প্রশাসন যে বাংলাদেশের চলতি ‘একতান্ত্রিক লক্ষণে’র বিরুদ্ধে কোন অবস্থান নেয়নি, তাতে মাইলাম তার অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
শেষ কথা: এ সত্য অস্বীকার করার যো নেই যে, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ এখন এক অবমাননার উপত্যকা। এখানে কে কখন অবমাননার শিকার হবেন তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। নিশা দেশাই আর মজিনার বিরুদ্ধে মন্তব্যে শুধু একটি নতুন বিষয়ই সংযুক্ত হয়েছে। অবমাননাকে এখন আমরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছি। এ সাফল্য অস্বীকার করার উপায় নেই।
No comments