একবার সবাই আসে... by রিপন আনসারী
সাংবাদিকরা আসেন। ছবি তোলেন। নেতাদেরও কেউ কেউ আসেন, কুশল জিজ্ঞেস করেন, আশ্বাস দেন, চলেও যান। বছরে এমন ঘটনা দু’বারই হয়। তারপর সব সুনসান। বাকি দিনগুলো কেমন করে কাটছে কি খাচ্ছি, সংসারই বা চলছে কি করে কেউ কোন খবর রাখে না। ‘বীরপ্রতীক মাহফুজ ও বীরপ্রতীক ইব্রাহীম দুই সহযোদ্ধা বন্ধু একবুক যন্ত্রণা নিয়ে চলে গেছে, এবার আমার পালা’। কথাগুলো বলেছেন আতাহার আলী খান বীরপ্রতীক। মানিকগঞ্জের বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত ৩ মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে বেঁচে থাকা একমাত্র তিনি। মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ উঠতেই তারুণ্যে বদলে যান মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার বারাহির গ্রামের আতাহার আলী খান বীরপ্রতীক। গৌরবের সুবর্ণ আলোয় উদ্ভাসিত ভিন্ন এক মানুষ হয়ে যান তিনি। ১৯৬৩ সালে বাবার সঙ্গে রাগ করে চট্টগ্রাম গিয়ে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস্ এ যোগ দেন। চাকরির আট বছরের মাথায় এলো ১৯৭১। তখন টগবগে তরুণ তিনি। বিন্দু মাত্র দ্বিধা করিনি, ভাবিনি পরিবার- পরিজনের কথা। সোজা লড়াইয়ের মাঠে। ভূরুঙ্গামারী কলেজে পাকসেনাদের একটি ক্যাম্পে প্রাণঘাতী হামলা চালিয়ে ২০ জনের মতো খানসেনা মেরে তাদের অস্ত্র ছিনিয়ে নেন তিনি। এরপর রায়গঞ্জে পাকসেনাদের হেডকোয়ার্টারে আক্রমণ চালায়। লে. সামাদসহ তারা ১২-১৩ জন সহযোদ্ধা শহীদ হওয়ার পর তারা পিছু সরে আসেন। তার ক’দিন বাদেই আবার হামলা চালায় সেখানে। এবার আর পিছু হটা নয়। তার হাতে নিহত হয় শতাধিক পাকসেনা। এমনিভাবেই দীর্ঘ প্রায় ৯ মাস রংপুর, লালমনিরহাট, রায়গঞ্জ, ভূরুঙ্গামারীসহ বিভিন্ন জায়গায়। দেশ স্বাধীন হলে যুদ্ধের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছি রাষ্ট্রীয় খেতাব বীরপ্রতীক। স্বাধীন দেশে আবার ফিরে যান আতাহার আলী খান বীরপ্রতীক। কিন্তু চরম অসম্মান নিয়ে ফিরে আসতে হয় তাকে। ১৯৮৫ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভালুকাপাড়ায় শান্তিবাহিনী আতাহার আলীদের ক্যাম্পে আক্রমণ চালিয়ে ৩ সৈনিককে হত্যা করে। আকস্মিক এ হামলা ঠেকানোর ব্যর্থতার দায়ে আতাহার আলীসহ ১০ বিডিআর সদস্যকে বরখাস্ত করা হয়। অথচ এ ব্যর্থতার দায় তাঁর ছিল না। দায়িত্বে ছিল না কোন গাফিলতি। এরপর মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রণালয়ে ঘুরেও চাকরি ফিরে পাননি তিনি। এসব স্মৃতিকথায় অশ্রুসিক্ত হন আতাহার আলী খান। প্রচ- মানসিক যন্ত্রণা হয় তার। চোখ গড়িয়ে নামে অশ্রু ধারা । সেই থেকে অভাব-অনাহার, ক্ষুধা তার পরিবারকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। তিনি বলেন, ‘ভেবেছিলাম চাকরি গেছে তো কি হয়েছে মুক্তিযোদ্ধার সম্মান নিয়েই বেঁচে থাকবো। জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে দেখলাম সে সম্মানটুকুও কেউ অন্তর দিয়ে দিতে চায় না। তাই বাধ্য হয়ে অভাব আর অবহেলায় দগ্ধ হয়েও মানিকগঞ্জের এই অজোপাড়াগাঁয়ে বাপ-দাদার মাটি কামড়ে পড়ে আছি। বাড়িতে সাংবাদিক আর নেতাদের আনাগোনা দেখলে গ্রামের মানুষ টের পায় স্বাধীনতা দিবস অথবা বিজয় দিবস হয়তো কাছে। আতাহার আলীর দুঃখ, বেঁচে আছি নাকি মরে গেছি সে খবর সারা বছর কেউ রাখে না। না রাখুক কিচ্ছু এসে যায় না। কিন্তু জেলার মুক্তিযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানগুলোতে যখন সামান্য দাওয়াতটাও মেলে না তখন বীরপ্রতীক খেতাবটার অর্থ ঝাপসা হয়ে আসে। আতাহার আলী সত্তরে পা দিয়েছেন। শরীরটা বাঁকা হয়ে গেছে। অসুখ-বিসুখ তাড়া করে বেড়াচ্ছে। একমাত্র ছেলের রোজগারেই বেঁচে থাকা। কিচ্ছু চাইবার নেই আতাহার আলীর, অভাবে নয়, কষ্ট বাড়ে শুধু অবহেলায়। এলাকাবাসীর আকাঙ্ক্ষা এ বীরের নামে তাদের গ্রামের পাশে ধলেশ্বরী নদীতে যে ব্রিজটি হবে তা যেন বীরপ্রতীক আতাহার আলীর নামেই হয়।
No comments