অসৎ হলেই বড়লোক হওয়া যায়? by মেজর (অব.) সুধীর সাহা
ঢাকা জেলার ধামরাই নিবাসী গেদু আর আক্কেল
দুই সহোদর। গেদুর বয়স ১০, আর আক্কেলের ৯। ঢাকা-আরিচা বড় রাস্তার পাশে তারা
তাদের বাবার সঙ্গে ক্ষেতে কাজ করছিল। ভারত তখন কংগ্রেসের শাসনাধীন। রাহুল
গান্ধী ঢাকায় বেড়াতে এসে সাভার স্মৃতিসৌধে গিয়েছিলেন গাড়িবহর করে। রাস্তার
পাশে দাঁড়িয়ে ছোট ভাই আক্কেল সেই গাড়িবহর দেখে বড় ভাই গেদুকে জিজ্ঞেস
করেছিল, ‘ভাই, উনি না জানি কত বড়লোক।’ উত্তরে গেদু ছোট ভাইকে বলেছিল, ‘উনি
অনেক বড়লোক অইব। মনে অয় দিনে একসের গুড় খায়।’ গেদু আর আক্কেলের ধারণা, কেবল
বড়লোক হলেই যত খুশি তত খেজুরের গুড় খাওয়া যায়। রাহুল গান্ধী বাংলাদেশ সফর
করে চলে গিয়েছিলেন ভারতে। গেদু বা আক্কেল কিংবা অন্য কোনো সাংবাদিক জানতে
পারেনি রাহুল গান্ধী সত্যি সত্যি খেজুরের সুস্বাদু গুড় খান কি-না; আর খেলে
কতটুকু খান।
আমার বন্ধু ছিল ডা. রেজাউল করিম রাজা। ছিল বলছি এ কারণে যে, অনেক আগেই আততায়ীর গুলিতে সে এ জগৎ ছেড়ে চলে গেছে। রাজার জীবন কেটেছিল অতি দারিদ্র্যের মধ্যে। অর্ধেক খেয়ে, না খেয়ে তার শিশুকাল কেটেছে। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হওয়ায় রাজা পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার এক কঠিন সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত করেছিল। গ্রাম থেকে শহরে এসে ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়েছিল রাজা। পড়াশোনার খরচ চালাতে তাকে লজিং থাকতে হতো। রোজী নামে একটি মেয়েকে সে পড়াত এবং বিনিময়ে থাকা-খাওয়া পেত। কলেজের বেতন, যাতায়াত এবং জামা-কাপড়ের খরচটি তার উঠত অন্য একটি প্রাইভেট টিউশনি করে। রাজা তারপরও থেমে থাকেনি। কলেজ পাস করে মেডিকেলে ভর্তি হয়েছিল এবং একসময় ডাক্তার হয়ে সুমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। রোজীর বাবা পাটের ব্যবসা করতেন। রাজার কাছে তাদের বড়লোকিপনার নানা গল্প শুনতাম। তাদের বাড়িতে গেট ছিল। মালিবাগের গেটওয়ালা বাড়িতে আমরা কখনও ঢুকতে পারিনি। কেননা রাজার নিষেধ ছিল। গরিব গৃহশিক্ষকের বন্ধুরা বাসায় এলে বড়লোক গৃহকর্তার মান যেতে পারে। রাজা বলত, সে সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকে। কাজের মেয়েটাকেও নাকি সে ভয় পায়। প্রশ্ন করলে বলত, অনেক বড়লোক- অনেক বড়লোক। পরে শুনেছিলাম, বড়লোকের মেয়েটি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার পাঠ চুকিয়ে একটি প্রাইভেট অফিসে ব্যক্তিগত সহকারীর চাকরি নিয়েছে, ততদিনে রাজা ডা. রাজা হয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত। তারপরও রাজার চোখে মালিবাগের গেটওয়ালা বাড়িটিই ছিল বড়লোকের বাড়ি এবং ডিমের মামলেট, কলা আর আটার রুটি ছিল বড়লোকদের বিলাসবহুল সকালের নাশতা।
তখন কলেজে পড়ি। পরিচয় হয়েছিল বনানীর এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে। একবার ওই ভদ্রলোক তার বাড়িতে দাওয়াত করেছিলেন। বনানীর ৪ নম্বর রোডের গেটওয়ালা বাড়িটিতে প্রবেশ করে পরপর তিনটি ড্রয়িংরুম দেখতে পেয়েছিলাম। বড় বাড়ি এবং তিনটি ড্রয়িংরুম দেখেই বুঝে ফেলেছিলাম, অনেক বড়লোকের বাড়িতে এসেছি। গ্রাম থেকে আসা শহরের কলেজে পড়া একজন ছাত্রের চোখে তখন এমন একটি পরিবারই ছিল সবচেয়ে বড়লোক পরিবারের ছবি। আমার স্কুলে পড়ার সময়ে পাশের গ্রামের লাল মিয়া চাচা ছিলেন আমার দেখা সবচেয়ে বড়লোক মানুষ। তিনি মহাখালীতে একটি বাসা ভাড়া করে থাকতেন। তিন বন্ধু মিলে একবার দুপুরে খেতে গিয়েছিলাম তার বাসায়। ভাত খেয়ে হাত ধুয়ে তার রেলিংয়ে ঝোলানো গামছা দিয়ে হাত মুছতে সাহস পাইনি আমরা। বড়লোক লাল মিয়া চাচার গামছা ব্যবহার করার দুঃসাহস ছিল না আমাদের তখন।
পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানে ২২টি ধনাঢ্য পরিবার ছিল। ২২ পরিবারের কাউকেই কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি আমার। তারা ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে। সাধারণ মানুষ তাদের গল্প শুনত, কিন্তু তাদের জৌলুস চোখে দেখার সুযোগ পেত না। আজ স্বাধীন বাংলাদেশে ২২ পরিবার নয়, হয়তোবা ২২ লাখ পরিবার বড়লোক হয়েছে। তারা কেমন বড়লোক, ঠিক আঁচ করা যায় না। হবে হয়তো অনেক বড়লোক। ঠিক এমন কিছু বড়লোককে এখন আমি অনেক কাছ থেকে চিনি ও জানি। ওঠা-বসাও করি তাদের কারও কারও সঙ্গে। ওই বড়লোকদের বাসায় গিয়েও কিন্তু তেমনটাই মনে হয়। মনে হয়, এরা অনেক বড়লোক- হয়তো অনেক খেজুরের গুড় খায় এরা!
তখন সবে কানাডায় গেছি। বাসা ভাড়া করা তখন বেশ কঠিন ছিল। খালি বাসা পাওয়া বেশ কষ্টকর ব্যাপার ছিল। পুরনো একটি পরিবারের সাহায্য লাভের আশায় একদিন একটি বাসায় গেলাম। ভদ্রমহিলা কানাডায় স্থায়ীভাবে থাকেন এবং ভদ্রলোক বাংলাদেশ ও কানাডা দু’জায়গায়ই থাকেন। গল্পের ছলে ভদ্রমহিলা আমাদের বোঝাচ্ছিলেন, তার স্বামী কানাডা থাকতে চান না। নিজেই আবার যুক্তি দেখান, কী করে থাকবেন? এখানে কী করবেন? ঢাকায় আমার স্বামী জমিদারের মতো থাকেন; এরকম ১০টা পরিবার পুষতে পারেন। গাড়ি-বাড়ি কি-না আছে আমাদের। শুনে কষ্টই লাগল। আহারে! এমন একটি বড়লোক পরিবারের লোকজন কত কষ্টে কানাডায় থাকছে। বিদায়ের ঠিক আগ মুহূর্তে ভদ্রমহিলার স্বামীর সঙ্গে মোলাকাত করার সুযোগ ঘটল। আমাকে দেখেই তিনি বললেন, স্যার আপনি? আমি ঠিক না চেনায় ভদ্রলোক বললেন, ‘আপনি তো স্যার উকিল। আমি পাঁচ নম্বর কোর্টের সহকারী পেশকার।’ চলে আসতে আসতে হিসাব মিলাতে চেষ্টা করছিলাম। একজন সহকারী পেশকার যদি গাড়ি-বাড়ির মালিক আর ১০টি পরিবার চালানোর যোগ্যতা রাখেন, তবে পেশকার সাহেবের অবস্থা কী হতে পারে!
অধুনা একজন বড়লোকের সঙ্গে কথা বলছিলাম। ভদ্রলোক অনেক বড়লোক। রাস্তায় বের হলে তার সঙ্গে সিকিউরিটি, ব্যক্তিগত সহকারী, প্রাইভেট সেক্রেটারি সবই থাকে। আলিশান বাড়ি, বাড়ির ভেতরে দামি দামি গাড়িগুলোর জায়গা হয় না বলে তার অফিসেও ব্যক্তিগত দু’-একটি গাড়ি রাখতে হয়। ভদ্রলোকের ব্যবসাটি ঠিক কী তা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছিলাম না। তবে এটা বুঝতে পারছিলাম, দেশী-বিদেশী বড় বড় ঠিকাদারি তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন। ভদ্রলোকের ব্যবসায়িক জীবন মাত্র কয়েক বছরের। তার আগে তিনি পুলিশে চাকরি করেছেন। অবসরের সময় না হলেও ইন্সপেক্টর হয়ে ভদ্রলোক চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। এত টাকার মালিকের অত ছোট চাকরি করা ঠিক মানায় না। তাই তিনি এখন জাতীয়-আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ঠিকাদারি কাজের সঙ্গে জড়িত।
বড়লোক নামের বিষয়টি একেকজন একেক দৃষ্টিতে দেখে। ডা. রাজা যাকে বড়লোক ভেবেছিল, তার মেয়ে অফিস সহকারীর চাকরি করতে বাধ্য হয়েছিল। বড়লোক বিষয়টি আসলে বড় বেশি আপেক্ষিক। চীনের কিংবা হংকংয়ের একজন পানের দোকানদার বাংলাদেশের একজন বড় কোম্পানির মালিকের চেয়েও বড়লোক। কত টাকা থাকলে বড়লোক হওয়া যায়? কেউ জানে না। গেদু জানে, বড়লোক হলে অনেক গুড় খাওয়া যায়। একজন অসৎ সহকারী পেশকার বড়লোক, পুলিশের মাঠপর্যায়ের একজন অসৎ কর্মকর্তাও বড়লোক। আবার লাল মিয়া চাচা, যার গ্রামের বাজারে একটি বড় মুদি দোকান ছিল, আমার কিশোর চোখে তিনি ছিলেন বিশাল বড়লোক। কত টাকা থাকতে হয় একটি বড়লোকের পরিবারে? কত বড় বাড়ি হলে লোকে তাকে বড়লোক বলবে?
কলেজের শিক্ষক অসিত বাবু তার দুই কন্যাসন্তান নিয়ে মফস্বলের কলেজপাড়ায় থাকেন। দু’বেলা-তিনবেলা কোনো বেলায়ই তার ভাতের অভাব নেই। আর ওই যে সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা, যার অনেক বড় বাড়ি, অনেকগুলো গাড়ি, বাসায় কাজের লোক অনেক- এ দু’জনের মধ্যে কে বেশি বড়লোক? আমি যেভাবে দেখি, আপনি যেভাবে দেখেন- সেভাবেই নির্মিত হবে তাদের দু’জনের বড়লোকির মানদণ্ড।
সৎ পথের রাস্তা ভুলে যাওয়া বড়লোক মানুষগুলো যে টাকার বস্তা খাটের নিচে রাখে, আর খেটে খাওয়া শ্রমিকটির পড়ুয়া ছেলেটি যে কাগজের খাতাগুলো খাটের ওপরে রাখে, এদের মধ্যে কোনটার মূল্য বেশি? ক্ষয়ে যাওয়া সমাজ যদি প্রশ্নের উত্তর বের করতে না পারে, তবে আমি আবার পেছনে ফিরে এসে উত্তরটি জেনে যাব।
মেজর (অব.) সুধীর সাহা : কলামিস্ট
আমার বন্ধু ছিল ডা. রেজাউল করিম রাজা। ছিল বলছি এ কারণে যে, অনেক আগেই আততায়ীর গুলিতে সে এ জগৎ ছেড়ে চলে গেছে। রাজার জীবন কেটেছিল অতি দারিদ্র্যের মধ্যে। অর্ধেক খেয়ে, না খেয়ে তার শিশুকাল কেটেছে। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হওয়ায় রাজা পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার এক কঠিন সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত করেছিল। গ্রাম থেকে শহরে এসে ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়েছিল রাজা। পড়াশোনার খরচ চালাতে তাকে লজিং থাকতে হতো। রোজী নামে একটি মেয়েকে সে পড়াত এবং বিনিময়ে থাকা-খাওয়া পেত। কলেজের বেতন, যাতায়াত এবং জামা-কাপড়ের খরচটি তার উঠত অন্য একটি প্রাইভেট টিউশনি করে। রাজা তারপরও থেমে থাকেনি। কলেজ পাস করে মেডিকেলে ভর্তি হয়েছিল এবং একসময় ডাক্তার হয়ে সুমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। রোজীর বাবা পাটের ব্যবসা করতেন। রাজার কাছে তাদের বড়লোকিপনার নানা গল্প শুনতাম। তাদের বাড়িতে গেট ছিল। মালিবাগের গেটওয়ালা বাড়িতে আমরা কখনও ঢুকতে পারিনি। কেননা রাজার নিষেধ ছিল। গরিব গৃহশিক্ষকের বন্ধুরা বাসায় এলে বড়লোক গৃহকর্তার মান যেতে পারে। রাজা বলত, সে সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকে। কাজের মেয়েটাকেও নাকি সে ভয় পায়। প্রশ্ন করলে বলত, অনেক বড়লোক- অনেক বড়লোক। পরে শুনেছিলাম, বড়লোকের মেয়েটি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার পাঠ চুকিয়ে একটি প্রাইভেট অফিসে ব্যক্তিগত সহকারীর চাকরি নিয়েছে, ততদিনে রাজা ডা. রাজা হয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত। তারপরও রাজার চোখে মালিবাগের গেটওয়ালা বাড়িটিই ছিল বড়লোকের বাড়ি এবং ডিমের মামলেট, কলা আর আটার রুটি ছিল বড়লোকদের বিলাসবহুল সকালের নাশতা।
তখন কলেজে পড়ি। পরিচয় হয়েছিল বনানীর এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে। একবার ওই ভদ্রলোক তার বাড়িতে দাওয়াত করেছিলেন। বনানীর ৪ নম্বর রোডের গেটওয়ালা বাড়িটিতে প্রবেশ করে পরপর তিনটি ড্রয়িংরুম দেখতে পেয়েছিলাম। বড় বাড়ি এবং তিনটি ড্রয়িংরুম দেখেই বুঝে ফেলেছিলাম, অনেক বড়লোকের বাড়িতে এসেছি। গ্রাম থেকে আসা শহরের কলেজে পড়া একজন ছাত্রের চোখে তখন এমন একটি পরিবারই ছিল সবচেয়ে বড়লোক পরিবারের ছবি। আমার স্কুলে পড়ার সময়ে পাশের গ্রামের লাল মিয়া চাচা ছিলেন আমার দেখা সবচেয়ে বড়লোক মানুষ। তিনি মহাখালীতে একটি বাসা ভাড়া করে থাকতেন। তিন বন্ধু মিলে একবার দুপুরে খেতে গিয়েছিলাম তার বাসায়। ভাত খেয়ে হাত ধুয়ে তার রেলিংয়ে ঝোলানো গামছা দিয়ে হাত মুছতে সাহস পাইনি আমরা। বড়লোক লাল মিয়া চাচার গামছা ব্যবহার করার দুঃসাহস ছিল না আমাদের তখন।
পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানে ২২টি ধনাঢ্য পরিবার ছিল। ২২ পরিবারের কাউকেই কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি আমার। তারা ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে। সাধারণ মানুষ তাদের গল্প শুনত, কিন্তু তাদের জৌলুস চোখে দেখার সুযোগ পেত না। আজ স্বাধীন বাংলাদেশে ২২ পরিবার নয়, হয়তোবা ২২ লাখ পরিবার বড়লোক হয়েছে। তারা কেমন বড়লোক, ঠিক আঁচ করা যায় না। হবে হয়তো অনেক বড়লোক। ঠিক এমন কিছু বড়লোককে এখন আমি অনেক কাছ থেকে চিনি ও জানি। ওঠা-বসাও করি তাদের কারও কারও সঙ্গে। ওই বড়লোকদের বাসায় গিয়েও কিন্তু তেমনটাই মনে হয়। মনে হয়, এরা অনেক বড়লোক- হয়তো অনেক খেজুরের গুড় খায় এরা!
তখন সবে কানাডায় গেছি। বাসা ভাড়া করা তখন বেশ কঠিন ছিল। খালি বাসা পাওয়া বেশ কষ্টকর ব্যাপার ছিল। পুরনো একটি পরিবারের সাহায্য লাভের আশায় একদিন একটি বাসায় গেলাম। ভদ্রমহিলা কানাডায় স্থায়ীভাবে থাকেন এবং ভদ্রলোক বাংলাদেশ ও কানাডা দু’জায়গায়ই থাকেন। গল্পের ছলে ভদ্রমহিলা আমাদের বোঝাচ্ছিলেন, তার স্বামী কানাডা থাকতে চান না। নিজেই আবার যুক্তি দেখান, কী করে থাকবেন? এখানে কী করবেন? ঢাকায় আমার স্বামী জমিদারের মতো থাকেন; এরকম ১০টা পরিবার পুষতে পারেন। গাড়ি-বাড়ি কি-না আছে আমাদের। শুনে কষ্টই লাগল। আহারে! এমন একটি বড়লোক পরিবারের লোকজন কত কষ্টে কানাডায় থাকছে। বিদায়ের ঠিক আগ মুহূর্তে ভদ্রমহিলার স্বামীর সঙ্গে মোলাকাত করার সুযোগ ঘটল। আমাকে দেখেই তিনি বললেন, স্যার আপনি? আমি ঠিক না চেনায় ভদ্রলোক বললেন, ‘আপনি তো স্যার উকিল। আমি পাঁচ নম্বর কোর্টের সহকারী পেশকার।’ চলে আসতে আসতে হিসাব মিলাতে চেষ্টা করছিলাম। একজন সহকারী পেশকার যদি গাড়ি-বাড়ির মালিক আর ১০টি পরিবার চালানোর যোগ্যতা রাখেন, তবে পেশকার সাহেবের অবস্থা কী হতে পারে!
অধুনা একজন বড়লোকের সঙ্গে কথা বলছিলাম। ভদ্রলোক অনেক বড়লোক। রাস্তায় বের হলে তার সঙ্গে সিকিউরিটি, ব্যক্তিগত সহকারী, প্রাইভেট সেক্রেটারি সবই থাকে। আলিশান বাড়ি, বাড়ির ভেতরে দামি দামি গাড়িগুলোর জায়গা হয় না বলে তার অফিসেও ব্যক্তিগত দু’-একটি গাড়ি রাখতে হয়। ভদ্রলোকের ব্যবসাটি ঠিক কী তা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছিলাম না। তবে এটা বুঝতে পারছিলাম, দেশী-বিদেশী বড় বড় ঠিকাদারি তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন। ভদ্রলোকের ব্যবসায়িক জীবন মাত্র কয়েক বছরের। তার আগে তিনি পুলিশে চাকরি করেছেন। অবসরের সময় না হলেও ইন্সপেক্টর হয়ে ভদ্রলোক চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। এত টাকার মালিকের অত ছোট চাকরি করা ঠিক মানায় না। তাই তিনি এখন জাতীয়-আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ঠিকাদারি কাজের সঙ্গে জড়িত।
বড়লোক নামের বিষয়টি একেকজন একেক দৃষ্টিতে দেখে। ডা. রাজা যাকে বড়লোক ভেবেছিল, তার মেয়ে অফিস সহকারীর চাকরি করতে বাধ্য হয়েছিল। বড়লোক বিষয়টি আসলে বড় বেশি আপেক্ষিক। চীনের কিংবা হংকংয়ের একজন পানের দোকানদার বাংলাদেশের একজন বড় কোম্পানির মালিকের চেয়েও বড়লোক। কত টাকা থাকলে বড়লোক হওয়া যায়? কেউ জানে না। গেদু জানে, বড়লোক হলে অনেক গুড় খাওয়া যায়। একজন অসৎ সহকারী পেশকার বড়লোক, পুলিশের মাঠপর্যায়ের একজন অসৎ কর্মকর্তাও বড়লোক। আবার লাল মিয়া চাচা, যার গ্রামের বাজারে একটি বড় মুদি দোকান ছিল, আমার কিশোর চোখে তিনি ছিলেন বিশাল বড়লোক। কত টাকা থাকতে হয় একটি বড়লোকের পরিবারে? কত বড় বাড়ি হলে লোকে তাকে বড়লোক বলবে?
কলেজের শিক্ষক অসিত বাবু তার দুই কন্যাসন্তান নিয়ে মফস্বলের কলেজপাড়ায় থাকেন। দু’বেলা-তিনবেলা কোনো বেলায়ই তার ভাতের অভাব নেই। আর ওই যে সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা, যার অনেক বড় বাড়ি, অনেকগুলো গাড়ি, বাসায় কাজের লোক অনেক- এ দু’জনের মধ্যে কে বেশি বড়লোক? আমি যেভাবে দেখি, আপনি যেভাবে দেখেন- সেভাবেই নির্মিত হবে তাদের দু’জনের বড়লোকির মানদণ্ড।
সৎ পথের রাস্তা ভুলে যাওয়া বড়লোক মানুষগুলো যে টাকার বস্তা খাটের নিচে রাখে, আর খেটে খাওয়া শ্রমিকটির পড়ুয়া ছেলেটি যে কাগজের খাতাগুলো খাটের ওপরে রাখে, এদের মধ্যে কোনটার মূল্য বেশি? ক্ষয়ে যাওয়া সমাজ যদি প্রশ্নের উত্তর বের করতে না পারে, তবে আমি আবার পেছনে ফিরে এসে উত্তরটি জেনে যাব।
মেজর (অব.) সুধীর সাহা : কলামিস্ট
No comments