নির্বাচন বন্ধের চেষ্টা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র -সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী
যুক্তরাষ্ট্র ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বন্ধের জন্য সব ধরনের চেষ্টা চালিয়েছিল বলে দাবি করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি অভিযোগ করেন, দেশটির তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, ‘কোনো দেশ পাশে থাকলে আমরা বেঁচে থাকব, আর পাশে না থাকলে মরে যাব—এটা ভাবা ঠিক না। বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। স্বাধীন দেশ হিসেবে মর্যাদা নিয়েই আমরা চলতে চাই।’
যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়ালকে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দুই আনার মন্ত্রী বলায় দেশটির সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হতে পারে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
গতকাল শুক্রবার বিকেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক সার্ক সম্মেলনে যোগ দেওয়া এবং মালয়েশিয়া সফর সম্পর্কে গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এই সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সম্পর্ক, টিআইবির দুর্নীতি প্রতিবেদন, কিছু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কথিত বৈঠকসহ বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তিনি নানা প্রশ্নের জবাব দেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক: প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করেনি। কিন্তু দেশ স্বাধীন হয়েছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন যাতে না হয়, তারা (যুক্তরাষ্ট্র) সব ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। বন্ধ করতে পারেনি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের সবাই যে এসব কাজে একমত, তা না। সেখানে বাংলাদেশেরও বন্ধু আছে। তাঁদের সমর্থন সব সময় আমরা পেয়েছি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিককে আমি বলব, এই দেশটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। কাউকে ছাড়া বাংলাদেশ চলতে পারবে না—এ চিন্তাটা না থাকাই ভালো। একটা দেশের সঙ্গে কখনো কখনো সম্পর্ক খারাপ হতে পারে। তাই বলে একেবারে কূটনৈতিক সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে বা বন্ধ হয়ে যাবে, আমি সেটা মনে করি না। কূটনৈতিক সম্পর্ক কূটনৈতিকভাবেই চলবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব নিয়েই আমরা চলতে চাই। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি উত্তর না দক্ষিণ, পূর্ব না পশ্চিম, তা বিবেচনা করে চলে না। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য যার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হবে, আমরা তা-ই করব। আমি ভালো থাকলে বন্ধুর অভাব হয় না।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পৃথিবী গোল। এটা মনে রাখতে হবে। পৃথিবী সারাক্ষণ ঘুরছে। এটাও মনে রাখতে হবে। ঘূর্ণায়মান পৃথিবীতে আমরা বাস করছি। আমাদের কূটনীতি সেভাবেই হবে।’
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব সি এম শফি সামি প্রথম আলোকে বলেন, কোনো দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে ও সমসাময়িক বাস্তবতায় হয়ে থাকে। আবার কোনো দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো না থাকলে যে বিরাট বিপর্যয় ঘটবে, তা-ও নয়। তবে দেশের অর্থনীতি, বাণিজ্য, পোশাকশিল্প প্রভৃতি বিবেচনায় বুঝেশুনে ও সুচিন্তিতভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
পদ্মা সেতু: প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করে দেন। আমরা তখন শুনেছিলাম, যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে এটা করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতু আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুর্নীতির অপবাদ দেওয়া হয়েছিল। আমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলাম। বিশ্বব্যাংক তন্নতন্ন করে বিশ্বব্যাপী খুঁজেও দুর্নীতি পায়নি। তারা অনেকভাবে আমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল।’
টিআইবি সময় সময় সরব: টিআইবির দুর্নীতিবিষয়ক প্রতিবেদন সম্পর্কে প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারা কী কারণে সময় সময় সরব হয়, সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ২০০১ সালের জুন মাসের আগেও তারা প্রতিবেদন দিয়েছিল। তিনি বলেন, ‘ঠিক আছে আমরাও যাচাই করব। যাঁরা আজ কথা বলছেন, তাঁদের ইনকাম কী? টাকাটা কোথা থেকে আসছে? কীভাবে ব্যয় হচ্ছে, সে হিসাবটাও নেওয়া হবে। জবাবদিহি সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।’
শেখ হাসিনা প্রশ্ন করেন, ‘যারা সত্যিকার দুর্নীতি করে হাজার হাজার কোটি টাকা বানিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে টিআইবিকে কখনো শুনেছেন?’ তিনি বলেন, ‘রাস্তায় কে কাকে ২০০ টাকা ঘুষ দিল, ট্রাক থেকে কে ১০ টাকা নিল—এসব খুচরা বিষয় নিয়ে আসা হয়েছে। পৃথিবীর কোন দেশটা আছে, যেখানে দুর্নীতি নেই? আমরা সরকারে আছি। আমরা নিজেরা কোনো দুর্নীতি করছি কি না, সেটা বলুন। যদি তাই করতাম, তাহলে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা থাকা সত্ত্বেও ধারাবাহিকভাবে প্রবৃদ্ধি ৬ ভাগের ওপরে উঠত না। কিন্তু যে বীজ বপন করে গেছেন সামরিক শাসকেরা, সেখান থেকে রাতারাতি কীভাবে শিকড়সহ উপড়ে ফেলা সম্ভব?’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘টিআইবির উদ্দেশ্য দেশের দুর্নীতি প্রতিরোধব্যবস্থা সুদৃঢ় এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হোক। আমরা জানি, প্রধানমন্ত্রীও এটা চান। আর এ জন্য আমরা নিজেদের সরকারের সহায়ক শক্তি বলে মনে করি।’
কে বা কোন দল ক্ষমতায় আছে, তা বিবেচনা করে টিআইবি কাজ করে না দাবি করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিএনপির সময়ে পর পর চারবার দুর্নীতির ধারণাসূচকে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে ছিল।
টিআইবির অর্থসূত্র প্রসঙ্গে নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘টিআইবি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আওতাধীন এনজিও ব্যুরোর অনুমতি সাপেক্ষে অর্থ সংগ্রহ ও কার্যক্রম পরিচালনা করে।’
দুর্নীতি করে টাকাও বানিয়েছে, ইজ্জতও কিনেছে: কারও নামোল্লেখ না করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেকে দুর্নীতি করে টাকা তো বানায়ই, ইজ্জতও কিনে নেয়। তিনি সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘নিজেরাই চিন্তা করেন। এতগুলো চ্যানেল দিয়েছি। মালিকদের একটা সংগঠন করেছে। কাকে নেতা বানিয়েছে? সে এত হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হলো কীভাবে? টাকা দিয়ে সে ইজ্জত কিনে নিয়েছে। টিআইবি কখনো এ ব্যাপারে একটা টুঁ শব্দ করেছে? করেনি। টাকা পাচার হয়েছে, আমরা উদ্ধার করেছি।’
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এতিমের টাকা মেরে দিয়েছেন। তিনি আদালতেও যেতে চান না। এ ব্যাপারে তো কেউ কথা বলেন না, টক শোতেও কথার ঝড় ওঠে না। তাঁর ছেলে লন্ডনে বিলাসী জীবন যাপন করছেন। একজনও কি টক শোতে টুঁ শব্দ করেছেন? করেননি। কারণ, তারা টাকা দিয়ে ইজ্জত কিনে নিয়েছে।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব টিভি চ্যানেল ওনার্সের (অ্যাটকো) সভাপতি ও এনটিভির চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক আলী ফালু বলেন, ‘অবৈধ আয়ের কোনো প্রশ্নই আসে না। কখনো অবৈধ আয় করিনি, করবও না। ২০-২৫ বছর ধরে যে আয় ও ব্যয় করেছি, তা সরকারের ট্যাক্স ফাইলে উল্লেখ আছে।’
খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথিত বৈঠক: শুক্রবার রাতে গুলশানে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সরকারের সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন কর্মকর্তার কথিত বৈঠক সম্পর্কে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকারি কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী আইনের বরখেলাপ করলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে মানুষের মনে সন্দেহ জাগে, এত গভীর রাতে ডাকা হলো কেন? এটা আগেও ঘটেছে। উত্তরা ষড়যন্ত্রের কথা আপনাদের তো মনে আছে।
বিমানে সোনা চোরাচালান: বিমানে সোনা চোরাচালান সম্পর্কে করা প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দীর্ঘদিন সেখানে অব্যবস্থাপনা ছিল। বিমানবন্দরে নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এখন সেখানে প্রতিমুহূর্তে তল্লাশি চালানো হচ্ছে বলেই সোনাদানা ধরা পড়ছে। তিনি দাবি করেন, যারা এসবের সঙ্গে দায়ী না, পত্রপত্রিকায় তাদেরও দায়ী করা হচ্ছে। বিমান চেয়ারম্যানের পালকপুত্র বানানো হয়েছে। আজেবাজে কথা লেখা হচ্ছে। এর সত্যতা নেই। যে দুজন জড়িত, তাদের ধরা হয়েছে। চেয়ারম্যান তাদের ছাড়াতে যাননি।
এইচ টি ইমামের বক্তব্যের দায় তাঁর নিজের: ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের বক্তব্য সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অনেকেই অনেক কথা বলেন। মাঝেমধ্যে দলের জন্য তা সমস্যার সৃষ্টি করে। সবাই কথা বলে যাচ্ছেন। তবে এ কথা উনি কেন বলেছেন, তা তাঁকেই জিজ্ঞাসা করুন। এ বক্তব্যের দায় তাঁর। উনাকে কিছু করতেও বলিনি, বলতেও বলিনি।’
ছাত্রলীগ: আরেক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যারা অপরাধের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। একমাত্র আওয়ামী লীগই ব্যতিক্রম যে, কে কোন দল করে, তা না দেখে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় কাউকে ছাড় দেইনি। কার জামাই, কার ভাগনে, তা না দেখে ব্যবস্থা নিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘তবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হত্যাকাণ্ডে যুবদলের নেতা জড়িত থাকলেও টক শোতে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি।’
প্রশ্ন ফাঁস: আরেক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপির আমলে প্রশ্ন ফাঁসের দরকার হতো না। প্রশ্ন আগেই দিয়ে দেওয়া হতো তাদের ক্যাডারদের হাতে। আমাদের সময়ে কখনো একটা-দুইটা দুর্ঘটনা যখনই ঘটেছে, তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়েছি। ব্যবস্থা না নিলে কথা থাকত।’
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী নেপালের কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত সার্ক শীর্ষ সম্মেলন এবং মালয়েশিয়া সফরের অর্জন ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। মালয়েশিয়া সফরকে সফল দাবি করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত বিভিন্ন চুক্তি বিদ্যমান সুসম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ করবে।
সংবাদ সম্মেলনে প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ফারুক খান, প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরীসহ দলীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়ালকে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দুই আনার মন্ত্রী বলায় দেশটির সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হতে পারে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
গতকাল শুক্রবার বিকেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক সার্ক সম্মেলনে যোগ দেওয়া এবং মালয়েশিয়া সফর সম্পর্কে গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এই সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সম্পর্ক, টিআইবির দুর্নীতি প্রতিবেদন, কিছু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কথিত বৈঠকসহ বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তিনি নানা প্রশ্নের জবাব দেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক: প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করেনি। কিন্তু দেশ স্বাধীন হয়েছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন যাতে না হয়, তারা (যুক্তরাষ্ট্র) সব ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। বন্ধ করতে পারেনি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের সবাই যে এসব কাজে একমত, তা না। সেখানে বাংলাদেশেরও বন্ধু আছে। তাঁদের সমর্থন সব সময় আমরা পেয়েছি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিককে আমি বলব, এই দেশটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। কাউকে ছাড়া বাংলাদেশ চলতে পারবে না—এ চিন্তাটা না থাকাই ভালো। একটা দেশের সঙ্গে কখনো কখনো সম্পর্ক খারাপ হতে পারে। তাই বলে একেবারে কূটনৈতিক সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে বা বন্ধ হয়ে যাবে, আমি সেটা মনে করি না। কূটনৈতিক সম্পর্ক কূটনৈতিকভাবেই চলবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব নিয়েই আমরা চলতে চাই। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি উত্তর না দক্ষিণ, পূর্ব না পশ্চিম, তা বিবেচনা করে চলে না। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য যার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হবে, আমরা তা-ই করব। আমি ভালো থাকলে বন্ধুর অভাব হয় না।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পৃথিবী গোল। এটা মনে রাখতে হবে। পৃথিবী সারাক্ষণ ঘুরছে। এটাও মনে রাখতে হবে। ঘূর্ণায়মান পৃথিবীতে আমরা বাস করছি। আমাদের কূটনীতি সেভাবেই হবে।’
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব সি এম শফি সামি প্রথম আলোকে বলেন, কোনো দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে ও সমসাময়িক বাস্তবতায় হয়ে থাকে। আবার কোনো দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো না থাকলে যে বিরাট বিপর্যয় ঘটবে, তা-ও নয়। তবে দেশের অর্থনীতি, বাণিজ্য, পোশাকশিল্প প্রভৃতি বিবেচনায় বুঝেশুনে ও সুচিন্তিতভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
পদ্মা সেতু: প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করে দেন। আমরা তখন শুনেছিলাম, যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে এটা করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতু আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুর্নীতির অপবাদ দেওয়া হয়েছিল। আমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলাম। বিশ্বব্যাংক তন্নতন্ন করে বিশ্বব্যাপী খুঁজেও দুর্নীতি পায়নি। তারা অনেকভাবে আমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল।’
টিআইবি সময় সময় সরব: টিআইবির দুর্নীতিবিষয়ক প্রতিবেদন সম্পর্কে প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারা কী কারণে সময় সময় সরব হয়, সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ২০০১ সালের জুন মাসের আগেও তারা প্রতিবেদন দিয়েছিল। তিনি বলেন, ‘ঠিক আছে আমরাও যাচাই করব। যাঁরা আজ কথা বলছেন, তাঁদের ইনকাম কী? টাকাটা কোথা থেকে আসছে? কীভাবে ব্যয় হচ্ছে, সে হিসাবটাও নেওয়া হবে। জবাবদিহি সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।’
শেখ হাসিনা প্রশ্ন করেন, ‘যারা সত্যিকার দুর্নীতি করে হাজার হাজার কোটি টাকা বানিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে টিআইবিকে কখনো শুনেছেন?’ তিনি বলেন, ‘রাস্তায় কে কাকে ২০০ টাকা ঘুষ দিল, ট্রাক থেকে কে ১০ টাকা নিল—এসব খুচরা বিষয় নিয়ে আসা হয়েছে। পৃথিবীর কোন দেশটা আছে, যেখানে দুর্নীতি নেই? আমরা সরকারে আছি। আমরা নিজেরা কোনো দুর্নীতি করছি কি না, সেটা বলুন। যদি তাই করতাম, তাহলে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা থাকা সত্ত্বেও ধারাবাহিকভাবে প্রবৃদ্ধি ৬ ভাগের ওপরে উঠত না। কিন্তু যে বীজ বপন করে গেছেন সামরিক শাসকেরা, সেখান থেকে রাতারাতি কীভাবে শিকড়সহ উপড়ে ফেলা সম্ভব?’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘টিআইবির উদ্দেশ্য দেশের দুর্নীতি প্রতিরোধব্যবস্থা সুদৃঢ় এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হোক। আমরা জানি, প্রধানমন্ত্রীও এটা চান। আর এ জন্য আমরা নিজেদের সরকারের সহায়ক শক্তি বলে মনে করি।’
কে বা কোন দল ক্ষমতায় আছে, তা বিবেচনা করে টিআইবি কাজ করে না দাবি করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিএনপির সময়ে পর পর চারবার দুর্নীতির ধারণাসূচকে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে ছিল।
টিআইবির অর্থসূত্র প্রসঙ্গে নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘টিআইবি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আওতাধীন এনজিও ব্যুরোর অনুমতি সাপেক্ষে অর্থ সংগ্রহ ও কার্যক্রম পরিচালনা করে।’
দুর্নীতি করে টাকাও বানিয়েছে, ইজ্জতও কিনেছে: কারও নামোল্লেখ না করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেকে দুর্নীতি করে টাকা তো বানায়ই, ইজ্জতও কিনে নেয়। তিনি সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘নিজেরাই চিন্তা করেন। এতগুলো চ্যানেল দিয়েছি। মালিকদের একটা সংগঠন করেছে। কাকে নেতা বানিয়েছে? সে এত হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হলো কীভাবে? টাকা দিয়ে সে ইজ্জত কিনে নিয়েছে। টিআইবি কখনো এ ব্যাপারে একটা টুঁ শব্দ করেছে? করেনি। টাকা পাচার হয়েছে, আমরা উদ্ধার করেছি।’
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এতিমের টাকা মেরে দিয়েছেন। তিনি আদালতেও যেতে চান না। এ ব্যাপারে তো কেউ কথা বলেন না, টক শোতেও কথার ঝড় ওঠে না। তাঁর ছেলে লন্ডনে বিলাসী জীবন যাপন করছেন। একজনও কি টক শোতে টুঁ শব্দ করেছেন? করেননি। কারণ, তারা টাকা দিয়ে ইজ্জত কিনে নিয়েছে।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব টিভি চ্যানেল ওনার্সের (অ্যাটকো) সভাপতি ও এনটিভির চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক আলী ফালু বলেন, ‘অবৈধ আয়ের কোনো প্রশ্নই আসে না। কখনো অবৈধ আয় করিনি, করবও না। ২০-২৫ বছর ধরে যে আয় ও ব্যয় করেছি, তা সরকারের ট্যাক্স ফাইলে উল্লেখ আছে।’
খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথিত বৈঠক: শুক্রবার রাতে গুলশানে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সরকারের সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন কর্মকর্তার কথিত বৈঠক সম্পর্কে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকারি কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী আইনের বরখেলাপ করলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে মানুষের মনে সন্দেহ জাগে, এত গভীর রাতে ডাকা হলো কেন? এটা আগেও ঘটেছে। উত্তরা ষড়যন্ত্রের কথা আপনাদের তো মনে আছে।
বিমানে সোনা চোরাচালান: বিমানে সোনা চোরাচালান সম্পর্কে করা প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দীর্ঘদিন সেখানে অব্যবস্থাপনা ছিল। বিমানবন্দরে নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এখন সেখানে প্রতিমুহূর্তে তল্লাশি চালানো হচ্ছে বলেই সোনাদানা ধরা পড়ছে। তিনি দাবি করেন, যারা এসবের সঙ্গে দায়ী না, পত্রপত্রিকায় তাদেরও দায়ী করা হচ্ছে। বিমান চেয়ারম্যানের পালকপুত্র বানানো হয়েছে। আজেবাজে কথা লেখা হচ্ছে। এর সত্যতা নেই। যে দুজন জড়িত, তাদের ধরা হয়েছে। চেয়ারম্যান তাদের ছাড়াতে যাননি।
এইচ টি ইমামের বক্তব্যের দায় তাঁর নিজের: ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের বক্তব্য সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অনেকেই অনেক কথা বলেন। মাঝেমধ্যে দলের জন্য তা সমস্যার সৃষ্টি করে। সবাই কথা বলে যাচ্ছেন। তবে এ কথা উনি কেন বলেছেন, তা তাঁকেই জিজ্ঞাসা করুন। এ বক্তব্যের দায় তাঁর। উনাকে কিছু করতেও বলিনি, বলতেও বলিনি।’
ছাত্রলীগ: আরেক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যারা অপরাধের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। একমাত্র আওয়ামী লীগই ব্যতিক্রম যে, কে কোন দল করে, তা না দেখে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় কাউকে ছাড় দেইনি। কার জামাই, কার ভাগনে, তা না দেখে ব্যবস্থা নিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘তবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হত্যাকাণ্ডে যুবদলের নেতা জড়িত থাকলেও টক শোতে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি।’
প্রশ্ন ফাঁস: আরেক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপির আমলে প্রশ্ন ফাঁসের দরকার হতো না। প্রশ্ন আগেই দিয়ে দেওয়া হতো তাদের ক্যাডারদের হাতে। আমাদের সময়ে কখনো একটা-দুইটা দুর্ঘটনা যখনই ঘটেছে, তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়েছি। ব্যবস্থা না নিলে কথা থাকত।’
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী নেপালের কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত সার্ক শীর্ষ সম্মেলন এবং মালয়েশিয়া সফরের অর্জন ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। মালয়েশিয়া সফরকে সফল দাবি করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত বিভিন্ন চুক্তি বিদ্যমান সুসম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ করবে।
সংবাদ সম্মেলনে প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ফারুক খান, প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরীসহ দলীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
No comments