‘আসল’ ডেথ সার্টিফিকেট পেলেন সেই নারী by রোকনুজ্জামান পিয়াস
বিতীয়
দফায় ডেথ সার্টিফিকেট লেখা হলো তার। প্রথম দফা ডেথ সার্টিফিকেট লেখার পর
ফিরে এলেও দ্বিতীয় দফায় আর ফিরলেন না। পৃথিবীর অযত্ন-অবহেলায় অভিমানে
চিরতরে বিদায় নিলেন তিনি। তবে বিদায় বেলায় রেখে গেলেন একগাদা প্রশ্ন? চোখে
আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেলেন দেশের স্বাস্থ্যসেবার প্রকৃত চিত্র। মহান পেশার
দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের দায়িত্বহীন কর্মকা-ও তুলে ধরলেন দেশবাসীর কাছে। না,
তিনি মুখে কিছু বলেননি, বলার শক্তিও পাননি। তার কোন স্বজন প্রতিবাদ করেননি,
প্রতিবাদ করার মতো কাউকে পাওয়াও যায়নি। কারণ তিনি অজ্ঞাতনামা এক হতভাগা
নারী। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দু’দিন চিকিৎসার পর ৪৫ বছর বয়সী ওই
নারীকে বৃহস্পতিবার দুপুরে মৃৃত ঘোষণা করা হয়। লেখা হয় মৃত্যুর প্রমাণপত্রও
(ডেথ সার্টিফিকেট)। অনারারি চিকিৎসক ডা. নিলুফার নিলু লেখেন তার ডেথ
সার্টিফিকেট। কিন্তু বিকাল ৫টায় সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে মর্গের দায়িত্বে
থাকা ডোম লাশ নিতে গেলে নড়েচড়ে ওঠেন তিনি। বেঁচে আছেন বলে চিৎকার দেন ডোম।
খবরটি মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে পুরো হাসপাতালে। আবারও ডাক্তার এনে পরীক্ষা
করানো হয়। পরীক্ষা করে দেখা যায় তিনি মরেননি। এ নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয় সারা
দেশে। আবারও চলে চিকিৎসা। তবে এবার আর অযত্ন-অবহেলা নয়। রীতিমতো
উচ্চপর্যায়ের মেডিক্যাল টিম দিয়ে তার চিকিৎসা করানো হয়। কিন্তু এত কিছুর
পরও তাকে আর ফেরানো গেল না। অবশেষে গতকাল বিকাল ৪টায় সত্যিই তিনি হার
মানলেন। এবার ডেথ সার্টিফিকেট লিখলেন ডা. সোহেল। গতকাল মধ্যবয়সী অজ্ঞাত ওই
মহিলা মারা যাওয়ার আগে হাসপাতালের ৮০২ নম্বর ওয়ার্ডের ৭ নম্বর ইউনিটে গিয়ে
দেখা যায় বেডে পড়ে আছে অসাড় শরীর। মুখে অক্সিজেনের মাক্স লাগানো। চলছে
স্যালাইন। মাথার পাশে একটি কলা, দুই পিস বনরুটি এবং একটি বাটিতে সামান্য
তরল খাবার। হাসপাতাল থেকেই সরবরাহ করা হয়েছে সেগুলো। হাসপাতালের অন্য রোগীর
স্বজনরা আসছেন, ভিড় করে উৎসুক দর্শকের মতো দেখছেন। মাঝেমধ্যেই নড়েচড়ে
উঠছিলেন রোগী। রোগীর স্বজনরা জানান, আজ বারবার ডাক্তাররা এসে দেখে যাচ্ছেন
তাকে। নার্সরা এসে বারবার সেবা দিচ্ছেন। তার জন্য আমাদেরও ঠিকমতো দেখছেন না
বলে অভিযোগ করেন তারা। দুপুরে ওই রোগীর ইসিজি, আল্ট্রাসনোগ্রামসহ রক্তের
কয়েকটি পরীক্ষা করা হয়। হাসপাতালের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তার খোঁজখবর নেন।
কিন্তু বিকাল ৪টায় চিরনিদ্রায় যান। তবে চিকিৎসকরা এবার ওই নারীর
আলট্রাসনোগ্রাম, ইসিজি, এক্স-রেসহ বেশ কয়েকটি পরীক্ষা করে পুরোপুরি নিশ্চিত
হয়ে মৃত ঘোষণা করেছেন। হাসপাতালের উপপরিচালক অধ্যাপক ডা. মুশফিকুর রহমান এ
তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার ওই ঘটনার পর মেডিসিন বিভাগের
অধ্যাপক ডা. ইনামুল করীমকে প্রধান করে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন
করা হয়েছে। তিন কার্যদিবসের মধ্যে এ কমিটিকে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ
দেয়া হয়েছে। কমিটির অপর ৩ সদস্যের মধ্যে একজন সহকারী অধ্যাপক, একজন আবাসিক
চিকিৎসক এবং অপরজন সহকারী পরিচালক (প্রশাসন)। তিনি জানান, তদন্ত রিপোর্ট
হাতে পাওয়ার পর ওই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ডা.
মুশফিকুর রহমান আরও বলেন, গতকাল উচ্চপর্যায়ের মেডিক্যাল টিম চিকিৎসা
দিয়েছে। পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে ডেথ সার্টিফিকেট দেয়া অত্যন্ত দুঃখজনক
উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে চিকিৎসা ঠিকই ছিল। ওই চিকিৎসকের
উদ্দেশে তিনি বলেন, তিনি সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেছেন। তার সন্দেহ থাকলে তিনি
অন্যের সহযোগিতা নিতে পারতেন যদিও এমবিবিএস চিকিৎসক হিসেবে তিনি ডেথ
সার্টিফিকেট লেখার যোগ্যতা রাখেন। তিনি বলেন, এটা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
এতে মানুষের আস্থা কমে যায়। দেশের বিখ্যাত এবং পুরনো একটি হাসপাতালের জন্য
এটি খুবই দুঃখজনক। গত ২রা ডিসেম্বর রাতে মেডিক্যালসংলগ্ন অবৈধ স্থাপনা
উচ্ছেদকালে ওই নারীকে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন হাসপাতালের পরিচালক
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান। তখন তিনি হাসপাতালের লোকজন দিয়ে
তাকে উদ্ধার করে ভর্তি করান। তাকে দু’দিন হাসপাতালের মেঝেতে রেখে চিকিৎসা
দেয়া হচ্ছিল। বৃহস্পতিবার ডা. নিলুফার নিলু প্রথম দফা তার ডেথ সার্টিফিকেট
ইস্যু করেন।
No comments