একটি দেশ পাশে না থাকলে মরে যাব না
প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা বলেছেন, আমেরিকার বিরোধিতার পরও মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ
যদি স্বাধীন হতে পারে, তাহলে এখন কোনো একটি দেশকে পাশে না পেলেও বাংলাদেশের
সমস্যা হবে না। তিনি বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন যাতে না হয়- সেজন্য
আমেরিকা সব ধরনের চেষ্টা চালায়। কিন্তু পেরেছে কি? প্রধানমন্ত্রী বলেন,
সেদিন নির্বাচন হয়েছিল বলেই দেশে আজ উন্নয়ন হচ্ছে। নির্বাচন না হলে
বাংলাদেশ আজকে থাইল্যান্ডের মতো হতো, সামরিক শাসন আসত। শুক্রবার গণভবনে
অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এভাবেই পরাশক্তি
যুক্তরাষ্ট্রের অতীত ও বর্তমান ভূমিকার সমালোচনা করেন শেখ হাসিনা। তবে কোনো
বিষয়ে মতবিরোধ হলেই সে দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাবে বলেও
তিনি মনে করেন না। যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই
বিসওয়ালের সাম্প্রতিক সফর এবং তার সম্পর্কে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ও আওয়ামী
লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মন্তব্য সম্পর্কে সংবাদ
সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে প্রধানমন্ত্রী এসব মন্তব্য
করেন।
নেপালে অনুষ্ঠিত সার্ক শীর্ষ সম্মেলন ও মালয়েশিয়া সফর বিষয়ে অবহিত করতে গণভবনে এ সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করা হয়। বিকাল ৪টায় সংবাদ সম্মেলন শুরুর পর ২০ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী চার পৃষ্ঠার একটি লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান। পরে আরও পৌনে ১ ঘণ্টায় তিনি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।
শেখ হাসিনা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের যে সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে এসেছেন, তিনি বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি নেত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। কেউ যদি কোনো মতামত দিয়ে থাকেন তাহলে সে দায়িত্ব তার। তাকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেন।
নিশা দেশাই বিসওয়াল সম্পর্কে দলের সাধারণ সম্পাদকের মন্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে মোটেও অখুশি নন তা পদ্মা সেতুতে অর্থায়নে বিশ্বব্যাংকের ভূমিকার উল্লেখ করতে গিয়ে প্রকাশ করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশেই তা করা হয়েছিল বলেও শোনা গেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সারা বিশ্ব তন্ন তন্ন করে খুঁজেও প্রমাণ পায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের অতীত ও বর্তমান ভূমিকায় অসন্তোষ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটা দেশ পাশে না থাকলে আমরা একেবারে শেষ হয়ে যাব? ’৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধেও যুক্তরাষ্ট্র বিরুদ্ধে ছিল। বাংলাদেশ শেষ হয়ে যায়নি। মুক্তিযুদ্ধের সময় যদি আমরা লড়াই করে টিকে থাকতে পারি তাহলে স্বাধীন দেশ হিসেবে এখনও পারব। প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীর উদ্দেশে বলেন, প্রত্যেকটি নাগরিককে বলব, এটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। সে মর্যাদা নিয়ে চলতে হবে। কেউ পাশে থাকলে বাঁচব, না থাকলে মরে যাব, এটা ঠিক না। ভালো থাকলে বন্ধুর অভাব হবে না। কাউকে ছাড়া বাংলাদেশ চলতে পারবে না- এমন চিন্তা না থাকাই ভালো। তবে সে দেশটিতেও (যুক্তরাষ্ট্র) একাত্তরে বাংলাদেশের বন্ধু ছিল এবং এখনও আছে বলে মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, তাদের সহযোগিতা বাংলাদেশ সবসময় পেয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের পররাষ্ট্রনীতি অত্যন্ত স্বচ্ছ। এটা পূর্ব না পশ্চিম, উত্তর না দক্ষিণ- তা আমি বিবেচনায় নিতে চাই না। এ সময় তিনি রসিকতা করে বলেন, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে। লন্ডনে গেলে কি আপনি এখন যাকে পূর্বদিক বলছেন, সেটা পূর্ব দিক থাকবে? বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে কারও সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করতে হলে তা করব। তবে সরকারের নীতি হল বঙ্গবন্ধুর সেই বাণী- ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়।’
প্রধানমন্ত্রীর এ সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী, প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী এবং আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পাদক কর্নেল (অব.) ফারুক খান উপস্থিত ছিলেন।
মালয়েশিয়া সফর : সংবাদ সম্মেলনে মালয়েশিয়া সফরকে অত্যন্ত সফল ও কার্যকর বলে দাবি করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, মালয়েশিয়া সফরে বেশ কিছু চুক্তি ও সমঝোতা স্বাক্ষর হয়েছে। দেশটি বাংলাদেশের আবাসন, জ্বালানি, রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। নিু আয়ের মানুষের জন্য কামরাঙ্গীরচরে বহুতল আবাসন নির্মাণ প্রকল্পে বিনিয়োগের আমন্ত্রণ জানালে তারা তা গ্রহণ করেছে। এছাড়াও মালয়েশিয়ার গাড়ি তৈরির কোম্পানি প্রোটনের একটি কারখানা বাংলাদেশে করার সম্ভাবনার কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
মালয়েশিয়ার সারওয়াক প্রদেশে ৬০ হাজার শ্রমিকের চাহিদা থাকার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১২ হাজার শ্রমিককে ওই প্রদেশে নিয়োগের লক্ষ্যে একটি প্রটোকল স্বাক্ষরের বিষয়ে তার সরকার সম্মতি জ্ঞাপন করেছে। তিনি জানান, দেশটির সার্বিক উন্নয়নে বাংলাদেশী শ্রমিকদের অবদানের কথা স্বীকার করেন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী। এ সফরে অভিবাসীদের সুযোগ-সুবিধা ও অন্যান্য বিষয়ে আলাপ হয়েছে।
সার্ক শীর্ষ সম্মেলন : সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর যেসব নাগরিক বহির্বিশ্বে কর্মরত রয়েছেন তাদের কল্যাণ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার বিষয়ে সার্কের নেতারা মতৈক্যে পৌঁছেছেন। সার্কের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করতে এখন থেকে প্রতি দুই বছর পরপর সম্মেলনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশ গঠনমূলক ভূমিকা রেখেছে। সম্মেলনে বাংলাদেশের উত্থাপিত বেশ কিছু প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে।
খালেদা জিয়ার সমালোচনা : প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৫ জানুয়ারি নির্বাচন হয়েছিল বলেই আজকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। নির্বাচন না হলে এটা কখনোই হতো না। উল্টো যুদ্ধাপরাধীরা জেলখানা থেকে বেরিয়ে এসে কচুকাটা শুরু করত। খালেদা জিয়ার সমালোচনা করে তিনি বলেন, তিনি যুদ্ধাপরাধীদের (জামায়াত নেতাদের) গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দিয়েছেন। তাদের বিচার হচ্ছে, এটা তিনি চান না। আসলে সরকারের পতন ঘটিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করাই তার (খালেদা) লক্ষ্য।
পাকিস্তানের কাছে চাওয়ার কিছু নেই : সংবাদ সম্মেলনের প্রশ্নোত্তর পর্বের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, পাকিস্তানের কাছে আমাদের চাওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। বরং তারাই এখন জানতে চাচ্ছে, কীভাবে আমরা এত দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছি। সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, কারও সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার সুযোগ নেই। সমস্যা থাকতে পারে। পাশাপাশি আলোচনাও হতে পারে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের এটিই নিয়ম।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে বঙ্গবন্ধুর ওআইসি সম্মেলনে অংশগ্রহণ এবং সেখানে পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বীকৃতিদানের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তান যেমন তাদের পরাজয় মেনে নিয়েছে, তেমনি বাংলাদেশের বিজয়কেও মেনে নিয়েছে। বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার সময় যারা ছিল তাদের অনেকেই এখন আর বেঁচে নেই। তাদের পর কয়েক প্রজন্ম এসেছে। তাদের পাকিস্তানে ফেরত নেয়ার জন্য অনেক প্রতিষ্ঠানও হয়েছে। সরকার থেকেও আমরা বলেছি। কিন্তু তারা নিচ্ছে না।
শকুনের দোয়ায় গরু মরে না : বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি নেত্রী নানাভাবে হুমকি-ধমকি ও নানা মন্তব্য করে যাচ্ছেন- তার এসব কথায় আমি ভয় পাই না, উদ্বিগ্নও হই না। এ প্রসঙ্গে ২০০৫-২০০৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়ার বিভিন্ন বক্তব্য স্মরণ করিয়ে দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, সে সময় তিনি বলতেন, আমি আর কখনোই প্রধানমন্ত্রী তো দূরের কথা বিরোধীদলীয় নেতাও হতে পারব না। কিন্তু এখন তার নিজের ক্ষেত্রেই সেটা ঘটেছে। এ পর্যায়ে তিনি মৃদু হেসে ‘শকুনের দোয়ায় গরুর মরে না’- এ প্রবাদ বাক্যটি স্মরণ করিয়ে দেন।
টিআইবির হিসাব নেয়ার ইঙ্গিত : ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের দুর্নীতিবিষয়ক রিপোর্ট প্রকাশ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করল তাদের বিরুদ্ধ কোনো টুঁ শব্দ না করে কে ট্রাক থামিয়ে কয় টাকা নিল, কোথা থেকে কী করল- এই খুচরা বিষয় নিয়ে এত সরব কেন? শেখ হাসিনা প্রশ্ন করেন, বড় বড় দুর্নীতির বিষয়ে নিশ্চুপ থেকে টিআইবি কি কারণে সময় সময় সরব হয়? তার মতে, ১৬ কোটি মানুষের দেশ এখানে কিছু না কিছু ঘটতেই পারে। পৃথিবীর কোনো দেশ নেই যে ছোটখাটো দুর্নীতি হচ্ছে না? আমাদের সরকার তো কোনো দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নয়। সরকার দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হলে দেশের এত উন্নয়ন হতো না। প্রবৃদ্ধি এত বাড়ত না। টিআইবির প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, যারা এত কথা বলছেন, তাদের আয়ের সোর্স কী? কীভাবে ব্যয় হচ্ছে- সেই হিসাব দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের মালিকের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, তারা এত টাকা কোথা থেকে পেল যে ব্যাংকের মালিক হলেন? তিনি আবার বেসরকারি টিভি মালিকদের সংগঠনেরও সভাপতি!
কথায় ট্যাক্স বসানো হয়নি : প্রধানমন্ত্রী তার উপদেষ্টা এইচটি ইমামের বক্তব্য প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, কথা বলার স্বাধীনতা থেকেই যে যার কথা বলে যাচ্ছেন। সে আমাদের দলের হোন বা অন্য দলের হোন। কথার ওপর তো কোনো ট্যাক্স বসানো হয়নি। সরকার ব্যক্তিস্বাধীনতা দিয়েছে বলেই সবাই কথা বলতে পারছেন। তবে এই স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে একটি দায়িত্বশীলতা আছে এটা সবাইকে মনে রাখতে হবে।
নারায়ণগঞ্জের সেভেন মার্ডার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াটা কঠিন ছিল। কিন্তু আমরা কাউকে ছাড় দিইনি। কারও জামাই হোক আর ভাগ্নে হোক আমরা কোনো আÍীয়তার সম্পর্ক দেখিনি। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি।
নেপালে অনুষ্ঠিত সার্ক শীর্ষ সম্মেলন ও মালয়েশিয়া সফর বিষয়ে অবহিত করতে গণভবনে এ সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করা হয়। বিকাল ৪টায় সংবাদ সম্মেলন শুরুর পর ২০ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী চার পৃষ্ঠার একটি লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান। পরে আরও পৌনে ১ ঘণ্টায় তিনি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।
শেখ হাসিনা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের যে সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে এসেছেন, তিনি বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি নেত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। কেউ যদি কোনো মতামত দিয়ে থাকেন তাহলে সে দায়িত্ব তার। তাকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেন।
নিশা দেশাই বিসওয়াল সম্পর্কে দলের সাধারণ সম্পাদকের মন্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে মোটেও অখুশি নন তা পদ্মা সেতুতে অর্থায়নে বিশ্বব্যাংকের ভূমিকার উল্লেখ করতে গিয়ে প্রকাশ করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশেই তা করা হয়েছিল বলেও শোনা গেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সারা বিশ্ব তন্ন তন্ন করে খুঁজেও প্রমাণ পায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের অতীত ও বর্তমান ভূমিকায় অসন্তোষ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটা দেশ পাশে না থাকলে আমরা একেবারে শেষ হয়ে যাব? ’৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধেও যুক্তরাষ্ট্র বিরুদ্ধে ছিল। বাংলাদেশ শেষ হয়ে যায়নি। মুক্তিযুদ্ধের সময় যদি আমরা লড়াই করে টিকে থাকতে পারি তাহলে স্বাধীন দেশ হিসেবে এখনও পারব। প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীর উদ্দেশে বলেন, প্রত্যেকটি নাগরিককে বলব, এটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। সে মর্যাদা নিয়ে চলতে হবে। কেউ পাশে থাকলে বাঁচব, না থাকলে মরে যাব, এটা ঠিক না। ভালো থাকলে বন্ধুর অভাব হবে না। কাউকে ছাড়া বাংলাদেশ চলতে পারবে না- এমন চিন্তা না থাকাই ভালো। তবে সে দেশটিতেও (যুক্তরাষ্ট্র) একাত্তরে বাংলাদেশের বন্ধু ছিল এবং এখনও আছে বলে মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, তাদের সহযোগিতা বাংলাদেশ সবসময় পেয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের পররাষ্ট্রনীতি অত্যন্ত স্বচ্ছ। এটা পূর্ব না পশ্চিম, উত্তর না দক্ষিণ- তা আমি বিবেচনায় নিতে চাই না। এ সময় তিনি রসিকতা করে বলেন, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে। লন্ডনে গেলে কি আপনি এখন যাকে পূর্বদিক বলছেন, সেটা পূর্ব দিক থাকবে? বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে কারও সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করতে হলে তা করব। তবে সরকারের নীতি হল বঙ্গবন্ধুর সেই বাণী- ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়।’
প্রধানমন্ত্রীর এ সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী, প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী এবং আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পাদক কর্নেল (অব.) ফারুক খান উপস্থিত ছিলেন।
মালয়েশিয়া সফর : সংবাদ সম্মেলনে মালয়েশিয়া সফরকে অত্যন্ত সফল ও কার্যকর বলে দাবি করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, মালয়েশিয়া সফরে বেশ কিছু চুক্তি ও সমঝোতা স্বাক্ষর হয়েছে। দেশটি বাংলাদেশের আবাসন, জ্বালানি, রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। নিু আয়ের মানুষের জন্য কামরাঙ্গীরচরে বহুতল আবাসন নির্মাণ প্রকল্পে বিনিয়োগের আমন্ত্রণ জানালে তারা তা গ্রহণ করেছে। এছাড়াও মালয়েশিয়ার গাড়ি তৈরির কোম্পানি প্রোটনের একটি কারখানা বাংলাদেশে করার সম্ভাবনার কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
মালয়েশিয়ার সারওয়াক প্রদেশে ৬০ হাজার শ্রমিকের চাহিদা থাকার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১২ হাজার শ্রমিককে ওই প্রদেশে নিয়োগের লক্ষ্যে একটি প্রটোকল স্বাক্ষরের বিষয়ে তার সরকার সম্মতি জ্ঞাপন করেছে। তিনি জানান, দেশটির সার্বিক উন্নয়নে বাংলাদেশী শ্রমিকদের অবদানের কথা স্বীকার করেন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী। এ সফরে অভিবাসীদের সুযোগ-সুবিধা ও অন্যান্য বিষয়ে আলাপ হয়েছে।
সার্ক শীর্ষ সম্মেলন : সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর যেসব নাগরিক বহির্বিশ্বে কর্মরত রয়েছেন তাদের কল্যাণ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার বিষয়ে সার্কের নেতারা মতৈক্যে পৌঁছেছেন। সার্কের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করতে এখন থেকে প্রতি দুই বছর পরপর সম্মেলনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশ গঠনমূলক ভূমিকা রেখেছে। সম্মেলনে বাংলাদেশের উত্থাপিত বেশ কিছু প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে।
খালেদা জিয়ার সমালোচনা : প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৫ জানুয়ারি নির্বাচন হয়েছিল বলেই আজকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। নির্বাচন না হলে এটা কখনোই হতো না। উল্টো যুদ্ধাপরাধীরা জেলখানা থেকে বেরিয়ে এসে কচুকাটা শুরু করত। খালেদা জিয়ার সমালোচনা করে তিনি বলেন, তিনি যুদ্ধাপরাধীদের (জামায়াত নেতাদের) গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দিয়েছেন। তাদের বিচার হচ্ছে, এটা তিনি চান না। আসলে সরকারের পতন ঘটিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করাই তার (খালেদা) লক্ষ্য।
পাকিস্তানের কাছে চাওয়ার কিছু নেই : সংবাদ সম্মেলনের প্রশ্নোত্তর পর্বের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, পাকিস্তানের কাছে আমাদের চাওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। বরং তারাই এখন জানতে চাচ্ছে, কীভাবে আমরা এত দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছি। সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, কারও সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার সুযোগ নেই। সমস্যা থাকতে পারে। পাশাপাশি আলোচনাও হতে পারে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের এটিই নিয়ম।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে বঙ্গবন্ধুর ওআইসি সম্মেলনে অংশগ্রহণ এবং সেখানে পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বীকৃতিদানের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তান যেমন তাদের পরাজয় মেনে নিয়েছে, তেমনি বাংলাদেশের বিজয়কেও মেনে নিয়েছে। বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার সময় যারা ছিল তাদের অনেকেই এখন আর বেঁচে নেই। তাদের পর কয়েক প্রজন্ম এসেছে। তাদের পাকিস্তানে ফেরত নেয়ার জন্য অনেক প্রতিষ্ঠানও হয়েছে। সরকার থেকেও আমরা বলেছি। কিন্তু তারা নিচ্ছে না।
শকুনের দোয়ায় গরু মরে না : বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি নেত্রী নানাভাবে হুমকি-ধমকি ও নানা মন্তব্য করে যাচ্ছেন- তার এসব কথায় আমি ভয় পাই না, উদ্বিগ্নও হই না। এ প্রসঙ্গে ২০০৫-২০০৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়ার বিভিন্ন বক্তব্য স্মরণ করিয়ে দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, সে সময় তিনি বলতেন, আমি আর কখনোই প্রধানমন্ত্রী তো দূরের কথা বিরোধীদলীয় নেতাও হতে পারব না। কিন্তু এখন তার নিজের ক্ষেত্রেই সেটা ঘটেছে। এ পর্যায়ে তিনি মৃদু হেসে ‘শকুনের দোয়ায় গরুর মরে না’- এ প্রবাদ বাক্যটি স্মরণ করিয়ে দেন।
টিআইবির হিসাব নেয়ার ইঙ্গিত : ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের দুর্নীতিবিষয়ক রিপোর্ট প্রকাশ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করল তাদের বিরুদ্ধ কোনো টুঁ শব্দ না করে কে ট্রাক থামিয়ে কয় টাকা নিল, কোথা থেকে কী করল- এই খুচরা বিষয় নিয়ে এত সরব কেন? শেখ হাসিনা প্রশ্ন করেন, বড় বড় দুর্নীতির বিষয়ে নিশ্চুপ থেকে টিআইবি কি কারণে সময় সময় সরব হয়? তার মতে, ১৬ কোটি মানুষের দেশ এখানে কিছু না কিছু ঘটতেই পারে। পৃথিবীর কোনো দেশ নেই যে ছোটখাটো দুর্নীতি হচ্ছে না? আমাদের সরকার তো কোনো দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নয়। সরকার দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হলে দেশের এত উন্নয়ন হতো না। প্রবৃদ্ধি এত বাড়ত না। টিআইবির প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, যারা এত কথা বলছেন, তাদের আয়ের সোর্স কী? কীভাবে ব্যয় হচ্ছে- সেই হিসাব দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের মালিকের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, তারা এত টাকা কোথা থেকে পেল যে ব্যাংকের মালিক হলেন? তিনি আবার বেসরকারি টিভি মালিকদের সংগঠনেরও সভাপতি!
কথায় ট্যাক্স বসানো হয়নি : প্রধানমন্ত্রী তার উপদেষ্টা এইচটি ইমামের বক্তব্য প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, কথা বলার স্বাধীনতা থেকেই যে যার কথা বলে যাচ্ছেন। সে আমাদের দলের হোন বা অন্য দলের হোন। কথার ওপর তো কোনো ট্যাক্স বসানো হয়নি। সরকার ব্যক্তিস্বাধীনতা দিয়েছে বলেই সবাই কথা বলতে পারছেন। তবে এই স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে একটি দায়িত্বশীলতা আছে এটা সবাইকে মনে রাখতে হবে।
নারায়ণগঞ্জের সেভেন মার্ডার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াটা কঠিন ছিল। কিন্তু আমরা কাউকে ছাড় দিইনি। কারও জামাই হোক আর ভাগ্নে হোক আমরা কোনো আÍীয়তার সম্পর্ক দেখিনি। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি।
No comments