সাধারণ মানুষ কেমন নির্বাচন চান? by মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার
বাংলাদেশে এখন সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক
একটি সংকট বিরাজমান। কারণ, নিয়ম বা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার কথা বলে
দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনটিকে সাধারণ মানুষ ভালো
নির্বাচন হিসেবে গ্রহণ করেননি। এ রকম একটি নির্বাচনের ওপর ভিত্তি করে সরকার
দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় থেকে বিদেশীদের কাছ থেকে ঘনঘন সংলাপ ও ভালো নির্বাচন
করার সবক শুনুক, তা তারা চান না। সে কারণে আরেকটি গ্রহণযোগ্য,
অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ সংসদ নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত এ সংকটের সমাধান
হবে না। তবে ওই নির্বাচনটি কখন হবে এবং কেমন সরকারের অধীনে হবে তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেক জলপনা-কল্পনা রয়েছে।
সরকারি দলের নেতারা আগামী নির্বাচনটি সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর অর্থাৎ ২০১৯ সালে করার পক্ষে। তারা চান, বর্তমান সংবিধানের বিধান অনুযায়ী ওই নির্বাচনটি দলীয় সরকারের অধীনে দশম সংসদ নির্বাচনের মতো একই প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত হোক। কিন্তু দেশের অধিকাংশ মানুষ এবং বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীরা তা চান না। কারণ, তারা মনে করেন দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ নির্বাচন করার মতো পরিবেশ-পরিস্থিতি এখনও বাংলাদেশে তৈরি হয়নি। এমন ধারণার পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে তারা দলীয় সরকারের অধীনে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত দশম সংসদ এবং চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ব্যাপক দুর্নীতি-কারচুপি ও অনিয়মের দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেন। ওই নির্বাচন দুটিতে প্রশাসন এবং নির্বাচন কমিশনের অপেশাদার ভূমিকার প্রসঙ্গও তারা উল্লেখ করেন। কাজেই পরবর্তী সংসদ নির্বাচনটি যদি বর্তমান সংবিধানের বিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী-এমপিদের ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন এবং আইনশৃংখলা বাহিনী নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারবে বলে তারা মনে করেন না। এ কারণে এরা একটি নির্দলীয়-নিরপেক্ষ কর্তৃপক্ষের অধীনে সংসদ নির্বাচন দাবি করেন।
সরকারি ও বিরোধী দলের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ যাচাই করে সরকারদলীয় প্রস্তাবের চেয়ে বিরোধীদলীয় দাবি সাধারণ মানুষের কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়। কারণ, সরকারি দলের পক্ষ থেকে দলীয় সরকারের অধীনে নমুনা হিসেবে একটি অবাধ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করে দেখানো সম্ভব হয়নি। বরং ওই নির্বাচনে দেখা গেছে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন এবং প্রশাসন কীভাবে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে কাজ করেছে। এমনকি সরকার উপজেলা নির্বাচনের মতো একটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনও দলীয় সরকারের অধীনে দুর্নীতি ও কারচুপিমুক্তভাবে সম্পন্ন করতে পারেনি। কাজেই এমতাবস্থায় সরকার যদি আগামী সংসদ নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার প্রতিশ্র“তি দেয়, তাহলে বিরোধী দল এবং সাধারণ মানুষ সে প্রতিশ্র“তি বিশ্বাস না করলে তাদের দোষ দেয়া যায় না। অন্যদিকে, বিরোধী দল চায় একটি নির্দলীয় কর্তৃপক্ষের অধীনে সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হোক। এ ক্ষেত্রে তাদের যুক্তি হল, নির্দলীয় কর্তৃপক্ষের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন এবং আইনশৃংখলা বাহিনী রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তভাবে অধিকতর স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করতে পারবে। ফলে নির্বাচন অবাধ ও স্বচ্ছ হবে। এ যুক্তির পক্ষে এরা পঞ্চম, সপ্তম ও অষ্টম সংসদ নির্বাচনের অধিকতর গ্রহণযোগ্যতা এবং ওই নির্বাচনগুলোর মাধ্যমে গঠিত সরকারের পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার উদাহরণ দেয়।
লক্ষণীয়, দেশের সাধারণ মানুষ অযৌক্তিক কোনো কিছু ভাবেন না। কোন দল কতদিন ক্ষমতায় থেকে দেশ পরিচালনা করবে তা নিয়ে তারা খুব বেশি মাথা ঘামান না। তারা চান, যে দলই দেশ শাসন করুক, তারা যেন একটি মুক্ত ও অবাধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। তারা আরও প্রত্যাশা করেন, সংসদ নির্বাচন যেন সব ধরনের দুর্নীতিমুক্ত থাকে।
সাধারণ মানুষ খুবই দেশপ্রেমিক। তারা দেশের মঙ্গল চান। দেশের মধ্যে তারা নির্বাচন নিয়ে হানাহানি, মারামারি দেখতে চান না। তারা দেশে দীর্ঘমেয়াদি সুস্থির রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দেখতে চান। এ কারণেই তারা অবাধ সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চান। এতে তাদের কোনো স্বার্থ নেই। এ ক্ষেত্রে দেশের স্বার্থকেই তারা নিজেদের স্বার্থ মনে করেন। দেশে শান্তি স্থাপিত হলে, দেশ উন্নয়নের পথে এগিয়ে গেলে তারা খুশি। তবে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী ব্যবস্থার মধ্যে দলীয় স্বার্থ খোঁজে। কেমন নির্বাচনী ব্যবস্থায় নির্বাচন হলে নিজ দল ভালো করতে পারবে সে ফন্দি-ফিকির করে। সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ এবং সুশীল সমাজের কিছু সদস্য ভালো-মন্দ বিবেচনা না করেই সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার আশায় ক্ষমতাসীন সরকারের সিদ্ধান্ত সমর্থন করে অনেক সময় দেশপ্রেমিক নাগরিক সমাজের বিরাগভাজন হন।
দেশের সংসদ নির্বাচন কেমন সরকারের অধীনে হবে সে ব্যাপারে দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দল একমত হতে না পারায় বন্ধুপ্রতিম বিদেশী রাষ্ট্রগুলো এ ব্যাপারে বিবদমান পক্ষদ্বয়ের মধ্যে সমঝোতা করার উদ্যোগ নিতে সুযোগ পায়। দেশের মানুষ কিন্তু স্বদেশী রাজনীতিতে বিদেশীদের নাগ গলানোকে একেবারেই পছন্দ করেন না। তারা মনে করেন, এ দেশের রাজনৈতিক সমস্যা সম্মানিত রাজনৈতিক নেতাদেরই সমাধান করা উচিত। রাজনৈতিক নেতারা যদি উদ্ভূত সমস্যা সমাধান করতে না পারেন তাহলে যে দেশ পিছিয়ে যাবে এবং উন্নয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হবে সে বিষয়টি সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে। সে জন্য রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনায় তারা প্রায়ই রাজনৈতিক নেতাদের সমালোচনা করেন। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের দাপট, দখল এবং সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের দৌরাত্ম্যকে সাধারণ মানুষ সমালোচনা করতে কখনোই ভয় পান না।
সাধারণ মানুষ নির্বাচন কমিশনের কঠোর ভূমিকা দেখতে চান। তারা চান নির্বাচন পরিচালনায় কমিশন স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্ব বজায় রেখে কাজ করবে। কমিশন যেন নির্দেশিত ভূমিকা পালন না করে। কমিশন যেন নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব দলের প্রতি খেলার মাঠের রেফারির মতো সমান আচরণ করে এবং অন্যায়-দুর্নীতিকে একদমই প্রশ্রয় না দেয়। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ড দেখে সাধারণ মানুষ এর ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। বিশেষ করে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ওপর সাধারণ মানুষ যথেষ্ট বিরক্ত। দশম সংসদ এবং চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনদ্বয় কমিশন যেভাবে করেছে তা দেখে নাগরিক সমাজ খুবই হতাশ। দশম সংসদ নির্বাচনের দুর্নীতি, কারচুপি এবং প্রশাসনের প্রভাব বিস্তার রোধে কমিশনের ব্যর্থতা প্রত্যক্ষ করে তারা কমিশনের নিন্দা করেছে। বিশেষ করে উপজেলা নির্বাচন চলাকালীন ওই নির্বাচনে মনোযোগ না দিয়ে সিইসির সস্ত্রীক বিদেশ গিয়ে নির্বাচন শেষ হওয়ার পর দেশে ফিরে আসার বিষয়টিকে সাধারণ মানুষ তীব্র ভাষায় উচ্চকণ্ঠে সমালোচনা করেছে। এহেন একটি নির্বাচন কমিশনের অধীনে আবার সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সে নির্বাচন কতটা অবাধ হবে সে সম্পর্কে তারা খুবই সন্দিহান। এ কারণে নাগরিক সমাজকে এ আলোচনাও করতে শোনা যায় যে, সংসদ নির্বাচন স্বচ্ছ ও অবাধ করতে হলে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা তৈরির সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠনও প্রয়োজন।
দেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। সাধারণ মানুষ চান, রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের সময় সংসদ সদস্য পদে সুশিক্ষিত, যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেবে, যাতে করে তারা এমপি হিসেবে সংসদে প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করতে পারেন। কিন্তু এ ব্যাপারে বড় দলগুলো প্রায় প্রতিটি নির্বাচনেই সাধারণ মানুষকে হতাশ করেছে। দলগুলো অনেক ক্ষেত্রেই অনেক সুযোগ্য জনপ্রিয় প্রার্থীকে বাদ দিয়ে নব্য টাকাওয়ালা ব্যবসায়ীদের দলীয় প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিয়ে যুগপৎ নাগরিক সমাজ ও দলীয় নেতাকর্মীদের বিরাগভাজন হয়েছে। সাধারণ মানুষ নির্বাচনের আগে প্রচারণায় বা নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে সন্ত্রাস-সহিংসতা দেখতে না চাইলেও প্রায় প্রতিটি নির্বাচনেই তাদের তা দেখতে হয়েছে। সাধারণ ভোটার চান, নির্বাচনের দিন একটি উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করুক এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিটি ভোটার যেন ভয়-ভীতিহীনভাবে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন।
গণতান্ত্রিক সরকারের কাজ হল সাধারণ মানুষের নাড়ির স্পন্দন অনুভব করা। তাদের দুঃখ-বেদনা হ্রাস করা। তাদের ছোট ছোট চাহিদাগুলো পূরণ করা। সরকারের উচিত নির্বাচন প্রসঙ্গে সাধারণ মানুষের ভাবনাকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা। সাধারণ মানুষ যদি আরেকটি সংসদ নির্বাচন চান, তাহলে সরকারের উচিত হবে না তাদের সে চাহিদা উপেক্ষা করে তাদের বিরাগভাজন হওয়া। তারা কেমন নির্বাচনকালীন কর্তৃপক্ষের অধীনে সংসদ নির্বাচন চান সে ব্যাপারটি সরকারের গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। সরকারকে ভুলে গেলে হবে না, সাধারণ মানুষই কিং মেকার। গণতন্ত্রে তারা অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী। তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো সরকারের পক্ষে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকা সম্ভব হয় না। কারণ, সাধারণ মানুষ কোনো সরকারের ওপর বিরক্ত হলে তাদের কর্মকাণ্ডে অসন্তুষ্ট হলে, মুক্ত ও অবাধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে খুব সহজেই তারা ওই সরকার পরিবর্তনের ক্ষমতা রাখেন।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
হবে না। তবে ওই নির্বাচনটি কখন হবে এবং কেমন সরকারের অধীনে হবে তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেক জলপনা-কল্পনা রয়েছে।
সরকারি দলের নেতারা আগামী নির্বাচনটি সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর অর্থাৎ ২০১৯ সালে করার পক্ষে। তারা চান, বর্তমান সংবিধানের বিধান অনুযায়ী ওই নির্বাচনটি দলীয় সরকারের অধীনে দশম সংসদ নির্বাচনের মতো একই প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত হোক। কিন্তু দেশের অধিকাংশ মানুষ এবং বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীরা তা চান না। কারণ, তারা মনে করেন দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ নির্বাচন করার মতো পরিবেশ-পরিস্থিতি এখনও বাংলাদেশে তৈরি হয়নি। এমন ধারণার পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে তারা দলীয় সরকারের অধীনে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত দশম সংসদ এবং চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ব্যাপক দুর্নীতি-কারচুপি ও অনিয়মের দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেন। ওই নির্বাচন দুটিতে প্রশাসন এবং নির্বাচন কমিশনের অপেশাদার ভূমিকার প্রসঙ্গও তারা উল্লেখ করেন। কাজেই পরবর্তী সংসদ নির্বাচনটি যদি বর্তমান সংবিধানের বিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী-এমপিদের ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন এবং আইনশৃংখলা বাহিনী নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারবে বলে তারা মনে করেন না। এ কারণে এরা একটি নির্দলীয়-নিরপেক্ষ কর্তৃপক্ষের অধীনে সংসদ নির্বাচন দাবি করেন।
সরকারি ও বিরোধী দলের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ যাচাই করে সরকারদলীয় প্রস্তাবের চেয়ে বিরোধীদলীয় দাবি সাধারণ মানুষের কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়। কারণ, সরকারি দলের পক্ষ থেকে দলীয় সরকারের অধীনে নমুনা হিসেবে একটি অবাধ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করে দেখানো সম্ভব হয়নি। বরং ওই নির্বাচনে দেখা গেছে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন এবং প্রশাসন কীভাবে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে কাজ করেছে। এমনকি সরকার উপজেলা নির্বাচনের মতো একটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনও দলীয় সরকারের অধীনে দুর্নীতি ও কারচুপিমুক্তভাবে সম্পন্ন করতে পারেনি। কাজেই এমতাবস্থায় সরকার যদি আগামী সংসদ নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার প্রতিশ্র“তি দেয়, তাহলে বিরোধী দল এবং সাধারণ মানুষ সে প্রতিশ্র“তি বিশ্বাস না করলে তাদের দোষ দেয়া যায় না। অন্যদিকে, বিরোধী দল চায় একটি নির্দলীয় কর্তৃপক্ষের অধীনে সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হোক। এ ক্ষেত্রে তাদের যুক্তি হল, নির্দলীয় কর্তৃপক্ষের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন এবং আইনশৃংখলা বাহিনী রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তভাবে অধিকতর স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করতে পারবে। ফলে নির্বাচন অবাধ ও স্বচ্ছ হবে। এ যুক্তির পক্ষে এরা পঞ্চম, সপ্তম ও অষ্টম সংসদ নির্বাচনের অধিকতর গ্রহণযোগ্যতা এবং ওই নির্বাচনগুলোর মাধ্যমে গঠিত সরকারের পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার উদাহরণ দেয়।
লক্ষণীয়, দেশের সাধারণ মানুষ অযৌক্তিক কোনো কিছু ভাবেন না। কোন দল কতদিন ক্ষমতায় থেকে দেশ পরিচালনা করবে তা নিয়ে তারা খুব বেশি মাথা ঘামান না। তারা চান, যে দলই দেশ শাসন করুক, তারা যেন একটি মুক্ত ও অবাধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। তারা আরও প্রত্যাশা করেন, সংসদ নির্বাচন যেন সব ধরনের দুর্নীতিমুক্ত থাকে।
সাধারণ মানুষ খুবই দেশপ্রেমিক। তারা দেশের মঙ্গল চান। দেশের মধ্যে তারা নির্বাচন নিয়ে হানাহানি, মারামারি দেখতে চান না। তারা দেশে দীর্ঘমেয়াদি সুস্থির রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দেখতে চান। এ কারণেই তারা অবাধ সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চান। এতে তাদের কোনো স্বার্থ নেই। এ ক্ষেত্রে দেশের স্বার্থকেই তারা নিজেদের স্বার্থ মনে করেন। দেশে শান্তি স্থাপিত হলে, দেশ উন্নয়নের পথে এগিয়ে গেলে তারা খুশি। তবে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী ব্যবস্থার মধ্যে দলীয় স্বার্থ খোঁজে। কেমন নির্বাচনী ব্যবস্থায় নির্বাচন হলে নিজ দল ভালো করতে পারবে সে ফন্দি-ফিকির করে। সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ এবং সুশীল সমাজের কিছু সদস্য ভালো-মন্দ বিবেচনা না করেই সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার আশায় ক্ষমতাসীন সরকারের সিদ্ধান্ত সমর্থন করে অনেক সময় দেশপ্রেমিক নাগরিক সমাজের বিরাগভাজন হন।
দেশের সংসদ নির্বাচন কেমন সরকারের অধীনে হবে সে ব্যাপারে দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দল একমত হতে না পারায় বন্ধুপ্রতিম বিদেশী রাষ্ট্রগুলো এ ব্যাপারে বিবদমান পক্ষদ্বয়ের মধ্যে সমঝোতা করার উদ্যোগ নিতে সুযোগ পায়। দেশের মানুষ কিন্তু স্বদেশী রাজনীতিতে বিদেশীদের নাগ গলানোকে একেবারেই পছন্দ করেন না। তারা মনে করেন, এ দেশের রাজনৈতিক সমস্যা সম্মানিত রাজনৈতিক নেতাদেরই সমাধান করা উচিত। রাজনৈতিক নেতারা যদি উদ্ভূত সমস্যা সমাধান করতে না পারেন তাহলে যে দেশ পিছিয়ে যাবে এবং উন্নয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হবে সে বিষয়টি সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে। সে জন্য রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনায় তারা প্রায়ই রাজনৈতিক নেতাদের সমালোচনা করেন। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের দাপট, দখল এবং সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের দৌরাত্ম্যকে সাধারণ মানুষ সমালোচনা করতে কখনোই ভয় পান না।
সাধারণ মানুষ নির্বাচন কমিশনের কঠোর ভূমিকা দেখতে চান। তারা চান নির্বাচন পরিচালনায় কমিশন স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্ব বজায় রেখে কাজ করবে। কমিশন যেন নির্দেশিত ভূমিকা পালন না করে। কমিশন যেন নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব দলের প্রতি খেলার মাঠের রেফারির মতো সমান আচরণ করে এবং অন্যায়-দুর্নীতিকে একদমই প্রশ্রয় না দেয়। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ড দেখে সাধারণ মানুষ এর ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। বিশেষ করে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ওপর সাধারণ মানুষ যথেষ্ট বিরক্ত। দশম সংসদ এবং চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনদ্বয় কমিশন যেভাবে করেছে তা দেখে নাগরিক সমাজ খুবই হতাশ। দশম সংসদ নির্বাচনের দুর্নীতি, কারচুপি এবং প্রশাসনের প্রভাব বিস্তার রোধে কমিশনের ব্যর্থতা প্রত্যক্ষ করে তারা কমিশনের নিন্দা করেছে। বিশেষ করে উপজেলা নির্বাচন চলাকালীন ওই নির্বাচনে মনোযোগ না দিয়ে সিইসির সস্ত্রীক বিদেশ গিয়ে নির্বাচন শেষ হওয়ার পর দেশে ফিরে আসার বিষয়টিকে সাধারণ মানুষ তীব্র ভাষায় উচ্চকণ্ঠে সমালোচনা করেছে। এহেন একটি নির্বাচন কমিশনের অধীনে আবার সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সে নির্বাচন কতটা অবাধ হবে সে সম্পর্কে তারা খুবই সন্দিহান। এ কারণে নাগরিক সমাজকে এ আলোচনাও করতে শোনা যায় যে, সংসদ নির্বাচন স্বচ্ছ ও অবাধ করতে হলে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা তৈরির সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠনও প্রয়োজন।
দেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। সাধারণ মানুষ চান, রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের সময় সংসদ সদস্য পদে সুশিক্ষিত, যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেবে, যাতে করে তারা এমপি হিসেবে সংসদে প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করতে পারেন। কিন্তু এ ব্যাপারে বড় দলগুলো প্রায় প্রতিটি নির্বাচনেই সাধারণ মানুষকে হতাশ করেছে। দলগুলো অনেক ক্ষেত্রেই অনেক সুযোগ্য জনপ্রিয় প্রার্থীকে বাদ দিয়ে নব্য টাকাওয়ালা ব্যবসায়ীদের দলীয় প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিয়ে যুগপৎ নাগরিক সমাজ ও দলীয় নেতাকর্মীদের বিরাগভাজন হয়েছে। সাধারণ মানুষ নির্বাচনের আগে প্রচারণায় বা নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে সন্ত্রাস-সহিংসতা দেখতে না চাইলেও প্রায় প্রতিটি নির্বাচনেই তাদের তা দেখতে হয়েছে। সাধারণ ভোটার চান, নির্বাচনের দিন একটি উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করুক এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিটি ভোটার যেন ভয়-ভীতিহীনভাবে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন।
গণতান্ত্রিক সরকারের কাজ হল সাধারণ মানুষের নাড়ির স্পন্দন অনুভব করা। তাদের দুঃখ-বেদনা হ্রাস করা। তাদের ছোট ছোট চাহিদাগুলো পূরণ করা। সরকারের উচিত নির্বাচন প্রসঙ্গে সাধারণ মানুষের ভাবনাকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা। সাধারণ মানুষ যদি আরেকটি সংসদ নির্বাচন চান, তাহলে সরকারের উচিত হবে না তাদের সে চাহিদা উপেক্ষা করে তাদের বিরাগভাজন হওয়া। তারা কেমন নির্বাচনকালীন কর্তৃপক্ষের অধীনে সংসদ নির্বাচন চান সে ব্যাপারটি সরকারের গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। সরকারকে ভুলে গেলে হবে না, সাধারণ মানুষই কিং মেকার। গণতন্ত্রে তারা অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী। তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো সরকারের পক্ষে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকা সম্ভব হয় না। কারণ, সাধারণ মানুষ কোনো সরকারের ওপর বিরক্ত হলে তাদের কর্মকাণ্ডে অসন্তুষ্ট হলে, মুক্ত ও অবাধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে খুব সহজেই তারা ওই সরকার পরিবর্তনের ক্ষমতা রাখেন।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
No comments