একজন মানব দরদী উম্মে আবদু
যখনই
হেলিকপ্টারের শব্দ শোনেন উম্মে আবদু, তখনই তিনি দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে
পড়েন। নিজের মেডিক্যাল সামগ্রী নিয়ে দৌড়ে চলে যান পার্শ্ববর্তী একমাত্র
হাসপাতালটিতে। সিরিয়ার সংঘাতপীড়িত আলেপ্পোর নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হলো
হেলিকপ্টারের রোটরের শব্দ আর বোমা বিস্ফোরণের বিকট আওয়াজ। আর এরপরই উম্মে
আবদু হামাগুঁড়ি দিয়ে চারতলা হাসপাতালের দিকে এগুতে থাকেন। তিনি জানেন,
কিছুক্ষণ পর তিনি দেখতে পাবেন আহত-নিহত মানুষের দেহ। এমনকি এ হাসপাতালটিও
নিরাপদ নয়। হাসপাতালের আশপাশের সবচেয়ে বড় ভবনগুলো প্রায় আধ-টন বোমার আঘাতে
ধ্বংস হয়ে গেছে। উম্মে আবদু বলেন, দোযখ বেশি দূরে নয় আর। হাসপাতালটির এই
তলায় তিনিই একমাত্র নারী। কালো বোরকা আবৃত এই নারী সবুজ গাউন পরিহিত আরও
তিন তরুণের সঙ্গে কাজ করেন। তারা এ হাসপাতালের কর্মী। যুদ্ধের ফলে আলেপ্পোর
আহত মানুষদের সারিয়ে তোলার চেষ্টা করা তাদের কাজ। তবে কেবল মানবিক কারণেই
নয়, উম্মে আবদু এ হাসপাতালে পড়ে আছেন আরেকটি কারণে। তার পিঠের খাপে স্টিলের
একটি পিস্তল রয়েছে। তার ভাষায়, এ যুদ্ধ থেকে বিচার পাওয়াটা আমার ব্যক্তিগত
জিহাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি এই পিস্তলটি ছাড়া আর কাজ করতে পারি না। যুদ্ধের
আগে তিনি বিয়ের পোশাক সেলাই করতেন। রোগীদের শরীরের আহত স্থানে নিপুণ হাতে
সেলাই কিংবা ব্যান্ডেজ লাগানোটা তিনি করতে পারছেন সে কারণেই। এ
যুদ্ধাক্রান্ত শহরের পূর্বদিকে যারা বসবাস করেন এখনও, তাদের প্রায়
প্রত্যেকেরই অপরিমেয় ক্ষতি ও বঞ্চনার গল্প রয়েছে। উম্মে আবদুও তাদেরই একজন,
যারা শহরের এ প্রান্তে এরপরও বেঁচে থাকছেন কোন না কোনো কারণে। এখানে হয়তো
তাদের অস্তিত্ব টিকে আছে, কিন্তু জীবনটা যেন থেমে গেছে। সিরিয়ার এ যুদ্ধে
ব্যারেল বোমা খুব বেশি জীবনহানি ঘটিয়েছে। এর ব্যবহারও হয়েছে অনেক বেশি।
উম্মে আবদুর ছেলে ইউসুফ তিন মাস আগে এমনই এক বিস্ফোরণে মারা গেছে। ইউসুফ
তখন একটি মিনিবাসে করে যাচ্ছিলেন হাসপাতালের কাজ সারতে। কিন্তু তখনই ওই
বিস্ফোরণ ঘটে, মারা যায় ইউসুফ সহ ৩৫ ব্যক্তি। উম্মে আবদু বলেন, সে দিনটি
ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ দিন। তার সঙ্গে বসে ছিলেন তার বেঁচে যাওয়া অপর সন্তান
আবদুল্লাহ। নিজের বড় ভাই ইউসুফ সমপর্কে আবদুল্লাহ বলল, আমরা একই সঙ্গে
ঘুমোতাম ১৭ বছর ধরে ধরে। আমরা একসঙ্গে সব করতাম। আমরা খেলতাম, আমরা স্বপ্ন
দেখতাম, আমরা বড় হতাম। কিন্তু সে চলে গেল। আমি কী আর বলবো? তাদের বিছানার
পেছনে দু’টি ‘ফ্রি সিরিয়া’ লেখা পতাকা, আরেকটি ইসলামি পতাকা। যুদ্ধের
প্রথম দিনগুলোতে তাদের মনে একটি আশা জেগে উঠেছিল। কিন্তু তিন বছর ধরে চলা এ
গৃহযুদ্ধ কেবল অবিরত নৃশংসতা ও প্রায় ২ লাখ মানুষের মৃত্যুই উপহার দিয়েছে।
উম্মে আবদুর স্বামীও আসাদ বাহিনীর এক স্নাইপারের গুলির আঘাতে মৃত্যুবরণ
করেছেন। আঠারো মাস আগের ঘটনা ছিল এটি। এসময় তার স্বামী একজন তাদের ঘরের
পাশেই অবস্থিত ‘নো ম্যানস ল্যান্ডে’র পড়ে থাকা একজন আহত ব্যক্তিকে উদ্ধারের
চেষ্টা করছিলেন। আর তখনই স্নাইপারের বুলেট তার মুখ ভেদ করে চলে যায়।
অল্পের জন্য বেঁচে যান উম্মে আবদু। সরকার-বিরোধী যোদ্ধারা বলছেন, উম্মে
আবদু সমপূর্ণ অনন্য। একসঙ্গে তিনি যোদ্ধা ও স্বাস্থ্যকর্মী। একজন স্থানীয়
বিদ্রোহী নেতা বললেন, কেউ তার মতো এত ঝুঁকি নেয় না। এবং তার মতো কেউই এত
মানুষের প্রাণ রক্ষা করেনি। আবু জুদ নামের এই বিদ্রোহী নেতা উম্মে আবদুকে
উদ্দেশ্য করে বললেন, আমরা তোমার কাছে ঋণী। পুরো আলেপ্পো তোমার কাছে ঋণী।
(গার্ডিয়ান অবলম্বনে)
No comments