চালকদের গ্রাম by আবদুর রহমান
(যাত্রী নিয়ে বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়ার প্রস্তুতি কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার জামিরাপাড়া গ্রামের কয়েকজন চালকের l ছবি: প্রথম আলো) ছোট্ট
গ্রামের মধ্য দিয়ে চলে গেছে মাধাইয়া-নবাবপুর সড়ক। এরই এক পাশে
ছেংগাছিয়া, অন্যপাশে নিচন্তপুর গ্রাম। পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ।
প্রকৃতির অপরূপ শোভায় ঢাকা ছোট্ট এই গ্রামটি জামিরাপাড়া। ড্রাইভারদের
গ্রাম। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার মাধাইয়া
বাজার থেকে জামিরাপাড়ার দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার। উপজেলার মহিচাইল
ইউনিয়নের এই গ্রাম আদতে কৃষিপ্রধান। বাঙ্গি, তরমুজ, টমেটো, করলা, শসা,
কৈডা, গোল আলু, মিষ্টি কুমড়া, ফুলকুপি, বাঁধাকপি, শিমসহ নানা সবজির ভালো
ফলন হয় এখানে। হয় বোরো ধানের বাম্পার ফলন। কিন্তু কৃষির জন্য পরিচিতি
পায়নি গ্রামটি। পেয়েছে হতদরিদ্র অবস্থা থেকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো
গাড়িচালকদের জন্য। গ্রামের সাড়ে তিন শ পরিবারের অর্ধেকের বেশি পরিবারের
পুরুষ সদস্যই গাড়িচালক।
গ্রামের সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্য মশু মিয়া (৬০) ও অটোরিকশাচালক স্নাতক শিক্ষার্থী ওয়ালীউল্লাহ (১৮) জানালেন, এই গাড়িচালকদের সংগ্রামগাথা। গত তিন দশক ধরে গ্রামের অধিকাংশ পুরুষ গাড়ি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। গ্রামের স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীও গাড়ি চালিয়ে বাবাকে সাহায্য করছে। তাদের আয় জনপ্রতি ৪০০ থেকে হাজার টাকা। তা দিয়েই চলছে ভরণপোষণ ও লেখাপড়া।
এককালের অতি দরিদ্র এই গ্রামের নাম এখন অনেকেরই মুখে মুখে। প্রতিদিন ভোর হতেই পুরুষেরা গাড়ি চালাতে বাড়ি থেকে বের হন, ফেরেন সেই মধ্যরাতে। সংসার, ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালিয়েও টাকা জমিয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশার মালিক হয়েছেন অর্ধশতাধিক মানুষ। অটোরিকশার পাশাপাশি চালান অন্যান্য যানবাহনও। পরিবারের কর্তাদের এভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর যিনি পথ দেখিয়েছেন, তিনি গ্রামের আবদুল আউয়াল মিস্ত্রি (৫৮)।
ঘুরে দাঁড়ানোর শুরুর কথা: ৩০ বছর আগে আবদুল আউয়াল পড়তেন পঞ্চম শ্রেণিতে। তখন বাবা মারা যান। জমিজমা বলতে কিছুই রেখে যাননি তিনি। পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে লেখাপড়া ছেড়ে ওই সময় শিশু আউয়ালই ধরেন পরিবারের হাল। প্রথমে চাচা হাজি আনু মিয়ার কাছ থেকে সেলাই শেখা। পরে হাটে হাটে গিয়ে খোলা আকাশের নিচে বসে সেলাই করা।
দাদা-দাদি, মা, ছোট ভাই ও তিন বোনের পরিবারের সবার মুখে আউয়ালকে দুমুঠো ভাত তুলে দিতে হতো কাপড় সেলাইয়ের ওই সামান্য টাকা দিয়েই। এভাবে চলল ১০ বছর। পাশের মহিচাইল গ্রামের পরিচিত শাহীন মিস্ত্রি চালাতেন নরসিংদীতে বেবিট্যাক্সি। এক দিন তাঁর পরামর্শেই আউয়ালও শুরু করেন এই ট্যাক্সি চালানো। পাঁচ বছর পর নিজেই কিনে ফেলেন একটি বেবিট্যাক্সি। সঙ্গে সংসারেও আসে সচ্ছলতা।
বর্তমানে একটি বাড়ি, পাঁচ বিঘা জমি আর দুটি সিএনজিচালিত অটোরিকশার মালিক আউয়াল। ছয় ছেলেমেয়ের সবাইকে পড়াশোনা করিয়েছেন তিনি। এক ছেলে পড়ছে স্নাতকে। এতেই থেমে থাকেননি তিনি। গ্রামের অর্ধশতাধিক লোককে শিখিয়েছেন ট্যাক্সি চালানো। তাঁরা সবাই এখন স্বাবলম্বী।
টুকরো টুকরো গল্প: গ্রামের মশু মিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) একজন সাবেক সদস্য। গুরুতর অসুস্থ বাবা এবং মা ও চার বোনের সংসারের হাল ধরতে তাঁকেও ছাড়তে হয়েছিল লেখাপড়া। পরে আউয়ালের কাছ থেকে শিখে শুরু করেন ট্যাক্সি চালানো। এ আয় থেকেই বাবার চিকিৎসা, পরিবারের ভরণপোষণ চালিয়ে বোনদের বিয়ে দিয়েছেন তিনি। নির্বাচিত হয়েছিলেন ইউপি সদস্যও।
মশু মিয়া বলেন, সততা থাকলে গাড়ি চালিয়েও সফল হওয়া সম্ভব। আউয়ালের মতোই ড্রাইভিং পেশাকে তিনি কেবল নিজের মধ্যে রাখেননি। একজন, দুজন করে পঁচিশজনকে শিখিয়েছেন। গ্রামের বেকার যুবকেরা তা শিখে অটোরিকশাসহ বিভিন্ন যানবাহন চালাচ্ছেন এখন।
সম্প্রতি গ্রামটি ঘুরে শোনা গেল সচ্ছলতা ফেরানোর আরও কিছু গল্প। গাড়ি চালিয়ে গ্রামের জসিমউদ্দিন তিনটি অটোরিকশা কেনার পর সম্প্রতি মালিক হয়েছেন একখণ্ড বাড়িরও। মোছলেম নামের আরেকজন জানালেন, তিনি এক ছেলেকে কাতার পাঠিয়েছেন, আরেক ছেলেকে কিনে দিয়েছেন অটোরিকশা।
মহিচাইল ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান আবু মুছা মজুমদার বলেন, দেশে দক্ষ গাড়িচালকদের চাহিদা রয়েছে। এ গ্রামের অধিকাংশ লোক বিভিন্ন ধরনের গাড়ি চালিয়ে নিজেদের অভাব ঘোচানোর পাশাপাশি ছেলেমেয়েদেরও লেখাপড়া শেখানোর চেষ্টা করছেন। তাঁদের এই প্রচেষ্টার কথা ছড়িয়ে পড়েছে অন্য গ্রামেও। তাই তো জামিরাপাড়া হয়ে উঠেছে ‘ড্রাইভারদের গ্রাম’।
গ্রামের সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্য মশু মিয়া (৬০) ও অটোরিকশাচালক স্নাতক শিক্ষার্থী ওয়ালীউল্লাহ (১৮) জানালেন, এই গাড়িচালকদের সংগ্রামগাথা। গত তিন দশক ধরে গ্রামের অধিকাংশ পুরুষ গাড়ি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। গ্রামের স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীও গাড়ি চালিয়ে বাবাকে সাহায্য করছে। তাদের আয় জনপ্রতি ৪০০ থেকে হাজার টাকা। তা দিয়েই চলছে ভরণপোষণ ও লেখাপড়া।
এককালের অতি দরিদ্র এই গ্রামের নাম এখন অনেকেরই মুখে মুখে। প্রতিদিন ভোর হতেই পুরুষেরা গাড়ি চালাতে বাড়ি থেকে বের হন, ফেরেন সেই মধ্যরাতে। সংসার, ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালিয়েও টাকা জমিয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশার মালিক হয়েছেন অর্ধশতাধিক মানুষ। অটোরিকশার পাশাপাশি চালান অন্যান্য যানবাহনও। পরিবারের কর্তাদের এভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর যিনি পথ দেখিয়েছেন, তিনি গ্রামের আবদুল আউয়াল মিস্ত্রি (৫৮)।
ঘুরে দাঁড়ানোর শুরুর কথা: ৩০ বছর আগে আবদুল আউয়াল পড়তেন পঞ্চম শ্রেণিতে। তখন বাবা মারা যান। জমিজমা বলতে কিছুই রেখে যাননি তিনি। পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে লেখাপড়া ছেড়ে ওই সময় শিশু আউয়ালই ধরেন পরিবারের হাল। প্রথমে চাচা হাজি আনু মিয়ার কাছ থেকে সেলাই শেখা। পরে হাটে হাটে গিয়ে খোলা আকাশের নিচে বসে সেলাই করা।
দাদা-দাদি, মা, ছোট ভাই ও তিন বোনের পরিবারের সবার মুখে আউয়ালকে দুমুঠো ভাত তুলে দিতে হতো কাপড় সেলাইয়ের ওই সামান্য টাকা দিয়েই। এভাবে চলল ১০ বছর। পাশের মহিচাইল গ্রামের পরিচিত শাহীন মিস্ত্রি চালাতেন নরসিংদীতে বেবিট্যাক্সি। এক দিন তাঁর পরামর্শেই আউয়ালও শুরু করেন এই ট্যাক্সি চালানো। পাঁচ বছর পর নিজেই কিনে ফেলেন একটি বেবিট্যাক্সি। সঙ্গে সংসারেও আসে সচ্ছলতা।
বর্তমানে একটি বাড়ি, পাঁচ বিঘা জমি আর দুটি সিএনজিচালিত অটোরিকশার মালিক আউয়াল। ছয় ছেলেমেয়ের সবাইকে পড়াশোনা করিয়েছেন তিনি। এক ছেলে পড়ছে স্নাতকে। এতেই থেমে থাকেননি তিনি। গ্রামের অর্ধশতাধিক লোককে শিখিয়েছেন ট্যাক্সি চালানো। তাঁরা সবাই এখন স্বাবলম্বী।
টুকরো টুকরো গল্প: গ্রামের মশু মিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) একজন সাবেক সদস্য। গুরুতর অসুস্থ বাবা এবং মা ও চার বোনের সংসারের হাল ধরতে তাঁকেও ছাড়তে হয়েছিল লেখাপড়া। পরে আউয়ালের কাছ থেকে শিখে শুরু করেন ট্যাক্সি চালানো। এ আয় থেকেই বাবার চিকিৎসা, পরিবারের ভরণপোষণ চালিয়ে বোনদের বিয়ে দিয়েছেন তিনি। নির্বাচিত হয়েছিলেন ইউপি সদস্যও।
মশু মিয়া বলেন, সততা থাকলে গাড়ি চালিয়েও সফল হওয়া সম্ভব। আউয়ালের মতোই ড্রাইভিং পেশাকে তিনি কেবল নিজের মধ্যে রাখেননি। একজন, দুজন করে পঁচিশজনকে শিখিয়েছেন। গ্রামের বেকার যুবকেরা তা শিখে অটোরিকশাসহ বিভিন্ন যানবাহন চালাচ্ছেন এখন।
সম্প্রতি গ্রামটি ঘুরে শোনা গেল সচ্ছলতা ফেরানোর আরও কিছু গল্প। গাড়ি চালিয়ে গ্রামের জসিমউদ্দিন তিনটি অটোরিকশা কেনার পর সম্প্রতি মালিক হয়েছেন একখণ্ড বাড়িরও। মোছলেম নামের আরেকজন জানালেন, তিনি এক ছেলেকে কাতার পাঠিয়েছেন, আরেক ছেলেকে কিনে দিয়েছেন অটোরিকশা।
মহিচাইল ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান আবু মুছা মজুমদার বলেন, দেশে দক্ষ গাড়িচালকদের চাহিদা রয়েছে। এ গ্রামের অধিকাংশ লোক বিভিন্ন ধরনের গাড়ি চালিয়ে নিজেদের অভাব ঘোচানোর পাশাপাশি ছেলেমেয়েদেরও লেখাপড়া শেখানোর চেষ্টা করছেন। তাঁদের এই প্রচেষ্টার কথা ছড়িয়ে পড়েছে অন্য গ্রামেও। তাই তো জামিরাপাড়া হয়ে উঠেছে ‘ড্রাইভারদের গ্রাম’।
No comments