আওয়ামী লীগের টার্গেট ইমেজ উদ্ধার by লুৎফর রহমান
ইমেজ উদ্ধারের টার্গেট নিয়ে সামনে যেতে চায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন নতুন সরকার। আপাতত সরকারের মেয়াদ নিয়েও ভাবছে না ক্ষমতাসীন দল।
বরং পরিস্থিতি বিবেচনায় মধ্যবর্তী নির্বাচন দেয়াকে সুবিধাজনক মনে হলে নির্বাচন আয়োজনেও আপত্তি থাকবে না তাদের। তবে এই মুহূর্তে স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং সংলাপ ইস্যুতে বিরোধী জোটকে ব্যস্ত রেখে দল এবং সরকারের ইমেজ উদ্ধারের চেষ্টা করবে আওয়ামী লীগ। এ লক্ষ্যে দলীয় এবং সরকারের আলাদা পরিকল্পনাও নেয়া হয়েছে। দলীয় পরিকল্পনার মধ্যে আছে বিতর্কিত ও জনবিচ্ছিন্ন নেতাদের বাদ দিয়ে সাংগঠনিক পুনর্গঠন। এছাড়া বিগত সরকারের নেয়া অসমাপ্ত মেগা প্রকল্পগুলো দ্রুত সময়ে সম্পন্ন করে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে দৃশ্যমান করা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক রেখে সামনে এগোবার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। একই সঙ্গে বিগত সরকারের যেসব মন্ত্রী-এমপিদের প্রতি দলের নেতাকর্মী ও ভোটারদের ক্ষোভ ছিল কৌশলে তাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের বাইরে রাখা হয়েছে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদ, সংসদের গুরুত্বপূর্ণ পদে সমালোচিত নেতাদের রাখা হয়নি। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নেতারা মনে করছেন, সরকার কত দিন চলবে এটি নির্ভর করবে পরিবেশ পরিস্থিতির ওপর। যত দিন নিরাপদে দায়িত্ব চালিয়ে যেতে পারে নতুন সরকার, ততদিন দায়িত্ব পালন করে যাবে। এক্ষেত্রে অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে মানুষের ভাল ইমেজ গড়ার চেষ্টা করা হবে। এটি করা সম্ভব হলে যখনই নির্বাচন হোক না কেন এতে ফল আওয়ামী লীগের ঘরেই আসবে। দলের একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সরকারের মন্ত্রী বলেন, সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে। সাংবিধানিকভাবে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার অধিকার আছে। তবে সবার অংশগ্রহণে নির্বাচনে যে কথা বলা হচ্ছে তা নির্ভর করবে পরিবেশ পরিস্থিতির ওপর। বিরোধী জোট যদি সহিংস কর্মসূচি বাদ দিয়ে সংলাপের পরিবেশ তৈরি করে তাহলে সংলাপ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের কোন আপত্তি নেই। সরকার ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে চলার চেষ্টা করবে বলে জানান তিনি। সরকারের এ মন্ত্রী জানান, দলের মন্ত্রী-এমপিদের অনেকের প্রতি মানুষের বিরূপ ধারণা ছিল। নতুন সরকারে তাদের সেভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানিয়েছে, বিগত পাঁচ বছরে সাংগঠনিক যে স্থবিরতা তৈরি হয়েছিল তা দ্রুতই কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা হবে। বিতর্কিত ও জনবিচ্ছিন্ন নেতাদের সরিয়ে নতুন নেতৃত্বকে সামনে আনা হবে। এক্ষেত্রে চলতি বছরে বিশেষ কাউন্সিলও আহ্বান করা হতে পারে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনসহ বিভিন্ন নির্বাচিত পদে তরুণ ও ত্যাগী নেতাদের নির্বাচিত করারও চেষ্টা করা হবে দলীয়ভাবে। এজন্য উপজেলা নির্বাচনে দলের একক প্রার্থী রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে কেন্দ্র থেকে। দলের নির্দেশনার বাইরে কেউ প্রার্থী হলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য স্থানীয় পর্যায়ে বার্তা পাঠানো হয়েছে। সূত্র বলছে, উপজেলা নির্বাচন শেষ হলে জেলা পরিষদের নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়া হবে। দীর্ঘ দিন থেকে প্রশাসক দিয়ে চলা জেলা পরিষদের দলের নেতাদের নির্বাচিত করে আনার পরিকল্পনা রয়েছে আওয়ামী লীগের। এদিকে সরকারের কর্মপরিকল্পনার রয়েছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের নির্বাচন দাবিকে অন্যান্য ইস্যু দিয়ে চাপা দিয়ে রাখা, নির্বাচন ও নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়ে সংগঠিত সহিংস গঠনার বিচার ও দায়ীদের আইনের আওতায় আনা। পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করা, কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে সরকারের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়। সূত্রমতে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সার্বিক দিক প্রধানমন্ত্রী নিজেই তদারক করছেন। এজন্য শুরু দিকে এ মন্ত্রণালয়ে শুধু প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীই দেবেন। সরকারের শুরুতে কূটনৈতিক চাপ এড়ানোর অংশ হিসেবে এ মন্ত্রণালয়ে পূর্ণ মন্ত্রী নিয়োগ দেয়া হয়নি। এ মন্ত্রণালয়ের সার্বিক কার্যক্রমও প্রধানমন্ত্রী সরাসরি তদারিক করছেন। এক্ষেত্রে তার পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী সহায়তা করছেন। আপাতত প্রতিমন্ত্রীকে এ মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব দেয়া হলেও নির্বাচনকালীন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে কিছুদিনের মধ্যেই এ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হতে পারে। বিগত সরকারের বিতর্কিত মন্ত্রীদের অনেকে বাদ পড়েছেন দলীয় পরিকল্পনার আলোকে। অপেক্ষাকৃত অনভিজ্ঞদের মন্ত্রণালয়ে আনাও একই লক্ষ্য থেকে। জাতীয় সংসদে চিফ হুইপ পরিবর্তন করা হয়েছে। হুইপদেরও সরিয়ে নতুনদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। দলীয় সূত্র জানিয়েছে, দশম সংসদের সংসদীয় কমিটিগুলোর চেয়ারম্যান নিয়োগের সময় স্বচ্ছ এবং ভাল ইমেজের এমপিদের গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কোন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কাউকে ওই মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সভাপতি নিয়োগ করা হবে না। সরকারি সূত্র বলছে, দু্রততম সময়ের মধ্যেই সরকার দৃশ্যমান উন্নয়নকাজ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে পদ্মা সেতুর কাজ শুরুকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে তৎপরতা শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট বিভাগ। রাজধানীতে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারগুলোর কাজও দ্রুত শেষ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চার লেন কাজ দ্রুত শেষ করার পরিকল্পনা নিয়েছে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়। এদিকে কম ভোটার উপস্থিতি ও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রেকর্ডসংখ্যক প্রার্থী এমপি হওয়ায় নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে যে বিতর্ক এবং গ্রহণযোগ্যতার সঙ্কট রয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে কূটনৈতিক তৎপরতাও জোরদার করা হয়েছে। সরকারের নীতি নির্ধারকদের মতে, ইতিমধ্যে অনেক দেশ নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানিয়ে সহযোগিতা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত থাকলে যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অন্যান্য দেশের মনোভাবও পরিবর্তন হবে বলে মনে করছেন সরকারের নীতি নির্ধারকরা। আর এ লক্ষ্য দিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতাও শুরু হয়েছে। এছাড়া বিগত সময়ে কিছু দাতা সংস্থার সঙ্গে সরকারের টানাপড়েন থাকলেও সামনে তাদের পরামর্শকে ইতিবাচক হিসেবে ধরে এগোতে চায় নতুন সরকার। এ জন্য দাতাদের পরামর্শ অনুযায়ী প্রকল্প প্রণয়ন ও অর্থায়নে গুরুত্ব দেয়ার কথাও ভাবা হচ্ছে। এদিকে দাতা ও বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর চাপেই বিরোধী দলের সভা-সমাবেশে বাধা দেয়া থেকে সরে আসছে সরকার। একই সঙ্গে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা থেকে নেতাদের জামিন ও মুক্তির ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে না। সূত্র বলছে, সার্বিক ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক আবহ তৈরি হলে তা সরকারি দলের জন্য পরবর্তী নির্বাচন বৈতরণী পার হওয়া সহজ হবে। এমন একটি পরিবেশ তৈরিই এখন সরকারের চূড়ান্ত লক্ষ্য।
No comments